ভালোবাসি তাই part:11

0
3150

ভালোবাসি তাই
part:11
Writer:Afifa Jannat Maysha

?

“রহস্য ” শব্দটাই কেমন যেনো রহস্যময় লাগে আমার কাছে। সিনেমায় কোনোকিছুর রহস্য উদঘাটন করাটা যতটা সহজভাবে দেখানো হয় বাস্তবজীবনে তা ততটাও সহজ নয়। এমুহূর্তে আমিও “রহস্য উদঘাটন ” নামক সমস্যায় ভুগছি। আমার হাতেই রয়েছে একটা পার্সেল। পার্সেলের গায়ে প্রেরকের কোনো নাম বা ঠিকানা কিছুই নেই। আমাকে এটা কে পাঠালো সেটাই একটা রহস্য। পার্সেলটা কি খুলবো নাকি খুলবো না এই নিয়ে দ্বিধাদন্দে জর্জরিত আমি।

সন্ধ্যায় একা একা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম । টিভি দেখছিলাম বললে ভুল হবে। টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। মাথায় তো ভর করেছিলো অন্য চিন্তা। কাল সকালেই আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র -জুনিয়র সবাই যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন হলো সায়ন ভাইয়া। এখন সবসময় উনার থেকে দুরে দুরে থাকি আমি। খালামনির বাসায় যাওয়াও কমিয়ে দেয়েছি এখন । আগে তো কারণ ছাড়াই খালামনির বাসায় চলে যেতাম কিন্তু এখন হাজার কারণ থাকলেও নিজে না গিয়ে ভাইয়াকে পাঠাই। ভারসিটিতেও উনার সামনে যাই না । মোটকথা উনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখিনি আমি। সবসময় পালিয়ে বেড়াই সায়ন ভাইয়ার থেকে। যেনো উনি কোনো ডাক্তার আর আমি ইঞ্জেকশন দিতে ভয় পাওয়া রোগী।

উনার থেকে এতো দূরে দূরে থাকার পরও আগামী দুইটা দিনের জন্য আবার কাছাকাছি থাকতে হবে আমাদের।
ভেবেছিলাম আমি যাবোই না কক্সবাজার। কিন্তু বাসার সবাই জেনে গেছে ভারসিটি থেকে ট্যুরের আয়োজন করা হয়েছে। এখন যদি আমি না যাই তাহলে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমায়। তাই না চাইতেও যেতে হচ্ছে আমার।

সায়ন ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে তা শুধু আমিই জানি। সেখানে আবার উনার আশেপাশে থাকলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো তো?নাকি উনার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে যাবো ?

এসব চিন্তাই মাথায় ঘুরছিলো আমার। তখনই কানে এলো কলিংবেলের শব্দ। বাড়ির সবাই যে যার ঘরে আছে। তাই একঝাক বিরক্তি নিয়ে আমিই গেলাম দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম শ্যামবর্ণের একজন ছেলেকে। হাতে কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ড্রেস আপ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা একজন ডেলিভারি বয়। আমি তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই সে বলে উঠলো

– ম্যাম, আফিফা জান্নাত মাইশা কে? উনার নামে একটা পার্সেল আছে।

– জ্বী, আমিই আফিফা জান্নাত মাইশা।

– ওহ তাহলে তো এটা আপনার জন্যই। এই নিন।

আমার হাতে পার্সেলটা ধরিয়ে দিয়েই চলে গেলো ছেলেটি। এতক্ষন ছেলেটাকে ডেলিভারি বয় মনে হলেও এখন আমার কিছুতেই তাকে ডেলিভারি বয় মনে হচ্ছে না। আমি যতদূর জানি, পার্সেল নেওয়ার পরে একটা কাগজে সিগনেচার করতে হয়। কিন্তু আমার সাথে তো এমন কিছুই হয় নি।

সব চিন্তা-ভাবনাকে সাইডে রেখে পার্সেলটার দিকে তাকালাম প্রেরকের নাম দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হতাশ হতে হলো আমায়। না আছে কারো নাম আর না আছে কোনো ঠিকানা। সেই থেকেই পার্সেল হাতে নিয়ে বসে আছি আমি।

পার্সেলের ভেতরে কি আছে সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে খুব। মন বলছে” মাইশা, খুলে ফেল।ভেতরে কি আছে দেখবি না? ” কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে “একদম খুলবি না। যদি ভেতরে ক্ষতিকারক কিছু থাকে? ” মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মনকেই বিজয়ী ঘোষণা করে পার্সেলটা খুলতে লাগলাম আমি।

পার্সেল খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে আছে হালকা ডিজাইনের একটা কালো রঙের থ্রিপিস। আশ্চর্য! আমায় থ্রিপিস পাঠালো কে? আমি কি কারো কাছে চেয়েছিলাম নাকি? কই, আমার তো তেমন কিছু মনে পরছে না। আমি শিউর কেউ ভুল করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। অন্যের জিনিস ব্যাবহার করা তো ঠিক না। কিন্তু এখন এটা কি করবো আমি? ভাবলাম এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপতত জামাটা আমার আলমারিতেই পরে থাক।

সোফা থেকে উঠে পা বারালাম আমার ঘরের দিকে৷ আলমারিতে রাখতে যাওয়ার সময় জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা কাগজ। আমি কাগজটা উঠিয়ে নিয়ে খুলে দেখলাম। কাগজে লিখা

” আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা উপহার। আশা করি এটা পরেই কক্সবাজারে যাবে। তাহলে খুব খুশি হবো আমি।”

কাগজের লিখাগুলো পড়ে অন্য কিছু না বুঝলেও জামাটা যে আমার জন্যই পাঠানো হয়েছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম আমি। কিন্তু কে পাঠাতে পারে এই প্রশ্নটাই ঘুরাঘুরি করছে মাথায়। আর বেশিকিছু না ভেবে পার্সেলটা তুলে রাখলাম আলমারিতে। কিন্তু কালকে এই জামাটা কিছুতেই পরবো না আমি। কে না কে পাঠিয়েছে। তার খুশির জন্য নাকি এই জামাটা পরতে হবে আমায়। কি আজব!

?

রাতের খাওয়া – দাওয়া শেষ করে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনই পিছন থেকে ডেকে উঠলো আপু। তার দিকে তাকাতেই মিষ্টি করে হেঁসে বললো

– তোর প্যাকিং করা শেষ, মাইশা?

– কিসের প্যাকিং?

– আরে কাল যে কক্সবাজার যাচ্ছিস তার জন্য প্যাকিং করবি না?

– ওহ, তুমি এই প্যাকিং এর কথা বলছো?

– হ্যাঁ।

– না, এখনো করিনি।

– কি? কালকে সকালবেলা বেরিয়ে যেতে হবে আর তুই কিনা এখনো প্যাকিং করিস নি?

– আরে তুমি এতো টেনশন করছো কেনো? এখন শুরু করবো।

– আচ্ছা ঠিক আছে চল আমিও হেল্প করছি।

– না, থাক লাগবে না।

– আমি তোর মতামত জানতে চেয়েছি? আমি যখন বলেছি হেল্প করবো তখন তো করবোই। তোর বারণ শুনতে হবে নাকি আমায়?

– আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। চলো।

বিছানায় পা তুলে গুটিশুটি মেরে বসে আছি আমি। আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ব্যাগ গোছাচ্ছে আপু। আমার কি লাগবে না লাগবে সব খেয়াল করে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে সে। আপুর কাজকর্মে মনে হচ্ছে সারাজীবনের জন্য কোথাও চলে যাচ্ছি আমি। তাই কোনোকিছুই দিয়ে দিতে ভুল করছে না সে।

-দেখ তো আরো কিছু লাগবে নাকি?

– এতোকিছু দিচ্ছো কেনো? মাত্র তো দুইদিনের জন্য যাচ্ছি। প্র‍য়োজনিয় জিনিসগুলো নিলেই চলবে।

– এখানে যা আছে সবকিছুই তোর প্রয়োজনীয়। সো, নো মোর ওয়ার্ড। ওকে?

– ওকে।

– গুড গার্ল।

আমাদের কথার মাঝেই আপুর ফোনের রিংটোন বেজে বেজে জানান দিচ্ছে যে কেউ আপুকে কল করেছে। আপু ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রেখে আবারো ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে সায়ন ভাইয়ার কন্ঠ।

– হ্যালো, মালিশা।

– জ্বী বলুন।

– কি করছিস সরি কি করছো?

– তেমন কিছু না।

– ওহ

– আপনি কি কিছু বলবেন?

– না মানে তেমন কিছু না। এই আরকি…

সায়ন ভাইয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে উনি কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু সেটা বলতে সংকোচ বোধ করছেন। উনি কি বুঝতে পেরে গেছেন যে আপু এখন আমার সাথে আছে? কিন্তু এটা তো উনার জানার কথা নয়। উনি হয়তো আপুর সাথে কোনো পারসোনাল কথা বলবেন। আমার এখানে থাকাটা উচিৎ হবে না। তাই ভাবছি অন্যরুমে চলে যাবো। দরজার দিকে হাটতে লাগলেই সায়ন ভাইয়ার কথা শুনে থমকে দাঁড়ালাম আমি।

– আসলে কালকে তো আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। আর খুব সকালেই বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। এতো সকালে মাইশার একা একা বাসা থেকে ভারসিটি আসা ঠিক হবে না। তুমি বরং মোয়াজকে বলে দিও, ও যেনো মাইশাকে ভারসিটি পর্যন্ত ড্রপ করে দেয়।

– আচ্ছা ঠিক আছে আমি ভাইয়াকে বলে দেবো। কিন্তু এর জন্য আপনি আমায় ফোন না করে মাইশার কাছেই ফোন করতে পারতেন।

আপুর কথায় চুপ হয়ে গেলেন সায়ন ভাইয়া। পরমুহূর্তেই বলে উঠলেন

– আচ্ছা আমি এখন রাখছি। একটু ব্যাস্ত আছি।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

সায়ন ভাইয়ার বলা কথাগুলো কানে বাজছে আমার। আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেছেন উনি? এটা কি সত্যি? আমার বিষয়ে ভেবেছেন সায়ন ভাইয়া? চোখদুটো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে । আচ্ছা আমি কি কাঁদছি? কিন্তু কেনো কাঁদছি? সায়ন ভাইয়া আমার খেয়াল রাখার কথা বলেছেন সেই খুশিতে? কিন্তু এখানে খুশি হওয়ার কি আছে? আমি উনার খালাতো বোন হই সেই হিসেবেই হয়তো বলেছেন কথাটা। এটা ভেবেই চোখ মুছে ফেললাম আমি। সায়ন ভাইয়ার জন্য আর এক ফোটাও চোখের পানি ফেলবো না । কাঁদলেই কি উনাকে পেয়ে যাবো? না তো। সেটা যখন হবেই না তাহলে শুধু শুধু কাঁদার কোনো মানেই হয় না।

সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো আপু। আমিও ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে পরলাম। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। তাই রাত জাগা চলবে না। কিন্তু ঘুমগুলো চোখে ধরা দিলে তো। তারা বোধ হয় আমার চোখে ধরা দেবে না বলে পণ করেছে। এই রাতটাও যে সায়ন ভাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে কেটে যাবে সেটা খুব ভালোই বুঝতে পারছি । উনার কথা না ভাবতে চাইলেও ভেবে ফেলি আমি। মাঝে মাঝে নিজের উপরই প্রচুর বিরক্ত লাগে আমার। তখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি সায়ন ভাইয়াকে বাদ দিয়ে কি আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবা যায় না? এর উত্তর স্বরূপ আমার মন শুধু একটা কথাই বলে “তোমার সবটা জোরেই যে আছে তাকে বাদ দিয়ে কিভাবে কিছু চিন্তা করবে তুমি? ”

চলবে….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here