প্রেমনগর
পর্বঃ১৭ +১৮
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
নীলার বাবা চিৎকার করে বললেন,পালাচ্ছে আর আপনারা হা করে দেখছেন? ধরুন ওদের!
পুলিশঃ রাস্তায় জ্যাম পরেছিলো আর জ্যাম ছাড়তেই বাইক নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
নীলা বাবাঃ তো এখনো হা করে চেয়ে আছেন কেন। যান খোঁজ লাগান। আর ওই মেঘকে আজই হাজতে দেখতে চাই।
নীলার বাবা আবারও আফতাব চৌধুরীকে ফোন দিলেন। কথা বলতে বলতে আফতাব চৌধুরী এক
পর্যায়ে খুবই ক্ষেপে গেলেন।
আফতাব চৌধুরীঃ আমার হিরের টুকরো ছেলের নামে কোনো বাজে কথা বলবেন না৷ আজই আমি আপনার নামে মান হানির মামলা করবো।
নীলার বাবাঃ আপনার হিরের টুকরো ছেলে নাকি সোনার টুকরো ছেলে সেসব আমার দেখার সময় নেই। আপনার ছেলে আমার মেয়ের পিছনে লেগেছে। ও জানেও না ও কিসে পা দিয়েছে…..ওকে আমি…..
রাগে আফতাব চৌধুরী ফোনটা কেটে দিলেন।
নীলার বাবাঃ ফোন কেটে দিলো! এতো সাহস ওই আফতাব চৌধুরীর। আমার ফোন কেটে দিলো।
.
কথা শেষ করতে না পারার জন্য নীলার বাবা আরও রেগে গেলেন। রুমে নীলার মা এসে উপস্থিত হয়।
নীলার মাঃ কি গো এখন রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো।
নীলার বাবাঃ ওই আফতাব চৌধুরী আমার ফোন কেটে দিয়েছে। এবার আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলবো।
নীলার মাঃ প্রেমনগর?
নীলার বাবাঃ ওসি সাহেব বলেছেন, ওরা এখন গুষ্ঠি শুদ্ধ একটা হাসপাতালে রয়েছে। আমি ওখানেই যাব।
নীলার মাঃ আমিও যাব। আমার মেয়েকে ওদের ছেলে লুকিয়ে রেখেছে। ওর মায়ের সাথে আমি কথা বলবো। এমন লম্পট ছেলে বানালো কি করে! আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি হলে ওর ছেলেকে আমিও ছাড়বো না! উনিও একজন মা৷ উনি ছেলেদের এসব মেনে নিচ্ছেন কেন!
.
এদিকে হাসপাতালে চলছে বিরাট গন্ডগোল। সব শুনে ম্যানেজারের বউ হাসপাতালে ছুটে এসেছেন। চেচাতে চেচাতে ম্যানেজারকে সে জুতার বারি মারলো। নার্সটাও এখন তার অধিকার দাবি করছে। কাল রাতে তার সর্বনাশের জন্য ম্যানেজার অপরাধী। ম্যানেজার এবার মুখ খুললেন, পুলিশের কাছে তুলে ধরলেন তার বউয়ের পরকীয়ার কথা। সে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় বউ অন্য পুরুষের সঙ্গ লাভ করতো। রাতের পর রাত থাকতো। সব প্রমাণ পাওয়ার পরও বউকে সে তালাক দেয়নি। তবে এখন দেবে। বউ ছিলো অর্থ লোভী। অর্থের লোভে সে বিয়ে করেছিলো।
.
ম্যানেজারের মুখে এই কথাগুলো শুনে নার্সের মনে এবার প্রেমের ফুল ফুটতে শুরু করে। নার্সের মনের আশা বুঝি এবার পূরণ হতে যাচ্ছে।
ম্যানেজার নার্সের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
ম্যানেজারঃ আমি ওকে বিবাহ করতে চাই৷
এই কথা শুনে লজ্জায় নার্স চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।
.
ভয়ে ম্যানেজারের স্ত্রীর মুখ শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে গেছে। তার মাথা ঘুরতে শুরু হয়। সে অজ্ঞান হয়ে পরে গেল। তার জারিজুরি আজ সবার সামনে ধরা পরেছে। সে দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। এটা সে ম্যানেজারকে জানায়নি। কয়েকজন নার্স এসে তাকে অচেতন অবস্থায় একটি কেবিনে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালো। তার কিছুক্ষণ পর হাসপাতালে একজন কাজী ডেকে সবার উপস্থিতিতে ম্যানেজারের সাথে নার্সের বিয়ে হয়। ঘটনা মিটমাট হওয়ায় পুলিশ ম্যানেজারকে ছেড়ে দিলো।
.
তুলি তার পরনের শাড়ি কাপড় চেইঞ্জ করে রৌদ্রের কেবিনে আসলো। তার হাতের কাটা স্থানে ব্যান্ডেজ। কেবিনে ঢুকতেই দেখতে পেল, ছোট ছোট জামা কাপড় পরা কিছু সুন্দরী মেয়েরা রৌদ্রের বেডের চারপাশে ঘিরে রয়েছে। এরা সবাই রৌদ্রের ক্লাসমেট। তুলি মনে মনে বলছে,মাইয়া গুলার লজ্জা শরম নাই! ওড়না পরে নাই। দুধ গুলান দেখা যাইতাছে। ছি ছি! আবার হাটু বাইর করা। কাপড় পিন্দে নাই। ছি ছি!
রৌদ্র ওদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
.
মেলার মধ্য স্টলে দাঁড়িয়ে নীলা জিনিসপত্র দেখছিলো। ঐতিহ্যবাহী মেলা। বিভিন্ন শো পিচ আর ঘড়ি গুলোতে হাত দিয়ে দিয়ে দেখছে সে৷ তখনই হঠাৎ করে একটা নিতে গিয়ে অন্য আরেকটা চীনা মাটির শো পিচ মাটিতে পরে দুই খন্ড হয়ে গেল। সাথে সাথে নিচের দিকে তাকিয়ে দুই ভাগ হওয়া অংশটা দেখে ভয়ে নীলার মুখ শুকিয়ে যায়। কেউ দেখার আগেই সেটা মাটি থেকে তুলে দুই ভাগ হওয়া অংশটা এক সাথে করে আবার সেখানেই রেখে দিলো।
.
পিছন থেকে হেটে আসছে মেঘ। নীলাকে কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলো।
মেঘঃ কিরে কি করছিস এখানে! এগুলো পছন্দ হয়েছে?
নীলা মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দেয়৷
মেঘঃ আরে বল বল! কোনটা পছন্দ হয়েছে! নইলে এখানে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে কি করছিস। কোনটা নিবি বল।
স্টলের দোকানদার এদিকে এগিয়ে এলো। নীলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ঘামছে। একটা ঢোক গিললো।
মেঘ এবার শো পিচ গুলো তে হাত দিয়ে একটা একটা করে ওখান থেকে উঠিয়ে বলছে, কোন পছন্দ হয়েছে? এটা? ওটা? না এইটা?
.
মেঘ কয়েকটা ওঠানোর পর একটু আগের ওই দুই ভাগ হওয়া শো পিচ টায় হাত দিলো। ওটায় হাত দিতেই উপরের একটা অংশ মাটিতে পরে গেল।
এটা দেখার সাথেই নীলা দ্রুত সেখান থেকে সরে পাশের দোকানে কসমেটিকস দেখতে চলে গেল। দোকানদার এদিকে এগিয়ে এসে বলছে, আপনি এটা ভেঙে ফেললেন?
মেঘ তার হাতে থাকা শো পিচের খন্ডটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলছে, এটা তো বোধয় আগেই ভাঙাই ছিল।
দোকানদার করা গলায় উত্তর দেয়, একটা জিনিসও এখানে ভাঙা নয়। সব চেক করে রেখেছি৷
মেঘঃ ইয়ে মানে আমি তো এটা ভাঙি নি৷
দোকানদার রেগে বলছে, আমি স্পষ্ট দেখলাম ওটা আপনার হাত থেকে পরে ভেঙে গেল! আর আপনি ভাঙেন নি!
মেঘঃ দেখুন আমি মিথ্যা বলছি না।
.
পাশের দোকান থেকে নীলা আড়চোখে ঘটনা দেখছে আর ওখানে হাতের চুড়ি দেখার ভান করছে। রবিন এগিয়ে এসে বললো, কি হয়েছে এখানে গ্যাঞ্জাম কিসের?
মেঘ শো পিচটা দেখিয়ে বললো, দেখ ভাই এটা ভাঙাই ছিল আর উনি বলছেন এটা আমি ভেঙেছি!
.
হঠাৎ মেঘ সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো নীলার চোখ মুখ হাস্যোজ্জ্বল! সে মুচকি মুচকি হাসছে। মেঘ যে ওকে হাসতে দেখছে সেটা নীলা খেয়ালই করলো না। সে পাশের দোকান থেকে হাতের চুড়ি কেনার ভান করছে৷
.
এদিকে আকাশ অহনাকে গাড়ি করে প্রেমনগরে রেখে আসছে। আকাশ নিজেই ড্রাইভ করছে। কাল থেকে হাসপাতালে আছে। বাড়ি গিয়ে এখন একটু ফ্রেস হওয়া দরকার। অহনা আকাশের পাশের সিটে বসে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে আছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
আকাশ সামনের দিকে তাকিয়েই ড্রাইভ করতে করতে বলছে, এভাবে দেখো না তো! ড্রাইভিং করতে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!
অহনা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো, কি আর হবে! বেশি কিছু তো হবে না৷
.
অহনা এগিয়ে এসে আকাশের গায়ে হাত দিলো এবং আকাশের ঘাড়, কান আর গলা শুকতে থাকে । আর গালের কাছে এসে ঠোঁটটা কিসের স্টাইল করছে।
আকাশঃ আরে… আরে এ্যাই কি করছো! থামো!
আকাশ তাড়াতাড়ি গাড়িটা ব্রেক করে থামিয়ে দেয়।
গাড়ি থামিয়েই আকাশ অহনার হাতটা ধরে ফেললো।
আকাশঃ এসব কি করছিলে!
অহনা কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে আকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশেরও আহনার মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিভ্রম হয়ে গেল।
আস্তে আস্তে আকাশ অহনার ঠোঁঠের কাছে চলে গেল । তারপর আকাশের ঠোঁট ডুবে যায় অহনার ঠোঁটে।
.
দশ মিনিট থেকে রাস্তায় গাড়ির লম্বা সিরিয়ালে জ্যাম পরে গেছে। সামনে একটা কালো গাড়ি সেই কতক্ষন থেকে দাঁড়িয়েছে আর সরে যাবার নাম নেই।
.
চলবে….
#প্রেমনগর
পর্বঃ১৮
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
আফতাব চৌধুরীর মুখোমুখি হতে নীলার বাবা মা এবং তাদের কিছু দলবল সঙ্গে নিয়ে হাতপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছেন। হাতপাতালের সামনে বেশ কয়েকটা মাইক্রো এসে জড়ো হয়েছে। তারা দ্রুত বেগে হন হন করে হেটে সিড়ি দিয়ে উঠছে। তিন তলায় এসে আটকে গিয়ে এদিক ওদিক ছুটে ওদের কেবিন খুঁজতে থাকে। দলবল গুলোও হাতে লাটি গুলি নিয়ে পিছু পিছু আসছে। হাসপাতালে থাকা অনান্য রোগীরা এই দৃশ্য গুলো দেখে ভয় পেয়ে গেল। হাসপাতালের ম্যানেজার তাড়াতাড়ি পুলিশ সুপার বাহিনীকে খবর দিলেন। এদের সামলাতে দুই একটা সিকুরিটি পুলিশে কাজ হবে না। ওরা সামলাতে গিয়ে পরে হাসপাতালে না কোন বাজে ঘটনা ঘটে যায়।
.
কাঙ্খিত আফতাব চৌধুরীর খোঁজ তারা পেয়েছেন। আফতাব চৌধুরীর মুখোমুখি হতে গিয়ে নীলার মা নীহারিকার এবার চোখ গেল মনিরা বেগমের দিকে। মনিরা বেগমও নীহারিকাকে দেখে উঠে দাড়ালেন। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ এবং একে অপরকে সুক্ষ্ণ ভাবে দেখে চেনার চেষ্টা করছেন। নীহারিকার চোখ গুলো গোল গোল হয়ে গেছে। নীহারিকা চিল্লিয়ে বলে উঠলো, মনিরা!!
মনিরা বেগমঃ নীহারিকা তুই!
মনিরা বেগম ছুটে এসে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরলেন। দুইজনের মুখেই ছড়িয়ে পরছে মুক্তোর হাসি।
নীলার বাবা আর আফতাব চৌধুরী একবার একে অপরের দিকে তাকালেন। তারা ঘটনার কোনো কিছুই বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
.
মনিরা আর নীহারিকা দুইজন স্কুলের বান্ধুবি। দীর্ঘ সাতাশ বছর পর তাদের আজ আবার দেখা হলো। সেই ষোল বছর বয়সে মনিরা আফতাবের প্রেমে পরে। এবং সেই প্রেমের টানে এক পর্যায়ে ঘর ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। ঘটনার কিছুদিন পর নীহারিকার স্কুল পাশ হলেই নীহারিকার পরিবার নীহারিকাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। পররর্তীতে দুই বছর পর মনিরা তার নিজ শহরে এসে নীহারিকাকে আর দেখতে পায় নি এবং আর কোন যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি৷
.
মনিরা যখন ক্লাস নাইনে ওঠে তখন থেকেই আফতাব মনিরার পিছু লাগে। আফতাব ছিল তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া তরুণ। মনিরা স্কুলে যাওয়া আসার পথে আফতাব রোজ দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতো৷ এভাবে ছিলো ওদের দুজনের প্রথম দেখা হওয়া৷ মনিরা ঘরে এসে আফতাবের ওই মায়াবি চোখ কিছুতেই ভুলতে পারতো না। আর আফতাব তো কিশোরী মনিরার ওই মিষ্টি চেহারায় বাধা পরেই গেছে৷ এরিমধ্যে মনিরা ক্লাস টেনে উঠে গেল। এরপর একদিন হুট করে শুরু হয়ে যায় চিঠি দেয়া নেয়া। রোজ রোজ চিঠির আশা করতো মনিরা। একদিন চিঠি না পেলে মন খারাপ থাকতো। ওইরাতে আর ঘুম হতো না। এভাবে মনিরাও আস্তে আস্তে আফতাবের প্রতি দুর্বল হতে থাকে। দুইজনই দুইজনের প্রেমে পরে গেছে। এটা ছিলো দুইজনের জীবনেই প্রথম প্রেম৷ আর মনিরার বয়স ছিল খুবই অল্প। মনিরার ষোল এবং আফতাবের উনিশ বছর চলছিলো তখন। শুরু হলে গেল তাদের রঙিন দিন। সেই মিষ্টি প্রেমের সাক্ষী নীহারিকা নিজেও ছিলো। মনিরার চিঠি দেয়া নেয়া এবং স্কুল ফাকি দিয়ে প্রেমিকের সাথে ঘুরতে যাওয়া সবই নীহারিকা জানতো। এমনকি মনিরা বাহিরে বের হতে না পারলে ওর প্রেমিকের চিঠি পর্যন্ত নীহারিকা নিজ হাতে বহন করেছিলো।
.
প্রেম এতোটাই গভীর হয়ে গিয়েছিলো যে মনিরা নিজেকে সামাল দিতে পারলো না৷ ধরা পরে গেল পরিবারের কাছে। পড়ার টেবিল,বিছানা আর বই খাতার মধ্য গাদা গাদা অনেক চিঠি পাওয়া গেল। মনিরার বাবা মনিরাকে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন। স্কুল ফাকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ঘটনাতেও ধরা পরে গিয়েছিলো মনিরা। মনিরার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় মনিরার স্কুল পাশের পর মনিরাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে৷ কিন্তু এরিমধ্যে ঘটে যায় আরেক বিপদ। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর দুইজনের আবেগ আরও বেড়ে যায়। প্রায়ই লুকিয়ে দেখা করার সময় মনিরা এসে আফতাবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। দুইজনই দুজনকে হারানোর কথা কল্পনাতেও আনতে পারতো না। লুকিয়ে লুকিয়ে খুবই গভীর ভাবে দুজনের মেশামেশা শুরু হলো আর আবেগে দুইজনই দুজনের কাছে সপে দিলো।
.
এভাবেই দুই মাস চললো তাদের গোপন প্রনয়। মনিরাকে মারধর করার পর মনিরা বলেছিলো সে আর আফতাবের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখবেনা৷ কিন্ত তাই কি হয়? তার প্রাণ হারাতে হবে যে তাকে! একদিন আফতাবকে দেখতে না পেলে সে পাগলের মতো হয়ে যেত। হঠাৎ মনিরা একদিন ক্লাসে মাথা ঘুরে পরে যায়। আর কয়েকদিন থেকেই সব সময় বমি বমি ভাব আসছে। ভালোভাবে কিছু খেতেও পারছেনা আর বমি করছে। মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার পর স্কুলের ম্যাডাম একজন মহিলা ডাক্তারকে স্কুলে আসতে বললো। উনি মনিরাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি টেস্ট করালেন। মনিরা সন্তান সম্ভাবনা। স্কুলের ম্যাডামও এটা শুনে ভিমরি খেয়ে গেলেন। ভয়ে মনিরা ওইদিন আর বাসায় না ফেরার সিধান্ত নেয়৷ এটা বাসায় জানলে ওকে আজ মেরেই ফেলবে৷ তাই বাড়ি না ফিরে স্কুল থেকেই মনিরা সোজা আফতাবের কাছে চলে গেল।
.
সব শুনে আফতাবের মাথায়ও আকাশ ভেঙে পরে। ভয়ে মনিরা খুবই কান্নাকাটি করতে শুরু করে দিয়েছে। আফতাবও এখন ছাত্র অবস্থায়। সবে কলেজের এক বছর পার হলো। এখনি নিজের বাড়িতে বিয়ের কথা জানানোর সাহস তারও যে নেই। বাবা মা এই কথা জানতে পারলে তাকেও চড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেবে নিশ্চিত। সিধান্ত নিলো আফতাবও আজ বাড়ি ফিরবে না।
.
ছোট্ট কিশোরী মনিরা তার বড় ছেলে আকাশকে পেটে নিয়েই ওইদিনই প্রেমিক আফতাবের হাত ধরে ওই শহর ছেড়ে পালিয়ে এলো। নতুন শহরে পালিয়ে এসে আফতাব তার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে। ঘটনার সব কিছু খুলে বলার পর সে এবং আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করলো। সেই রাতেই বিয়ে হয় মনিরা আর আফতাবের। এবং আপাতত ওরা বন্ধুর বাড়িতে গিয়েই উঠলো। সবাই সেখানে ঘর বাড়ি সুন্দর করে সাজায়। এবং বাসর ঘরের ব্যবস্থাও করলো। কিশোরী মনিরার কাছে এখন সব কিছু রঙিন রঙিন লাগছে। সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে পালিয়ে এসে ভালোই করেছে৷
.
কিছুদিন পর আফতাব বন্ধুদের সহায়তায় সেখানে ছোট একটি ব্যবসা শুরু করলো এবং পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালালো৷ এরপর কিছু টাকা হলে ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া করে বন্ধুর বাড়ি থেকে দুজন সোজা সেই ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠলো। তখন থেকেই শুরু হলো এই প্রেমনগরে তাদের সাজানো ছোট্ট সংসার। সেখানেই জন্ম নিলো তাদের আদরের সন্তান বড় ছেলে আকাশ।
.
আকাশের বয়স এক বছরের কাছাকাছি আসতেই মনিরা আর আফতাব নিজেদের শহরে গিয়ে বাবা মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। এবং তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। ছেলে মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার কারণে দুইজনের পরিবারই এতোদিন ছিলো পাগল প্রায় তাই ওদের ফিরে পেয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে দুই পরিবারই ওদের বুকে জড়িয়ে নেয়৷ এরপর মনিরা আর আফতাব তাদের সন্তান আকাশকে নিয়ে প্রেমনগরে ফিরে আসে ওদের এতোদিনের সাজানো ছোট্ট সংসারে। ধীরে ধীরে মনিরা এবং তার সন্তানও বড় হতে থাকে এবং আফতাবও পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। সব কিছুই সম্ভব হয়েছে দুইজন দুইজনের প্রতি প্রেম আর সহযোগীতায়। এরিমধ্যে জন্ম নিলো ওদের মেজো ছেলে মেঘ।
.
আফতাবের সুনামে এখন বেশ খুশি মনিরার পরিবার। আফতাবের পরিবারও মনিরাকে বউ হিসেবে পুরোপুরি মেনে নিয়েছে৷ বিখ্যাত বড় বিজনেসম্যান আফতাব চৌধুরীর সুনাম এখন চারিদিকে। আফতাব প্রেমনগরই নিজস্ব অনেক জায়গা জমি কিনে ফেলেছে। বিশাল বড় বাড়িও করে ফেললো। আফতাব তার স্ত্রী মনিরা এবং দুই পুত্রকে নিয়ে সেখানে গিয়ে উঠলো। নতুন বাড়িতে উঠেই আরও একটি সুখবর এলো। মনিরা আবারও মা হতে যাচ্ছে। কিছুদিন পর নতুন চৌধুরী মহলেই জন্ম নিলো ওদের ছোট ছেলে রৌদ্র। তখন থেকেই চলতে থাকে প্রেমনগরের এই চৌধুরী মহল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সব এবং বড় হয় ছেলেরাও।
.
আজ এতো গুলো বছর পর আবার সেই ছোট্ট মনিরার সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি নীহারিকা। মনিরাও ভাবেনি নীহারিকার সাথে এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে৷ তবে মনে মনে চেয়েছে কোথাও কোনো দিন দেখা হোক। অনেক খুঁজেছে সে স্কুলের বান্ধুবিদের কিন্তু যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। আজ দুইজন দুইজনকে এভাবে দেখে দুইজনই আবেগে আপ্লুত। কে জানত এই আফতাব চৌধুরীই আসলে সেই আফতাব যে ছিলো মনিরার জীবনের স্কুলের প্রেমিক৷ যার সাথে মনিরা পালিয়ে গিয়েছিলো।
.
এদিকে তুলি রৌদ্রের কেবিনে বসে খুবই বিরক্তবোধ করছে। কেননা সেখানে একের পর এক সুন্দরী মেয়েরা এসে ভিড় জমাচ্ছে। রৌদ্রের সাথে যে একটু আলাদা ভাবে কথা বলবে সেই সুযোগ টুকুও পাচ্ছে না। রৌদ্রের ডিপার্টমেন্টর সব মেয়েরা এসে হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছে। তাদের মোস্ট হ্যান্ডসাম বয় যে এখন এখানে। ওরা ভাবছে এই অবস্থায় হ্যান্ডসাম বয়ের একটু খেতমত করতে পারলে যদি মনটা জয় করে নেওয়া যায়!
.
চলবে….