এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
পর্বঃ০৪
#Arshi_Ayat
রুহি ভয়ের চোটে থরথর করে কাঁপছে।রুহির মা রুনা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে কিন্তু সেগুলো একদমই রুহির কানে যাচ্ছে না।চোখের সামনে বারবার ভয়ংকর দৃশ্যগুলো ভাসছে।যা একটু আগেই স্বপ্নে দেখলো সে।এমন ভয়ংকর স্বপ্ন রুহি কখনো দেখে নি।এই স্বপ্ন রুহির ভেতর ভয়ের সৃষ্টি করলো।যদি স্বপ্নটা সত্যি হয়!রুহির ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো।রুহি মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল”মা,আকাশা আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দিবে না।মা ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে।”
রুনা বেগম রুহির মাথাটা আবারও বুকের সাথে চেপে ধরে বলল”কিচ্ছু হবে না।তুই একদম চিন্তা করিস না।আমরা আছি তো।”
মায়ের কথায়ও তেমন একটা ভরসা পায় না রুহি।আসলে ভয়টা এমন ভাবে জেঁকে বসেছে যে কোনো আশ্বাসেও কাজ হচ্ছে না।মনটা অশান্তই হয়ে আছে।
——————-
আকাশ সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো নাতাশার চেম্বারে যাওয়ার জন্য।রুহির বিষয়ে একটা জরুরী কথা আছে।হাসপাতালে পৌঁছে নাতাশার কেবিনে গিয়ে দেখলো নাতাশা কার সাথে যেনো কথা বলছে আকাশকে দেখে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিয়ে বলল”খবর টবর কিছু পেলে?”
“না তেমন কোনো খবর পাই নি।কিন্তু একটা জরুরী আলাপ করতে এলাম।”
“বলো শুনি।”
নাতাশা আকাশকে বলতে বলে দুইকাপ কফি দিতে বলল।
“আচ্ছা নাতাশা বেবিটাকে মারার দরকার কি?ওকে ডিবোর্স দিয়ে দিলেই তো হয়।তারপর আমরা বিয়ে করে নেবো।”
নাতাশা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল”বেবিটাকে মারতেই হবে।কারণ ওই মেয়েটা বেবিটাকে দিয়েই তোমাকে ফাসাবে।”
“কিভাবে?” আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলল।
“বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার পর অবশ্যই ওর বাবার পরিচয় চাইবে তখন রুহি তোমার নাম বলবে।বায়োলজিক্যাল ভাবেতো তুমিই ওর বাবা।ব্যাস আর কি সম্পত্তির ভাগ দাও!আর তাছাড়াও বাচ্চাটা সব জায়গায় তোমার নাম ব্যাবহার করবে।যেটা আমি মানতে পারবো না।” শেষের কথাটা নাতাশা মুখে কাঠিন্য এনে বলল।
আকাশও নাতাশার কথাগুলো ভাবতে লাগলো।আকাশকে ভাবতে দেখে নাতাশা মনে মনে হাসলো আর বলল”’কোপটা একবারে জায়গা মতো পড়ছে।’
এরমধ্যেই কফি চলে এলো।আকাশ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল”তুমি ঠিকই বলেছো নাতাশা।আসলেই বাচ্চাটা রাখা ঠিক হবে না।আমি কালই ওদের বাসায় যাবো।আমার বিশ্বাস রুহি ওই বাসায় আছে।”
নাতাশা আর আকাশ এভাবেই আরো কিছুক্ষণ কথা বলল সাথে কফি শেষ করে উঠে পড়লো।নাতাশা আর আকাশ নিজেদের বাসায় চলে গেলো।
আকাশা বাসায় ফিরতেই আকাশের মা বলল”ওই মুখপুড়ি কি একবারে গেছে গা?”
“হুম।ওকে আমি ডিবোর্স দিবো।চরিত্র ভালো না ওর।কার না কার বাচ্চা আমার বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে।”
আকাশের মা ছিঃছিঃ করতে করতে বলল”ঠিকই আছে।এসব নষ্টা মাইয়া লইয়া ঘর করা যায় না।তুই ভালো কাজ করছিস।”
আকাশ আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
—————————-
মাত্রই এশার নামাজ আদায় করে রুহি বিছানায় এসে বসলো।তারপর ডান হাতটা পেটের ওপর রাখতেই পানিতে দুঃচোখ ভরে গেলো।কিন্তু এতটুকুও শব্দ হয় নি।রুহি ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না অশ্রুগুলো তার ফর্শা কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।এতো কষ্ট সহ্য হচ্ছে না রুহির।
কিছুক্ষণ নিরবে অশ্রু ফেলে রুহি জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালো।দুইতলার ওপর বাসা হওয়ায় জানালার কাছে দাড়ালে রাস্তার অনেকটাই দেখা যায়।ল্যাম্পপোস্টের নিচে চলতি গাড়িগুলোকে তাকিয়ে রুহি।তবে ভাবছে অন্যকিছু!হঠাৎ রুহির ভাবনার সুতা ছিড়লো তার মায়ের ডাকে।রুহি পিছনে ফিরতেই দেখলো রুনা বেগম চা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।রুহি একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল”বাবাকে দিয়েছো?”
“হুম,দিয়ে আসলাম।এই নে তোরটা।”
রুহি মায়ের হাত থেকে হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে বলল”তুমি খাবে না?”
“খাবো তো।দাড়া নিয়ে আসি।”
রুনা বেগম কিচেন থেকে নিজের কাপটা নিয়ে এলেন।
রুহি ভাবছে কতোদিন পর মায়ের সাথে চা খাচ্ছে।প্রায় তিনবছর হয়ে গেছে।
আগে সন্ধ্যা হলেই রুনা বেগম চা বানাতেন তারপর আনোয়ার সাহেবকে তার চা টা দিয়ে মা মেয়ে একসাথে বসে চা খেতো।সেই চা খওয়ায় যে কতোটা তৃপ্তি ছিলো!তিনবছর পর আবার এই দিনটা এলো কিন্তু একটা জিনিস অবশ্য বদলেছে।তিনবছর আগে মা মেয়ে একসাথে চা খেতে বসলে অনেক গল্প হতো,হাসিঠাট্টা অনেককিছু কিন্তু আজ কিছুই হচ্ছে না সবকিছু যেনো নিরব হয়ে আছে।
চা খাওয়া শেষ হতেই রুনা বেগম উঠে দাড়িয়ে বললেন”চা টা শেষ কর।আমি আসছি তোর মাথায় তেল দিবো।চুলগুলো শুকনো হয়ে পাটকাঠি হয়ে আছে।কতোবছর ধরে তেল দিস না?”
রুহি মলিন হেসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল”মনে নেই।”
রুনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল”আমি আসছি।”
তারপর চলে গেলেন।রুহি চা খেতে খেতে কিছু একটা ভাবছিলো হঠাৎ কারো কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো।কথার আওয়াজটা আসছে সামনের রুম থেকে।রুহির বিষয়েই কিছু বলছে তাই রুহি কান খাড়া করলো শোনার জন্য।
.
.
নিচতলার ভাবি এসেছে রুহিদের বাসায়।আজকে সকালেই তার মেয়ের থেকে সবকিছু শুনে দেখা করতে এলো।রুনা বেগম তাকে বসতে দিয়ে বললেন”কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভাবি।আপনারা?”
“এইতো আল্লাহ ভালোই রাখছে।চা আনি আপনার জন্য?”
“না ভাবি আমি মাত্রই চা খেয়ে এলাম।”
মহিলাটা একটু থেমে আবার বলল”শুনলাম আপনার মেয়ে নাকি এসেছে।”
রুনা বেগম এমন কিছুই আন্দাজ করছিলো।তাই সাবলীল ভাবে বলল”হ্যাঁ ভাবি।”
“তা একবারের জন্যই এসেছে?নাকি আবার চলে যাবে।”
“একবারেরই জন্যই।ওর স্বামী ভালো না।”
“ওও,,আচ্ছা ওকে একটু ডাক দেন।দেখি।কখনো তো দেখি নাই।”
রুনা বেগম জানেন মহিলাটা কেমন।এখন গিয়ে আশেপাশের সবাইকে ছড়াবে।রুনা বেগমের মন সায় দিলো না রুহিকে ডাকতে।কে জানে ওর সামনে কোনো বেফাঁস কথা বলে দিলে!রুহির মন তো নরম সহ্য না করতে পেরে কান্না করবে।এমনিতেইতো সারাদিন কাঁদে।মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।কি অপরিসীম কষ্ট বুকে ধারণ করে আছে সেটা কেউ না বুঝলেও সে বোঝে।মা তো তাই!মায়েরা নাকি সন্তানের কষ্ট বোঝে।
রুনা বেগম মহিলাটাকে মিথ্যা বলে বিদায় করলেন।
রুহি ভেতরের ঘর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এটাতো কিছুই না আর কয়দিন পর তো আরো অপমান সহ্য করতে হবে ভেবেই রুহির মন খারাপ হয়ে গেলো।
আমাদের সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের কে কোন চোখে দেখা হয় এটা আমরা সবাই জানি।একটা ছেলেকে কিন্তু এতো অপমান সহ্য করতে হয় না।ডিবোর্সের পর তারা অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করতে পারলেও কোনো ডিবোর্সী মেয়ের কপালে অবিবাহিত ছেলেতো দূরের কথা দুই তিনবার ডিবোর্সী ছেলেও নাক সিটকায়।
———————
আকাশ নাস্তা করে বের হলো রুহিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য।দুইদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে এই বাচ্চার ঝামেলা সরানোর জন্য তার ওপর আবার নাতাশার প্যারা তো আছেই।
কিন্তু রুহিদের বাসায় যাওয়ার আগে একবার নাতাশার সাথে দেখা করতে হবে।আকাশ সোজা এসে নাতাশা কেবিনে ঢুকলো।দেখে নাতাশা কার সাথে যেনো কথা বলছে ওকে দেখা তড়িঘড়ি করে ফোনটা কেটে দিয়ে বলল”ব্রেকফাস্ট হইছে?
“হ্যাঁ,তোমার?”
“হ্যাঁ হইছে।এখন কি ওই মেয়েটার বাসায় যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ দুইদিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।”
“শোনো প্রথম গিয়ে মাফ টাফ চাবা।একটু কনভেন্স করার ট্রাই করবা।এতে যদি হয় তাহলে তো হলোই।আর না হলে জোরাজোরি করবা।তবে ওর বাচ্চা যাতে না বাঁচে।”
আকাশা নাতাশার কথায় সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুহির বাসার উদ্দেশ্যে।কি জানি রুহির দুঃস্বপ্ন কি সত্যি হতে চললো আজ!
——————-
চা টা খেয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অরুণী।এখন যাবে রুহিদের বাসায়।মেয়েটা একদম ভেঙে পড়েছে।কিছুক্ষণ ওর সাথে গল্প করে তারপর ভার্সিটিতে যাবে।অরুণীর একদম কষ্ট সহ্য হয় না।রুহির জায়গায় যদি অরুণী থাকতো তবে আকাশ আর নাতাশার উচিত শিক্ষা দিতো।কিন্তু রুহিতো এগুলোর কিছুই করবে না।এতো শান্ত একটা মেয়ের কপাল টা এমন হলো ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে অরুণীর।চারদিকে এতো মন ভাঙার গল্প হচ্ছে দেখে অরুণীর ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠে গেছে।অরুণীর মনে এটা নিয়ে ফিলিংস জাগে না।আশেপাশের এমন মনভাঙার গল্প গুলোই ওকে এমন শক্ত করেছে।অরুণী মাঝেমধ্যেই ভয় পায় যদি কেউ ওর সাথেই এমন করে তখন!
চলবে…….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)