বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ১৮

0
83

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ১৮

“তুমি ভাবলে কি করে এই ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব? কি আছে এর?”
তপা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রয়। এ কোন পার্থিব মোজাম্মেল কে দেখছে সে! এতটা অহংকারী তো ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ বাবা। যে নিজের একমাত্র মেয়ের জন্য জান কোরবান করতেও পিছু পা হতেন না। তবে আজ কি হলো?
পার্থিব মোজাম্মেল পুনরায় বললেন,
“যে ছেলের আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়ার কথাটা বলতেই হাঁটু কাঁপে, এমন কাপুরুষের মতো বসে থাকে তার কাছে তো আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারি না। এই ছেলে তো রাস্তাঘাটে কোনো বিপদ হলে আমার মেয়েকে রেখে পালাবে। যে ছেলে বুক ফুলিয়ে আমার মেয়ে কে চাইবে তার কাছেই আমি মেয়ে বিয়ে দেব। নইলে মেয়ে আমার আজীবন আমার কাছেই থাকবে।”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আংকেল এটা আসলে আপনাকে সম্মান করার জন্য করেছে। বুঝেন নাই ব্যাপারটা?”
“এমন ভীরু প্রজাতির সম্মান আমি বয়কট করছি। তাকে বলো সাহস থাকলে বুক ফুলিয়ে আমার মেয়ের হাত চাইতে। আমি ভেবে দেখব। নতুবা এ বিয়ে মন্তবি ঘোষণা করব।”

সিজান শুকনো মুখে ঢোক চেপে পৃথার দিকে তাকাল। পৃথা ইশারায় বোঝালো সাহস করে বলে ফেলতে। বড় করে শ্বাস টানে সিজান। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সাহস যোগায়। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করেই বলল,
“আমি আপনার মেয়ে কে ভালবাসি আংকেল। আপনার মত নিয়ে ওকে বিয়ে করতে চাই। আপনি যদি এই বিয়ে মন্তবি ঘোষণা করেন; পৃথার বিয়ে আমার সাথে না দেন তবে আমি আপনার বাড়ির সামনে অবরোধ করব। রাতদিন অনশন করব। নাওয়া খাওয়া ভুলে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকব আপনার দরজায়। তবুও যদি আপনি অন্যত্র বিয়ে দেন তবে আমি আমি চিরকুমার থাকব। তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনি। একটা বংশের বাতি নেভার দায়ভার কিন্তু আপনাকে নিতে হবে আংকেল। আপনি রাজি আছেন তো?”

পার্থিব মোজাম্মেল পুরো হতভম্ব। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিঞ্চিৎ সময় ধীরে ধীরে বললেন,
“এই ছেলে তোমাকে সাহস দেখাতে বলেছি বলে তুমি থ্রেড দিবে নাকি? এ তো আস্ত একটা গুন্ডা। আর যাই হোক কোনো গুন্ডার সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। কোনো দিনও না।”

পৃথা অসহায় চোখে তাকাল সিজানের দিকে। সিজান এবার এগিয়ে এসে পার্থিব মোজাম্মেলের পায়ের কাছে বসল। মাথা নিচু করে বলল,
“আমি জানিনা আমি কি; আমি জানিনা আপনার মেয়ে কে কতটা ভালো রাখতে পারব। কতটা বিলাসিতার জীবন তাকে উপহার দিতে পারব। তবে আমি এটা বলতে পারি, আমি বেঁচে থাকতে আপনার মেয়ের কখনো ভালবাসার অভাব হবে না। ভালবাসার শহরে আপনার মেয়ে ঠিকই বিলাসিতার রাণী হয়েই থাকবে। আমি এটা জানি না আমি মাসে মাসে আপনার মেয়েকে নতুন জামা, শাড়ি, গহনা কিনে দিতে পারব কি-না; তবে আমি এটা বলতে পারি সুখের মালা গলায় নিয়েই আপনার মেয়ের একজীবন কেটে যাবে। আমি আপনার মেয়েকে আমি ভালবাসি। এটাই আমার একমাত্র শক্তি, একমাত্র জোর এবং একমাত্র সত্যি। তবুও যদি মনে হয় আমি আপনার মেয়ের অযোগ্য, তবে যোগ্য কাউকে খুঁজে তার হাতেই তুলে দিন ওকে। আমিও চাই ও সুখী জোক; ও ভালো থাকুক। আমি না-হয় দূর থেকেই দেখলাম।”

পার্থিব মোজাম্মেল হাস্যজ্জল কণ্ঠে বললেন,
“এই আগুনটাই তো দেখতে চেয়েছিলাম আমি। আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে এই গুণটাই থাকা চাই। তবে একটা কথা পরিষ্কার বলে দিচ্ছি আমি রাজি হয়েছি বলেই ভেবো না কালই সানাই বাজবে। আগে দুজনে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজেদের পরিচয় তৈরি করবে; তারপর এসো বিয়ের কথা বলতে। ততদিন যেমন চলছিল তেমনই চলবে। খবরদার বাড়াবাড়ি কিছু যেন না হয়।”
তপার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তপা মা এই দায়িত্বটা আমি তোমাকে দিলাম। তোমার কথার উপর ভরসা করে যেমন চারহাত এক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তেমনি এদের নজরে রাখার দায়িত্বও নিতে হবে। পারবে তো?”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“আপনি শুধু দেখে যান আংকেল। এদের এমন টাইট দেব যে এরা একে অপরের মুখ দর্শন করতেও আগে আমার মুখ মনে করবে।”

সিজান অসহায় চোখে তপার দিকে তাকাল। তপা চোখ টিপে ঠোঁট কামড়ে হাসল।

পার্থিব মোজাম্মেল চলে যাওয়ার পর পৃথা তপা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাবা তোর কথার উপর ভরসা করে আমাদের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে মানে কি রে?”
তপা মুচকি হেসে বলল,
“কিছু না।”
“কিছু তো একটা আছেই। ভালোয় ভালোয় বল। নইলে কিন্তু কথা বের করার টেকনিক জানা আছে আমার। দেব কাতুকুতু?”
“আসলে তুই আংকেল কে সিজানের কথা বলার পর আংকেল আমার কাছে সিজানের খুটিনাটি জানতে চেয়েছিল। আমি এমন তেল মালিশ করেছি যে আংকেল পুরো কাত।”
পৃথা একহাতে জড়িয়ে ধরল তপা কে। কৃতজ্ঞতা সূচক হেসে বলল,
“তুই ছিলি বলেই এ জীবন এত সুন্দর। যুগে যুগে এভাবেই আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাক।”

কিছু বলল না তপা। চেয়ে চেয়ে কেবল দেখল একজোড়া সুখী মানুষের সুখ সুখ চেহারা।

বেশ কিছু দিন পর তপা পলাশ তলী ফুচকা হাউজে ফুচকা খেতে আসে। বিকেল তখন প্রায় গড়িয়ে এসেছে। সামনে চেয়ারে বসে আছে একজন সুদর্শন যুবক। যার সাথে তপার বহু বছরের পরিচয়। যার সাথে কেবল হৃদয়ের নয় রয়েছে আত্মিক বন্ধন। তপা তার সাথে কথা বলতে বলতে খুশির জোয়ারে ভাসছে। থেকে থেকে হাসির তোড়ে লুটিয়ে পড়ছে তারই উপর। অন্য দিকে সেই মানুষটাও থেমে থেমে হাসি বিনিময় করছে।

ফুচকা হাউজের বাইরে থেকে একজন কালো পোশাকধারী লোক তপার উপর নজর রাখছে। সহসাই তার ফোন বেজে ওঠে। সদা পরিচিত নাম্বারটা দেখে তটস্থ হয়ে কল রিসিভ করে বলল,
“জ্বি স্যার।”
অপর প্রান্ত থেকে পলক থমথমে গলায় বলল,
“ম্যাম কোথায়?”
লোকটা একবার তপার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ম্যাম এই মূহুর্তে পলাশতলী আছেন। ফুচকা হাউজে ফুচকা খাচ্ছেন।”
পলক স্বস্তির শ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই লোকটা ইতস্তত করে বলল,
“কিন্তু স্যার একটা সমস্যা আছে। ম্যামের সাথে একজন আছে। তাকে এর আগে কখনো দেখি নি। ম্যামের সাথে মনে হচ্ছে খুব ভালো সম্পর্ক। হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে একেবারে।”
পলক খানিকটা উদ্বিগ্ন হলো। প্রেমিক হৃদয় হাহাকার করে উঠল। কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল,
“লোকটা সিজান নয় তো? বয়স কেমন?”
“না স্যার। সিজান নয়। এমন কি ম্যামের সমবয়সীও নয়। লোকটা সম্ভবত আপনার বয়সের হবে স্যার।”
পলক এবার সত্যি চিন্তিত হয়। কে এই লোকটা!
ছোট্ট করে দম ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,
“তুমি নজর রাখো। আমি আসছি।”

মিনিট দশেকের পার্থক্যেই পলক পলাশ তলী এসে পৌঁছায়। কালো পোশাকধারী গার্ডের সামনে আসতেই নজর পড়ে তপার উপর। মুখে এখনো তার স্নিগ্ধ হাসি লেপ্টে। ইসসসস কতদিন পর দেখছে সে এই হাসি। অন্তরে মুগ্ধতা ছড়ানোর আগেই পায়ের রক্ত ছলাৎ করে মাথায় উঠে যায় তার। তপার উল্টো দিকের লোকটা তপার ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা উচ্ছিষ্টটুকু স্বহস্তে মুছে দিচ্ছে। সহ্য সীমা পেরিয়ে যায় তার। ধুপধাপ শব্দ তুলে গিয়ে তপার পাশের চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়ে। তপা চমকে খানিকটা লাফিয়ে উঠে। অপর পাশের ছেলেটাও বিস্ময়ে তাকায়।
তপা আশ্চর্যান্বিত ভাব কাটিয়ে স্থির কণ্ঠে বলল,
“পলক! আপনি কবে এলেন? জানান নি তো।”
উত্তর দিল না পলক। সামনে বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,
“প্রান্ত শাহরিয়ার!”
প্রান্ত হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডসেক করার উদ্দেশ্যে। পলক হাত মেলালো। প্রান্ত মৃদু হেসে বলল,
“তপা কে চিনিস?”
পলক মাথা নাড়ায়। মুখে কিছু না বলে তপার দিকে তাকাল। তপা তখন দুজনের মিলিত হাতের দিকে তাকিয়ে।
প্রান্তই পুনরায় বলল,
“তোর মত এতবড় নেতা আমার পিচ্চি কে চিনে কি করে? ”
পলকের রাগ আবার ঝাড়া দিয়ে ওঠে। আমার পিচ্চি শব্দটা শ্রবণেন্দ্রিয়ে সূচ ফুটিয়ে দেয় বারংবার। তপার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“তুমি এত নিশ্চিন্তে এখানে বসে ফুচকা খাচ্ছো কি করে? একবারও মনে হয় নি বিপদ হতে পারে? চিন্তা কি আমি একা একাই করে যাচ্ছি? যার জীবন তার তো কোনো হুঁশই নেই। আমি শালা বেকার চিন্তা করে মরছি।”

তপা কথার দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠল। প্রান্ত তৎক্ষণাৎ পলকের কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোর সাহস কি করে হয় আমার সামনে আমার বোন কে এভাবে কথা বলার? কলেজের মারগুলোর কথা ভুলে গেছিস? নাকি মনে করিয়ে দেব?”
তপ আতঙ্কিত হয়ে প্রান্তর হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে ছাড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া ছাড়ো। উনি আমার ভালোর জন্য বলেছে। তুমি শান্ত হও প্লিজ।”

প্রান্ত শান্ত না হলেও একজনের মনে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। এতক্ষণ সূচ ফুটতে থাকা কর্ণেই এবার মলম লাগায় ভাইয়া ডাকটা।

শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পলক প্রান্তর দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“আমি যতদূর জানি তোর কোনো বোন নেই। এত বড় বোন টপকালো কোথা থেকে?”
তপা প্রান্ত দু’জনেই একসাথে চমকে উঠল। এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিব্রতবোধ করল কিছু সময়ের জন্য। পরক্ষণেই তপা চোখমুখ শক্ত করে ফেলল। যা নজর এড়ালো না জহুরী চোখের মালিক পলক তাজওয়ারের।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here