বাঁধন হারা তীরে #রাহনুমা রাহা #পর্বঃ৩৩

0
84

#বাঁধন হারা তীরে
#রাহনুমা রাহা
#পর্বঃ৩৩

পরের দিন বিকেল নাগাদ তপা নিজের কক্ষ থেকেই ব্র্যান্ড পার্টির আওয়াজ শুনতে পেল প্রবলভাবে। রুম সংলগ্ন রাস্তায় উঁকি মেরে বুঝতে পারল না আওয়াজের উৎস। পরে ভেবে নিল হয়তো কাছেপিঠে কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। পলকের কথা খুব করে মনে পড়ল। কি জানি কি করছে ছেলেটা। নিজেকে বাইরের দিকটায় শক্ত রাখলেও ভেতরটা তীব্র হাহাকার করছে। একটা কাক যখন প্রচন্ড পানি তৃষ্ণায় ধুঁকে, ঠিক তেমনি পলকের এক চিলতে ভালবাসার তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে তপা। তাদেরও তো বিয়ের কথা ছিল। আজই। এতকিছু না হলে নিশ্চয়ই আজ সারাজীবনের মত নিজের ভালবাসার মানুষটার বাঁধনে বাঁধা পড়ে যেতো। নিয়তি কি নিষ্ঠুরতম কাজ করছে তার সাথে। ছোট বেলায় বাবা মা হীন করল। যারা কি-না বেঁচে থেকেও মৃত। আবার বড় হয়ে যাকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে; মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসেছে তাকেও আলাদা করে দিতে চাইছে। কেড়ে নিতে চাইছে। তারাই- যারা কি-না ওর ছোটবেলাটাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। নিজের রক্তের ওপর বিতৃষ্ণা এসে যায় তপার। ইচ্ছে করে সুন্দর শরীরটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবটুকু রক্ত বের করে দিক। ঝরে যাক সব পাষণ্ডদের নাম নিশানা।

সানাইয়ের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে হঠাৎ করেই থেমে গেল। তপা ফোঁত করে শ্বাস ছাড়ল। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ টিকল না এই স্বস্তি। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল আজমল হোসেন। এসেই তপার হাত ধরে টানতে টানতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল। তপা বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। তবে কি পলক এসেছে? বিয়ে, ব্র্যান্ড পার্টি সব মিলিয়ে যা বোঝার বুঝে গেল তপা। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি কোত্থাও যাব না।”
আজমল হোসেন নাছোড়বান্দা। পলকের কাছে তিনি কোনো ভাবেই হেরে যাবেন না। না আজ এই মূহুর্তে আর না অতীব নিকটে আসন্ন নির্বাচনে। তপা হাত ধরা অবস্থায় মোচড়ামুচড়ি করছিল দেখে রেগে বললেন,
“আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করো না।”
বুকের ভেতর একরাশ চাপা কষ্ট নিয়েও তাচ্ছিল্য সূচক হাসল তপা। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আরও খারাপ হতে পারে কোনো মানুষ? আপনি নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেন না, মিস্টার হোসেন?কখনো অনুশোচনা হয় না? কখনো মনে হয় না, এই মেয়েটা তো আমার-ই মেয়ে! আমার-ই ঔরসজাত সন্তান!কোনো দিনও মনে হয় না, না? কেমন বাবা আপনি? পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটাও একটা খারাপ বাবা হতে পারে না। কিন্তু আপনি? কখনো আমার দিকটা ভেবে দেখেছেন? ঘৃণ্য হলেও আমি তো আপনার-ই মেয়ে। এটা অস্বীকার কোনো রাস্তা নেই। নাকি আমাকে পেটে ধরা মহিলার সাথে অন্য কারো অবৈধ সম্পর্ক…” বাকিটা শেষ করতে পারে না তপা। চেঁচিয়ে ওঠেন আজমল হোসেন।
“তিয়াশা!”
থমকে গেল তপা। কতগুলো বছর পর মানুষটা সেই নামে ডাকল। একটা সময় তো ছিল, যখন বাবার আদরে, মায়ের ভালবাসায় ছিল। হোক না সেটা অল্প সময়; হোক না সেটা স্মৃতিতে ঝাপসা। তবুও তো ইনিই ওর জন্মদাতা! বাবা!

“উনি তোমার মা তিয়াশা। মিনিমাম সম্মানটুকু কি তার পাওনা নয়?”
বিস্ময়ে তপা হা করে তাকিয়ে রইল। এত বাকবিতন্ডার পর মিউচুয়াল ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দু’জনে। সময়ের পরিক্রমায় তপাও হয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন। এক পর্যায়ে ঠাঁই হয়েছে আয়েশার কোলে। কিন্তু এতকিছুর পরেও সেই অমানবিক, পাষণ্ড মা নামক মানুষটার জন্য আজও কিঞ্চিৎ টান ছিন্ন হওয়ার বাকি রয়েছে গেছে আজমল হোসেনের।

“মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে সে? কতখানি করেছে?” আক্ষেপ ঝড়া কণ্ঠে বলল তপা।
“পেটে ধরেছে তোমাকে।”
“ওহ্! পেটে ধরেছে। আমি চাই নি তো। পেটে থাকতেই মেরে ফেলতে। তাহলেও তো এতকিছু সহ্য করতে হতো না। নিজের বাবা মা নামক মানুষগুলোর কাছে এত অবহেলিত হতে হতো না। তোমরা কি একটিবারও ভেবেছো আমার দিনগুলো কিভাবে কেটেছে? রাতগুলো কতটা দুর্বিষহ ছিল? রাস্তার পাগলিও নিজের দিনশেষে নিজের বাচ্চাকে বুকে আগলে ঘুমায়। কিন্তু তোমরা? নিজেদের ক্ষমতা, নিজেদের চাহিদার জন্য ছোট্ট একটা বাচ্চা কে ছুঁড়ে ফেলেছো অন্ধকারে। এখন এসেছো সম্মান চাইতে। করি না আমি তোমাদের সম্মান। চাই না তোমাদের পরিচয়। তোমরা একেকজন একেকটা খুনি। তোমরা একটা বাচ্চা মেয়ের শৈশব গলা টিপে খুন করেছো। এখন আবার আমার ভালবাসা খুন করতে চাইছো? পারবে না আজমল হোসেন। এবার তিয়াশা একা নয়, তার সাথে আছে পলক তাজওয়ার। তার এক আঙুলের বুদ্ধির কাছে তুমি চুনোপুঁটি। এবার আর তোমার ছাড় নেই। জানো তো, আল্লাহ ছাড় দেয়, কিন্তু ছেড়ে দেয় না।”

পলকের নাম শুনতেই আজমল হোসেন নিজের খোলসে আবৃত হলো। উন্মোচিত হলো পাষন্ড হৃদয়। পুনরায় তপার হাত আঁকড়ে ধরতে চাইলে তপা আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“আমাকে সরানোর চেষ্টা করলে ভালো হবে না মিস্টার আজমল হোসেন? ভুলে যাবেন না আমার শরীরে আপনার-ই রক্ত বইছে। তেজ আমারও কিছু কম নয়।”
“তুমি বাড়াবাড়ি করছো তিয়াশা!”
“কেবল তো শুরু!” কিঞ্চিৎ হাসল তপা।

আজমল হোসেন গরম চোখে তাকালে তপা মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল, সে আর ভয় পায় না৷ তার সামনে আছে এক অভেদ্য দেয়াল। যে শত বাঁধা বিপত্তি এলেও আগলে রাখবে পরম মমতায়।

কিছুক্ষণ পর তপা শুনতে পায় নিচে আজমল হোসেন বেশ উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করছে। ভয় পেল না তপা। সে জানে পলক এসেছে। তাকে যে আসতেই হবে। কিন্তু ব্যান্ড পার্টি নিয়ে আসার কারণটা বুঝতে পারল না। সে কি রাজ্য জয় করে এসেছে যে একেবারে ব্যান্ড পার্টি নিয়ে ঘুরছে। সে তো এসেছে রাজকন্যা উদ্ধার করতে!
আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে পেটে হালকা ক্ষুধা অনুভূত হলে টেবিলের উপর থেকে একটা ডাঁসা আপেল নিয়ে আরামসে একটা কামড় বসালো। তার মিনিট খানেক পরেই হুরমুর করে ঘরে ঢুকল পলকসহ আরও বেশ কয়েকজন লোক। অবাক হলো না তপা। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পলকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“আপেল খাবে? নাও।”
পলকের যেন ভীমড়ি খাওয়ার যোগাড়। যার জন্য এতকিছু সে-ই কি-না আরাম করে আপেল চিবুচ্ছে!
বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে আপেলটা নিয়ে এক কামড় খেয়ে আবার তপার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোখ টিপে বলল,
“বেশ মিষ্টি! ঠিক তোমার মত!”

চলবে…

আমার লেখা ই-বই #আসক্তি পড়ুন বইটই অ্যাপে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here