দ্বিতীয় স্ত্রী,৫ম এবং শেষ পর্ব
লেখাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া
লাগেজ হাতে বাড়ির বাইরে এসে দাড়ালো নুপুর, চোখের জল মুছে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পেছন থেকে দাদী ডেকে বললো, ‘ জানি তোকে আটকে রাখার কোনো পথ নেই, তুই চলে যাচ্ছিস তোর সাথেই চলে যাচ্ছে এই বাড়ির হাসি আনন্দ; যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস এটাই কামনা।’
হিমেল দাড়িয়ে আছে চুপচাপ, কিছু বলছে না।
নুপুর এখনও খুব ধীরে পা ফেলে এগোচ্ছে হিমেলের একটি ডাকের অপেক্ষায়, কিন্তু সেই ডাক শোনা নুপুরের ভাগ্যে নেই। একবুক যন্ত্রণা, হতাশা আর চোখের জল নিয়ে চলে গেল নুপুর। মেয়েটি এসেছিল একবুক আশা নিয়ে, ফিরলো একবুক যন্ত্রণা নিয়ে। এসেছিল দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, ফিরলো দুচোখ ভরা জল নিয়ে। হয়তো বিধাতা সুখ লেখেননি নুপুরের কপালে! কিছু জীবন দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খায়, তবুও বাঁচে একটু সুখের আশায়, সেই আশা পূর্ণতা না পেলে জীবনটা থেকে যায় যন্ত্রণাময়। নুপুরের জীবনটা হয়তো এমনই।
হিমেলের মা-বাবা, দাদী, ছোট ভাই রায়হান, সবাই যেজার রুমে চুপচাপ বসে আছে, পুরো বাড়ি জুড়ে নীরবতা। হিমেল ড্রইং রুমে এসে চেচিয়ে বললো, ‘ বাহ! যে চলে গেলে আমার পথের কাটা দূর হয়, সে চলে গেল বলে সবাই শোক পালন করছো? আমার থেকে ঐ মেয়েটা তোমাদের কাছে বেশি দামী হয়ে গেল!’
হিমেলের কথার কেউ কোনো জবাব দিলো না, সবাই আগের মতোই চুপচাপ।
মেয়েটি এসে অল্প কদিনে সবার মন জয় করে নিলো, শুধুমাত্র হিমেলের মনে ঠাই মিললো না।
একটু পরেই কলিং বেল বেজে উঠল। হিমেল দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে নীলাকে দেখে খুশীতে আত্মহারা। সবাইকে ডেকে ডেকে চেচিয়ে বললো, ‘ মা-বাবা, রায়হান, দাদী তোমরা সবাই দেখে যাও আমার নীলা ফিরে এসেছে, আমি জানতাম নীলা ফিরে আসবেই।’
কারো কোনো সাড়া নেই, সবাই আগের মতোই যে যার ঘরে চুপচাপ বসে আছে।
নীলা এগিয়ে এসে সোফায় বসে হিমেলকে বসতে বললো। হিমেল নীলার মুখোমুখি বসলো।
নীলা বললো, ‘ আচ্ছা হিমেল, যে জিনিসটা তোমার অপ্রিয়, সেটা বারবার তোমার সামনে এলে কেমন লাগবে?’
: বিরক্ত লাগবে।
: তাহলে তুমি কেন বুঝছো না আমি স্বইচ্ছায় আলাদা হয়ে যাবার কারণ এটাই যে তোমাকে আমার ভালো লাগেনা। তোমার উগ্র মেজাজ, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, গম্ভীর স্বভাব, এগুলো চুপচাপ মেনে নিয়ে চলা হয়তো একটা রোবটের পক্ষে সম্ভব, রক্তে মাংসে গড়া মানুষের পক্ষে নয়।
: এগুলো কি বলছো নীলা!
: একদম ঠিকই বলছি, তুমি কিকরে ভাবলে তোমার মতো একটা লোকের কাছ থেকে মুক্তি পাবার পরে আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। আমার মন বুঝতে পারে, স্ত্রী হিসেবে যতটুকু মূল্যায়ন করা উচিৎ, ইচ্ছা অনিচ্ছার যার কাছে দাম আছে, এমন একটা লোককে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেছি, এবং তাকে নিয়ে আমি হ্যাপি। তুমি বারবার ফোন, মেসেজ এসব করে আমাকে বিরক্ত না করলেই খুশী হবো। এবং এসব বলার জন্যই শেষবারের মতো এখানে আসা, তোমার সাথে পুনরায় সংসার করার জন্য নয়।
কথা শেষে নীলা উঠে হনহন করে হেটে চলে গেল। হিমেল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মা-বাবা, রায়হান এবং দাদি সবাই এক যায়গায় চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। একবার সকলের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে হিমেল চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল।
প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পড়েছে হিমেল, কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না। যাকে এতটা ভালোবাসলো সেই নীলার কাছে হিমেল বিরক্তিকর, উগ্র মেজাজী!
আবার এই হিমেলকে ভালোবেসে আগলে রাখবে বলে এত যন্ত্রণা সয়েও নুপুর শেষমেশ হিমেলের ভালোবাসা পেতে ব্যর্থ হয়ে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেল।
নুপুরের ভালোবাসা হিমেল এখন ভীষণ করে উপলব্ধি করতে পারছে, প্রতিটি মূহুর্তে নুপুরের সাথে করা অন্যায়ের অপরাধ বোধ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছে হিমেলের হৃদয়ে।
দুদিন হলো হিমেলের ঠিকমতো নাওয়া খাওয়া নেই, বেহাল দশা। দাদী এসে হিমেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘ অতোটাও দেরি হয়ে যায়নি, এখনও সময় আছে, চল নুপুরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।’
দাদীর কথায় আর অমত করলো না হিমেল। সকলে মিলে রওনা দিলো নুপুরের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
নুপুরের গ্রামের বাড়িতে এসে উপস্থিত সবাই, হিমেল নুপুরের মা-বাবার কাছে বললো, ‘ আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি নুপুরের সাথে, ভীষণ কষ্ট দিয়েছি, এর জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই, এবং নুপুরের কাছেও ক্ষমা চাইবো, ও যদি ক্ষমা করে তবে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়েই বাড়ি ফিরবো।’
নুপুরের মা বললো, ‘ নুপুর বাড়ির পেছনের দিকেই আছে আসুন সবাই।’
সবাই বাড়ির পেছনে আসলো, কিন্তু নুপুর কোথায়?
হিমেল প্রশ্ন করলো, ‘ কোথায় নুপুর?’
নুপুরের বাবা আঙ্গুলের ইশারা করে একটি নতুন কবর দেখিয়ে বললো, ‘ ঐ তো ঐ কবরে শুয়ে আছে।’
সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! এটা হতে পারেনা, এটা মেনে নেবার মতো নয়।
নুপুরের মা কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো, ‘ আপনাদের ওখান থেকে যেদিন চলে আসে, সেদিন গাড়িতে বসে ফোন করে অনেক কথা বলেছে নুপুর। বলেছিল দূরে কোথায় চলে যাবে, হারিয়ে যাবে অজানায়। এর কয়েক ঘন্টা পরে কেউ ফোন করে সড়ক দুর্ঘটনায় নুপুরের মৃত্যুর কথা জানায়। মেয়েটা আমার ঠিকই হারিয়ে গেল দূর হতে দূরে, তুই অপেক্ষায় থাক মা, দেখা হবে পরপারে।’
সবার চোখ জলে টলমল করে উঠলো, কান্নায় ভেঙে পড়লো সবাই।
এই প্রথমবার হিমেলের চোখে জল দেখলো সবাই, হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দৌড়ে গিয়ে নুপুরের কবরের পাশে বসে বিলাপ করতে লাগলো, ‘ আমার ভুল হয়ে গেছে নুপুর, আমাকে ক্ষমা করে দাও, ফিরে আসো নুপুর আর একটি বার সুযোগ দাও।’
সমাপ্ত