আমি ও সে পর্ব দুই

0
4106

আমি ও সে
পর্ব দুই
লেখা অধরা জেরিন
,
পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী আমার আর আরিনের সংসার কেটে যাচ্ছে । আরিন মানুষ হিসাবে অসাধারণ । জয়ন্তী ওর কলিজা । একটা মুহূর্ত মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে পারে না। অফিসে যাওয়ার পর কয়েকবার ফোন করে খোঁজ খবর নিবে। আমার ভালোলাগে ওর মনের উদারতা দেখে । কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে ও আজও আমার কাছে স্বামীর দাবি নিয়ে আসেনি। এই তো সেদিনের কথা । আমি জয়ন্তী কে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজে ঘুমিয়ে গেলাম । আরিনের কাছে আরেক টা চাবি আছে তাই ভিতরে ঢুকতে সমস্যা হয়না । সেদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম এলোমেলো হয়ে । কেমন যেন শীত শীত করছিল । জয়ন্তী আমার পাশে গভীর ঘুম । ঠিক এমন সময় বুঝতে পারলাম আমার কপালে কারো হাত। ঘুম ভেঙে গেল । আরিন কোনও কিছু না বলে আমার গায়ে কাঁথা দিয়ে চলে গেল । আমি শুয়ে শুয়ে সব বুঝতে পারলাম । ও চাইলেই পারতো স্বামীর অধিকার খাটাতে কিন্তু নাহ বাসর ঘরেই আরিন আমাকে বলেছিল আপনাকে বিয়ে করেছি কিন্তু যেদিন আপনি স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারবেন সেদিন আমার চাওয়া পাওয়া ভাববার বিষয় আপনার হাতে থাকবে ।
,
আমি মাঝে মাঝে একটু অবাক হয়ে যাই কিভাবে একটা বিবাহিত পুরুষ নারী সঙ্গ ছাড়া থাকতে পারে ?
হ্যা ! পারে মানুষ ইচ্ছে করলেই সব পারে আর যারা বলবো পারে না তারা হচ্ছে মানুষ রুপী হিংস্র পশু।
,
আরিন মাঝে মাঝে আমাদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে যায় । এদিক ওদিক ঘুরে আমাকে নিয়ে যায় জয়ের বাড়িতে যেখানে জয়ের বাবা আর ভাইয়েরা থাকে । ওদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে চলে আসি। আরিনের এই কাজটা আমার কাছে ভাল লাগে । ও আমাকে এতোটাই কেয়ার করে যে আমার নিজের অজান্তে ভালোবাসা ওর উপরে জন্ম নিলো।
,
সেদিন হঠাৎ করে আরিন বাড়িতে চলে এলো। খুব জ্বর ওর গায়ে । এসেই শুয়ে পড়লো। আমি রান্না করছিলাম । ওকে এভাবে চলে আসতে দেখে একটু অবাক হলাম । ওতো এভাবে কখনও আসেনা। আমি কাছে গিয়ে ওকে বললাম ,
– কি ব্যাপার আজ হঠাৎ চলে এলেন যে ? কোনও সমস্যা আপনার ?
– আসলে সকাল থেকে মাথা খুব যন্ত্রণা । খুব খারাপ লাগছে তাই চলে এলাম। আমাকে একটু পানি দিতে পারেন ।
আমি তাড়াতাড়ি করে পানি নিয়ে ওকে এগিয়ে দিলাম । ও কাঁপা কাঁপা হাতে পানি খাচ্ছে ।ওর হাত খুব কাঁপছে । পানি পরে গেল গায়ে । আমি টিস্যু এনে মুছাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে । আমি আঁতকে উঠে বললাম ,
– সে কি আপনার তো অনেক জ্বর ! চলুন ডাক্তারের কাছে নিতে হবে ।
– কিছু হবে না অফিসে বসে নাপা খেয়েছি একটু পর জ্বর পরে যাবে । আপনি টেনশন করবেন না। আমি একটু ঘুমাবো আমার যদি ফোন আসে আমাকে ডাকবেন না।
এই বলেই কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
আমি ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে তাই জয়ন্তী কে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলাম । না হলে মেয়েটা খুব বিরক্ত করবে আরিনকে।
, সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন।
নাহ আরিনের জ্বর কমেনি। আরিনের মা মানে আমার শ্বাশুরি এলেন খবর শুনে । তিনি এসে ছেলের পাশে বসে আছেন । আমার আর আরিনের দুরত্বের কথা জানেন না। এক জনের কাছে শুনেছিলাম আমাকে বিয়ে করা নিয়ে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে ওকে ওদের বাড়ির লোকের সাথে । সবার এক কথা ওমন মেয়ে কে এই বাড়ির বউ করা যাবে না। পরে আরিন সবাই কে কিভাবে রাজি করিয়েছিল জানি না। যাইহোক রাতে আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম ,
– মা খেতে চলুন ?এসে কিছু মুখে দেননি এখন চলুন ?
– আমার খিদে নেই মা ! তুমি খেয়ে নাও।
– আপনি এভাবে ভেঙে পরলে চলবে বলুন । আপনি চলুন আমি আছি ওর কাছে ।
এক রকম জোর করে উনাকে খেতে নিলাম ।
রাতে আরিনের জন্য সুপ বানালাম । শ্বাশুরি জয়ন্তী কে নিয়ে শুয়ে পড়েছে একান্ত বাধ্য হয়ে । উনাকে বলেছি সকাল থেকে আপনি আবার আপনার ছেলের কাছে বসে থাকবেন রাতে আমি আছি। উনি ঠিক তাই করলেন ।
,
আরিনের ঔষধ খেতে হবে । সুপ নিয়ে ওর কাছে গিয়ে বললাম ,
– অল্প একটু সুপ খেয়ে নিন। সকাল থেকে কিছু খাননি।
আরিন বললো ,
– মুখ তিতা লাগছে খেতে ইচ্ছে করছে না।
– ঔষধ খেতে হবে । হা করুন বলছি আমি খাইয়ে দিচ্ছি ।
আরিন উঠে বসে বালিশে হেলান দিলো। আমি ওর মুখে অল্প অল্প করে দিতে লাগলাম । আরিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওর চোখ ছলছল করে উঠলো হয়তো বেশি জ্বরের কারণেই ।
,
আরিন ঘুমিয়ে আছে । আমি পাশে চেয়ার টেনে বসলাম । একটু ঘুম মতো এসেছে হঠাৎ করে একটা কাঁপুনি টের পেলাম । আরিনের জ্বর এসেছে খুব বেশি ঠকঠক করে কাঁপছে । আমি আরো একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে দিলাম তবুও কেঁপে যাচ্ছে । কি করবো বুঝতে পারছি না এক রকম নিরুপায় হয়ে কম্বলের নিচে আরিনের কাছে চলে গেলাম ওর গরম নিশ্বাস আমার শরিরে লাগছে কোনও কিছু না ভেবেই ওভাবে ওকে …… ।
,
অনেক সময় পর ও শান্ত হলো। আমি উঠবার চেষ্টা করলাম না। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি আরিন নেই। ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আমি উঠতেই বললো ,
– আসলে আমি সরি !
– কেন সরি ?
– এই যে তোমার ঘুম নষ্ট করলাম ।
এই প্রথম তুমি করে বললো আমাকে । আমি একটু হেসে দিয়ে বললাম ,
– এখন কেমন লাগছে ?
– অনেক ভাল ,মনে হচ্ছে অফিস করতে পারবো।
ওর কথা শুনে হেসে দিয়ে বললাম ,
– তাহলে তাড়াতাড়ি অফিসে যাও দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
এই কথায় আরিন ও হেসে দিল।
,
আরিন এখন আগের থেকে একটু ভাল । সারা দিন ভালোই কেটেছে । এর মধ্যে অনেকে এসে ওকে দেখে গেছে । বিকালে আরিন জয়ন্তী কে নিয়ে খেলছে । আমি বিকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত । ঠিক এমন সময় শ্বাশুরি আমার কাছে এসে বললো ,
– ঠিক করছো মা ?
– এই তো মা আসুন । মা আপনি কিন্তু আজ রাতের রান্না করবেন শুনেছি আপনার হাতের ইলিশ পোলাও অনেক মজার ।
– ঠিক আছে করবো। আরিনের খুব পছন্দ ওটা । ও যখন লেখাপড়া করতে আট বছর দেশের বাইরে ছিল অনেক আমার এই রান্না মিস করতো।
– তাহলে তো আপনার ছেলে এসেই আপনাকে পাগল করে দিয়েছিল তাই না ?
আমি একথা বলতেই উনার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল বললো ,
– থাক মা ওসব বাদ দাও। তুমি তোমার কথা বলো?
– না মা আপনি বলুন কি হয়েছে ? আমি শুনতে চাই?
আমার কথা শুনে শ্বাশুরি বলতে শুরু করলো ,
– এই তো বছর খানেক আগের কথা । আরিন এসেছিল লন্ডন থেকে আট বছর পর। এসেই বলেছিল আমার একটা বন্ধু ফেসবুকে পরিচয় ওর সাথে আমার কথা ছিল এসেই দেখা করবো সেখানে যাচ্ছি ।ওর বাবা বললো , আরিন তুই এসেই বাইরে বের হচ্ছিস শুনে যা বাবা । আরিন বললো , বাবা ওকে আমি সাথে করে নিয়ে আসবো। তখন পরিচয় করিয়ে দেবো সবার সাথে । এই বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল ।
,
আরিন এসেছিল তিন ঘন্টা পর কিন্তু বিধ্বস্ত অবস্থায় । জিজ্ঞাসা করতে যা বললো আমাদের শরীর কেঁপে উঠছিল ভয়ে ।
– আমি অবাক হয়ে শ্বাশুরির কথা শুনছিলাম । বললাম কি বলেছিল মা ?
শ্বাশুরি এবার বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বললো ,
সে দিন আরিন কাঁদতে কাঁদতে এসে আমাদের সামনে এলো। ওর বাবা বললো ,

– কি হয়েছে বাবা তোর ?
– বাবা ও মরে গেছে আমার সেই বন্ধু মরে গেছে ।
ওর বাবা অবাক হয়ে বললো কি বলিস কি ভাবে মরেছে তাইতো বলবি ,
– বাবা ওর নাম জয়। আমাদের ফেসবুকে চার বছরের বন্ধুত্ব । আমার আর জয়ের ইচ্ছে ছিল আমি দেশে আসলেই সবার সাথে আমরা পরিচয় করিয়ে দেব। আমি আসার পর যখন ফোন করলাম ও বললো হাসপাতালে এখন ওর বউয়ের বেবি হবে । এটা শুনে আমি আরো খুশি হয়ে হাসপাতালের কাছে গেলাম। ফোন করতেই ও নিচে নেমে এলো। খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ঔষধ কিনতে কিনতে আমাকে সব বললো ওর বউ অরিত্রা । বেবি হলেই আমাকে নিয়ে গিয়ে অরিত্রা সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।
,
আমি ও খুব খুশি। জয় বললো আরিন তুমি এক কাজ করো বাসায় যাও আমি তোমাকে ফোন করবো। আমি ওর কথা শুনে বাসায় চলে আসছিলাম ঠিক এমন সময় জয়কে কিছু বলে ডাকতে যাবো তখনই জয়ের পিছন থেকে একটা মাইক্রো মেরে দিল। জয় অরিত্রার চিন্তা নিয়ে মোটেই বুঝতে পারলো না ও ভুল পথে এগিয়ে যাচ্ছে । আমি এই দেখে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলাম । মা আমি জয়কে মেরেছি। সেদিন আমি কথা না বললে ও আরো আগে ঔষধ নিয়ে যেতে পারতো। জয়কে হারাতাম না। এই বলেই আরিন কান্নায় ভেঙে পড়লো।

,

চলবে ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here