#ভূমধ্যসাগরের তীরে
#পর্বঃ৩১
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি বসে আছে রাফসানের বাড়ির একটি বিশাল সোফায়। তার মুখে কোন কথা নেই। কিছু সময় পর রাফসান এসে মিষ্টির পাশে বসলো। অতঃপর মিষ্টির মাথায় হাত রেখে বললো,
“চিন্তা করো না, আমি আছি৷ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
মিষ্টি রাফসানের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। ইয়াসিনের মৃত্যুর পর এক মাস অতিবাহিত হয়েছে৷ মিষ্টি এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। এরইমধ্যে রাফসান মিষ্টিকে বলল,
“আমার মনে হয়, তোমার এখন যা মানসিক অবস্থা তাতে তোমার আর এখানে না থাকাই ভালো। তার চেয়ে ভালো হবে, তুমি বাংলাদেশে ফিরে যাও। আমি তোমার বাংলাদেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
মিষ্টি হতাশ স্বরে বলে,
“আমি একাই যাবো? আপনি যাবেন না আমার সাথে?”
“না, আমার পক্ষে এই মিশন ছেড়ে বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভব না। তুমি তো জানোই, আমি যখন এই মিশনের কাছে যুক্ত হয়ে ফ্রান্সে এসেছিলাম তখন সব পিছুটান ফেলেই এসেছিলাম। তাই আর এখন আমার পক্ষে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। যতদিন না এই মিশন শেষ হচ্ছে ততদিন আমার পক্ষে দেশে ফেরা অসম্ভব।”
“কিন্তু এই মিশন কি আদৌ শেষ হবে কখনো? ইয়াসিনের মৃত্যুর পর থেকে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের আর কোন সদস্যের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। কেউ নিশ্চিতও না পাওয়া যাবে কি না। তবে তাদের কার্যক্রম তো থেমে নেই। নিশ্চয়ই তারা কোন না কোন পরিকল্পনা করছে।”
রাফসান বলে,
“সেটাই তো। আর তাদের ধরতেই আমাদের এই মিশন চালিয়ে যেতে হবে। যদি ইয়াসিনকে জীবিত উদ্ধার করা যেত, তাহলে হয়তো আমরা অনেক তথ্য পেতাম ওর কাছ থেকে। কিন্তু…”
মিষ্টি হঠাৎ বলে ওঠে,
“আচ্ছা, ইয়াসিন মার্সেইয়ের মধ্যে যে আন্ডারগ্রাউন্ড শহরের কথা বলেছিল তার সন্ধান কি আপনারা পেয়েছেন?”
“না, আমরা অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাই নি। শহরেও কোথায় এমন আন্ডারগ্রাউন্ড শহরের চিহ্ন নেই। জানি না, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই শহরের কোথায় ঐসমস্ত সন্ত্রাসীরা আন্ডারগ্রাউন্ড শহর নির্মাণ করল। আর এর নেপথ্যেই বা আছে কে।”
ভূমধ্যসাগরের কথা মনে আসতেই মিষ্টির মাথায় কিছু প্রশ্ন এলো। সে ভাবুক কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা, কোন ভাবে কি এই শহর ভূমধ্যসাগরের নিচে অবস্থিত হতে পারে না?”
মিষ্টির কথা শুনে রাফসানও সংকোচে পড়ল৷ তার মাথায় তো এটা আসে নি। রাফসান বলল,
“তুমি একদম ঠিক বলেছ মিষ্টি। আমাদের একটু খুঁজে দেখা উচিৎ ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে। তবে তোমাকে আমি এই পরিবেশে রাখতে চাই না। তুমি বাংলাদেশে ফিরে যাও।”
মিষ্টি বললো,
“আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। এই মিশনে তো শুধু আপনি একাই যুক্ত না, আমিও যুক্ত। তাই এই মিশন সম্পন্ন করার তাগিদা আমারও আছে। আর আমিও তাই এখানেই থাকব।”
“তুমি কিন্তু এবার জেদ দেখাচ্ছ।”
“বেশ, প্রয়োজনে আরো জেদ দেখাবো। তবে আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।”
রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“বুঝলাম, তোমার জেদের কাছে আমায় হার মানতে হবে। যাইহোক, তুমি বলো তোমার পরবর্তী পরিকল্পনা কি?”
“আমি এখন একটু আমিনাদের বাড়িতে যেতে চাই। আমিনা ও ফাতিমা আন্টির সাথে দেখা করতে চাই।”
“ঠিক আছে, চলো আমি তোমাকে ওখানে পৌঁছে দিচ্ছি। তারপর আমাকে আবার একটা জরুরি কাজে যেতে হবে।”
“আচ্ছা।”
এই বলে রাফসান মিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মিষ্টিকে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে রাফসান আবারো কিছু জরুরি কাজের জন্য রওনা দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে আবার পিছনে ফিরে বলে,
“সাবধানে থেকো মিষ্টি। আমার কেন জানি, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে, একবার যদি তোমায় ছেড়ে যাই তাহলে হয়তো তোমায় হারিয়ে ফেলব!”
মিষ্টি কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
“এসব কেমন কথা বলছেন আপনি? এমন কথা মুখে আনবেন না। অনেক কষ্ট করে, অনেক অপেক্ষার পর আমি আপনার খোঁজ পেয়েছি। আপনাকে আর আমি হারিয়ে যেতে দেব না।”
রাফসান বলে,
“আমি যদি আবারো হারিয়ে যাই, তাহলে আবার আমাকে খুঁজে বের করবে তো?”
রাফসানের কথায় মিষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলে,
“করবো। প্রয়োজনে ভূমধ্যসাগর তন্ন তন্ন করে দেব। তবুও আপনাকে খুঁজে বের করব। আপনার পিছু আমি ছাড়ব না কখনো।”
রাফসান মিষ্টিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রাফসানের এত নিকটে এসে মিষ্টিও যেন তার আলিঙ্গনে হারিয়ে যায়। তার মাঝেও হঠাৎ করে রাফসানকে হারানোর ভয় জেকে বসে। তাই তো সে বলে,
“আমায় কথা দিন, আপনি আবার আমার কাছে ফিরে আসবেন একদম সুস্থ ভাবে।”
রাফসান কথা দেয়,
“যদি আল্লাহ চান, আমি সব বিপদ পাশ কাটিয়ে আবার তোমার সামনে এসে উপস্থিত হব।”
বলেই রাফসান দ্রুত রওনা দেয়৷ যাওয়ার আগে আবারো মিষ্টির দিকে তাকায়। মিষ্টি বলে,
“সাবধানে যাবেন।”
“আচ্ছা।”
রাফসানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মিষ্টি। কেনো জানি তার মন কেমন একটা বিপদের আশংকা করছিল। মিষ্টি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলে,
“আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে সকল আগত বিপদ থেকে রক্ষা করো।”
★★★
ফাতিমা বিবি ছেলের শোকে পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন। আমিনাও ভাইকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন। মিষ্টি ফাতিমা বিবির পাশে বসে বলে,
“আপনি আল্লাহর কাছে ইয়াসিনের জন্য দোয়া করুন, আন্টি। ও জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছে কিন্তু ওর অতীত..ওর ঐ ভয়ংকর অতীতের জন্য যেন ওর পাপ একটু হলেও লাঘব হয়।”
ফাতিমা বিবি ক্রন্দনরত স্বরে বলেন,
“আমার ছেলেটা এমন ছিল না, জানো মিষ্টি। ও অনেক ভালো, ভদ্র ছেলে ছিল। কিন্তু অল্প বয়সেই এত সবকিছু সহ্য করতে হয়েছে যে…আসলে দোষটা আমারই। আমিই মায়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি নি। কিন্তু আমিই বা কি করবো? আমি তো হ স্বেচ্ছায় পতিতাবৃত্তিতে নাম দেই নি। আমাকে ঐ মিস্টার ল্যুঁই একপ্রকার বাধ্য করে..”
আমিনা বলে ওঠে,
“এসব কথা বাদ দাও না, আম্মু। এসব বলে কি আর কোন লাভ আছে? যা হবার তো হয়েই গেছে। এখন আমাদের সবটা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”
“সবটা ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ? আমি যে একদণ্ডও ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই আমার ছেলের চেহারাটা সামনে ভেসে ওঠে। ওর চেহারাটা মনে পড়লেই আমার বুক ফেটে কান্না আসে।”
বলেই ফাতিমা বিবি কাঁদতে থাকেন। মিষ্টি আমিনাকে বলে,
“আচ্ছা, আমিনা তুমি তো এই গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করেছ, তুমি কি এই সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে অতিরিক্ত কোন তথ্য জান?”
“আমি যা জানি, সবই তো আমি রাফসানকে বলেছি। এর বাইরে আমার আর কিছু জানা নেই।”
“তবে আমি যতদূর বুঝতে পারছি, এই সংগঠনের লোকেরা থেমে নেই। ওরা নিশ্চয়ই আরো নতুন নতুন টার্গেট খুজছে৷ নতুন নতুন যুবকের ব্রেইনওয়াশ করে ওদেরও এই সংগঠনের সাথে যুক্ত করতে চাইছে। এভাবে চলতে থাকলে, ওরা সত্যিই একসময় এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। এটা আমাদের আটকাতেই হবে।”
“কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?”
মিষ্টি আর কিছু বলবে তার আগেই হঠাৎ তার মাথা ঘুরে যায়। আর সে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমিনা ও ফাতিমা বিবি তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মিষ্টির জ্ঞান ফিরতেই সে দেখতে পায় একজন ডাক্তার এসে তার চিকিৎসা করছে। আমিনা ও ফাতিমা বিবি উৎকন্ঠার সাথে তার শিয়রে দাঁড়িয়ে। মিষ্টিকে চোখ খুলতে দেখেই আমিনা বলে ওঠে,
“তোমার কি হয়েছে আপু? তুমি ঠিক আছ তো?”
ডাক্তার বলে ওঠেন,
“চিন্তার কোন কারণ নেই। একটা ভালো খবর আছে। উনি প্রেগন্যান্ট!”
ডাক্তারের কথা শুনে সবাই অবাক হয় সাথে খুশিও। মিষ্টি নিজের পেটে হাত দিয়ে বলে,
“আমার আর রাফসানের সন্তান!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨