দ্বিতীয় স্ত্রী,চতুর্থ পর্ব

0
4463

দ্বিতীয় স্ত্রী,চতুর্থ পর্ব
লেখাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।

সবার সামনেই চোখের পলকে ওঝার দুই গালে বিশটা থাপ্পড় মেরে আবার খাটে গিয়ে বসে পড়লো নুপুর। ফ্লোরে পড়ে ওঝা বিলাপ করতে লাগলো, ‘ ও বাবা, বাবাগো, শরীরে সারাজীবনের সঞ্চিত ভিটামিন থাপ্পড় খেয়ে ভেগে গেল নাকি। উঠে দাড়ানোর মতো শক্তিটুকুও পাচ্ছিনা শরীরে, মাথা ঝিমঝিম করছে, ভো-ভো করছে, কানেও ঠিকঠাক সিগন্যাল পাচ্ছিনা, পর্দায় ফাটল ধরলো না তো আবার।’

হিমেল ওঝাকে টেনে তুলে বললো, ‘ আহ একটু শান্ত হোন এবার।’

ওঝা মৃদু আর্তনাদের সুরে বললো, ‘ এত ধোলাই খাবার পরে কেউ কি অশান্ত থাকতে পারে, শান্ত মানে, মনে হচ্ছে একেবারে সর্ব শান্ত হয়ে গেছিরে।’

বাবা বললো, ‘ আচ্ছা, একটু বিশ্রাম নিয়ে আপনি চলে যান তবে।’

ওঝা বললো, ‘ বিশ্রাম বাড়ি গিয়ে নেবো, ভূতের আগে আমাকেই এলাকা ছাড়তে হবে, নইলে বিপদ। আর একটা কথা, রাতের বেলায় নুপুরকে কিছুতেই রুমে একলা রাখা যাবেনা, তাবেই সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। এই ভূত যার ঘাড়ে চাপে, তাকে প্রাণে না মেরে যায়না। সুতরাং সাবধান।’

ওঝা চলে গেল।

সকলে মিলে হিমেলকে বললো এই অবস্থায় নুপুরের সাথে থাকতে।

হিমেলের অবস্থা টাইট, যাকে স্ত্রী হিসেবে মানতেই পারেনি তার জন্যই যন্ত্রণায় আছে খুব, তার ওপর আবার নুপুরের কাঁধে ভূত চেপেছে। আগে ছিল নুপুর একা, এখন আবার সঙ্গে ভূত জুটেছে! এক যন্ত্রণার সাথে আরেকটা ফ্রী।

দাদী হিমেলকে বললো, ‘ তুই আর অমত করিস না হিমেল, আমদের একটু অবহেলা নুপুরের মৃত্যুর কারণ না হয়।’

হিমেল বললো, ‘ মরে মরুক, মরলেই বাচিঁ।’

বাবা হিমেলকে ধমক দিয়ে বললো, ‘ অসভ্যতার একটা সীমা থাকা দরকার, তুমি মানতে পারো আর না পারো, মনে রেখো সে তোমার বর্তমান স্ত্রী, বিপদে আপদে তার পাশে থাকা তোমার একান্ত কর্তব্য।’

এই অবস্থায় নুপুরের সাথে থাকতে মন থেকে আপত্তি নেই হিমেলের, সমস্যা হলো ভূত নিয়ে। ভূতের ভয় খুব হিমেলের, কিন্তু প্রেস্টিজ পাংচার হবার ভয়ে কারো সামনে প্রকাশ করতে পারছে না।

অবশেষে সকলের কথায় বাধ্য হয়ে রুমে এসে ঢুকলো হিমেল। দরজা খোলা রেখে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দরজার পাশে।

খাটে বসে নুপুর শান্ত মেজাজে বললো, ‘ ওখানে দাড়িয়ে আছেন কেন, দরজা’ই বা কেন খোলা রেখেছেন।’

: ইয়ে মানে সুরক্ষার জন্য।

: দরজা বন্ধ করে সুরক্ষা হয় জানতাম, খোলা রেখে সুরক্ষা হয় এই প্রথম শুনলাম।

: না মানে, ও যদি এসে পড়ে।

: ও মানে কে?

: ঐ যে তোমার সঙ্গী।

: আমার সঙ্গী তো আপনি, জীবন সঙ্গী।

: আচ্ছা একটা বুঝলে হয়।

নুপুর উঠে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো, তাই দেখে হিমেলের অবস্থা টাইট। নুপুর আবার গিয়ে খাটে বসে হিমেলকে ডাকলো খাটে গিয়ে বসার জন্য। হিমেল মূর্তির মতো অনড় অবস্থায় দাড়িয়ে।

এবার হঠাৎ করে নুপুর সেই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর কণ্ঠে হিমেলকে বললো, ‘ কি ব্যাপার, ভালোয় ভালোয় ডাকছি বলে কানে যাচ্ছেনা।’

এইরে নুপুরের ঘাড়ের ভূত ক্ষেপে যাচ্ছে মনে হয়। হিমেল লক্ষী ছেলের মতো চুপচাপ গিয়ে খাটে নুপুরের পাশে বসলো।

নুপুর বললো, ‘ বলেন আমি আপনার কি হই?’

হিমেল আমতা আমতা করে বললো, ‘ আআ আমার স্ত্রী।’

নুপুর বললো, ‘ ঠিক আছে তাহলে এবার গুনে গুনে শতবার বলুন তুমি আমার স্ত্রী।’

এই অবস্থায় কথা বাড়ালে সেটা ভূতের ধোলাই খেয়ে শারীরিক ব্যথায় পরিনত হবে ভেবে, হিমেল নুপুরের কথা অনুযায়ী বলতে লাগলো।

হিমেলের বলা শেষে নুপুর বললো, ‘ এবার স্ত্রী হিসেবে আমার কপালে একটা চুমু দিন।

প্রাণের ভয়ে হিমেল নুপুরের কপালে চুমু দিলো।

নুপুরের চোখের কোণে জল টলমল করে উঠলো। কোনো চাপে পড়ে নয়, এই চুমুটা যদি হিমেল স্ত্রী হিসেবে ভালোবেসে দিতো, তবে এর চেয়ে বড়ো পাওয়া, অধিক সুখের আর কি হতো।

শুয়ে পড়ে নুপুর হিমেলকে বললো, ‘ এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’

ভয়ে ভয়ে হিমেল নুপুরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো, নুপুর ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত আর হিমেলের ঘুম হলো না। ঘুম কিকরে হবে, ভূতের ভয়ে হিমেলের ঘুমের শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে যে।

সকাল সকাল উঠে হিমেল দাদীকে ডেকে নুপুরের খেয়াল রাখতে বলে কোথাও চলে গেল।

হিমেল চলে যাবার সাথে সাথেই দাদী এবং রায়হান নুপুরের রুমে হাজির।

দাদী চোখ টিপে নুপুরকে বললো, ‘ কিরে প্ল্যানটা সাকসেসফুল তো? তবে তোর ভূতে ধরার অভিনয় ফাটাফাটি ছিল কিন্তু।’

রায়হান বললো, ‘ আমার নির্দেশনা বলে কথা, ওঝার ভূমিকায় আমার বন্ধু রাতুল দারুণ অভিনয় করেছে কিন্তু, আর ভাবীর চোখের মনি সাদা দেখানোর জন্য লেন্স কিন্তু আমিই এনেছিলাম।’

ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে নুপুর বললো, ‘ সবার সবকিছু পারফেক্ট, কিন্তু একটা কথা চিরন্তন সত্য, সেটা হলো– জোর করে এবং কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। যদি এরকম চাপে ফেলে আদায় করার চেষ্টা করা হয়, সেটা বোকামি এবং মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।’

নুপুরের চোখের জল অঝোরে গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগলো।

দাদী এগিয়ে এসে নুপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, ‘ হিমেলের কথা বলতে পারিনা, তাছাড়া এই পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষ তোর ভালোবাসায় জড়িয়ে গেছি ভীষণ। একটা মানুষের অবহেলায় এতগুলো মানুষকে ভুলবিনাতো বল।’

চোখের জল মুছে নুপুর বললো, ‘ দাদী, প্রতিটি মেয়ে ঐ একটা মানুষের ভরসায় মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে নতুন এক ভুবন স্বামীর সংসারে আসে, সংসার সাজাতে, জীবনের পূর্নতা পেতে, মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত স্বামীর হাতে হাত রেখে পাশাপাশি থেকে সুখ, দুঃখ ভাগাভাগি করে চলতে। অথচ আমার বেলায় সেই মানুষটার অবহেলা। এই যন্ত্রণা বুকের ভেতরটা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে সব আশা আকাঙ্খা। তারচেয়ে ভালো নিজে নিজেই এ সংসার ছেড়ে চলে যাই। যার ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই, তার অশান্তির কারণ আমি হতে চাইনা।’

এদিকে হিমেল যাবার সময় মানিব্যাগ নিতে ভুলে গিয়েছিল বিধায় একটু পরেই আবার ফিরে এসেছিল। রুমের সামনে এসে নুপুর, দাদী, এবং রায়হানের কথাবার্তা শুনে রুমে না ঢুকে বাইরে দাড়িয়ে ছিল।

এবার সোজা রুমে ঢুকে রায়হানের গালে কষে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘ আমার সাথে সবাই নাটক করছিস তাই না, আমার জীবন, সিদ্ধান্ত আমার; এখানে অন্য কারো নাক গলাবার দরকার নেই।’

তারপর নুপুরকে হিমেল বললো, ‘ তোমাকে আগেই বলেছি এবং এতদিনে তোমার বোঝা উচিৎ ছিল যে, দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তোমাকে কেন কাউকেই আমি মানতে পারবো না, সুতরাং এবার তোমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর, চাইলে এখানে এভাবে থেকে যেতে পারো, নয়তো চলে যেতে পারো।’

নুপুর কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, ‘ যেখানে আমারই কোনো মূল্য নেই সেখানে ইচ্ছা অনিচ্ছায় কি এসে যায়! আমি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী হলেও আপনি আমার প্রথম স্বামী এবং আপনিই শেষ। আপনার সাথেই যদি সংসার না করতে পারি তবে জীবনে দ্বিতীয় বার আর ইচ্ছা নেই। জানেন খুব ইচ্ছে হয় আপনার হাতে পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে আপনার কাছে থাকার সুযোগ পেতে। কিন্তু আমি সেটা করবো না, কারণ আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা নিখুঁত এবং নির্ভেজাল, সেই ভালোবাসা চিনতে যে না পারবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ভুল। যতদিন বেঁচে আছি আপনার প্রতি আমার এই ভালোবাসা অক্ষত থাকবে হৃদয়ে। আমি তো চলেই যাবো, তবে যদি কখনো একাকিত্ব বোধ করেন আমার ঠিকানায় চলে যাবেন, আপনাকে দেবার মতো পর্যাপ্ত সময় আমার থাকবে আজীবন। আপনি না মানতে পারলেও আমি তো মেনে নিয়েছি আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে।’

হিমেল তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘ ওসবের আর দরকার হবেনা, তুমি চাইলে এখনই চলে যেতে পারো। ও হ্যাঁ, কালকে আমার প্রথম স্ত্রী নীলা এখানে আসবে; তার আগে তুমি চলে গেলেই ভালো হয়।’

হিমেলের কথা শুনে নুপুরের বুকে যন্ত্রণার ঝড় শুরু হলো, আর সেই ঝড়ের আভাস মিলছে দুচোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু জলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here