আমার_মনপাখি পর্ব – ১৪

0
2655

আমার_মনপাখি পর্ব – ১৪
#পলি_আনান

রাইফা লোকটির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে অনুষ্ঠানে পৌছে যায়।বাড়ির চারিদিকে গান চলছে।মানুষের কোলাহল। পুরো বাড়ি মুখর হয়ে আছে।রাইফা রাইসাকে খুজছে।তার গলা শুখিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে এখনি নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দেবে।এই মুহূর্তে রাইফার মনে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ।নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে সামনে থাকা চেয়াটিতে বসে পড়ে রাইফা।ক্লান্ত শরীর চোখ নিয়ে রাইসাকে খুজে যাচ্ছে রাইফা।শরীরটার ভর আর নিজের মধ্যে সামলে রাখতে পারছে না সে।ক্লান্ত শরীরটা অজানা কারো কাধের উপর ভর ছেড়ে দেয়।রাইফার ক্লান্ত শরীরটাকে কেউ সযত্নে আকড়ে ধরে।রাইফার চোখগুলো বারবার বন্ধ হয়ে আসছে তবুও কার বাহুডোরে সে আছে তা দেখার জন্য চোখ গুলো অনেক কষ্টে খোলার চেষ্টা করছে।তার চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে।কানে আসছে পরিচিত কারো শব্দ।যে তাকে পাগলের মতো ডেকে যাচ্ছে।তবু্ও রাইফার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।নিজের ঝাপসা চোখে সেই পরিচিত মানুষটিকে দেখে ,নিজের শরীরের সমপূন্ন ভার ছাড়ার আগে রাইফা বিড়বিড় করে বলে,
_ আ….হা…দ,, ভা..ই, আ….মি,, বা…সায় যা
..ব।

???

রাত ৯ টা।পুরো বাড়ি নিরিবিলি। চৌধুরী বাড়ি আর মির্জা বাড়ির সদস্যরা এখনো খান বাড়িতে।আহাদ রাইফার রুমে রাইফার পাশে বসে আছে।ঘুমন্ত রাইফার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।
বিয়ে বাড়িতে আহাদ রাইফাকে দেখে খুব বিদস্ত অবস্থায়।তার আগের সাজ আর পরের সাজের মিল খুজে পায়না আহাদ।তাকে দেখে মনে হয় এখনি সেন্সলেস হয়ে যাবে তাই তাড়াতাড়ি রাইফার পাশে গিয়ে বসে পড়ে।রাইফাকে পাগলের মতো ডাকতে থাকে। আর সে সময় রাইফা সেন্সলেস হয়ে যায়।তাকে বাসায় আনার সময় শিহাব আর রাইসা আহাদের সাথে আসতে চেয়ে ছিল।কিন্তু আহাদ তাদের বারন করে না আসতে।আর কাউকে বিষয় টা না জানাতে বলে।রাইফাকে বাড়ি এনে রাইফার রুমে শুইয়ে দেয় আহাদ।তার মনে জন্ম নিয়েছে হাজার প্রশ্ন।রাইফার এ অবস্থা কি করে হলো।তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে ভিষণ ভয় পেয়েছে।অনেক্ষন কেদেছে।আহাদের সকল প্রশ্নের উওর পাবে রাইফার সেন্স আসার পর। আহাদ রাইফার পাশে বসে তার হাত দুটো আকড়ে ধরে।রাইফার হাতে সযত্নে কিস দিয়ে বলে,

_ এভাবে কাছে তোমায় সারাজীবনের জন্য চাই।যদি তুমি আমার মনের ভাষা বুঝতে তবে এই জিবনে চাওয়ার আর কিছুই থাকতো না।

আহাদ রাইফার পাশ থেকে উঠে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ায়।পুরো কালো আকাশ টায় একটি মায়াবি চাঁদ ফুটে আছে।কিছু তারা জ্বলজ্বল করছে।চাঁদের আলোয় চারপাশ মনমুগ্ধ কর লাগছে।আহাদ ভাবতে থাকে এই মূহুর্তটা অন্য রকম হতে পারত তার পাশে রাইফা থাকতো।দুজনে মিলে চন্দ্রবিলাশ করতো।কিন্তু রাইফা তার কাছে আছে তবে ঘুমন্ত।আবেগ প্রকাশের নেই কোন সুযোগ।নেই কোন ভালোবাসি বলার মূহুর্ত।রাইফা নাইবা ভালোবাসলো তবে নিজের ইচ্ছার মূহুর্তটা তো পূরন করতে পারে আহাদ।তাই সে রাইফার রুমে গিয়ে জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেয়। রুমের লাইট টা অফ করে দেয়।চাঁদের আলোয় রাইফার মুখখানা আরো মায়াবী লাগছে।আহাদ রাইফার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

_ নাই বা পাশে বসে চাঁদ দেখলাম।ঘুমন্ত তোমার চেহারায় মায়াবী চাঁদের আলোর এই মোহময় মূহুর্তের ভালোবাসার অপেক্ষায় রইলাম আবার।

????

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠনে বিভিন্ন বয়সের ছেলে মেয়েরা নাচ করছে।রাইসা ক্ষনে ক্ষনে ফোপাচ্ছে। সে যেন এই মুহূর্তে কেদে দিবে।কিছুক্ষন আগেও কেদে কেদে চোখ ভাসিয়েছে।শিহাব তাকে কিছুতেই শান্ত করতে পাচ্ছে না।শিহাব রাইসার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
_ প্লিজ তুমি কেদো না,আমার দোহায় লাগে।তোমার কান্না দেখে আমার ও কান্না পাচ্ছে।

শিহাবের কথা শুনে রাইফা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রাইসার তাকানোর ভাব দেখে শিহাব বলে,

_কি হলো এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো।তুমি কেদোনা প্লিজ।আর কতো কাদবে আমি আহাদের সাথে কথা বলেছিতো।রাইফা একদম ঠিক আছে তুমি যদি এভাবে কাদো তবে সবাই সন্দেহ করবে।এবারের মতো থামো প্লিজ।

রাইসা শিহাবের কথা শুনে থেমে যায়।এবার শিহাব রাইসাকে অবাক করে দিয়ে রাইসারএলো মেলো চুলগুলো ঠিক করে আর বলে,

_দেখেছো কেদে কেদে মুখটা কেমন করেছো। পুরো পেত্নি লাগছে। কতো সুন্দ্র চুল গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।দাঁড়াও আমি ঠিক করে দেই।

শিহাব সযত্নে রাইসার চুল, ঠিক করে দেয়।আর রাইফা অবাক হয়ে শিহাবের কান্ড দেখছে।রাইসার চাহনি দেখে শিহাব মুচকি মুচকি হাসছে।

????

_ তুমি কি আমাকে সত্যেটা বলবে।নাকি আমি সত্যেটা খুজে বের করবো।(শান্ত ভাবে রাইফার চোখের দিকে তাকিয়ে আহাদ)।

আহাদের কথা শুনে রাইফা ভয়ে একবার ঢোক গিলে। সে বুঝতে পারছে তার আজ আর রক্ষে নেই।সে আহাদের খবর জানে, একবার কোন বিষয়ে সন্দেহ হলে তা খুটিয়ে খুটিয়ে বের করে ছাড়বে।তবুও নিজেকে বাচাতে অভিনয় করে রাইফা বলে,
_ আ…..আমার কি হবে আহাদ ভাই। আমি একদম ঠিক আছি।
_ না,, তুমি ঠিক ছিলেনা তখন।তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল তুমি কোন কারনে ভয় পেয়েছিলে।।

রাইফার কান দিয়ে এবার গরম ধৌয়া বের হচ্ছে।কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে।বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে।সেই শব্দ পুরো রুমজুড়ে তাল মেলাচ্ছে। এলোমেলো লাগছে তার সবকিছু। বলতে গিয়েও বলতে পারছে না কোন কথা। মাছের কাঁটার মতো কথাগুলো তার গলায় বিধছে। রাইফার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন সে আহাদকে তার পাশে দেখতে পায়।পুরো বাড়ি এখনো নিস্তব্ধ। কেউ এখনো বাসায় ফিরেনি। কিচ্ছুক্ষণ পর আহাদ রাইফাকে জেরা করা শুরু করে,তারপর থেকেই বেচারির অবস্থা ভয়ে করুন।

_ তোমার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছেনা কেনা। আমি এত বার প্রশ্ন করছি ।(ধমক দিয়ে আহাদ)
_ আ…..মি….. আ…..মি।
_ কি আমি আমি করছো তখন থেকে।,তুমি যদি সত্যে টা না বলো তবে আমি এখনি বিয়ে বাড়ি থেকে সবাইকে খবর দিয়ে আনবো।এখন বাজে রাত ১০.২০। তারা আসতে আসতে ১২.৩০ তো বাজবেই।আমি যদি এখন খবর দি তবে তুমি ঠিক করেই বুঝতে পারছো কি হবে।

আহাদের কথাগুলো রাইফার জন্য একেক টা আগুনের ফুলকির মতো লেগছে।তার পুরো শরীর জ্বলে উঠে আহাদের কথা শুনে।নিজেকে বাচাতে উপায় খুঁজে পাচ্ছেনা সে।বিপদের সময় মনে হয় কোন বুদ্ধি মাথায় আসেনা।সব এলোমেলো লাগে,কথা বলার ভাষা গুলো ও হারিয়ে যাচ্ছে।কোন কথা থেকে কোন কথা সাজাবে ভেবে পাচ্ছেনা।ঘামে তার পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে।আহাদ রাইফার দিকে সুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মনে হচ্ছে সে বরশিতে মাছ ধরছে। মাছের দিকে সে তাকিয়ে আছে টোপ ফেলে ধরার উদ্দেশ্য।

_ কি হলো বলবে নাকি আমি সবাই কে খবর দিয়ে আনাবো।তখন মুখথেকে ঠিকিই সব কথা বের হবে।(রাইফার দিকে এগোতে এগোতে)
_ আ……আসলে আমি যখন ওয়াশরুমে যাই তখন কেউ আমার সাথে অশভ্যতা করা চেষ্টা করে আর আমি পালিয়ে আসি।বাকিটা আমার আর মনে নেই।

রাইফার কথা শেষ হয়ে দেরি হলো কিন্তু তার গালে চড় পরতে দেরি হলো না।আহাদের চোখ গুলো ভিষণ লাল হয়ে গেছে।কপালের রগ ভেসে উঠেছে। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে আছে।রাগে তার পুরো শরীর কাপছে।আর রাইফা চড় খেয়ে কিছুদূর ছিটকে যায়।সে ফ্যালফ্যাল করে আহাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না তার সাথে কি ঘটে গেল।যখন বুঝলো তখন হাটু মুড়ি দিয়ে কান্না শুরু করে।আহাদের রাগ কিছুতেই কমছে না। সে রাইফাকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে চিল্লিয়ে বলে,

_ তোমায় আমি বলেছিলাম না এমন করে সেজে তুমি বাড়ির বাইরে যাবেনা কিন্তু তুমি কি করলে আমি বারন করা স্বর্তেও নাচতে নাচতে চলে গেলে কেন এখন ভালোলাগছে না। এখন ভয় পেলে কেন আর কাদছোই বা কেন।(রাইফার কান্না মাখা চোখের দিকে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলে আহাদ)

আহাদ রাইফার সামনে থেকে সরে গিয়ে সামনের টেবিল থেকে একটা ফুলদানি নিয়ে নিচে আছাড় মারে।ভাঙ্গার শব্দে রাইফার পুরো শরীর কেপে উঠে।আহাদ আরেকটা ফুলদানি হাতে নিতেই রাইফা গিয়ে আহাদের বুকে ঝাপিয়ে পরে। আর আহাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকে।রাইফা বুঝতে পারে আহাদের রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে হয়ে গেছে তাই সে ছোট বেলার মতো আহাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
রাইফা তাকে জড়িয়ে ধরার কয়েক সেকেন্ড সে স্তব্ধ হয়ে যায়।যখন বুঝতে পারে রাইফা তাকে জড়িয়ে ধরেছে তখন ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ভেসে উঠে।আহাদ মনে মনে বলে,

_ছোট বেলার কথা তোমার এখনো মনে আছে।আমি যখনি রেগে যেতাম তুমি তখনি আমায় জড়িয়ে ধরতে।আর তখনি আমার রাগ পানি হয়ে যেত।
কিছুক্ষণ পর রাইফা আহাদকে ছেড়ে দেয়।আর আহার রাইফাকে ঔষুধ এনে খাইয়ে দেয়।এভাবে কেটে যায় আরো কিছু মূহুর্ত।

????
সকাল ৭ টায় ঘুম ভেঙ্গে যায় রাইফার।বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে খেয়াল করে তার পেটে কোমড়ে ক্ষত স্থানে কোন ব্যাথা নেই। রাইফা আনমনে বলে,
_এটা কি হলো কাল যখন আহাদ ভাইয়ের সাথে কথা বললাম তখনো ক্ষত স্থানে ব্যাথা ছিল তাহলে এখন ব্যাথা নেই কেন।

রাইফা নিজের কোমড়ে পেটে হাত দিয়ে চমকে যায়।না কোন ব্যাথা নেই। তাহলে ব্যাথা সেরে গেল কেমনে। রাইফা এইসব ভাবতে ভাবতে বালিশের পাশ থেকে ফোন নিতে যায়। সে দেখে ফোনের নিচে একটা কাগজ। কাগজ টা খুলে দেখে লেখা আছে,

“আমি জানি কাল আমি তোমাকে বেশি আঘাত করেছি।কিন্তু কি করবো বলো। তোমার আচরন দেখে আমার মাথায় আগুন লেগেযায়।তাই একটু ব্যাথা দিয়েছি।যদি ভবিষ্যতে আবার এমন করো তবে আরো ভয়ংকর কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করবে।আর ক্ষত স্থানে আমি মলম লাগিয়ে দিয়েছি।আশা করি ব্যাথা কমে যাবে।ভালো থেকো মনপাখি।”

রাইফা লেখা গুলো পড়েই কাগজটা কুচিকুচি করে ডাস্টবিনে ফেলে আর বলে,
_ বদমাইশ লোক তুই একটা নেকড়ে কোন ছেলে। এতো বড়ো নখ রাখে। তোর হাতে এতো বড় নখ থাকে কেন।তোর জীবনে বিয়ে হবেনা অভিশাপ দিলাম।

লেপটপের স্কিৃনের দিকে তাকিয়ে অচেনা লোকটি রাইফার কান্ড দেখে হাসতে হাসতে বলে,

_তোমার কারনে নেকড়ে আর পিচাশ ও হতে পারি।যদি তুমি বলো বিড়ালের মত থাকবো তবুও আমার তোমাকে পেলেই হবে।(বাকা হাসি দিয়ে)

???
সকাল ৯ টা।যানজটে আটকে আছে রাইফা। তার গর্ন্তব্য ভার্সিটি।আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে তাই সে যাচ্ছে। তা না হলে অনিকের থেকে বাচতে সে কিছুতেই সে ভার্সিটি তে যেত না। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস্টাও মিস দেয়া যায় না।বাসয় আজ তাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছে। সবাই যানতে চেয়েছে কেন সে কাল এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছে।সবাইকে সে বলেছে তার হঠাৎ জ্বর হয় তাই চলে এসেছে। অবশ্য বাড়ির সবাইকে মেনেজ করতে রাইসা তাকে হেল্প করেছে।

রাইসা দোয়া পড়তে পড়তে ভার্সিটিতে ডুকে। যেন অনিকের সাথে না দেখা হয়,কিন্তু সে গেটে ডুকেই যা দেখে তা দেখে ভয়ে একবার ডোক গিলে।

চলবে……

(ভুলগুলো ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here