#কলঙ্কিত চাঁদ
#পর্বসংখ্যা ৯
#ফাতেমা আক্তার মাইশা
সুন্দর পৃথিবীটা হুট করে চন্দ্রের কাছে বিষাক্ত ঠেকছে। কারণটা কী বুঝে উঠতে পারল না চন্দ্র। পারবে না কেন? বেশ বুঝতে পারছে। ভয়, চন্দ্র ভয়ে কোণঠাসা হয়ে রয়েছে। সে কী করবে। আল্লাহ তায়ালা তার জন্য যাকে বানিয়েছে সে আগে কেন তার জীবনে এলো না। সে আগে এলেই তো তার জীবনটা সুন্দর হতো। এমন কলঙ্কের দাগ লাগত না তার অঙ্গে। সে থাকত পবিত্র, পবিত্র ফুল। সদ্য ফুটে উঠা ফুলের ন্যায়। এখন যে সে মূর্ছা গিয়েছে। সুবাস নেই তার মধ্যে। কিছুটা সুগন্ধহীন, দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা। আচ্ছা সে কী আবর্জনা? আবর্জনায় বটে। নোংরা, বড্ড নোংরা। গা ঘিনঘিন করার মতো।
চন্দ্র হাঁসফাঁস করতে লাগল। দম আটকে যাওয়ার জোগাড়। কী হলো কী? শ্বাস কেন নিতে পারছে না? আচ্ছা সে কী মারা যাবে? এভাবে দম আটকে মরবে? চন্দ্রের চোখে পানি এলো। সামান্য পানি চোখের কোণ ঘেসে গড়িয়ে পড়ে। চন্দ্র আপ্রাণ চেষ্টা করেও চোখে পানি আসা আটকাতে পারল না।
বোকা চন্দ্র তো আর বোকাটি নেই। সে যে সময়ের আবর্তনে অনেক বুঝদার হয়েছে। আগের মতো চোখের পানি ফেলে না। যেদিন মানুষটা অন্য কারো হয়ে গিয়েছিল সেদিনও তো চোখে পানি আসেনি। তবে আজ চোখে পানি এলো কেন?
ভয়ে, আবার ভয় আঁকড়ে ধরেছে তাকে। কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার ভয়। চন্দ্রের সাথে এমনটা না হলেও তো পারত।কেন হলো এমনটা।
সব মেয়েরই তো স্বপ্ন থাকে তার একটা সংসার হবে। নিজস্ব একটা পুরুষ থাকবে, যে পুরুষটা শুধু তার। চন্দ্রেরও তো এমনটাই স্বপ্ন ছিল। তবে মাঝে কেন মরীচিকার পিছনে ছুটতে গেল। এমন চোরাবালিতে আটকা পড়েছে যে চন্দ্র আর বের হতে পারছে না। সে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। এবার কেউ তাকে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে তুলছে না। বাড়িয়ে দিচ্ছে না ভরসার হাত। যাকে আশ্রয় করে চন্দ্র বেঁচে ফিরবে।
চন্দ্রের মা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে মেয়ের বিয়ের জন্য। চন্দ্র চাইলেও মুখ ফুটে বলতে পারছে না যে, সে বিয়ে করবে না। পারবে না করতে বিয়ে। এ বিয়েতে তার যত ভয়। মা তো আর জানে না তার মেয়ে কত বড়ো অপরাধ করে রেখেছে। জানলে নিশ্চয় মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করত না। বরং নিজ দায়িত্বে দাফন দিত চন্দ্রকে।
চন্দ্র না পারছে চুপ থাকতে আর না পারছে মুখ বুজে সব সয়ে নিতে। এ যে হয় না। জেনেশুনে চন্দ্র এমন পাপ কি করে করবে। আর কত পাপের ভাগীদার হতে হবে তাকে। চন্দ্র বুঝতে পারছে বেঁচে থাকতে এ পাপ তার পিছু ছাড়বে না। ক্ষণে ক্ষণে তাড়া করে বেড়াবে। এই যে চন্দ্র আগের মতো হাসতে পারে না, হাসতে গেলে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, পাগল পাগল লাগে নিজেকে। মাকে কি করে বলবে ও। মা যে একেবারে বুঝতে চাইছে না। তার মাও তার মতো অবুঝ হয়ে গিয়েছে।
চন্দ্র ভাবল, অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল সে বিয়ে করবে না।
এমন কলঙ্ক নিয়ে কার ঘরের ঘরনী হবে সে। যার সাথে চন্দ্রের বিয়ে হবে সে যদি জেনে যায় চন্দ্রের শরীর তার আগে কেউ ছুঁয়েছে। সে কী তা মেনে নিবে?
মানবে না। কখনোই মানবে না। কোনো পুরুষই এমন নারী চায় না যার শরীরে অন্য পুরুষের ছোঁয়া লেগে আছে। তবে চন্দ্রকে কেন কেউ মেনে নিতে যাবে। আর মেনে নিলেও চন্দ্র যে পারবে না।
চন্দ্র যে একটা সংসার চায় না তা কিন্তু না। চন্দ্রও একটা সংসার চায়। আজকাল এ জিনিসটা চন্দ্রকে বড্ড পোড়ায়।
চন্দ্র যখনই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে তখন তার ভিতরের সত্তা যেন তাকে বলে উঠে,
তুই যে কলঙ্ক। ঠিক যেমন ঐ আকাশের চাঁদে কলঙ্ক লেপ্টে আছে। তুই কোনো পুরুষের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। কেউ তোকে অর্ধাঙ্গী হিসেবে মেনে নিবে না। তোর জায়গা ঐ বিছানা অবধি সীমাবদ্ধ। কারো মনে জায়গা পাবি না তুই।
চন্দ্র উঠে বসল। জাবেদার সাথে কথা বলতে হবে। মা না হয় কিছু জানে না। কিন্তু তার ফুফু তো সব জানে। সব জেনেশুনে কীভাবে মায়ের কথায় সায় দিচ্ছে।
_
– তোমার সাথে আমার কথা ছিল।
জাবেদা এমন সন্ধ্যায় চন্দ্রকে নিজের ঘরে দেখে খুব একটা অবাক হলো না। তিনি যেন জানতেন চন্দ্র তার কাছে আসবে।
– আয় বোস, বসে কথা বল।
চন্দ্র বসল তার ফুফুর পাশে। নিচের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ।
পাশ ফিরে তাকাল না। মাথা নামিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,
– মাকে তুমি কিছু বলছ না কেন?
জাবেদা পান চিবোতে চিবোতে বলল,
– কোন কথা? কীসের কথা বলতে বলছিস?
চন্দ্র আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
– মা যে আমার জন্য ছেলে দেখছে। তাকে বারণ করছ না কেন? আমি বিয়ে করতে চাই না।
বিয়ে করতে চাই না শুনে জাবেদা খেঁকিয়ে উঠল,
– বিয়া করবি না ক্যান? বিয়া করতে সমস্যা কই?
চন্দ্র হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– মানে? তুমি সব জেনেশুনেও এ কথা বলছ? তুমি তো জানো আমি…
চন্দ্রের মুখের কথা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে বলল,
– কী জানি আমি বল, কী এমন হয়ছে? ঐ পোলা বিয়া কইরা সংসার করতে পারলে তুই ক্যান পারবি না। দোষ কী তুই একলা করছোস? ঐ পোলা কিছু করে নাই। ঐ সংসার করতে পারলে তুই ক্যান পারবি না? না কি এখনও ঐ পোলাতে মইজ্জা আছোস?
– তেমন কিছু না। আমি তাকে ভুলে গিয়েছি।
– তাইলে সমস্যা কই? আমি তো আর কোনো কারণ দেখতাছি না। বিয়েটা করে নে।
– ফুফু তুমি বুঝতে পারছ না। আমার মতো নষ্ট মেয়েরা কারো বউ হওয়ার যোগ্য না।
– চুপ কর মাইয়্যা। আইছে আমার যোগ্য অযোগ্য নিয়া কথা কইতে। এসব কথা মুখে নিবি না। বছর পার হইয়া গেছে তুই এখনও ঐসব লইয়া পইড়া আছোস? দুনিয়ার কত মাইনসে কত আকাম কুকাম কইরা বেড়ায়তাছে, তারা কী বিয়া করতাছে না। এসব ভুইলা যা।
– বললেই ভুলে যাওয়া যাই, ভুলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো সব ভুলে গিয়েছি। তবে কেন ঠিক হচ্ছে না।
আনমনে কথাগুলো বলে চন্দ্র উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে বলে গেল সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। জাবেদাও কড়া গলায় বলে দিয়েছে যাইহোক না কেন বিয়ে তাকে করতেই হবে।
_
চন্দ্র ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। চন্দ্রের মা কতক্ষণ করা নেড়ে গেলেও চন্দ্র উঠল না। মাগরিবের আজান কানে আসছে। অথচ উঠতে মন সায় দিচ্ছে না, মন বলছে ঘুমাতে। চন্দ্র মনের কথা শুনে। কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
চন্দ্রের যখন ঘুম ভাঙে ধরণীতে তখন গভীর রাত। সময় না দেখেও চন্দ্র বুঝতে পারল এখন রাতের দুটো বা তিনটে। চন্দ্র আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। হুট করে যেন ওর তেষ্টা পেল। চন্দ্র হাঁসফাঁস করতে লাগল। বিকেলেও এমনটা হয়েছে। এখন আবার। জানালার কপাট খুলে দিতে শীতল বাতাস ওর গা ছুঁয়ে দেয়। চন্দ্র চোখ মেলে চাইল। আকাশে আজ চাঁদের হাট বসেছে। চাঁদ যেন ঝলমলিয়ে হাসছে। চাঁদের কী রূপ! আঁধার কাটিয়ে ধরণী আলোকিত করে রাখে। আর সে চাঁদকে লোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। সামান্য দাগকে কলঙ্ক ভেবে বসে।
চন্দ্র আপনমনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,
– চাঁদের গায়েও না কি কলঙ্ক আছে? অদ্ভুত! চাঁদকে কেউ ছুঁয়ে দেয়নি। তবুও চাঁদ কলঙ্কিত!
– মাইশা