ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ৩৬
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
শরীরটা অসুস্থ তাই আজ আর মেডিকেলও আজ বন্ধ আছে। সারাদিন বাড়িতেই কেটেছে। আদ্রিয়ানও ল্যাবে গিয়ে বসে আছে। ওনার করা নির্দেশ সারাদিনে ঘরে বেড রেস্টে থাকতে হবে? আমার তো সবকিছুই বিরক্ত লাগছে। এভাবে সারাদিন রুমে বসে থাকা যায়? কিছুই ভালো লাগছে না। ফোনে গেমস খেলতে খেলতেও একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ফোনটা এককোণে ফেলে রেখে দিয়েছি। আপি আর জাবিন এসছিল দুবার বেশ কিছুক্ষণ গল্পও করে গেছে। বিয়ের পর আদ্রিয়ানের শাসনে বিকেলে ঘুমানোর অভ্যেস হয়ে গেছে তাই শুয়ে পরলাম ঘুমানোর জন্যে। ও তো বলল তাড়াতাড়ি চলে আসবে, এখনও এলো না কেনো? হয়তো আটকে আছে, হাতের কাজ না সেড়ে কীকরে আসবে? আমি এরকমি যখন একা বসে থাকি তখন নিজেই প্রশ্ন করি নিজেই উত্তর দেই। নিজের মতই চিন্তা করতে থাকি। এখনও ঠিক তাই করতে করতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
ঘুম ভাঙতেই কারো কারো শরীরের উষ্ণতা অনুভব করলাম। আর সাথেসাথেই চোখ না খুলেও বুঝতে পারলাম আমি আদ্রিয়ানের বুকে আছি। নিজের বুকে খুব সযত্নে আবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে ও আমাকে। আমি ওনাকে জরিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করেই বললাম,
— ” কখন এলে?”
ও একটু চুপ থেকে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” অনি প্লিজ। ঘুম থেকে উঠে আমার সাথে কখনও কথা বলো না।”
আমি একটু অবাক হয়ে চোখ খুলে ভ্রু ওর দিকে তাকালাম। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম,
— ” কেনো?”
ও আমায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
— ” তোমার ঘুম জড়ানো কন্ঠটা নেশার মতো কাজ করে আমার ওপর। এক অদ্ভুত ঘোরে চলে যাই। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে কষ্ট হয়। খুব করে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে।”
ওনার কথাটা শুনেই কেনো জানিনা চুপ হয়ে গেলাম। লজ্জা পেয়ে চোখ এক অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করছে আমাকে। ইদানিং হয় এরকম। ওর কাছাকাছি থাকলে এখন আর আগের মতো অস্বস্তি বা ভয় লাগেনা। অনেকটাই নরমাল হয়ে গেছি ওর সাথে। এখন সেই ভয় আর অস্বস্তির জায়গায় এসে ভর করেছে নাম না জানা অন্যরকম কিছু অনুভূতি আর হালকা লজ্জা এসে ভর করেছে। এ পরিবর্তনের কারণ কী ওনার প্রতি আমার অনুভূতি পরিবর্তনের লক্ষণ? ও আমার মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,
— ” কিন্তু আমি চাইনা এমন কিছু হোক যার জন্যে তুমি এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নও।”
আমি আস্তে করে তাকালাম ওর দিকে। ও আমার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
— ” ঘুমতো হয়েছে। এবার তো উঠতে হবে না কী? আমি মনিকে বলে দিয়েছি এক্ষুনি কফি নিয়ে চলে আসবে চলো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
আমি আস্তে করে ওর বুক থেকে উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ওয়াসরুম থেকে ফিরে এসে দেখি মনি অলরেডি কফি দিয়ে গেছে। আদ্রিয়ান বলল,
— ” হাতমুখ ভালোভাবে মুছে ব্যালকনিতে চলে এসো।”
আমি মাথা নাড়লাম। ও ব্যালকনিতে চলে গেল। আমিও মুখ মুছে নিয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। পাশাপাশি ফ্লোরে বসে দুজনেই মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর ধোয়া ওঠা গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছি। অক্টোবর প্রায় শেষ তাই হালকা ঠান্ডাও লাগছে। আদ্রিয়ান এক হাতে আমায় নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল।আমি ওর টিশার্ট ওপর দিয়েই আঁকাবুকি করতে করতে করতে বললাম,
— ” তুমিতো বললে যে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। তাহলে এতো দেরী হলো যে?”
আদ্রিয়ান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
— ” ইশরাকের বাড়িতে নূরের কাছে গেছিলাম। হসপিটালে নিতে হয়েছিল ওকে আজকে।”
আমি হালকা চমকে তাকালাম ওর দিকে। অনেকটা উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,
— ” কী হয়েছে নূর আপুর? ঠিক আছে তো? মানে ওনার কোনোরকম কোনো বিপদ হয়নি তো? আপু..”
আদ্রিয়ান আমাকে থামিয়ে বলল,
— ” আচ্ছা কুল কুল। বলছি আমি। কিচ্ছু হয়নি নূরের। ও একদম ঠিক আছে। শান্ত হও তুমি।”
আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম,
— ” তাহলে?”
— ” আসলে হঠাৎই একটু পেইন হচ্ছিল নাকি। উইক হয়ে পরেছিল। আমি ভাবলাম অনেক সময় তো টাইমের আগেও বেবি হয়ে যায়। তারওপর ওরতো এই বাইশ তেইশ দিন পরেই ডেইট। সো ভাবলাম দেখিয়ে নিয়ে আসি। বুঝতেই পারছো। আঙ্কেলের বয়স হয়েছে। বাড়িতে কোনো ছেলে নেই। তারওপর ওর পরিবার চট্টগ্রাম থাকে। ওর যদি একটা ভাই বা দেবর থাকতো তাহলে তো সেই এসব করতো তাইনা?”
ওর কথা শুনে কষ্ট আর ভালোলাগা দুটোই কাজ করল। কষ্ট হচ্ছে নূর আপুর জন্যে। ইশরাক ভাইয়ার মতো বর তো কপাল করে পাওয়া যায়। যেখানে এই সময়টা ওনার ইশরাক ভাইয়ার অসম্ভব রকমের কেয়ার, ভালোবাসা, শাসন,যত্নে কাটার কথা সেখানে আজ ওনার একটু ডক্টরের কাছে যেতেও অন্যকারও সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে। কীকরে পারছে মেয়েটা এই যন্ত্রণা সহ্য করতে। ইশরাক ভাইয়ার স্মৃতিগুলো কী ওনাকে তাড়া করে বেড়ায় না? এমনিতেই ইশরাক ভাইয়া নূর আপুকে মাথায় তুলে রাখতো সবসময় আর এইসময় হলে তো কথাই ছিলোনা। আমি যদি কোনোদিন নূর আপুর মতো পরিস্থিতিতে পরি আমিতো মরেই যাবো, একেবারে মরে যাবো। আর ভালোলাগছে এটা ভেবে যে আমার স্বামী এমন একজন মানুষ যে সবার প্রতি নিজের দায়িত্বগুলো নিজের সবটুকু দিয়ে পালন করে। আজ নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ড এর অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীকে ভাইয়ের মতই আগলে রাখছে। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ও বলল,
— ” হুম। অনেকদিন যাবত দেখা হয়না নূর আপুর সাথে। নিয়ে যাবে আমায়?”
— ” আচ্ছা নিয়ে যাবো সময় করে। শোনো আজ আর পড়তে বসতে হবেনা। আজকে দিনটা চুপচাপ রেস্ট করো। শরীর ফিট রাখতে হবে। কাল ক্লাস আছে তো? ”
— ” হ্যাঁ আছেতো কেনো?”
— ” কাল থেকে আবার তোমার যাওয়ার সময় ড্রপ আমি করবো আর আসার সময় গার্ড পাঠিয়ে দেবো যদি আমি না আসতে পারি। এন্ড ইয়েস, এটা আমার ওর্ডার। এই বিষয়ে আমি কোনো এক্সকিউস, অজুহাত, জেদ শুনবোনা।”
আমি কিছু বলতে নিয়েও ওর শেষের কথাটা শুনে থেমে গেলাম। কী আর করার বলে যখন দিয়েছে তখন আর কিছু বলেই কিছু হবেনা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা দিয়ে বসে রইলাম।
___________________
এরমধ্যেই সপ্তাহের মতো কেটে গেছে। মেডিকেল, বাড়ি, পড়াশোনা, আর বাকি সময়টা আদ্রিয়ানের ভালোবাসা আর কেয়ারে কেটে গেছে। এরমধ্যে নূর আপুর সাথে দেখা করে কথা বলে এসছি। একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে তা নয় কিন্তু তবে এখন আর নিজের অযত্ন করেনা। নিজের ভেতরের ঐ ছোট্ট প্রাণটার কথা ভেবে এখন জোর করে হলেও ভালো থাকতে হচ্ছে তাকে। কী আর করার আছে তার?
আজ অফ ডে তাই সবাই মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছি। সবাই মানে ইফাজ ভাইয়া, আপি, জাবিন, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য, আদ্রিয়ান আর আমি। প্লানটা আমার কিন্তু এরেঞ্জমেন্ট করেছেন আদ্রিয়ান। একটা বিশাল পার্কে ঢুকেছি। আদিব ভাইয়াও ওনার গার্লফ্রেন্ড রাইমা আপুকে নিয়ে এসছেন। সবাই মিলে হাটছি আর কথা বলছি। কথার মাঝেই সজীব ভাইয়া বলল,
— ” তোমরা থাকো আমি একটু আসছি হ্যাঁ? জাস্ট যাবো আর আসবো।”
বলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল। আমরা সবাই কিছুক্ষণের বোকার মতোই তাকিয়ে রইলাম। তারপর আবার যে যার মতো বিজি হয়ে গেলাম। আদিব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য কথা বলছে। ইফাজ ভাইয়া আর আপি একটু দূরে বসে গল্প করছে। জাবিন একটা গাছে হেলান দিয়ে কথা বলছে ফোনে। আদ্রিয়ান বলল,
— ” চলো আমরা ওদিক দিয়ে একটু হেটে আসি।”
আমিও মাথা নাড়লাম। আমি আর আদ্রিয়ান ইটের সরু রাস্তা দিয়ে হাটছি। দুপাশে বিভিন্ন ফুলের টব। আমি আদ্রিয়ানের এক হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছি। আশেপাশের অনেক কাপল নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে।আদ্রিয়ান বলল,
— ” তুমি এতো ছোট কেন বলবে? তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাওনা?”
আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,
— ” মানে?”
— ” মানে তুমি এখনও ছোট বলেই তো আমাকে এতোটা সামলে থাকতে হয়। আর হানিমুনটাও পিছিয়ে দিলাম। আর যাই হোক হানিমুনে গিয়ে তো আর ব্রহ্মচারী হয়ে বসে থাকতে পারবোনা। ওখানে তো..”
আমি চোখ মুখ কুচকে বললাম,
— ” আপনি আসলেই অসভ্য।”
এটুকু বলে সামনে তাকাতেই থমকে গেলাম। আমার সাথে আদ্রিয়ানও দাঁড়িয়ে গেলো। আমরা দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সামনে যা দেখলাম সেটা দেখে দুজনেই অবাক। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। এটা কী দেখছি আমি? এতো বড় ধোঁকা?
#চলবে…
( রি-চেইক হয়নি। হ্যাপি রিডিং গাইস। )