ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ২১ লেখিকা দিশা মনি

0
53

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ২১
লেখিকা দিশা মনি

মিষ্টি হাসপাতালের বেডেই শুয়ে ছিল। তার শরীর স্বাস্থ্য তখনো অব্দি খুব একটা ভালো হয়নি। এমন সময় নার্সটি তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনার কি কোন সাহায্যের প্রয়োজন?”

মিষ্টির এই মুহুর্তে ইয়াসিনদের কথা মনে পড়ে। এই মার্সেই শহরে তাদের থেকে আপন মিষ্টির আর কেউ নেই। তাই মিষ্টি বলে ওঠে,
“আপনি কি আমাকে দয়া করে আপনার ফোন থেকে একটা ফোনকল করতে দেবেন?”

“কেন নয়, এই নিন।”

বলেই নার্সটি মিষ্টির দিকে তার ফোনটা বাড়িয়ে দেয়। মিষ্টি ফোনটা হাতে নিয়েই ইয়াসিনের নম্বরটা ডায়াল করে। অতঃপর সেই নাম্বারে কল করে। কিছুক্ষণ রিং হবার পর বিপরীত দিক থেকে ফোনটা রিসিভ হতেই মিষ্টি বলে ওঠে,
“হ্যালো, ইয়াসিন।”

মিষ্টি কন্ঠ শুনেই ইয়াসিন হতবাক সুরে বলে,
“হ্যালো, মিষ্টি! আপনি কোথায় আছেন? ঠিক আছেন তো? নিউজে এসব কি দেখাচ্ছে..আপনাকে নাকি গ্রেনেডসহ ধরা হয়েছিল তারপর নাকি আপনাকে ক্রসফায়ার করা হয়েছে..আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

মিষ্টি নম্রভাবে বলে,
“একটু শান্ত হন,ইয়াসিন। আমি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।”

বলেই মিষ্টি সব ঘটনা ইয়াসিনকে খুলে বলে। সব শুনে ইয়াসিন রেগে বলে,
“ঐ ইন্সপেক্টর পলকে আমি ছাড়ব না। ও কিভাবে পারল আপনার সাথে এমন করতে? ভাগ্য ভালো আপনি বেঁচে আছেন। নাহলে কি হয়ে যেত?”

মিষ্টি বলে,
“আমি ঠিক আছি। আর ওনার হয়তোবা কোন দোষ নেই। উনি তো আমাকে একজন সন্ত্রাসীই ভেবেছেন। তাই একজন সন্ত্রাসীর মতোই ব্যবহার করেছেন আমার সাথে।”

“আপনি মোটেই সন্ত্রাসী নন, মিষ্টি। একথা আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। আপনি কিছুতেই একজন সন্ত্রাসী হতে পারেন না।”

“এতটা বিশ্বাস আমার উপর?”

মিষ্টি এমন প্রশ্নে ইয়াসিন কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। ব্যাপারটা সামাল দিতে বলে,
“আপনি এখন কোথায় আছেন মিষ্টি? আমায় বলুন, আমি যাব আপনার সাথে দেখা করতে। আপনাকে আবার নিয়ে আসবো আমার বাড়িতে। আম্মু, আমিনা ওরা ভীষণ উদ্বিগ্ন আপনার জন্য।”

“আপনারা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন ইয়াসিন। আমি চাই না,আমার জন্য আপনাদের উপর কোন বিপদ নেমে আসুক।”

“এসব আপনি কি বলছেন?”

“ঠিকই বলছি। আপনার মা এবং বোনকে বলে দেবেন আমি ঠিক আছি। সুযোগ পেলে ওনাদের সাথে দেখা করে আসব। আপনি নিজের আর নিজের পরিবারের খেয়াল রাখবেন।”

বলেই মিষ্টি ফোনটা রেখে দেয়। ইয়াসিন এদিক থেকে হ্যালো হ্যালো করতে থাকে। কিন্তু মিষ্টি ফোনটা রেখে দিয়েই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইয়াসিনের নাম্বারটা ব্লকলিস্টে রেখে নার্সের হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে বলে,
“এরপর যদি কেউ আপনার কাছে ফোন করে আমার ব্যাপারে কিছু জানতে চায় তাহলে আপনি বলবেন আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছি। কোথায় গেছি সে ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন না।”

“আচ্ছা।”

★★★
ইতিমধ্যেই মিষ্টিকে যে ফাঁসানো হয়েছিল সেই ভিডিওটা ফ্রান্সে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে যায়। নানান মানুষ ব্যাপারটা নিয়ে নানান মত দিচ্ছিল।

বর্তমানে এলিজা ও পল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এলিজা পলের সামনে নিজের মাথাটা নিচু করে আছে। পল হতাশ স্বরে বলে,
“কি যেন বলেছিলেন আপনি মিস এলিজা? আপনি ফ্রান্সের সেরা গোয়েন্দা,আপনার তদন্তে কোন ভুল হতেই পারে না। এই তার নমুনা?”

এলিজা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আমার কাছে যেই রিপোর্ট ছিল আমি সেই অনুযায়ীই কথা বলেছি। আর মাঝে মাঝে এমন সামান্য ভুল হতেই পারে,,”

পল রেগে বলে,
“সামান্য? এত বড় একটা ভুলকে আপনার কাছে সামান্য মনে হচ্ছে? শুধুমাত্র আপনার দেয়া ভুল ইনফরমেশনের জন্য একজন নিরপরাধ মানুষকে মরতে হয়েছে।”

“আচ্ছা, মেনে নিচ্ছি যে আমার দেয়া রিপোর্ট ভুল ছিল৷ কিন্তু ঐ মেয়েটাকে যে সন্ত্রাসী হিসেবে ফাঁসানো হয়েছিল সেটাও কি আমার দোষ? আপনি তো ঐ ঘটনার প্রেক্ষিতেই মেয়েটাকে এনকাউন্টার করেছেন। তাহলে আমাকে কেন দোষ দিচ্ছেন?”

এবার এলিজা কিছুটা প্রতিবাদ জানিয়ে বলল। এলিজার এই কথার জবাবে পল কিছু বলতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আপনি এখন আমার সামনে থেকে চলে যান মিস এলিজা।”

এলিজা যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। হঠাৎ কি মনে করে যেন আবার পিছন ফিরে বলে,
“আচ্ছা৷ একটা কথা সত্য করে বলুন তো, ঐ মিষ্টি নামের মেয়েটাকে কি আপনি কোন ভাবে চিনতেন? ওর সাথে কি আপনার কোন সম্পর্ক ছিল?”

“নান অফ ইউর বিজনেস।”

পলের এই জবাবে এলিজা ভীষণ অপমানিত বোধ করে রাগে গজগজ করতে করতে স্থানত্যাগ করে।

পল এলিজাকে যেতে দেখে বিড়বিড় করে বলে,
“ঠিকই ধরেছেন আপনি মিস এলিজা। মিষ্টির সাথে আমার একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাও যে সে সম্পর্ক না, জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক।”

★★
এক সপ্তাহ পর,
পুরো মার্সেই শহর মেতে উঠেছে উৎসবের আমেজে। আর এক সপ্তাহ পরেই ক্রিসমাস। মার্সেই শহরে ক্রিসমান অনেক বড় পরিসরে পালিত হয়। এখন থেকেই মার্সেইয়ের সাধারণ লোকেরা ক্রিসমাসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

এলিসও তার ব্যতিক্রম নয়৷ সে আজ এসেছে ক্রিসমাস মার্কেটে। তার উদ্দ্যেশ্য ক্রিসমাস উপলক্ষে কিছু শপিং করবে। নিজের গাড়িতে না এসে ইয়াসিনের ক্যাব বুক করে এই ক্রিসমাস মার্কেটে এসেছে সে। ইয়াসিন পুরোটা রাস্তা মুখ ভাড় করে এসেছে। অথচ তার এই গম্ভীর মুখটা দেখতেই ভীষণ ভালো লাগছে এলিসের৷ সে বিমোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইয়াসিনের দিকে। এলিসকে ক্রিসমাস মার্কেটে নামিয়ে দিয়েই ইয়াসিন অপেক্ষা করছিল তার ফিরে আসার জন্য। কারণ এলিস তার ক্যাব তিন ঘন্টার জন্য ভাড়া করেছে।

ইয়াসিনের সময় কাটছিল উদাসীন ভাবে। তাই সে ক্যাব থেকে নেমে বাইরে আসল। এলিস তখন কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল। একপলক এলিসের দিকে তাকিয়েই ইয়াসিন নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

এমন সময় হঠাৎ করে চোখ ঘুরিয়ে মার্কেটের অন্য পাশে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় ইয়াসিন। কারণ এখানে সে স্পষ্ট মিষ্টিকে দেখতে পায়। একটি বর্ণিল আলোক সজ্জার দোকানে কাজ করছিল মিষ্টি। তাকে দেখামাত্রই ইয়াসিন মিষ্টির কাছে ছুটে যায়। মিষ্টি ইয়াসিনকে দেখে অবাক হয়। ইয়াসিন হাপাতে হাপাতে বলে,
“আপনি এখানে কি করছেন মিষ্টি? আপনি জানেন, আপনাকে এক সপ্তাহ ধরে আমি কোথায় কোথায় খুঁজেছি?”

এমন সময় সেই দোকানের মালিক তথা একজন বৃদ্ধা বলে ওঠেন,
“তুমি কি এনাকে চেনো, মা শেরি(প্রিয়)”

মিষ্টি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আপনাকে বলেছিলাম না গ্রান্ড-মেরে(দাদিমা) এই মার্সেই শহরে যখন আমি এসেছিলাম তখন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল৷ ইনিই সেই শুভাকাঙ্ক্ষী মোহাম্মদ ইয়াসিন আল খলিলি।”

বৃদ্ধা হেসে বলেন,
“ওকে এখানে বসতে দাও।”

ইয়াসিন মিষ্টিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আপনি আমার সাথে আমাদের বাড়িতে ফিরে চলুন মিষ্টি। আম্মু এবং আমিনা আপনাকে দেখে খুশি হবে।”

মিষ্টি বিনয়ের সাথে বলে,
“জ্বি, অবশ্যই। আমি শীঘ্রই তাদের সাথে দেখা করতে যাব। তবে এখন নয়৷ এখন আমার এই মার্কেটে কিছু জরুরি কাজ আছে।”

“এখানে আপনার কি জরুরি কাজ মিষ্টি?”

মিষ্টি ব্যাপারটা এড়ানোর জন্য বলে,
“আপনার মা কেমন আছেন? আর আমিনা?”

“ওরা সবাই ভালো আছে। তবে আপনাকে দেখলে হয়তো আরো ভালো হয়ে যাবে।”

“আর আপনি?”

মিষ্টির এহেন প্রশ্নে ইয়াসিন থতমত খেয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছিল না। এমন সময় এলিস সেখানে এসে বলে,
“ইয়াসিন, তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে সব যায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ আমার শপিং হয়ে গেছে, চলো এখন যাই এখান থেকে।”

কথা বলতে বলতেই এলিসের নজর যায় মিষ্টির দিকে। মিষ্টিকে দেখে সেও ভীষণ অবাক হয়৷ মিষ্টি ইয়াসিনকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আপনি এখন যান। আমি কাল-পরশুর মধ্যে আপনার পরিবারের সাথে দেখা করে আসব।”

এলিস মিষ্টিকে প্রশ্ন করে,
“আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? ইয়াসিন আপনাকে কতো খুঁজেছে!”

“আমি মার্সেইতেই ছিলাম। সঙ্গত কারণে আত্মগোপনে ছিলাম। তবে খুব শীঘ্রই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব। আশা করছি, এখানকার কাজ শেষ করে শীঘ্রই নিজের দেশে ফিরতে পারব।”

বলেই সে স্মিত হাসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here