আপনিতে ব্যস্ত,পর্ব-১

0
3265

আপনিতে ব্যস্ত,পর্ব-১
Write : Sabbir Ahmed

রেলস্টেশনে একা বসে আছি। রাত অনেক হয়েছে স্টেশন ফাঁকা। স্টেশনের বড় বাবু কাউন্টার লক করে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে একবার আমার দিকে তাকালেন পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।
,,
আমার হাতে একটা ফাইল, তাতে ১৭ বছরের লেখাপড়ার কিছু সার্টিফিকেট। কিন্তু নাহহ এখন এগুলো কাগজ মনে হচ্ছে। ভাবছি স্টেশনে ফেলে রেখে চলে যাবো। রেখে গেলেও সমস্যা কোনো সহৃদয় ব্যক্তি কাগজ গুলো পেলে ঠিকই আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
তাহলে এগুলোকে পুড়িয়ে ফেলবো?
মনে মধ্যে কতটা ক্ষোভ থাকলে এমন কথা মাথায় আসে। পাঁচ বছর হলো লেখাপড়া শেষ করেছি এখন পর্যন্ত একটা ভালো চাকরি কপালে জুটেনি।
,,
আপ্রাণ চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারছিলাম না। আজও একটা পরীক্ষা ছিলো সেটা ফেইল মেরে স্টেশনে এসে বসে আছি। বাড়িতে মা আর দুটো বোন আছে, পুরো সংসারের খরচ আমাকে চালাতে হয়।
চাকরি করি না তবে দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে দিন চলছিলো। প্রতিদিন কাজ করি আর আশায় বুক বাঁধি যে কিছু একটা হবে।
কিন্তু দিন শেষে আশার খাতায় জিরো পেয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার করার থাকে না।
মা তো মাঝে মাঝে বলে “কিরে গ্যাদা এত লেহাপড়া করলি, চাকরি বাকরি করস না কেন? ” আমার উত্তর একটাই”হয়ে যাবে একসময়”
,,
কথাটা বলতে বলতে আমি নিজেই ক্লান্ত। এখন বাড়িতে যেতেও ইচ্ছে করছে না৷ স্টেশনের পশ্চিমে তাকালাম দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার, পূর্বেও একই অবস্থা। মনটা চায় এই অন্ধকারে মিশে যেতে। আবার পরক্ষণেই মনে পরে একটা পরিবারের কিছু মানুষ আমার উপর নির্ভরশীল।
,,
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবার বসে থাকে। আমার থেকে অনেকটাই দূরে একটা লোক রাতের খাবার খাচ্ছে। দেখতে পাগলের মতো লাগলেও খাবার খাওয়া দেখে পাগল মনে হচ্ছে না। হয়তো সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে অভিনয় করছে।
,,
নাহহ রাত একটা বাজতে আর বেশি দেড়ি নেই। এবার উঠতে হবে, মা বোন ওরা টেনশন করছে। আমি বসা থেকে উঠে দাড়ালাম, প্যান্টে লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে নিলাম। ঠিক তখনই ট্রেনের হুইসেলের শব্দ। মনে হয় থ্রু পাস করে চলে যাবে। কিন্তু নাহহ ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামলো। মনে হয় ক্রসিং হবে।
,,
ট্রেনের জানলা দিয়ে কিছু লোক বাইরে টা তাকিয়ে দেখছে হয়তো আমাকেও দেখছে। যাইহোক সেটা ভেবে কি হবে আমি কিছুক্ষণ থাকি আরেকটা ট্রেন দেখি তারপর না হয় চলে যাবো। আমি আবার ট্রেন প্রেমি মানুষ এটার নেশায় আমি বুদ হয়ে থাকি।
,,
কিছুসময় পার হলো ট্রেন দেখতেই। হঠাৎ একটা মেয়ে ট্রেন থেকে নামলো সাথে ব্যাগ নিয়ে। আমি ভাবছি এটা তো এই ট্রেনের গন্তব্য স্টেশন না, এখানে যাত্রী নামার ও কথা না। আমি কি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করবো? নাহহ দরকার নেই হয়তো তার দরকার তাই সে নেমেছে৷ মেয়েটি ব্যাগ হাতে নিয়ে একটা সিটে বসলো।
,,
ক্রসিং না হয়েই ট্রেন ছেড়ে দিলো৷ হয়তো সামনের লাইন ক্লিয়ার ছিলো না। যাক ট্রেন চলে গেছে এবার আমার বাড়ি যাবার পালা। আমি চলে যাবো এমন সময় সেই মেয়েটি আমাকে ডাকে “এই যে শুনুন”
,,
মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে ঘুরে তাকালাম। মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল…
-এখানে আশে পাশে ভালো কোনো হোটেল আছে?? (মেয়েটি)
-আশে পাশে বলতে শহরে যেতে হবে (আমি)
-এখন থেকে কত মিনিটের রাস্তা আর কিভাবে যাবো একটু যদি বলতেন
-এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে আর সি.এন.জি তে যেতে হবে। আর এত রাতে সি.এন.জি পাওয়া যাবে না
,,
আমার কথা শোনার পর মেয়েটা কেমন যেন আমতা আমতা শুরু করলো। মেয়েটাকে দেখে বেশ বনেদী ঘরের মনে হচ্ছে। বয়স কত হবে! বিশ এর মতো দেখতে মাশাআল্লাহ কেউ চোখ ফেরাতে পারবে না।
,,
-আচ্ছা আ আ আমি ভুল করে ফেলেছি (মেয়েটি)
-হ্যাঁ আমি সেটা খেয়াল ও করেছি, এখানে নেমেছেন কি জন্য? কোনো সমস্যা ছাড়া এই ট্রেন এখানে থামায় না (আমি)
-আমি টিকেট কেটেছিলাম ট্রেনের শেষ গন্তব্য পর্যন্ত কিন্তু..
-আপনি কিছু লুকাচ্ছেন। সে যাই হোক সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে যাইয়েন
,,
আমি চলে আসবো আবার সে ডাকলো…ফিরে তাকাতেই সে আমাকে দারুণ একটা কাহিনী শোনালো…
-আমি বাসা থেকে রাগ করে চলে এসেছি (মেয়েটি)
-কেনো??(আমি)
-অনেকদিন হলো বাসার মধ্যে থাকি ভালো লাগছিলো না। বাবা-মা ভাইয়া যার যার মতো ব্যস্ত আমি বলি আমার কথা তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না৷ এরকম থাকতে থাকতে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম। বন্ধুদের ঘুরতে যাওয়ার কথা বলি তারা আমাকে ব্যস্ততার কথা শোনায়। তাই রাগ করে বাসা থেকে একাই ঘুরতে বের হয়েছে। সত্যি বলতে আমি কিছুই চিনি না ট্রেনে যে উঠলাম তাও এই প্রথম আমি ভাবছি যে স্টেশনের আশে পাশে হোটেল থাকে সেগুলো তে উঠবো কিন্তু এখন দেখছি……
-হ্যাঁ থাকে তো কিন্তু এটাতে নেই
-প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করবেন?
-পুরোটা বাংলায় বলেন
-দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
-হ্যাঁ এইতো এখন মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছেন, যাই হোক দুঃখিত আমি আপনাকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে পারবো না আমি বাড়ি যাচ্ছি
-আমিও যাই আপনার সাথে
-এ মাথা খারাপ নাকি? এমন করে কেন. (মনে মনে ভাবলাম)
-কাল সকালেই চলে যাবো শুধু একটু থাকার জায়গা দরকার
-স্টেশন অনেক নিরাপদ
-এটা স্টেশন নাকি অন্যকিছু দেখতেই ভয় লাগছে
-পুরোনো হয়ে গেছে তো তাই ভয় লাগবেই
-ঐদিকে দেখলামা পাগল
-এই স্টেশন টাই পাগলের বাসা
-আমি আপনার সাথে যাবো
-আগলা ভেজাল কইরেন না তো এমনি আমার মন খারাপ
-কেনো?
-আপনাকে বলব কি জন্য?
,,
আর কথা বাড়ালাম না, মেজাজ তো এমনিতেই খিটখিটে হয়ে আছে, এর মধ্যে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না।
আমিও হাঁটছিলাম মেয়েটাও আমার পিছু পিছু হাঁটছিলো। স্টেশনের সীমানা তখনও শেষ হয়নি। আমি আবার তার দিকে ঘুরে দাড়ালাম। কারন তাকে আটকানো দরকার৷
-ভালো ভাবে বলছি এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না (আমি)
-একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে এটা আপনি দেখবেন না?(মেয়েটি)
-আপনাকে আশ্রয় দিলে আমি বিপদে পড়বো
-কেনো? আন্টি বকা দিবে?
-হ্যাঁ আর আপনি মেয়ে মানুষ এ নিয়ে আবার কথাও হতে পারে।
-মানে বিপদে পড়েছি দেখেই সাহায্য চাইছি,, এমনি এমনি আপনার বাড়িতে কেনো যাবো? থাক লাগবে না ভাই আপনি চলে যান।
,,
আমি চলে আসলাম। কিছুটা এসেই আবার দাঁড়িয়ে গেলাম। স্টেশন টা বেশ সুবিধার না রাতে নেশার আড্ডা চলে। মেয়েটা বিপদ পড়তে পারে।
আবার বাড়িতে নিয়ে গেলে মা কথা শুনাবে। কি যে করি! ভাবতে ভাবতে আবার স্টেশনের দিকে ফিরে গেলাম।
দূর থেকে দেখলাম মেয়েটা ব্যাগ থেকে বের করে কি যেন খাচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সে আমাকে দেখেই খাবার গুলো ব্যাগে রাখলো আর আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
,,
কাছে এসে..
-চলুন যাওয়া যাক (মেয়েটি)
-আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি আপনাকে নিতে আসছি (আমি)
-আরেহ তাছাড়া কি জন্য আসবেন? আমাকে নিতেই তো আসছেন
,,
মেয়েটার সাথে অন্ধকারে হাঁটছি চুপচাপ। মনে মনে ছক কষতেছি মা’কে কিভাবে কি বলব। হঠাৎ মেয়েটা বলল..
-আপনার বাড়িতে যাচ্ছি তো আমাদের পরিচিত হওয়া উচিত। আমি ইরা
-শুভ
-অশুভ
-মোটেও না
-গোমরা মুখো
-এত অল্প সময়ে আমার নামের পাশে এতগুলো বদনাম না দিলেও পারতেন
-একটা মেয়ে আপনার পাশে হাঁটছে আর আপনি কিছু বলছেন না, গোমরা মুখোই তো বলব তাই না?
-হুমম
-কি করেন আপনি?
-কাজের কথা?
-হ্যাঁ
-দিনমজুর
-হাগে কাগজপত্র গুলো কি?
-জমির দলিল
-দলিল নিয়ে বাইরে এত রাতে
-এমনি একটা কাজ ছিলো
-ওহহ আচ্ছা
,,
দলিল বলি চালিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। কারণ লেখাপড়া শেষ করে দিনমজুর এর কাজ করি এটা জানলে সে ও নাক ছিটকানি দিবে।
-আপনার বাড়িতে কে কে আছেন? (ইরা)
-মা আর দুই বোন (আমি)
-ওহহ
-শোনেন মা’কে যা বলার আমি বলব আপনি শুধু চুপ থাকবেন ঠিক আছে
-হুমম আর কতদূর?
-এইতো আর একটু
-এত অন্ধকার কেনো?
-আলো নেই তাই
-বাহহ দারুণ কথা বলতে পারেন আপনি
,,
বাড়ির যত কাছে যাচ্ছি বুকের ধুকপুকুনিটা ততই বাড়ছে। আমাদের বাড়িতে তিনটা ঘর। একটা ঘরে দুটো পার্ট করা একটাতে আমি থাকি আর একটাতে মা আর বোন দুজন। বাকি দুটো ঘর হলো রান্না ঘর আর গোয়াল ঘর। যদিও এখন গোয়াল ঘরে গরু নেই। বাবা যখন ছিলো তখন অনেক গরুই ছিলো
,,
মা’র ঘরের দরজায় এসে টোকা দিলাম আর ডেকে বললাম দরজা খুলো। মা হয়তো জেগেই ছিলো আমি ডাকার সাথে সাথে ভেতর থেকে আমাকে বকা দেওয়া শুরু করলো আমি কই ছিলাম? এত রাত হয়ে গেলো বাড়ি আসছিলাম না কেনো? এইগুলো।
,,
এদিকে ইরা আমাদের বাড়ির এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি ডেকে বললাম” মা দরজা খুলবে এদিকে ঘুরে থাকেন ”
,,
মা দরজা খুলে দিলো, ভেতরে থাকা লাইটের আলো দরজা দিয়ে বাইরে এলো আর মা’র চোখে হয়তো আমার পাশে আরেকজনকে ধরা দিয়েছে।
-কে এটা?(মা অবাক হয়ে)
-আসলে মা ও স্টেশনে.. (ইরা আমি কথা বলতে দিলো না থামিয়ে দিলো)
,,
আর ও বলল..
-আরে ধুর কথা বলতে পারেন না কিছু না। আন্টি কেমন আছেন আপনি??(ইরা)
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো(মা)
-আন্টি ভেতরে গিয়ে সব বলি? নাকি বাইরে দাঁড়িয়ে সব বলব?
-না না ভেতরে আসো
-…(ইরা দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে)
আমি ভাবছি “কি চালাক মেয়েরে বাবা!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here