কলঙ্কিত চাঁদ #পর্বসংখ্যা ৭ #ফাতেমা আক্তার মাইশা

0
24

#কলঙ্কিত চাঁদ
#পর্বসংখ্যা ৭
#ফাতেমা আক্তার মাইশা

ভদ্রলোকের কথা যেন চন্দ্রের কাছে বিষের মতো ঠেকল।
একটা মানুষের এত রূপ কি করে হয়।
এত জঘন্য রূপ! চন্দ্রের এখন নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। সে কি করে এমন একটা নোংরা মনের মানুষকে ভালোবাসতে পারল। একবারও মানুষটার মনোবাসনা টের পেল না।
বুঝতে পারল না ভালোবাসার নামে তার নোংরা চাওয়া।

চন্দ্রের মনে হলো একজন ধর্ষক আর প্রেমিক নামক পুরুষের মাঝে শুধু একটাই পার্থক্য। একজন জোর করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে। আর আরেকজন ভালোবাসাকে অজুহাত বানিয়ে।

চন্দ্র যেমন তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা নয়, ঠিক তেমনি সে প্রথম নারী নয় যার সাথে এ প্রথম ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এর আগেও কাউকে মন দিয়েছে। ঠিক যেভাবে চন্দ্রকে ছুঁয়েছে ঠিক সেভাবে অন্য কাউকে ছুঁয়েছে।

এত কিছুর পরও চন্দ্র মানুষটার বাবাকে মানাতে চাইল। তবে পারল না, ব্যর্থ হলো। ওনার কথা নিজের ছেলেকে ওনার থেকে ভালো কেউ চিনে না। এ ছেলে এর আগেও বিধবা এক মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। তারপর আবার তার বান্ধবীকে। তার ছেলের চাওয়ার শেষ নেই। তবে বিদেশ থেকে এসেও আবার সম্পর্কে জড়াবে জানলে ছেলেকে কখনো দেশে ফিরতে বলতেন না। সারা জীবন দেশের বাহিরেই ফেলে রাখতেন।

প্রেম জিনিসটা হারাম। তিনি এসব বিষয়ে মোটেও সম্মতি দিবেন না। জেনেশুনে কেন হারাম কাজে তিনি সম্মতি দিবেন। কিছুটা ধার্মিক গোছের মানুষ তারা। তাদের পরিবারে প্রেমের বিয়ে মেনে নেওয়া হয় না। পরিবারের সম্মতিতে তাদের ছেলেমেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। তার ছেলেও তাই করবে। অথচ ওনার বড়ো ছেলের প্রেমের বিয়ে ছিল। ওনার ছোটো শালার ছেলেরও প্রেমের বিয়ে। কই সে বেলায় তো সকলে মেনে নিয়েছে। ঝামেলা করেনি, এত তালবাহানাও দেয়নি। সব নিষেধাজ্ঞা বুঝি চন্দ্রের বেলায়।

সব অন্যায় জেনে বুঝে চন্দ্র না জানার ভান করে থাকল।
তার মন মস্তিষ্ক যে ভিন্ন কথা বলে। মস্তিষ্ককে বুঝ দিতে পারলেও মনকে বুঝ দিতে সে অপারগ। অবুঝ মনকে কী বুঝ দেওয়া যায়। মন যে ন্যায় অন্যায় বুঝতে চায় না। তাকে বুঝ দিবে কী করে?
তার মন মানুষটাকে ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে নারাজ। এত কিছুর পরও চন্দ্র যে কত শতবার তার কাছে ছুটে গিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। পথে ঘাটের মানুষ চন্দ্রের দিকে বাঁকা নজরে চাইত। চাইবেই তো। একটা মেয়ে ঘন ঘন বাজারে আসছে যাচ্ছে। একদিন দুদিন অদেখা করলেও একটা সময় বাদে ঠিকই সকলের চোখে বাঁধবে। চন্দ্র দেখত সব। বুঝত সকলের চাহনি ঘুরেফিরে তার দিকে। তবে সেসব নজরকে খুব একটা তোয়াক্কা করত না।

চন্দ্রের মনে আছে মানুষটা যখন প্রথমবারের মতো আশা ভেঙে ছিল সেদিন চন্দ্র খুব করে কেঁদে ছিল। শুধু কেঁদেকুটে রহম করেনি। খাওয়া দাওয়াও লাটে উঠিয়ে ছিল। রাতের আঁধারে চোখের পানিতে বালিশ ভেজাত। খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব যেন বন্ধ। চন্দ্রের বাবা মেয়ের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে চিন্তিত স্বরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিল,
– মেয়ের এ অবস্থার কারণ কী?

– ঐ ছেলে পরিবার নিয়ে আসবে বলেও আসেনি। তাই তোমার মেয়ে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে বসে আছে।

চন্দ্র তখন বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। বাবার আদরের মেয়ে কিনা মাত্র দু মাসের সম্পর্কের জন্য নিজের এ হাল করেছে। মাত্র দু মাস। কী এমন পেয়েছে ঐ ছেলের মাঝে যে এত মরিয়া হয়ে উঠল। মানুষ তো বছরের পর বছরের সম্পর্ক ভাঙার পরেও নিজের এহেন দশা করে না। আর তার মেয়ে কিনা দু মাসের একটা ছেলের জন্য নাওয়া খাওয়া সব ভুলে বসে আছে।

চন্দ্রের বাবা মা চুপচাপ মেয়ের দশা পরিলক্ষিত করে যেত। তবে মেয়ে যতটুকু উপরে উপরে দেখাত ঠিক ততটুকু। মেয়ে যে ঐ ছেলের জন্য শুধু খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেনি। বরং হাতও কেটে ছিল। তাও তাদের অজানা নয়। তারা জেনেও চুপ থাকত।

চন্দ্রের ভুলের জন্যই তার এ অবস্থা। চন্দ্রের মা প্রথমেই মেয়েকে বলেছিল, ছেলে ভালো তো? এসব ছেলেরা কিন্তু খুব একটা ভালো হয় না। চন্দ্র তখন অকপটে জবাব দিয়েছিল ছেলে ভালো। তাকে ছেড়ে যাবে না। অথচ ছেড়ে গেল। মায়েরা বুঝি সব আন্দাজ করতে পারে। তাদের কথা সবসময় সঠিক হতে হবে কেন? এই যে চন্দ্রের বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে গেল। চন্দ্রের বিশ্বাস এত ঠুনকো কেন? এত সহজে ভেঙে গেল।

বাড়িতে ভাঙচুর করে মানুষটা যখন চন্দ্রকে বলেছিল তার কাছে যেতে, চন্দ্র সব ভুলে ছুটে গিয়েছিল। রাগের মাথায় হাতের ফোনটাও ভেঙে ফেলেছিল। চন্দ্রের তখন কী কান্না! এ মানুষটা কী করে তাকে ঠকাতে পারে? চন্দ্রের যে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়।

এটাই নাকি শেষ দেখা। এরপর চন্দ্র চাইলেও মানুষটার দেখা পাবে না। কষ্টে যখন চন্দ্র কান্না করছিল মানুষটা একটা কথায় বলেছিল, আমার মন ভালো করার জন্য তোমাকে নিয়ে এলাম। আর তুমি কিনা…

ঐ কথার মানে যেন চন্দ্র হারে হারে টের পাচ্ছে। মানুষটা নিজের জন্য চন্দ্রকে কাছে টেনে নেয়। ভালোবেসে চন্দ্রকে কাছে টানে না, আদুরে ছোঁয়া ছুঁয়ে দেয় না। তাহলে এ ছোঁয়া কীসের? শুধুই শারীরিক চাহিদা!

চন্দ্র আজ প্রথম এত ঘনিষ্ঠ হয়নি। এর আগেও তিন তিনবার কাছে গিয়েছিল, মানুষটার মাঝে ডুবে ছিল।
বাবা মা কেউ বুঝতে পারেনি। তবে আজ যে ফুফু কি করে দেখে নিল। দেখবেই তো। দেখার ব্যবস্থা যে চন্দ্রই করে দিল।
ট্যাবলেটটা সময়মতো খেয়ে নিলেই ঝামেলা চুকে যেত। এত কাহিনী হতো না।

চন্দ্র আবছা আঁধারে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জানালার কপাট বেয়ে বেহায়া চাঁদটা উঁকি ঝুঁকি মারছে। মৃদু বাতাস বয়ছে। ঘুমে চন্দ্রের চোখ নেতিয়ে আসে।

_

ভোরে উঠেই চন্দ্র গোসল সেরে নেয়। গলার ধারে রক্ত শুকিয়ে কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তাই সকাল সকাল গোসলটা সেরে নিল। এখন বেশ ভালো লাগছে। ওযু করে ফজরের সালাত আদায় করে রান্নাঘরে ছুট লাগায়। ফুফুর ঘরের দরজা ভিতর থেকে লাগানো। তার মানে এখনও ওঠেনি। অথচ প্রতিদিন আজানের আগে ঘুম ভেঙে যায়। চন্দ্র ডাকবে কী ডাকবে না ভেবে উঠতে পারল না। কতক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল বন্ধ দুয়ারের বাইরে। সাহস করে ডেকে উঠতে পারল না। কয়েক পলক চেয়ে নাস্তা বানানোর কাজে লেগে পড়ে। দুজন মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করার দরকার নেই। চন্দ্র দুটো দুটো করে চারটে রুটি বেলে নিল। যদিও সে খুব একটা রুটি খায় না। তবে জাবেদার রুটি ছাড়া অন্য কিছুতে হয় না, তাও আবার চালের গুঁড়োর। যা চন্দ্রের গলা দিয়ে একেবারে নামতে চায় না। রুটি ভেজে কুচি করে রাখা আলুগুলো গরম তেলে ছেড়ে দিল। পানি থাকায় তেলে পড়ার সাথে সাথে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। চন্দ্র হাসল। তেল যেন তাকে বলছে,
– এই মেয়ে জানিস না, তেলে পানি মিশ খায় না। গরম তেলে পানি পড়লে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তবে দিলি কেন?

জাবেদা উঠতে উঠতে চন্দ্রের হাতের কাজ সব শেষ। তার আর ডাকতে হলো না। জাবেদা নিজেই উঠে পড়েছে।জাবেদা চন্দ্রের দিকে একবারের জন্যও তাকায়নি। চুপচাপ খেয়ে উঠে গিয়েছে। এমনভাবে চলছে যেন কাল কিছুই হয়নি। সব ঠিক আছে, যেমনটা আগে ছিল।

চন্দ্র উশখুশ করছে কিছু বলার জন্য। তবে বলতে পারছে না। সে বাড়ি যেতে চায়। এখানে থাকার কোনো মানে নেই। সে যে তার ফুফুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। এত চেষ্টা করেও চন্দ্র বলতে পারল না সে বাড়ি যাবে। তার বাড়ি খুব একটা দূরে না। এই তো হেঁটে গেলে বড়োজোড় দশ মিনিটের রাস্তা। চন্দ্র কতক্ষণ ঘুরঘুর করে কলেজের জন্য তৈরি হতে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট, ঠোঁটের ফোলা ভাব কমেনি, আরও বেড়েছে। বোরকা পড়ে মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিল। করোনা নেই। তবুও মাস্ক পড়াটা যেন চন্দ্রের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য চন্দ্র সবসময় মুখ ঢেকে চলে। নিকাব পড়লে সে ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারে না। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। অথচ মাস্কে তার কোনো অসুবিধা হয় না। বরং মাস্ক না পড়লে আরও অস্বস্তি লাগে।

কলেজে যাওয়ার পথে মানুষটার সাথে চোখাচোখি হলো। চন্দ্র চেয়ে রইল। অথচ মানুষটা এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এখন কী তার চোখে চোখ রাখতেও দ্বিধাবোধ করে। অল্প সময়ে এত পরিবর্তন।
চন্দ্র তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। মানুষটা দেখল না সে হাসি।

– মাইশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here