মন শুধু মন ছুঁয়েছে,পর্ব_২০

0
2902

মন শুধু মন ছুঁয়েছে,পর্ব_২০
জান্নাতুল নাঈমা

আমি যখন সেদিন তোমার মায়ের কাছে যাই। প্রথম ওনাকে দেখে আমি ভীষণ চমকে যাই। আমার পুরো শরীর ঘামতে থাকে মাথা থেকে পা অবদি ঘেমে একাকার অবস্থা। চোখ বন্ধ করে আমি দুটো মানুষকে মেলানোর চেষ্টা করি।

আদেও দুজন আলাদা নাকি একি তা আমি বুঝে ওঠতে পারছিলাম না৷ হুট করে যেনো অতীত মাথায় নাড়া দিয়ে ওঠলো।সেই সাথে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অপরাধ বোধ জেগে ওঠলো মনের ভিতর। নিজেকে কোনরকম সামলে নিয়ে ওনার সাথে কথা বলতে থাকি। তোমার বিয়েটা যেনো কোনভাবেই না হয় সেই চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু ওনি কোনভাবেই মানতে রাজি নন। আমার ইচ্ছে ছিলো জাষ্ট বিয়েটা ভাঙ্গা এরপর আমার পরিবার নিয়ে বেশ আয়জন করে বিয়ে করা। কিন্তু ওনি রাজিই হচ্ছিলেন না।

আমি যেনো খুব বেশী নরম হয়ে গেলাম। ঐ মানুষ টাকে দেখে তোমাকে পাবার তীব্র নেশা ধরে গেলো। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি বলছিলো যে করেই হোক তুই আরোহীকে নিজের করে নে, ওর দায়িত্ব নিয়ে নে শুধু আরোহী নয় সামনের মানুষ টা আরোহীর মা তাঁর দায়িত্বও তো তোর নেওয়ার কথা।
কিন্তু ওনি আমায় সোজা না করে দিলেন।
আর আমি হুট করেই ওনার দু পা আঁকড়ে ধরলাম। কেনো, কিসের জন্য, কিসের টানে আমি স্নিগ্ধ এমন একটা কাজ করলাম জানিনা। ভালোবাসলে একজন মানুষ সব করতে পারে। ভালোবাসার পীড়ায় পুরুষ শুধু পুরুষ থাকে না একদিকে যেমন মহাপুরুষ হয়ে ওঠে অন্যদিকে হয়ে ওঠে উন্মাদ। কিন্তু আমার টান টা শুধু ভালোবাসার ছিলো না ছিলো একটা দায়িত্ব বোধের। যা আমার মন কে বার বার অশান্ত করে তুলছিলো। ততোক্ষণ শান্তি পাচ্ছিলাম না যতোক্ষণ তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেনে স্বীকৃতি দিতে না পারছিলাম।
.
আমি যখন ওনার দু পা আঁকড়ে ধরি ওনি আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি। চোখের জল ফেলে আমার মাথায় হাত রাখেন। আমাকে ওঠিয়ে বিছানায় ওনার পাশে বসান। বলতে থাকে ওনার জীবনের সেই অতীত গুলো যেই অতীতের শাক্ষি আমি বহুবছর আগেই হয়েছিলাম। ওনার সেই অতীত শুনেই আমি সিওর হয়ে যাই সামনের মানুষ টা সেই মানুষ টাই।
.
আরোহী আরো গভীর মনোযোগ দিয়ে চেয়ে থাকে স্নিগ্ধর দিকে স্নিগ্ধ বলতেই থাকে।
.
ওনি আমাকে বলতে থাকেন তাঁর জীবনের ঘটে যাওয়া নির্মম সত্যি ঘটনা গুলো।

ওনি তখন তোমার বয়সি। ওনার চাচাতো ভাই জসিমের বন্ধু যায় গ্রাম দেখতে। শহড়ে একসাথে পড়াশোনা শেষ করে। জবে ঢোকার আগে কিছুদিন তাঁরা ঘুরে ফিরে নিতে চায়। তাই সর্বপ্রথম যায় তোমাদের ঐ গ্রামে। বন্ধুর নাম এহসানুল হক। রাত তখন সাড়ে বারোটা চড়ায় চড়ায় ডোবা পানি। বন্যার সময়ের ঘটনা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।

এহসানুল আর জসিম যায় নৌকা ভ্রমণ করতে। রাত একটা অবদি নৌকা দিয়ে দুই বন্ধু ঘুরা ফেরা করে।
ঘাটে এসে নামতেই দুই বন্ধুর শীতে কাঁপুনি ধরে যায়।
জসিমের তেমন সমস্যা না হলেও এহসানুলের বেশ সমস্যা হয়। শহড়ের ছেলে তাই গ্রামের মানুষের মতো ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। জসিম বুঝতে পেরে বলে,
“কিরে শীত লাগছে দাঁড়া তরে আগুনের ব্যাবস্থা করে দেই বেশ মজা পাবি”

এহসানুল কাঁপা কাঁপা শরীরে জসিমকে অনুসরণ করে যায়। জসিম তাঁদের বাড়ির থেকে বেশ কয়েক বাড়ি এগিয়ে এক বাড়ির জানালায় সমানে টোকা দিতে থাকে। কয়েক মিনিট পর ঘুমু ঘুমু চোখে, মুখে এক মেয়ে জানালা খুলে জসিমকে দেখে ভয়াতুর স্বরে বলে,”জসিম ভাই এতো রাতে তুমি এখানে কেনো”??
“আর বলিস না নৌকা দিয়ে ঘুরতে গিয়ে দেখ দুই বন্ধু কেমন ভিজে গেছি, বড্ড ঠান্ডা লাগছে আগুনের ব্যাবস্থা করতো”

আমেনা বন্ধু নাম শুনে লজ্জা পেলো খানিকটা। জসিম তাঁর পরিচিত হলেও এহসানুল সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ বিধায় লজ্জা পাওয়াটা স্বাভাবিক।
জসিম আবারো বললো-, “কিরে গ্যাসম্যাস থাকলে দে আগুন ধরাবো,তোদের খড়ই নিবো তোর বাপ,ভাইকে বলিস না যেনো”,,,

আমেনা গ্যাসম্যাস দিলো জসিম বললো “এহসানুল তুই এখানে দাঁড়া আমি খড় নিয়ে আসতাছি আগুন এখানেই ধরাবো। আমেনা এতো বড় উপকার করলো ওকেও তো একটু আগুনের ভাগ দিতে হবে”
জসিম কথাগুলো বলেই চলে যায়। এদিকে এহসানুল আর আমেনা পড়ে যায় বিপাকে। কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারেনা,আমেনা না পারে সরে যেতে না পারে ওখানেই স্থির থাকতে কেউ কাউকে সেভাবে স্পষ্ট দেখতে পায় না। তবুও লজ্জার সীমা নেই,,,
বেশ খানিক সময় পর এহসানুল বলে,,,
“এক গ্লাস পানি হবে খুব পানি পিপাসা পেয়েছে”
আমেনা এক মূহুর্ত দেরী করে না কলস থেকে পানি ভরে জানালা দিয়েই দেয়। এহসানুল পানি খেয়ে যেই গ্লাস ফেরত দিতে যাবে তখনি বেশ মোটা স্বর কানে ভেসে আসে,”বাহ মাঝরাতে পরপুরুষের সাথে পানির গ্লাস দিয়ে হাতাহাতি হইতাছে”

আমেনা কেঁপে ওঠে হাত ফস্কে গ্লাসটা পড়ে যায়। এহসানুল হকচকিয়ে পাশে তাকায়। ততোক্ষণে চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে গেছে। ষাটোর্ধ বয়সি লোকটা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে আমেনার অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠছে। জসিম এসে সমানো বলছে” দাদা চুপ করেন আপনি যা ভাবছেন তা না “জসিম এতো করে বোঝাচ্ছে তবুও বোঝার নাম নেই হাকডাক করে প্রায় পনেরো,ষোলজন মানুষ জরো করে ফেলেছে আমেনার দাদা।আমেনার মা-বাবা বড় ভাই লজ্জায়, রাগে নিচের দিকে মাথা করে আছে। আমেনা সমানে কেঁদে যাচ্ছে। এহসানুল ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে হয়েছে টা কি।

জসিমের মুখ দেখে বুঝতে পারছে মারাত্মক কোন দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমেনার দাদা বললেন “এই পোলাডারে গাছের সাথে বান্দোই তোরা।কতো বড় সাহস রাত দুপুরে পেরেম লীলা করতে আইসে”
জসিম বললো “দাদা আপনি ভুল করছেন এহসানুল আমার বন্ধু, আমরা নৌকা ভ্রমণ,,,
বাকি কথা আর বলতে দিলো না সবাই একস্বরে বলতে লাগলো” বাবাগো বাবা পেটে পেটে এতো,তুই শহড়ে বন্ধুর সাথে ভালোবাসা করাই দিছস, রাত দুপুরে আমাগোর মেয়ারে নৌকায় নিয়া কু কাম করার মতলব ধর ছেড়ারে” বলেই এহসানুল কে চেপে ধরলো সবাই। এহসানুলের আর বোঝার বাকি রইলো না আসল ব্যাপারটা। সে সমানে বোঝাতে চেষ্টা করলো কাজ হলো না। তাঁকে সকলে মিলে গাছের সাথে বেঁধে ফেললো। জসিম মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। আমেনা বেগম জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। সে খুব ভালো করে তাঁর পরিবার আর গ্রামের মানুষদের চিনে। এরা নিজেরা যা বুঝবে তাই কারবে। কারো কথা তাঁরা শুনবে না। তাঁর কপালে আর এই শহড়ে ছেলের কপালে যে দুঃখ আছে বেশ বুঝলো। আগামী কাল শালিশের আয়োজন করা হবে বলেই সকলে যে যার ঘরে ফিরলো। পাহাড়ায় রইলো শুধু আমেনার দাদা।

সে জসিমকে বলতে লাগলো “ভাগ্যিস তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য ওঠছিলাম নয়তো এমন ছেঁচা বিড়াল ধরতেই পারতাম না”

জসিম অসহায় চোখে,মুখে তকিয়ে বললো- “ও দাদা আমার একটা কথা শোনেন”

দাদা বললেন-” চুপ হতচ্ছাড়া আমার অমন সাদা, সিদা নাতনীটারে তোরা এইভাবে ঠকাবি আর আমি তা সহ্য করমু,না হয় নাতনী আমার তেমন সুন্দরী না তাই বলে তোরা পেরেমের নামে ফাঁসাবি আমি বাঁইচা থাকতে এ হইতে দিমুনা”

এহসানুল এক ঢোক গিলে বললো- “আপনারা কি শুধু আপনাদের মতামতই দিবেন আমাদের কিছু বলতে দিন।আমাকে এভাবে বেঁধে রাখছেন কেনো? আমি এ গ্রামের অতিথী হয়ে এসেছি।আর আপনারা অতিথি আপ্যায়ন এইভাবে করছেন”? আমি না হয় পরের ছেলে নিজের মেয়ের প্রতি আপনাদের একটু ভরসা নেই”

দাদা খ্যাক খ্যাক করতে করতে লাঠি ওঠিয়ে বললেন-“এই ছোঁকড়া বেশী কথা বললে লাঠির বাড়ি একটাও মাটিতে পড়বো না সব পিঠে পড়বো। নাতনীর হাত ধরার সময় এইগুলা মনে আছিলো না”??

“আপনি ভুল করছেন আমি শুধু পানি খেতে চেয়েছি। খুব পানি পিপাসা পেয়েছিলো”

“ওওও পেরেম পিপাসা নিয়া আইসা ধরাধরি করবার মন চাইছে তাই নাতনী রে বোকা বানাই পানি চাইছোস তুই তো খুব শেয়ান।কিন্তু আমিও কম না শেয়ানের শেয়ান আমি হুম” বলেই লাঠিটা মাটিতে গেড়ে পান চিবুতে লাগলো।
.
পূর্ব আকাশে সূর্যের উদয় ঘটেছে। চারদিকে অন্ধকার ছাড়িয়ে আলোকিত রূপ ধারন করেছে। এক এক করে জনে জনে মানুষের ভীর বাড়ছে। জানার পাশে লুকিয়ে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে আমেনা। এহসানুল সেই জানালার কোনে গভীর মনোযোগ স্থাপন করেছে। গায়ের রং টা চাপা মেয়েটার শারীরিক গঠন স্পষ্ট বুঝতে পারলো। অসহায়ের মতো কাঁদছে পাশে কেউ নেই কাঁদার ফাঁকে মাঝে মাঝে ওকি দিচ্ছে বাইরে।এহসানুল ভাবলো “গ্রামের মেয়েরা কি এমনই সহজ সরল, অসহায় হয়??মেয়েটা কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছে না বলেই তো কেঁদে যাচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটাকে কেউ কিছু বলতে দিচ্ছে না কেনো??এ গ্রামের মানুষজন কেনো এতো অদ্ভুত”।
.
আমেনার চোখের পানি আর অসহায় মায়াবি মুখ দেখে গভীর মায়ায় জরিয়ে যেতে লাগলো এহসানুল।
চারদিকে মানুষ জন তাঁকে ঘিরে রেখেছে সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। সে সরু দৃষ্টি তে জানালার কোনে চেয়ে আছে। যার ফলে গ্রামের মানুষ বলতে শুরু করেছে,,,” বাবাগো প্রেম বেঁধে রাখছে সেদিকে খেয়াল নেই। নজর আমেনার দিকে কেমন মায়া মাখানো নজরে দেখছে। এমন রাজপুএের মতো ছেলে টারে বেঁধে রাখছে কেনো আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো হয়”এমন পাএ কি নিজেরা জোগার করতে পারবো বিয়ে দিয়া দিক গা।

সবার কথা শুনে জসিম ভ্রু কুঁচকে তাকালো এহসানুলের দিকে। সত্যি এহসানুল আমেনার দিকে চেয়ে আছে৷ জসিম কাছে গিয়ে এহসানুলের কাঁধে হালকা ধাক্কা দিতেই এহসানুল চমকে তাকালো জসিমের দিকে।
.
শালিশ শুরু হলো দশটায়,,, আমেনার দাদা হুংকার দিলেন তাঁর নাতনীকে ফাঁসানো হয়েছে। তাই তাঁর নাতনীকে তাঁরা ঘরেই যা শাস্তি দেওয়ার দিবে।
মাতব্বর রা ছেলের শাস্তি বিধান দিতে যাবে তখনি এহসানুল হুট করে বলে ওঠলো। আমি আমেনা খাতুন কে বিয়ে করতে চাই। তাঁর কথা শুনে সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। শহড়ের ছেলে গ্রামের মেয়ে তবুও আমেনা কে বিয়ে করতে চাইবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। স্বয়ং আমেনাও না। সকলেই ভেবেছিলো শহড়ের ছেলে কয়েকদিনের জন্য সময় কাটাতে সম্পর্ক করেছে। আমেনাকে বোকা বানিয়েছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here