কলঙ্কিত চাঁদ #সূচনা পর্ব #ফাতেমা আক্তার।মাইশা

0
47

#কলঙ্কিত চাঁদ
#সূচনা পর্ব
#ফাতেমা আক্তার।মাইশা

– হারামজাদি কার লগে ফস্টি, নষ্টি কইরা আইছোস? নষ্টা মাইয়া কোনখানের! তোর শরীরে এত জ্বালা কেন? নিজের অসুস্থ বাপটার কথা একবারও ভাবলি না। মানুষটা জানলে কী হয়বো? অসুস্থ শরীরডা লইয়া দিনে রাইতে খাইটা মরতাছে তোগো লাইগা। এ কথা জানলে মানুষটা বাঁচব? তোর বাপ, মায় তোরে কেন দুনিয়ার মুখ দেখায়লো? পেটে থাকতেই মাইরা লাইতো, তাইলে আজকে এই দিন দেখা লাগত না। আল্লাহ আমি কী করাম? ‌এ মাইয়া কেমনে এ কাম করল…

কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করছে জাবেদা। ঘরের এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে আছে চন্দ্র। মার খেয়েও তার মুখে রা নেই। বোধ হয় তার কথা বলা কেউ রোধ করে দিয়েছে। কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো কথায় যে বের হচ্ছে না। ঠোঁটের কোণা ফেটে রক্ত চিবুক ছুঁয়েছে। গায়ের ওড়নাটা অবহেলায় অদূরে পড়ে রয়েছে। এলোমেলো চুলগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখ মুখের বেহাল দশা। শরীরে অগণিত আঘাতের চিহ্ন! কোনোরকম অস্ফুটনে বলল,
– ফুফু তুমি আমায় ভুল বুঝছ। আমি…

কথাটুকু শেষ করতে পারল না। তার আগেই পুনরায় ঠাঁটিয়ে চড় মারল জাবেদা। রাগে তার শরীর কাঁপছে। চন্দ্রকে জ্যান্ত কবর দিতে পারলে বুঝি তার শান্তি মিলবে।

শক্ত হাতে গাল চেপে বলল,
– এই মাইয়া তুই এহন আমারে ঠিক ভুল বুঝাইবি? আমি কি কম বুঝি রে? এমনি এমনি কি মাথার সব চুল সাদা হয়ছে। তোর থেইকা বুঝতে হইব আমারে এহন? তুই কি বুঝ দিবি তা আমি বুঝি না মনে করছোস? আমারে বলদ পাইছোস? ভুলভাল বুঝ দিবি আর আমি তা বিশ্বাস করুম। তোর ঘরে বাচ্চা না হওয়ার ওষুধ কেন থাকব ওইডার জবাব দে আগে। পরে তোর বাকি কথা হুনমো।

এবার চন্দ্র চুপ মেরে গেল। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না।
কী বলবে সে? শরীরটা আর চলছে না। ব্যথায় লুটিয়ে পড়তে মন চাচ্ছে। এ জীবনে কোনোদিন একটা চড় খেয়েছে কিনা সন্দেহ। আদরে আদরে বড়ো হয়েছে। সে শরীরে এত ব্যথা সহ্য করার মতো। এত দুঃখের কেন এ জীবন? একটু শান্তি কী তার প্রাপ্য না?

বাবার কানে কথাটা গেলে কী হবে? বাবার কথা মনে পড়তে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হলো। বাবাও কী জানলে তাকে মারবে, না কি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিবে? না চন্দ্র আর ভাবতে পারছে না।
মাথার চুল টেনে ধরল। নিজেই নিজেকে আঘাত করতে লাগল উন্মাদের মতো। হাতে মুখে আঁচড় কাটল অনবরত।
শরীর জ্বলছে, তার ভিতরটাও যে জ্বলছে। শরীরের দহনের চেয়ে মনের দহন যে অসহনীয়।

ইশ্, এত যন্ত্রণা কী করে সহ্য করবে! ও যে বড্ড দুর্বল চিত্তের। নরম,‌ আদুরে ফুল। একটুতে মূর্ছা যাবে।

– কিরে এখন চুপ মাইরা গেলি ক্যান? জবাব দে? জবাব নাই তো তোর কাছে তাই না? আমি জানতাম।

আসলেই চন্দ্রের কাছে জবাব নেই। কী জবাব দিবে? নেই জবাব নেই, কোনো জবাব নেই।

জাবেদা আর বসে রইল না। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এ মেয়েকে চোখের দেখাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। রাগের মাথায় না জানি কখন কী করে বসবে তার ঠিক নেই।
তাছাড়া তার এখন অনেক কাজ। এ মাইয়া মরল কী বাঁচল তাতে কিছু যায় আসে না। তার যত চিন্তা তার ভাইকে নিয়ে। কী জবাব দিবে ভাইকে। কত ভরসা করে মেয়েটার দায়িত্ব দিয়েছিল তার কাছে। আর সে কিনা দেখে রাখতে পারল না।

যতই মুখে বলুক এ মাইয়ার লাইগা তার চিন্তা নাই। কিন্তু দিন শেষে তার বুক পুড়ে। ছোটোবেলা থেইকা একলা হাতে কোলে পিঠে মানুষ করছে। ভাইয়ের সন্তান হলে কী হবে? একবারের জন্যও মাথায় আনেনি চন্দ্র ওনার নিজের সন্তান না। বরং সন্তানের থেকেও বেশি আদর যত্ন দিয়ে মানুষ করেছে।

জাবেদা একলা মানুষ। স্বামী নেই তার। বিয়ের বছর দশেক পর দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। আর তাকে করে যায় সর্বহারা। কোনো সন্তানাদিও নেই তার। একা একলা মানুষ। ছোটো থেকে বেশিরভাগ সময় চন্দ্রকে নিজের কাছে এনে রাখতেন তিনি। বাচ্চাটাকে দেখলে কী মায়া মায়া লাগত তার। কত ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করল। এত ভালোবাসার দাম কী দিল? এমন কেন করল মাইয়াডা? একবারও তাদের কথা মাথায় এলো না। বিলিয়ে দিল নিজের সর্বস্ব! এত বড়ো ভুল কেমনে কইরা ফেলল। এহন যে সব হাতের বাইরে। কেমনে সামাল দিব সব। কার লাইগা ফুলের মতো গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগাইল?

_

চন্দ্র নিজের দুর্বল শরীরটা টেনে খাট পর্যন্ত যেতে পারল না। তার আগেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

জাবেদা ঘরে এলো সন্ধ্যার পর। একটু পরেই মাগরিবের আজান দিবে। অথচ ঘরে বাতি জ্বালানো নেই। পুরো ঘর অন্ধকারে ছেয়ে আছে। না কোনো আলোর দেখা মিলছে আর না কানে আসছে কোনো শব্দ। আঁধার ঘেরা নিস্তব্ধ পরিবেশ। এ যেন কোনো মৃতপুরী!

প্রৌঢ় মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল। আজানের সময় যে ঘরের বাতি জ্বালায়তে হয় তা কি ভুইলা গেছে মাইয়াডা।

তিনি বাইরে থেকে হাক ছাড়লেন,
– এই চন্দ্র, এই মাইয়া কই তুই? দিন দুনিয়া ভুইলা গেলি না কি? আজান দিব একটু পর। ঘর আন্দাইর কইরা রাখছোস কেন ছেমড়ি? বাত্তি দে ঘরের।

না সাড়া নেই। তিনি আবার হাক ছাড়লেন। এবারও কোনো শব্দ কানে এলো না। বিরক্ত হলেন তিনি। এ মাইয়া মরল নাকি।

জাবেদা ঘরে ঢুকতেই নজরে এলো মাটিতে লুটিয়ে থাকা চন্দ্রকে। কতক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আল্লাহ কী সুন্দর রূপ দিছে, পুরা চান্দের নাহাল! তাই তার ভাই মেয়ের নাম রেখে ছিল চন্দ্র। কী মায়াবী চেহারা! গোলগাল মুখশ্রীর ছোট্ট মাইয়াডারে দেখলেই তার মায়া লাগে।
এই যে এত বড়ো ভুল করার পরও…
ভুল, ভুল না তো পাপ! চন্দ্র যে পাপ করেছে! এ যে পাপ!

এমন জঘন্য পাপ করার পর তার তো উচিত চন্দ্রকে বাড়ি ছাড়া করা। তার ভাইরে ফোন দিয়া বলা উচিত ভাই তোর এই কলঙ্কিনী মাইয়ারে লইয়া যা আমার বাইত থেইকা। এ নষ্টা মাইয়ারে আমি আমার ঘরে জায়গা দিতে পারুম না। এমন নষ্ট মাইয়া রাখলে তার পাপ হবে। লোকে জানলে ছিঃ! ছিঃ! করবে। সমাজে মুখ দেখানোর জো থাকবে না। তাকে লোকে একঘরে করে দিবে। টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে তখন।
কই সে যে তার ভাইকে কল দিয়ে এখন পর্যন্ত কথাগুলো বলতে পারল না। আর না পারল এ মেয়েকে তার বাড়ি থেকে বের করতে। ভাইয়ের শরীরের কথা সে ভাবছে না।
সে তো ভাবছে মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে থাকা চন্দ্রকে নিয়ে। ক্ষত বিক্ষত শরীরটা দেখে তার কষ্ট বাড়ছে। কেন যে নিজের রাগ দমন করতে পারল না। এতটা না মারলেই পারত। না জানি কত ব্যথা পেয়েছে। এই প্রথম নরম শরীরে এত আঘাত পেল। মুখ বুজে তার মার সহ্য করেছে। টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। তাকে বাধাও দেয়নি। কীভাবে পারল অমন নিষ্ঠুরতার সহিত ফুলের মতো মেয়েটাকে আঘাত করতে!

– মাইশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here