ভূমধ্যসাগরের তীরে #পর্বঃ৩০ লেখিকা দিশা মনি

0
19

#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ৩০
লেখিকা দিশা মনি

ইয়াসিনের মুখে তার অপরাধী হওয়ার স্বীকারোক্তি শুনে মিষ্টি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসিন মিষ্টির এই হতবাক চাহনি দেখে মলিন হেসে বলে,
“আমি জানি, আমার এই পরিচয় জানার পর আপনি আমায় ঘৃণা করবেন….আমাকে বিশ্বাস করার জন্য পস্তাবেন। তবে এটাই সত্যি যে, আমি সেই জঘন্য সংগঠনের একজন সদস্য যে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চাই।”

মিষ্টি বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না৷ কিছু সময় নীরব থেকে বলে,
“এটা কিভাবে হতে পারে মিস্টার ইয়াসিন? আমি যেই ইয়াসিনকে চিনেছি যাকে নিজের বন্ধু ভেবেছি সে কিছুতেই এমন হতে পারে না।”

“এটাই আমি মিসেস মিষ্টি। ”

“আপনি এটা হতে পারেন না।”

মিষ্টির চোখে এই অবিশ্বাস দেখে ইয়াসিনের এলিসের চেহারাটা মনে পড়ে যায়। তার চোখেও এই অবিশ্বাস ছিল। ইয়াসিন বলে ওঠে,
“জানেন, এলিসকেও আমি নিজের হাতে শেষ করেছি। আরো অনেক নিরপরাধ মানুষকে আমি শেষ করেছি।”

মিষ্টি যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছিল। ইয়াসিন একটু দম নিয়ে বলে,
“ঐ শরণার্থী শিবির থেকে বেরোনোর পর থেকেই আমি এই পৃথিবীকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। এভাবে সময় কাটতে থাকে একসময় আমার ফ্রান্সেরই এক স্থানীয় তরুণ ক্রিস্টোফারের সাথে পরিচয় হয়। তার বাবা ছিলেন চার্চের একজন পাদ্রী যাকে মিথ্যা অভিযোগে হ**ত্যা করা হয়েছিল৷ সেজন্য সেও এই পৃথিবীকে ঘৃণা করত। ক্রিস্টোফার আমাকে মার্সেই শহরের আন্ডারগ্রাউন্ডে গড়ে ওঠা এক নিষিদ্ধ সাম্রাজ্যে নিয়ে যায়। যেখানে আমাদের মতো আরো অনেক মানুষ ছিল৷ যাদের বেশির ভাগই নিম্ন-বিত্ত, দরিদ্র, অসহায় মানুষ যারা এই পৃথিবীর কষাঘাতে জর্জরিত। যারা ঘৃণা করত এই পৃথিবীতে। আমরা ঐ নিষিদ্ধ যায়গায় এক মাসের বেশি ছিলাম। সেখানে থাকাকালীন কিছু মানুষ প্রতিদিন এসে আমাদের বোঝায়, আসলে এই পৃথিবী হলো বড়লোকদের জন্য সুখের যায়গা আর আমাদের মতো যারা আছি তাদের শুধু কষ্ট পেয়ে যেতে হয়। এই পৃথিবী আমাদের জন্য শুধুই অভিশাপ। তাই এই পৃথিবীর টিকে থাকা উচিৎ নয়। যদি আমরা এই পৃথিবী ধ্বংস করতে পারি তাহলেই আমাদের মতো অসহায় মানুষেরা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। এসব কথা আমাদের উপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে। তাই আমরা এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে যাই। ”

মিষ্টি ইয়াসিনের মুখে এসব শুনে বলে,
“কি বলছেন এসব আপনি? তার মানে তো এই সংগঠন মানুষের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্রেনওয়াশ করে ভুলপথে পরিচালনা করছে।”

“হয়তোবা তাই। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, আমার মতো পরিস্থিতিতে থাকলে যে কেউই কি তাদের দ্বারা ব্রেনওয়াশড হবে না?”

মিষ্টি এই মুহুর্তে আর কিছু বলতে পারে না। ইয়াসিন বলে,
“জানেন, আমার বোন আমিনা..ও খুব সাহসী। আমার থেকে লুকিয়ে ও ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দিয়েছিল। আমি সব জেনেও ওকে কখনো বলিনি। অথচ ও আমার আসল সত্যটা জেনেছে অনেক পরে। এলিসের মৃত্যুর একদিন আগে। আমিনাই আমাকে বলেছিল আপনাকে সাহায্য করতে। আমি তখন ভেবেছিলাম, আপনিও পৃথিবীকে বাঁচানোর এই মিশনে যুক্ত। সেই জন্য আপনাকে আমি শত্রু হিসেবেই গণ্য করেছিলাম। আমার উদ্দ্যেশ্য ছিল, সেদিন মেট্রোস্টেশনের বাইরেই আপনাকে মে**রে ফেলি।”

মিষ্টির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে সেই জলটুকু মুছে নিয়ে বলে,
“তাহলে কেন মারলেন না আমায়?”

“যে কারণে আজ অব্দি আপনাকে মারতে পারছি না! ঠিক সেই কারণেই। জানেন, আমি অনেক অনেক মানুষকে নির্দয়ভাবে হ**ত্যা করেছি কিন্তু কখনো আমার হাত কাপেনি। কিন্তু আপনাকে দেখার পর না..আমি আপনাকে মারতে পারিনি। এই প্রথম কোন মানুষের প্রতি আমার মায়া জন্মেছিল। আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না এর কারণ কি। অতঃপর আপনার ব্যাগ চুরি হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই৷ না চাইতেও আপনাকে সাহায্য করি৷ আপনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দেয়ার পর আমি আরো বেশি করে আমি আপনার মায়ায় আটকে গেলাম। তারপর যখন আপনার স্বামীর ব্যাপারে জানলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল তাকে শেষ করে দেই। আপনি যখন বলেছিলেন ইমানুয়েল পল আপনার স্বামীর মতো দেখতে তখন আমি তাকে মেরে ফেলতে পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তবে সেটা আর হয়ে ওঠে না। তবে পরে যখন ইমানুয়েল পল আপনাকে জেলে বন্দি করে অত্যাচার করেছিল তখন আমি সত্যিই তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করি কিন্তু অল্পের জন্য সে বেচে যায়। ”

মিষ্টি এসব শুনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এরমধ্যে ইয়াসিন কাতর স্বরে বলে ওঠে,
“আপনিই সেই কারণ, যার জন্য আমার মনে হয়েছিল সব খারাপ কাজ বাদ দিয়ে আবার সঠিক পথে ফিরে আসতে। আপনাকে ভালোবেসে নতুন জীবন শুরু করতে।”

মিষ্টি এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলে,
“ইয়াসিন!”

ইয়াসিন কাতর কন্ঠে বলে,
“জানি এটা সম্ভব নয়! তবে আমি একথা নিদ্বিধায় বলতে পারি, আমি যদি এই পৃথিবীতে কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে থাকি, যেই পৃথিবীকে আমি চরম ঘৃণা করি সেখানে যদি আমার ভালো লাগার শুধুমাত্র একটা বিষয় থাকে সেটা শুধু আপনিই মিষ্টি শুধু আপনি।”

মিষ্টি ও ইয়াসিন দুজনেই একসাথে কাঁদতে থাকে। ইয়াসিন বলতে থাকে,
“আমি ভীষণ পাপিষ্ঠ তাই না, মিষ্টি? আমার সাথে থাকতে আপনার নিশ্চয়ই ভীষণ ঘৃণা হচ্ছে।”

“আপনি চুপ করুন প্লিজ..আমি আপনার এই পরিচয় মেনে নিতে পারছি না। আপনি আমার কাছে শুধুই ইয়াসিন। সেই ইয়াসিন যাকে আমি বন্ধু ভেবেছি।”

“যাক, এটা জেনে ভালো লাগল যে আপনি আমায় অন্তত বন্ধু ভেবেছেন। জানেন, এলিস মেয়েটা আমায় ভীষণ ভালোবাসত। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসত। তবুও ওকে মা**রতে আমার হাত কাপেনি। অথচ আপনার গায়ে একটা আচড় দিতেও আমার হাত কাপবে।”

মিষ্টি জিজ্ঞেস করে,
“তাহলে কি আমার ব্যাগে বো-মা রাখা, জাহাজের মধ্যে আমায় গু**লি করা এসবের সাথে আপনি জড়িত ছিলেন না?”

“না,আমি এমন কিছু ভাবতেও পারি না। তবে আপনি মেট্রোস্টেশনে ধরা পড়ার পর যে আপনাকে বাঁচিয়েছিল সে আমিই ছিলাম।”

মিষ্টি অবাক স্বরে বলে,
“তাহলে এসবের পেছনে কে ছিল?”

“জানিনা। তবে আপনাদের অনেক শত্রু থাকতে পারে।”

এরইমধ্যে হঠাৎ করে চারিদিকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বেজে ওঠে। মিষ্টি হতবাক স্বরে বলে,
“পুলিশ এলো কোথা থেকে!”

“হয়তোবা আমার খবর পেয়ে এখানে এসেছে।”

বলেই সে হাতে বন্দুক তুলে নেয়। মিষ্টি ইয়াসিনকে অনুরোধ করে বলে,
“আপনি প্লিজ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। আমি জানি, আপনার মধ্যে একটা ভালো মানুষ আছে। আপনি..আপনি ভালো হতে পারবেন।”

ইয়াসিন একটা বাকা হাসি দিয়ে বলে,
“আমার এই ভালো রূপ শুধু আপনার জন্য মিষ্টি। বাকি পৃথিবীকে আমি শুধু ঘৃণাই করি। তাই আত্মসমর্পণ আমি করবো না।”

মিষ্টি কাতর স্বরে বলে,
“আমি আমার বন্ধুকে মরতে দেখতে পারবো না।”

ইয়াসিনের বুক হঠাৎ কেপে ওঠে। তবুও সে বলে,
“যেই ইয়াসিনকে তুমি বন্ধু ভেবেছ সে অনেক আগেই মারা গেছে। যেদিন সে তার মা-বোনকে ধ**তা হতে দেখেছিল, যেদিন সে নিজের হাতে তার বাবাকে হ**ত্যা করেছিল। এখন যাকে দেখছ সে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ।”

বলেই ইয়াসিন বেরিয়ে যেতে নেয়। যাওয়ার আগে বলে,
“আর হয়তো কখনো বলার সুযোগ পাব না, তাই শেষবারের জন্য বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি মিষ্টি, এই পৃথিবীতে একমাত্র আপনিই সেই ব্যক্তি যাকে আমি শেষদিন পর্যন্ত ভালোবেসে যেতে পেরেছি।”

বলেই ইয়াসিন বেরিয়ে যায়। মিষ্টি তার পেছনে যেতে চায় কিন্তু ইয়াসিন বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

ইয়াসিন বাইরে আসতেই পুলিশের সাথে তার বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। একসময় একটা গুলি এসে লাগে ইয়াসিনের বুকে। এরমধ্যে রাফসানও সেখানে চলে আসলে ইয়াসিন ইশারা করে সেই ঘরটা দেখিয়ে দেয় যেখানে মিষ্টি আছে। রাফসান গেইট খোলা মাত্রই মিষ্টিকে দেখে খুশি হয়। মিষ্টিও রাফসানকে দেখে খুশি হয়৷ কিন্তু তারপরেই একের পর এক গুলি এসে ঝাঝড়া করে দেয় ইয়াসিনের বুক। মিষ্টি গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে চলে যায় ইয়াসিনের কাছে। ইয়াসিন একদম ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেষে দাঁড়ায়। সে পড়ে যেতেই নেবে এমন সময় মিষ্টি তার হাত ধরে নেয়। ইয়াসিন শেষবারের মতো একটা হাসি দেয়। মিষ্টির হাত আলগা হয়ে যায়। অতঃপর ইয়াসিন পড়ে যায় ভূমধ্যসাগরের জলে। সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় তার অধ্যায়। মিষ্টি হতবাক নয়নে তার বন্ধুকে বিদায় নিতে দেখে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here