গল্প : একটি লাল গোলাপের হাসি
পর্ব-৪
লেখক – Riyad Ahmod Bhuiya
এবার তানহা ওর হাসি থামিয়ে বললো,
-আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?
আমি বললাম,
-হুম, করুন!
তানহা,
-আপনার জীবনে কি কখনো প্রেম-ভালোবাসা এসেছিলো?
আমি ওর প্রশ্ন শুনে হেসে উঠলাম। আমাকে হাসতে শুনে ও বলে উঠলো,
-থাক, বলতে হবেনা আর। ঘুমান আপনি!
টের পেলাম ও অভিমান করেছে। আসলে, মানুষ তার সাথেই অভিমান করে সে যাকে ভালোবাসে এবং পছন্দ করে। যার তার সাথে অভিমান করা উচিৎ নয়। আর যদি করেনও তাহলে সেখানে অভিমানের সৌন্দর্যটা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, যে অভিমান করে সে চায় তার অভিমান ভাঙ্গানো হোক। সে চায় তার প্রিয় মানুষটা তাকে একটু বেশিই কেয়ার করুক। সে চায় তার ভালোবাসার মানুষটি সারাক্ষণ তাকে নিয়েই মগ্ন থাকুক। তবে, সারাক্ষণ মগ্ন থাকা মানে এই নয় যে, দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে তাকে নিয়েই পড়ে থাকুক সে এটা চায়! বরং, এর মানে হলো, সে চায় তাকে দেয়া সময়টা যেন দুজনের স্পেশালভাবে অতিবাহিত হয়। হোক না সেটা দিবা কিবা রাত্রির অল্প কিছু সময়!
আমি এবার বললাম,
-যদি চলে যান তাহলে আর রাতে আমার ঘুম হবেনা।
ও অবাক হলো কথাটি শুনে। বললো,
-কেন কেন? আমি চলে গেলে আপনার ঘুম হবেনা কেন?
আমি,
-থাক, আপনি তাহলে চলেই যান! আমি না হয় ফেসবুকে ঢুকে সুন্দরী মেয়েদের সাথে হাই/হ্যালো করি। যান আপনি!
এবার ও বললো,
-আপনি যদি এখন আমার কাছে থাকতেন না, তাহলে আমার হাতের মোবাইল ফোনটা আপনার মাথায় ভাঙ্গতাম আমি বুঝেছেন..
অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলবো শুনে বেশ রেগে গেল ও। আমি চুপচাপই রইলাম। মেয়েরা এমনই হয়। স্ত্রীরাও। তারা সবকিছুর ভাগ দিবে তবে নিজের স্বামীর দিকে যদি পরনারী নজর দেয় সেটা তারা সহ্য করতে পারেনা। আর এটাই স্বাভাবিক।
আমি চুপ হয়ে আছি। এবার ও নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে বললো,
-একটা কথা সাফ সাফ শুনে রাখুন! আজ আর এই মুহুর্ত থেকে যদি আর অন্য কোন মেয়ের কথা স্বপ্নেও ভেবেছেন কখনো তাহলে আমি আপনার স্বপ্নে এসেই পেটাবো। কথাটা মনে থাকে যেন! হুহহ..
আমি কল্পনা করতে পারি। রাগলে যেকোন মেয়ের সৌন্দর্যই শতগুণ বেড়ে যায়। কপাল আর নাক ঘেমে যায়। ঘামের ফোটাগুলোকে তখন মুক্তোর দানার মতো দেখায়। চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারন করে। কিছু অবাধ্য চুলে এসে কপালের ঘামের সাথে লেপ্টে যায়। এবার আমি মুখ খুললাম। বললাম,
-আচ্ছা, আপনি কি বিয়ের পর আমার সাথে প্রতিদিন রাগ করতে পারবেন?
ও এমন আজগুবি প্রশ্ন শুনে বললো,
-আপনার কি মাথা খারাপ নাকি? এমন কথা কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে?
আমি,
-কেউ কাউকে করে কিনা সেটা জানিনা। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন!
তানহা,
-যদি প্রতিদিন নুডুলস্ খেতে চান তাহলে রাগ করবো। প্রতিদিন রেঁধে খাওয়াতে পারবোনা। সপ্তাহের যেকোন দুদিন নুডুলস্ খাওয়াবো আপনাকে। চলবে?
আমি বললাম,
-আমি কি এখানে নুডুলসের কথা কিছু বলেছি?
তানহা,
-আপনি না বলেন আমি তো বলেছি। আর তাছাড়া, সবকিছুই আগে থেকে মিটমাট করে রাখা ভালো।
আমি,
-আচ্ছা, সেটা না হয় বুঝলাম। এবার আমার সেই প্রশ্নের উত্তর দিন তো!
তানহা,
-আগে তো বিয়েটা হোক। তারপর না হয় বুঝাবো কত ধানে কত চাল!
আমি এবার বললাম,
-বুঝেছি, বলবেননা। আচ্ছা, এবার ঘুমান তাহলে। শুভরাত্রি।
তানহা,
-আচ্ছা, শুভরাত্রি।
ওর সাথে দীর্ঘদিন পর এত কথা বললাম ফোনে। বেশ ভালোই লাগলো। ও আসলেই খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। দায়িত্বশীল অনেক। এমনিতে সাদাসিধে জীবনযাপন করে। বাবার তুলনামূলক ভালো অবস্থা থাকার পরও এত এটা লাগবে সেটা লাগবে, এটা কিনবো সেটা কিনবো এসব করেনা। এত চাকচিক্য নাকি ওর পছন্দ নয়। পছন্দ নয় মানুষকে ছোট-বড় করে দেখার। হিংসা করেনা একদম। আর অনেক মিশুক। যে কারোর সাথেই খুব কম সময়েই মিশে যেতে পারে। আর মুখের হাসিটার কথা আর কি বলবো। থাক, এটা আপনাদের না জানলেও চলবে। তবে হ্যাঁ, এবার যদি প্রশ্ন করেন, দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ নেই অথচ এত ইনফরমেশন ওর সম্বন্ধে পেলাম কোথায়? এক্ষেত্রে বলবো, জানতে হয় এসব। যাকে ভালো লাগবে। যাকে মন ভালোবাসবে তার সম্বন্ধে ইনফরমেশন জানতে তো হবেই। সেটা যেকোনভাবেই হোক।
অনেকদিন পর আজ বাড়ি যাচ্ছি। মাঝখানে মায়ের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম, আমি বাড়িতে দশ তারিখে গেলে বারো তারিখে তানহাকে দেখতে যাব। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। বিয়ে বিয়ে একটা ব্যাপার কাজ করছে মনে। ফুরফুরে না লাগলে কি আর হয়। তায়েফের চাকরী হয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ও এখনো ছুটিতে আসেনি। বিয়ের দিন তারিখ পাকাপাকি হলে তারপর আসবে। ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাইকে বিষয়টা জানিয়ে রেখেছি। সবাই মোটামুটি কাজেই আছে। ওরাও ঠিক করে রেখেছে, বন্ধুর বিয়েতে এসে বেশ মজা করবে।
আজ বারো তারিখ। সকালে ফোন দিলাম তানহাকে। রিসিভ করলো ও।
ওপাশ থেকে,
-কি ব্যপার, কখন আসবেন?
আমি,
-সম্ভবত দুপুরের পর। কি করছেন?
তানহা,
-বসে আছি।
আমি,
-মন খারাপ কি?
ও চুপ করে আছে। বললাম,
-বলুন আমাকে! কোন সমস্যা হয়েছে কি?
তানহা,
-আজকে এমন একটা দিন অথচ তায়েফ বাসায় নেই। ওর কথা খুব মনে পড়ছে।
আমি এবার ওকে অন্যমনস্ক করার জন্য বললাম,
-কি পরবেন আজ?
তানহা,
-আপনিই বলুন কি পরব।
আমি,
-থ্রিপিস পরবেন। আর হ্যাঁ, এত সাজুগুজু করার প্রয়োজন নেই। এমনি যেমন বাসায় সবসময় থাকেন সেভাবেই থাকবেন।
তানহা,
-তাই নাকি!
আমি,
-হুম তাই।
তানহা,
-আচ্ছা ঠিক আছে। তাই হবে।
বেলা দুইটার দিকে ওদের বাসায় গেলাম আমরা। অনেক আদর যত্ন করলো। আমার সাথে আমার মা আর ছোটমামাও গেলেন। তানহাকে আনা হলো সামনে। বেশ মুটিয়ে গেছে ও। ফোনে যেভাবে বলেছিলাম সেভাবেই এসেছে। এতেই দেখে মনটা ভরে গেল। তারপর আসলো আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া বিয়েতে পাত্রপক্ষের দাবিদাওয়ার বিষয়টি অর্থাৎ, যৌতুক প্রসঙ্গ।
তানহার বড় মামা আমার ছোটমামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-আচ্ছা, তাহলে সেই বিষয়টিও আমরা সেড়ে ফেলি কি বলেন!
মামা আমার দিকে একবার তাকালেন এবং বললেন,
-এটি নিয়ে আমার ভাগিনার মুখ থেকেই না হয় আমরা শুনি। কারণ, বিয়েটা তো করবে সে। তার কি কি লাগবে বা না লাগবে সেটা সেই তার নিজের মুখে বলুক।
মামার কথায় মাও সায় দিলেন। তারা খুব ভালোভাবেই চেনেন আমায়। এবার আমি বলতে লাগলাম,
-আসলে দেখুন, আমি জানিনা আমি কতটা আমার ধর্ম মেনে চলতে পারি। আমি গোনাহগার। নিজের পাপ-পূণ্যের দিক দেখতে গেলে সেখানে শুধু পাপ আর পাপই দেখি। আল্লাহর নাফরমান একজন বান্দা আমি। তবুও যেহেতু এটি বিয়ের বিষয় সেক্ষেত্রে আমি আমার ধর্মের নির্দেশনাই অনুসরণ করতে চাই। আমি এখানে কোন কেনাবেচা করতে চাইনা। শুনুন কি বলি,
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী লিখেন,
“যৌতুক
ইসলামি বিধানমতে কনের পক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকাপয়সা নেওয়া বা দেওয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। বাংলা অভিধানমতে, যৌতুক হলো ‘বিবাহের পর বর বা কনেকে যে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত উপহার।’ (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান)। এই অর্থে যৌতুক ও মহরের মধ্যে বিভ্রাট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ইসলামে মহর হলো ফরজ ইবাদাত আর যৌতুক হলো বিলকুল হারাম ও সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তাই যৌতুক ও মহর এই উভয়ের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা জরুরি।
‘ছেলেপক্ষ যে অর্থ দেয় তা হলো মহর, মেয়েপক্ষ যা দেয় তা হলো যৌতুক।’ মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও হারাম যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয় ও জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ। আমাদের দেশের আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে অবৈধ শর্ত পালনীয় নয়, বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়।
উপহার
নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ দানকে উপহার বলা হয়। এই উপহার যে কেউ যে কাউকে যেকোনো সময়ে যেকোনো অবস্থায় যেকোনো অবস্থানে যেকোনো অবস্থান থেকে দিতে পারেন। সুতরাং, বিয়ের সময় বা তার পরে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যেকোনো কিছু উপহার দিতে পারেন।
স্বামীর দেওয়া উপহার সাধারণত মহরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে না। কখনো যদি মূল্যবান গয়না ও অলংকার মহরের মধ্যে শামিল করা হয়, তখন বলা হয়ে থাকে ‘জেওর ও মহর’ এত টাকা এবং জেওর বা অলংকার বাবদ ওয়াসিল বা পরিশোধ এত টাকা। কনের পরিবারের পক্ষ থেকে শর্ত ও দাবি ছাড়া বরকে কোনো উপহার দিতে বাধা নেই। তবে প্রথা বা অঘোষিত শর্তরূপে দিতে বাধ্য হলে তা পরিহারযোগ্য। বিবাহ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বর ও কনেকে উপহার দিতে পারেন। তবে এটি যেন প্রথারূপে না হয়। উল্লেখ্য যে মহর প্রদেয়, উপহার অফেরতযোগ্য।
বিয়ের সময় প্রদত্ত উপহারসামগ্রী বা অর্থের মালিক বর বা কনে। যে উপহার যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনিই সেই উপহারের মালিক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ মালিকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব উপহার কাউকে দিতে পারবেন না এবং যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারবেন না। স্ত্রী বা কনে প্রাপ্ত উপহার নিজে ব্যবহার করা ছাড়াও যাকে খুশি কারও অনুমতি ছাড়া দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা বরপক্ষের কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না; যদিও সেই উপহারসামগ্রী স্বয়ং স্বামী বা বরপক্ষই দিয়ে থাকে।” (তথ্যসূত্র- প্রথম আলো অনলাইন পোর্টাল, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮)
কথাগুলো শোনার পর উপস্থিত তানহার মামা এবং ওর মা যারপরনাই আনন্দিত হলেন। এবং বিয়ের দিন ধার্য করা হলো পরবর্তী শুক্রবারে।
রাত দশটায় বিছানায় শুয়ে তানহাকে কল দিলাম। ও রিসিভ করে বললো,
-অনলাইনে আসুন! জরুরী কথা আছে।
বিষয়টি ঠিক মনে হলোনা আমার কাছে। আমি ফোনটা কেটে দিলাম এবং ডাটা অন করে ওর মেসেজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
——-চলবে——-