ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ৩৮
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
সময় খুব দ্রুত প্রবাহমান। বিশেষ করে ব্যস্ত সময়গুলো জেনো ঝড়ের বেগে পার হয়। কীভাবে যে সপ্তাহ মাস দিন পার হয়ে যায় সেটা বোঝাই যায়না। দিন, সপ্তাহ, মাস কীভাবে পার হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায়না। ঠিক সেরকম সময়ই কাটছে এখন। আরও সপ্তাহখানেক কেটে গেছে এর মধ্যেই। বাড়ি টু মেডিকেল মেডিকেল টু বাড়ি বাকি সময়টা খাওয়া, পড়া, ঘুম এসবের মধ্য দিয়েই কাটছে। তবে এসবের মধ্যে একটা জিনিসের পরিবর্তন ঘটেছে। আদ্রিয়ানের প্রতি আমার অনুভূতি গভীরতা। কেন জানিনা এক অদ্ভুতরকম ফিল হয় আমার। ওর ছোট ছোট কেয়ারিং, ভালোবাসা, শাসনগুলো এখন আর আগের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করেছি। আমি জানিনা এটা কেমন অনুভূতি। এটুকুও জানিনা যে এই অনুভূতি ঠিক কীরকম বা কেন হচ্ছে? শুধু এতটুকুই জানি যে এই অনুভূতি আগের মত না। একটু বেশিই ভিন্ন। নবীন বরণের পর থেকে একদিনও আমাকে একা ছাড়েনি ও। সবসময় চোখে চোখে লাগে, একটা বাচ্চার মতো আগলে রাখে আমাকে। যদিও মাঝেমাঝে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই করে তবুও আমার খুব ভালোলাগে। মেডিকেল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে নিচে নামতেই মামনী বলল,
— ” এসে গেছিস? তাড়াতাড়ি বোস। সেই সকালে বেড়িয়েছিস নিশ্চয়ই কিছু খাসনি? ক্যানটিনে তো কিছু খেয়ে নিতে পারিস মা?”
আমি চেয়ার টেনে বসে বললাম,
— ” বাড়ির সবাই খেয়ে নিয়েছে?”
মামনী আমার প্লেটে খাবার প্লেটে দিতে দিতে বলল,
— ” হিয়া আর আমি আর তোর বড় আম্মু বসে আছি তোর জন্যে।”
— ” তোমরা খেয়ে নিলেই তো পারো। আমি এসে নিজেই নিতে পারি।”
— ” হ্যাঁ! হ্যাঁ! জানি আমরা সেটা আপনি খুব পারেন। এবার চুপচাপ শুরু করুন। এতোটা সময় খালি পেটে থাকার কোনো মানে হয়?
— “প্লিজ মামনী এই কথাটা তোমার ছেলের সামনে বলোনা। একসপ্তাহ কানে শুনতে পাবোনা আমি!”
তখন আপি আর বড় আম্মু একসাথে এলো। আপি চেয়ার টেনে বসে বলল,
— ” বলাই উচিত। একমাত্র ওই পারে তোকে শিক্ষা দিতে। এতো অনিয়ম মানুষ করে?”
বড় আম্মুও ওদের কথায় তাল দিয়ে বলল,
— ” তবুও তো এখন আদ্রিয়ানের শ্বাসনে একটু সোজা হয়েছে।”
আমি ওদের সবার দিকে গোমড়া মুখ করে একপলক তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। ওরা সবাই আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো। এরপর সবাই হাসি, মজা আর আড্ডা দিতে দিতে লাঞ্চ নিয়ে সেরে নিলাম।
__________________
বিকেল বেলা ইফাজ ভাইয়া, আদ্রিয়ান কেউই বাড়িতে নেই তাই ঘুমোনোর জন্যে আপির রুমেই চলে গেলাম। আপি আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আর আমি আপির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আদ্রিয়ানকে নিয়েই ভাবছি। উনি এ নিয়ে দুবার আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি ওনাকে আমি ভালোবাসি কী না। কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। কীকরে দেবো? আমি নিজেও যথেষ্ট দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু এই সপ্তাহ আমি বারবার ভেবেছি গভীরভাবে ভেবেছি। কিন্তু ওনার প্রতি আমার অনুভূতিটাকে ভালোবাসা বলা যায় কী না? সেটা বুঝতে পারছি না। এসব চিন্তা করতে করতেই আপি বলল,
— ” তোদের ব্যপারটা কতদূর কী হলো বলতো? মানে কিছুকি এগোলো?”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,
— ” কী এগোনোর কথা বলছ! তুমি?”
— ” বাঃ রে। এতো কিছু হলো। আদ্রিয়ান ভাইয়া থেকে আদ্রিয়ান হলো। আপনি থেকে তুমি হলো? সব সেটেল?”
আমি আবারও আপির কোলে গুটিয়ে শুয়ে বললাম,
— ” নোওও। ও বলে দিয়েছে যে ও আমায় ভালোবাসে কিন্তু আমিই এখনও কিছু বলিনি। ইন ফ্যাক্ট আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা।”
আপি একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
— ” আদ্রিয়ান ঠিকই বলে তুই আসলেই একটা গাধা।”
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— ” এখানে গাধার কী দেখলে?”
আপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— ” আচ্ছা একটা কথা বলতো আদ্রিয়ান যখন তোর আশেপাশে থাকে তোর কাছে থাকে। তখন তোর মনে হয়না যে তোর আর কিচ্ছু চাই না। আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রাখলে তোর মনে হয়না যে তুই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাতে আছিস? যতক্ষণ আদ্রিয়ান তোর থেকে দূরে থাকে ততক্ষণ ওকে ভীষণভাবে মিস করিসনা তুই?”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আপির দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। আপি মুচকি হেসে বলল,
— ” এগুলোই ভালোবাসার একেকেটা প্রকাশ।তুইও ওকে ভালোবাসিস আর ভীষণভাবে ওকে চাসও। সেটা এট্রাকশন বা ভালোলাগা নয় ভালোবাসা। বুঝলি?”
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আপিও আর কিছু না বলে আবার আমার মাথায় বিলি কাটতে শুরু করল। আর আমি আবার ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলাম। আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরলাম আপির কোলে।
__________________
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আদ্রিয়ান একটু আগে ফিরে এসছে। এখন ওয়াসরুমে গেছে ফ্রেশ হতে। আমি বেড ঠিক করছি আর বিকেলে আপির বলা কথাগুলো এখনও ভাবছি। আদ্রিয়ান দরজা খুলে বেড়িয়ে আসতেই আমি পেছন ঘুরে একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাত চালাতে শুরু করলাম। একটু পরেই ও আমায় পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আমার ঘাড়ে একটা চুমু দিলো আমার শরীর হালকা করে কেঁপে উঠল। তারপর ও আমার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
— ” কী নিয়ে এত ভাবছেন ম্যাডাম?”
— ” ক্ কই কী নিয়ে ভাবছি? তেমন কিছুই না জাস্ট এমনি।”
— ” এমনি? কিন্তু আমার তো মনে হলো আমার বউটা খুব গভীরভাবে কিছু একটা নিয়ে ভেবে চলেছে। আমি বলেছিলাম না যে মিথ্যেটা তোমার দ্বারা হয়না। ”
আমি কথা ঘোরাতে বললাম,
— ” হ্যাঁ অনেক হয়েছে ছাড়ো এবার। ঘুমাবে না রাত হয়েছে অনেক।”
ও আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমরের দুপাশে হাত রেখে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,
—- ” তোমার কী পালাই পালাই রোগ আছে না কী? আমি কাছে এলেই সবসময় এভাবে পালাও কেন ? অস্বস্তি হয়? খারাপ লাগে? এসবে কী হার্ট হও তুমি?”
ওর কথায় আমি চমকে গেলাম। সাথেসাথেই বলে উঠলাম,
— ” নানা। তেমন কিছুই না।”
ও আমার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,
— ” সত্যি?”
আমি চোখ বন্ধ করে রেখে বললাম,
— ” হুম।”
ও আর কিছু বলল। ওভাবেই কপালে কপাল লাগিয়ে রাখল। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম ওর দিকে। ও মুচকি হেসে আমার নাকে নাক ঘষে দিল। আমিও হেসে দিলাম। আর লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলাম। ও আমার গালে পরে থাকা কাটা ছোট চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে ডান গালে খুব সফটলি একটা কিস করল। আমি সাথে সাথে ওর টিশার্ট খামছে ধরলাম। একটুপর ও আমার বামগালেও কিস করল। আমি জমে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর চোখ বন্ধ করে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। ও আমাকে ঝট করেই কোলে তুলে নিল আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। ও আমায় কোলে করে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। তারপর নিজেও আমার পাশে শুয়ে আমার ওপর আধশোয়া হলো। আমি অবাক আর লজ্জা দুটোরই মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওর আঙ্গুল দিয়ে আমার চুল নাড়াচাড়া করতে করতে চুলে নিজের নাক ডুবিয়ে দিয়ে ঘ্রাণ নিতে শুরু করল। আমি শক্ত হয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে শুয়ে আছি। ও আস্তে আস্তে ঘ্রাণ নিতে নিতে আমার গালের কাছে এসে থামল এরপর ওর নাক নিয়ে গালে আলতো করে স্লাইড করতে শুরু করলো। আর তার সাথে সাথে আমার নিশ্বাসও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। ওর স্পর্শগুলো যতো গভীর হচ্ছে ততোই আমি হারিয়ে যাচ্ছি কোথাও। এক অন্যরকম অনুভূতি ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে আমাকে। আমার এরকম মনে হচ্ছে যেন ওও নিজের মধ্যে নেই, কোনো এক অদ্ভুত নেশা জেনো ওকেও ঘিরে রেখেছে। কিন্তু আজ আমি ঠিক করে নিয়েছি আমিও ওকে বাধা দেবোনা। ও। বারবার ওকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার নেই আমার, একেবারেই নেই। আমিতো ওরই। হয়তো নিজের অনুভূতি নিয়ে দিধা-দন্দ্বে ছিলাম। তাতে যাই হোক। বেশ কিছুক্ষণ পর ও নিজেই থেমে গেল। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে আমার ওপর থেকে সরে গিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে আমায় টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— ” আমায় ভালোবাসো কী না? কথাটা জিজ্ঞেস করাও বোকামি তাইনা? কারণ তুমি ভালো বাসো বা না বাসো তোমার জন্যে কোনো সেকেন্ড অপশন তো কেউ খোলা রাখেনি। তাইনা? আর এখনতো আমি মরার আগে তোমাকে ছাড়তেও পারবোনা। আর না তোমাকে যেতে দেবো। হয়তো সেটা অন্যায় করা হবে তোমার ওপর, হয়তো একটু বেশিই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি খুব সরি জানপাখি। আমার কিছু করার নেই। পারবোনা আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে। ভালো না বাসলেও তোমাকে আমার হয়েই থাকতে হবে। তোমার ভালোবাসা নাই বা পেলাম, সারাজীবন তোমাকে ভালোবেসেই কাটিয়ে দিতে পারব।”
বলে আমার মাথায় খুব গভীরভাবে একটা চুমু দিল আর খুব শক্ত করে নিজের বুকের সাথে জরিয়ে ধরে রাখল। পারলে যেনো নিজের বুকেই ঢুকিয়ে ফেলতো আমাকে। আমি স্হির হয়ে শুয়ে আছি ওর বুকে। কাউকে কেউ এতোটা কীকরে ভালোবাসে সেটাই বুঝতে পারিনা। এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার আদোও কী আছে? হ্যাঁ আপির বলা কথাগুলো ভেবেছি। বারবার ভেবেছি। প্রথম যখন ওকে দেখেছিলাম ভালোলেগেছিল। ওর লুক এটিটিউট এসব দেখে অল্প হলেও মুগ্ধ হয়েছিলাম। বারবার ওর বিভিন্ন কাজও ভালোলেগেছে। মানে ভালোলাগা ছিল সেটা। আর বিয়ের পর ওর কাছ থেকে এটেনশন, প্যামপার এসব পেতে মন টাইতো। ঠিক যেভাবে নায়করা নাইকাদের করে ঠিক সেরকম ওর কেয়ার পেতে ইচ্ছে হতো। সেটা এট্যাকশন ছিল! কিন্তু এখন এসব পেয়েও আমি সুখি নই কারণ ও কষ্টে আছে। কোথাও না কোথাও ও ভালো নেই। করণটাও আমি। এখন প্রতি মুহূর্তে ওকে মিস করা, ওর সামান্য আবেগ মেশানো কথায় কেঁদে দেওয়াটা, ওর প্রতিটা কথা ফিল করা, ওকে সবসময় খুশি দেখতে চাওয়া কী ভালোবাসা নয়? হ্যাঁ ভালোবাসাই তো। ভালোবাসি আমি ওকে। সত্যিই ভালোবাসি। ও চাইলে আগেই পারতো নিজের অধিকার আদায় করে নিতে। আমি হয়তো বাধা দিতাম না। হ্যাঁ সেদিন কেঁদে দিয়েছিলাম কারণ ও খুব রেগে ছিল তাই ভয় পেয়ে গেছিলাম খুব। কিন্তু যেদিন ও বলেছে ও আমাকে ভালোবাসে তারপর থেকে আমি এমনিতেও ওকে আটকাতাম না। কিন্তু ও করেনি সেটা কারণ ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। ও অন্যসবার মতো নয়। ও চায়না আমি মেনট্যালি হার্ট হই। ও চয়না আমাকে মনের ওপর জোর খাটাতে। তাইতো এখনও আমার মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শুনবে বলে অপেক্ষা করছে। না আমি বলব। আজকেই এখনই বলব। ভালোবেসে ফেলেছি আমি ওকে। সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি।
— ” শুনছো?”
— ” হুম।”
আমি ইতস্তত করে বললাম,
— ” একটা কথা বলার ছিল।”
— ” হ্যাঁ বলো? এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে বললাম,
— ” আমি…
হঠাৎ করেই ওর ফোনটা বেজে উঠল। ও ফোনটা রিসিভ করে কী শুনলো জানিনা। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল,
— ” অনি নূর ওয়াসরুমে পরে গেছে। অবস্থা ভালো না। আমাদের যেতে হবে। তুমি ওড়না নিয়ে এসো আমি গাড়ি বার করছি।”
বলে একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। আমি স্হির হয়ে বসে আছি। সবতো ঠিক ছিল। কদিন পর ডেলিভারি ছিল। শেষ মুহূর্তে এসে এটা হতে হলো? এমনিতেই মেয়েটার সাথে এর আগে এতো বড় অন্যায় হয়ে গেছে। ইশরাক ভাইয়া চলে গেলেন। এখন এই বাচ্চা আর আপু কে নিয়েও টানা হ্যাচড়া হবে ? আবার নতুন করে কেন? ভালোদের সাথে সবসময় খারাপই কেন হয়? কেন?
#চলবে…