ডেভিলস গার্ল,শেষ ৬ষ্ঠ পর্ব
Tasmima Yeasmin
একটা মেয়ের এত পরিবর্তন এত দ্রুত কিভাবে সম্ভব সেই ব্যাখ্যা হাসিবের মাথায় কিছুতেই আসলো না। তার চোখের সামনে দিয়ে নীলা, নীলার বাবা, রুহি আর সেই মেয়েটা ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। রুহি এখানে কিভাবে এলো এতদূরে একা একা। সবকিছু হাসিবের কাছে কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হাসিব একটু দূরে গিয়ে একটা মোটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। চাঁদের আবছা আলোয় বনের ভিতরে একটা মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। হাসিব সবকিছুর হিসেব মেলাতে চাইছে। ও বুঝতে পারছেনা এখন ঠিক কি করা উচিত। পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেলো। চমকে পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলো নীলা দাড়িয়ে আছে। নিষ্প্রান মুখে ঘোর লাগা দৃষ্টি। হাসিব একদৃষ্টিতে নীলার চোখের পানে তাকিয়ে আছে। চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারছে না। নীলাই বলতে শুরু করে আমি সত্যিই কখনো ভাবিনি তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে। অথচ দেখ আমাদের দেখা হয়ে গেলে। আমার কোথাও যেন একটু বিশ্বাস ছিলো তুমি আসবে।
হাসিব কাপাঁকাপাঁ কন্ঠে বললো তুমি বেঁচে আছো নীলা?
-মরে তো সেই কবেই গেছি। এখন আছি শুধু মৃতলাশ হয়ে। কি করবো বলো নিয়তির লিখন না যায় খন্ডন।
তোমরা আবার নিয়তিতেও বিশ্বাস করো নাকি। নিয়তি তো তোমাদের হাতে। হাসিব অবজ্ঞার সুরে বললো।
-তুমি এভাবে কথা বলছো কেন হাসিব?
তো কিভাবে কথা আশা করো। তুমি কি জানো এ ছয়টা বছর কিভাবে গিয়েছে আমার। কেন করলে আমার সাথে এরকম নীলা। তোমার আর তোমার পরিবারের কি ক্ষতি করেছিলাম। তোমাকে তো আমি সত্যিই ভালোবেসেছিলাম নীলা। কেন আমার জীবনটা এভাবে এলোমেলো করে দিলে। তোমার কি একবার জানতেও ইচ্ছে করেনি আমি কেমন আছি। হাসিব এবার বাচ্চাদের মত কাঁদতে শুরু করলো।
-বেচেঁ থাকলে তোমার খবর নিতাম আমি। নীলার মুখে ম্লান হাসি।
তার মানে? আর কোন নাটক নয় নীলা। দিব্যি এখানে ভালো আছো। নিজেদের স্বার্থে ছোট ছোট বাচ্চা ধরে এনে বলি দিচ্ছ। আর কি চাই।
-নাটক করছি না হাসিব। তোমার অজান্তে অনেক কিছুই ঘটে গেছে যা তুমি জানোনা। যার জন্যই আমাকে ভুল বুঝছো। তবে আজ আমি তোমাকে সত্যি বলবো।
ঠিক ছয়টা বছর আগের কথা। কোন একটা সমস্যার কারনে আমরা নিঃসন্তান ছিলাম। আশেপাশের বাচ্চাগুলো যখন তাদের মাকে মা বলে ডাকতো আমার বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠতো। আর যখন তুমি সেদিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আমাকে শান্তনা দিতে তখন ভিতরটা পুড়ে উঠতো। তাই তোমাকে না জানিয়েই শুধু একটা সন্তানের আশায় আমি ব্লাক ম্যাজিক শুরু করি। শয়তানের উপাসনা করার জন্যই তখন ঘনঘন বাবার বাড়ি যেতাম। সন্তানের মোহে এতটা অন্ধ ছিলাম যে এর শেষে কি হবে আমার মাথাতেই আসেনি। শয়তান আগে আমার প্রান চাইলো। তবে তারপর আবার আমার আত্মা আমার দেহেই ফিরে আসবে। মাঝপথে আমার ফিরে আসাও সম্ভব ছিলনা। তাই সবকিছু যখন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম তখন আত্মহত্যা করে ফেললাম। এরপর বাবা কিভাবে কিভাবে যেন আমাকে বাচিয়ে দিলেন তার জন্য শিলা আর মাকেও প্রান দিতে হলো। তুমি আমার আত্মহত্যার কথা শুনে চলে গেলে আর আমি বাবার বেড়াজালে বন্দি হয়ে গেলাম। শয়তানের সন্তান জন্ম দিলাম। লিনা হল শয়তানের মেয়ে।
কাল রাতে যে মেয়েটেকে দেখেছিলাম? হাসিব জানতে চাইলো।
-হ্যাঁ।
তাহলে রুহি এখানে কিভাবে এলো?
-লিনাই ওকে নিয়ে এসেছে। কাল পূর্নিমা রাত। কাল ওকে বলি দেবে। ওর আগেও বারো জনকে বলি দেওয়া হয়েছে। ওকে বলি দিলে বাবা হবে অমর আর লিনা পাবে শয়তানি ক্ষমতা।
রুহি এখান থেকে যেতে চায়না?
-কিভাবে চাইবে। ওতো মায়াজালে বন্দী।
তুমি তোমার মা এখান থেকে চলে যেতে পারোনা।
আমরা যে আবছায়া। বাবার মন্ত্রের বেড়াজালে বন্দী। নীলার গলা ধরে এলো।
হাসিব এবার আমি আসি। কাল তোমার অনেক কিছু করতে হবে। আমি তোমাকে সব বলে দিবো। বাবার ধ্যানের সময় শেষ। নীলা যেন বাতাসে ভেসেভেসে চলে গেল। হাসিবের বুকচিরে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। সেইরাত হাসিব আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলো। কল্পনায় ছিলো নীলার কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি। কয়েকবার চোখের জল বেরহলেও মুছবার চেষ্টা করেনি একবারও।
.
.
.
সকাল হতে না হতেই পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনতে পেল। বেশ কিছুক্ষন পর পা টিপে টিপে কুটিরের পেছন দিকে গেল। বোধহয় ভিতরে দুইটা ভাগ। দুইপাশে ছোট দুইটা জানালা। হাসিব একটা জানালা দিয়ে উকিঁ দিলো। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভিতরটা ফাকাঁ। তারপর পাশের জানালাটায় উকিঁ দিলো। একটা শয়তানের মূর্তির সামনে নীলার বাবা আর দুই রুহি ধ্যানে মগ্ন। এই রুহিকেও আজকে বলি দিবে। তার আগে হাসিবের রুহিকে বাচাঁতে হবে। কিন্তু কিভাবে বাচাঁবে। আর কিভাবে বুঝবে আসল রুহি কোনটা। দুজনের তো একই চেহারা।
হাসিব একটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়। আস্তে আস্তে কুটিরটার পাশ থেকে সরে আসে। পায়ের কাছে একটা দলাপাকানো কাগজ পায়। হাসিব কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করে। সেখানে লেখা,
হাসিব যা করবে আজ সন্ধ্যার আগেই করতে হবে। বিকেলে বাবা ধ্যানে বসবেন। তখন কৌশলে তার গলা থেকে তাবিজটা খুলে নিবে। সামনেই একটা তলোয়ার রাখা থাকবে। সেটা দিয়ে আঘাত করলেই বাবা মারা যাবেন। এরপর বাবার ঝোলার মধ্যে বড় একটা শিশিতে কিছু তরল পাবে। সেটা লিনার গায়ে ছিটিয়ে দিবে। শেষ বিকেলে লিনার কোন শক্তি থাকেনা তাই কাজটা তখনি করতে হবে। এরপর কুটির থেকে একটু দূরে চারধারে চারটা তুলসি গাছ আছে সেগুলো উপড়ে ফেলবে। তাহলে আমাদের আত্মা মুক্তি পাবে। রুহিকে নিয়ে তুমি চলে যাবে। নতুন করে সবকিছু শুরু করবে। শুভকামনা রইলো।
নীলা।
ব্যাস। হাসিব বুঝে গেছে ওর কি করতে হবে। কিন্তু নীলা সামনাসামনি না এসে এভাবে লিখলো কেন। যাইহোক কাজগুলো ঠিকমত করতে হবে। একদম সহজও না আবার একদম কঠিনও না। রুহিকে উদ্ধার করার একটা উপায় তো পেয়ে গেছে। এই ঢের।
.
.
.
হাসিব বিকেল নাগাদ জানালা দিয়ে উকিঁ দিয়ে দেখলো ঘরে নীলার বাবা একা একা একটা মূর্তির সামনে বসে জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছে। হাসিব আলতো পায়ে ঘরে ঢুকলো। নীলার বাবার সামনে বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে একটা তরবারিও রাখা আছে। হাসিব তরবারিটা তুলে নেয়। নীলার বাবার তাবিজে লাগানো সুতলিটা পিছন থেকে কাটার চেষ্টা করে। কিন্তু কাছেই নিতে পারছেনা। চুম্বকের বিপরীত প্রান্তের মত একটা শক্তি কাজ করছে। হাসিব ঘরের আশেপাশে তাকিয়ে একটা ছোট ছুরি দেখতে পায়। সেটা এনে সুতো কেটে দিতেই টুপ করে তাবিজটা তার কোলের উপর পড়ে। সাথেসাথেই নীলার বাবা চোখ খুললেন। কিন্তু তাবিজটা আবার পড়ার আগেই তার বুক বরাবর তরবারিটা ঢুকিয়ে দেয় হাসিব। মুখে একটা ক্রুর হাসি এনে বলে এবার নরকে গিয়েই তবে তুমি অমর হও। তাকের উপর একটা বড় ব্যাগ দেখতে পেয়ে সেটা খুলে দেখে ভিতরে একটা বড় শিশি। শিশিটা পকেটে পুরে নেয়।
এবার পাশের কামরাটায় এসে দেখে লিনা আর রুহিও ধ্যানে মগ্ন। কিন্তু কোনটা লিনা। ভালোভাবে দুজনের দিকে তাকায়। কপালে তিলকের হালকা চিহ্ন দেখেই বুঝে যায় কোনটা লিনা। তরলের শিশিটা খুলে পুরোটাই লিনার মাথায় ঢেলে দেয়। লীনার বিকট চিৎকারে রুহি একদৌড়ে হাসিবের কাছে এসে দাড়ায়। লিনার দেহ ক্রমশ ধূসর আর বিকৃত হতে থাকে। কুড়েঘরটাও ধসে পড়ে। হাসিব রুহিকে নিয়ে বাইরে আসে। কুড়েঘরটায় আগুন জ্বলে উঠে সেইসাথে গোঙানির শব্দ। রুহি ভয় পেয়ে হাসিবের শার্টের কোনা শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে থাকে। হাসিব যেন সেই আগুনের ভিতর স্পষ্ট দেখতে পায় নীলাকে। বুকের পাশে চিনচিনিয়ে একটা ব্যাথা ওঠে। চারদিক খুঁজে চারটা তুলসি গাছ তুলে নদীতে ফেলে দেয়। কুলে রাখা ছোট নৌকাটার সাহায্যে নদী পার হয়। রুহির মুখে একটাই প্রশ্ন আমি এখানে কিভাবে এলাম। নদী পার হতে হতেই রাতের আধাঁর নেমে আসে। হাসিব অন্ধকারেও রুহির হাত ধরে হাটতে থাকে। রুহিকে বাচাঁনোর জন্য ভালোলাগা আর নীলাকে হারানোর জন্য খারাপলাগা এই দুইয়ে মিলে ওর অনুভূতি শূণ্য। গ্রামটাতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুর । হাসিব প্রথমেই চায়ের দোকানীর সাথে দেখা করে। তিনি হাসিবকে দেখে প্রচুর খুশি হয়। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। বাসে উঠে আবিদকে ফোনে জানিয়ে দিলো যে রুহি তার সাথে নিরাপদেই আছে আর রুহিকে নিয়ে সে আসছে। বাস চলছে শহরের দিক। রুহি ঘুমের মাঝেই মাথাটা হাসিবের বুকে এলিয়ে দিয়েছে। বাসের জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় রুহির ঠৌঁটটা দেখাচ্ছে একদম কাঁচা হলুদ রঙের!
সমাপ্ত