মন গহীনে,পর্ব_৬

0
3059

মন গহীনে,পর্ব_৬
সামান্তা সিমি

রেডি হয়ে চারতলার গলির এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিচ্ছি। পাঁচটার দিকে আমার ম্যাথ প্রাইভেট।এখন সাড়ে চারটা বাজছে।তুষার ভাইয়ার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।পরে যদি প্রাইভেটে পৌঁছাতে লেট হয় তাহলে স্যারের সুমিষ্ট বকাগুলো আমায় গিলতে হবে।বিকেলের প্রাইভেটে তুষার ভাইয়া আমাকে দিয়ে আসে আবার নিয়েও আসে।বেশি দূরে নয়।এই এলাকার শেষ মাথায় ম্যাথ স্যারের বাসা।আমি মা’কে বলেছিলাম এত অল্প রাস্তা আমি একাই আসা যাওয়া করতে পারব।এই কথাটার বিনিময়ে মা আমায় চোখ মুখ পাকিয়ে এক রামধমক দিলেন।তার কারণ মা’য়ের দু চোখের মনি ফারদিন তুষার ঘোষণা দিয়েছে উনি আমায় প্রতিদিন আনা নেওয়া করবেন।মা ও চোখ বন্ধ করে সেই ঘোষণা শিরোধার্য করে নিয়েছে।
মাঝেমধ্যে মাথাটা হাই ভোল্টেজে গরম যায় আমার।মানে আমি কি ক্লাস ওয়ান টু’তে পড়ুয়া বাচ্চা যে বড়দের হাত ধরে বাইরে যেতে হবে?আমার এই বক্তব্য শ্রবণ করার ন্যূনতম সময়টুকু কারো নেই।

শেষবারের মত হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে লিফটের কাছে চলে গেলাম।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে উনাকে বাসা থেকে ডেকে আনাই উত্তম। একা একা চলে গেলেও বিপদ।তুষার ভাইয়ার জ্বলন্ত চোখের সামনাসামনি হওয়ার সাহস নেই আমার।
লিফটের বাটন চাপার কিছুক্ষণ পরই লিফট হাজির।দরজা খুলতেই ঢুকতে যাব এমন সময় আবার থেমে গেলাম।
ভেতরে তুষার ভাইয়া এবং সাদনান ভাইয়া।সাদনান ভাইয়াকে চিনি আমি।উনি এই বিল্ডিংয়েই থাকেন।তুষার ভাইয়া এবং উনি সেইম এইজের।একই বিল্ডিংয়ে থাকার কারণে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে।
আমি সন্তর্পনে ভেতরে এক সাইডে দাঁড়িয়ে গেলাম।হঠাৎ সাদনান ভাইয়া বলে উঠলেন,

” তুমি তো নীলাশা, রাইট? তুষারের মামাতো বোন। ”

আমি আড়চোখে একবার তুষার ভাইয়াকে দেখে নিলাম।উনি ভাবলেশহীন চেহারায় সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছোট করে উত্তর দিলাম,

” জ্বি ভাইয়া।”

সাদনান ভাইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগলেন,
” ইন্টারে পড়ছো এবার?পরীক্ষা তো আর কয়েকমাস আছে।ভালো করে পড়ো।এ প্লাস কিন্তু পেতে হবে।”

মনে মনে মুখ ভেংচি দিলাম।সবার শুধু এক কথা।এ প্লাস পেতে হবে, এ প্লাস পেতেই হবে।তাজ্জবের কারবার। এ প্লাস পেতেই হবে কেনো?সবাই যদি এ প্লাস পেয়ে বসে থাকে তাহলে বাকি যে গ্রেড গুলো আছে ওগুলো কাঁদের জন্য?
আমি মৃদু হেসে মুখস্থ করা বাক্যটা প্রকাশ করলাম।

” জ্বি ভাইয়া।দোয়া করবেন।”

কিন্তু পরক্ষণেই তুষার ভাইয়ার দিকে তাকাতে মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।উনি এ পর্যন্ত একটা কথাও বলেন নি।প্রতিক্রিয়া শূন্য চেহারায় এখনো চুপচাপ। এসব তো ভাল লক্ষণ নয়।আবার কি কারণে রেগে আছে কে জানে।
লিফট থেকে বেরোতেই সাদনান ভাইয়া আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।কিন্তু তুষার ভাইয়া তাঁকে থামিয়ে অন্য দিকে টেনে নিয়ে গেলেন।চোখ দিয়ে ইশারা করলেন আমি যেন গেইটের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।

আমি আগে আগে হাঁটছি আর আমার পেছনে তুষার ভাই। রাস্তার আশেপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে।ওদের বেশিরভাগকেই আমি চিনি।ওঁরা এই এলাকাতেই থাকে।প্রতিদিন প্রাইভেটে যাওয়ার সময় বাচ্চা গুলোর ছুটাছুটি দেখা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।ওদের দস্যিপনা দেখলে চট করে একটা লাইন মাথায় আসে। আহা! শৈশব কত মধুর!নেই কোনো পড়ালেখার কঠিন বেড়াজাল, নেই কোনো কড়া শাসন।অফুরন্ত ভুল করলেও তাঁদের কেউ কিছু বলবে না।তিরস্কার করবে না।কারণ তাঁরা বাচ্চা।

” তুই রেড কালারের ড্রেস কেনো পড়েছিস নীল?”

তুষার ভাইয়ার শক্ত কন্ঠের আওয়াজ পেতেই আমার চিন্তা ভাবনার ঝুলি বন্ধ করলাম।
নিজের দিকে তাকাতেই দেখি লাল কালো’র সংমিশ্রণের থ্রি-পিস আমার গায়ে।সামনে যে জামাটা পেয়েছি সেটাই পরে চলে এসেছি।আমার নিজেরই তো ভালভাবে খেয়াল নেই কি রঙের ড্রেস পড়েছি আজ।উনার কথায় বুঝতে পারলাম আসলেই লাল ড্রেস আমার গায়ে।কিন্তু লাল ড্রেস পড়লে সমস্যা কোথায়?
চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” এখন কি আপনার থেকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে যে কোন কালারের ড্রেসটা আমি পড়ব?”

উনি দু পা সামনে এসে বললেন,
” হ্যাঁ জিজ্ঞেস করতে হবে।তুই লাল ড্রেস পড়ে ঘুরাঘুরি করবি আর দূর থেকে সবার নজর তোর উপরই পড়বে।তোর মতলব আমি ভালোই বুঝি।তোর এই সুন্দর মুখশ্রী সকলের সামনের তুলে ধরার জন্যই এই প্ল্যান তাই না?কিন্তু তুই কি জানিস তোর চেহারা বাংলা ছায়াছবির রিনা খানের মত?নিজেকে সুন্দরী প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা কেনো করিস?”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।তুষার ভাই এসব কি ছেলেমানুষী কথা বলছে।আর কি আমি রিনা খানের মত দেখতে?আমার সময় কি এতই খারাপ চলছে যে শেষমেষ উনি আমায় এই উপাধি দিলেন!
রাগের চোটে মাথাটা চিড়বিড় করে উঠল।চোখ গরম করে বললাম,

” মানুষের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে ওঁরা রাস্তাঘাটে খুঁজে বেড়াবে কে লাল জামা পড়েছে।আর আমি রিনা খানের মত দেখতে হলে আপনার তাতে কি!আপনার তো কিছু যায় আসে না।”

” যায় আসে।আমারই তো সব।শোন এত বকরবকর না করে মূল কথাটা ব্রেইনে ঢুকিয়ে নে।লাল জামা পড়ে আর বাসা থেকে বের হবি না।”

আমি বিরক্তমুখে সামনের দিকে দৃষ্টি দিলাম।মন চাইছে একটা ঘুষি মেরে উনার নাসিকা ফাটিয়ে দেই।আমার ব্যাপারে এত খবরদারী করতে কে নির্দেশ দিয়েছে?

” আপনি তো দেখি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে করতে আমাকে একদম পিষে ফেলছেন।”

” পিষে ফেলব।নিজের অস্তিত্বের সাথে পিষে ফেলব তোকে।”

ফিসফিসিয়ে কথাটা বলেই উনি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন।আমিও কিছুই বুঝতে পারলাম না।মাঝেমধ্যে উনি এরকম উদ্ভট কথাবার্তা কেনো বলেন!

আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর স্যারের বাসার সামনে পৌঁছে গেলাম।গেইটের এক পাশে পূজা দাঁড়িয়ে আছে।এই মেয়ের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।প্রতিদিন একই কাহিনী।কিভাবে পারে এত ন্যাকামো করতে!তুষার ভাইয়াকে দেখলেই ওর লজ্জারাঙা চেহারা নজরে পড়ে।সে পুরো দিওয়ানা হয়ে আছে ভাইয়ার জন্য।

গেইটের কাছে আসতেই ভাইয়া বলল,
” ছুটি হলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি।দুনিয়া উল্টে গেলেও এক পা অন্যদিকে দিবি না।আমি সময়মত চলে আসব।”

আমি ঠোঁটে হাসি চেপে বলে উঠলাম,

” দুনিয়া উল্টে গেলে তো আমিও উল্টে যাব ভাইয়া।তখন এখানে চুম্বকের মত সেঁটে থাকা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

তুষার ভাইয়া চোখ পাকিয়ে ডানের রাস্তায় মোড় নিলেন।পাশে তাকিয়ে দেখি পূজা’র উজ্জ্বল দৃষ্টি ভাইয়ার যাওয়ার পানে নিবদ্ধ। ঠোঁটে প্রানবন্ত হাসি।ওর মাথায় বড়সড় একটা চাটি মেরে বললাম,

” হয়েছে? চল এবার ভেতরে যাই।”

পূজা হড়বড় করে বলতে লাগল,
” দোস্ত, তোর এই ভাইকে দেখলে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারি না।প্রতিদিন একপলক দেখার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে থাকি।কিছুক্ষণ আগে তোর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো সেটা দেখেই আমি ফিদা। ”

” আহারে কি প্রেম তোর মনে! ডেইলি এভাবে সঙের মত দাঁড়িয়ে না থেকে ডিরেক্ট অ্যাকশনে নেমে পড়লেই তো পারিস।প্রপোজ করে দে।”

কাঁদোকাঁদো মুখ করে পূজা বলল,
” আমি যদি মুসলিম হতাম তাহলে কবেই তুষার ভাইয়াকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম।আর উনি এত নিরামিষ কেনো বলতো!প্রত্যেকটা দিন আমি মাছের চোখের মত উনার দিকে তাকিয়ে থাকি আর উনি একপলক ফিরেও দেখে না।কত কষ্ট করে সাজুগুজু করে আসি জানিস?”

” তোর জন্য অনেক সমবেদনা রইল।ভাইয়ার প্রেমিকা আছে।তাই তুই বিশ্ব সুন্দরীর রূপ নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও উনি চোখ তুলে দেখবে না।বুঝেছিস? চল এবার।”



ছুটির পর ভাইয়ার সাথে হাঁটছি।সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।রাস্তায় তেমন একটা লোকজন দেখা যাচ্ছে না।দুই পাশের উঁচু বিল্ডিং গুলো মিনারের মত দাঁড়িয়ে আছে।তুষার ভাইয়া নিঃশব্দে হাঁটছেন।চোখের চাহনিতে উদাস দৃষ্টি।উনার কি মন খারাপ নাকি!অন্যসময় হলে তো কিছু না কিছু বলে আমাকে রাগানোর চেষ্টা করতেন।উনার চুপচাপ থাকাটা আমার ভালো লাগছে না।কেনো জানি মনে হচ্ছে উনি উনার আগের ক্যারেক্টারেই ফিরে যাক।আবার আমাকে বিরক্ত করুক।বিরক্ত করে নিজেই হেসে উঠুক আর আমি চেহারায় রাগী ভাব আনার অভিনয় করে মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসব।
হঠাৎ তুষার ভাইয়া বলে উঠলেন,

” দীঘির পাড়ে যাবি নীল?”

আমি কৌতূহল চোখে উনার দিকে তাকালাম।এতদিন ধরে উনার সাথে আসা যাওয়া করি কখনো তো দীঘির পাড়ে যাওয়ার কথা শুনিনি।উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে গেলাম।বেচারার মন খারাপ।হয়তোবা মন ভালো করার চেষ্টায় যেতে চাইছেন।
পাঁচ মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম দীঘির পাড়।এই এলাকার ভেতরেই দীঘি।জায়গাটা এমনিতে খুব ভালো লাগে আমার।চারদিকে রাস্তা মাঝখানে টলমলে পানি।লাইটের আলোয় পানিতে একধরনের বিচ্ছুরণ তৈরি হচ্ছে। দৃশ্যটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
তুষার ভাইয়ার পিছু পিছু আমি গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম।উনি দুইহাত দুইপাশে ছড়িয়ে দিলেন।তাই আমি কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে এলাম যাতে উনার বাহুতে আমার শরীরের স্পর্শ না লাগে।
অনেকক্ষণ থেকে ভাইয়া চুপ করে আছেন।তাই ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপনার কি মন খারাপ ভাইয়া?”

উনি যন্ত্রের মত উত্তর দিলেন,
” কিছুটা।”

আমি চুপ মেরে গেলাম।কারো মন খারাপ থাকলে কি করে তাঁর মন ভালো করতে হয় তা আমার জানা নেই।তারউপর ভাইয়া আমার থেকে বয়সে কত বড়।সমবয়সী হলে একটা কথা ছিল।কিছু না কিছু বলে হাসানোর চেষ্টা করতাম।কিন্তু উনার সাথে এমন কিছু করলে সেটা বড্ড বেমানান লাগবে।

হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একজন লোক বাদাম বিক্রি করছে।
আর কিছু চিন্তা না করেই বলে উঠলাম,

” ভাইয়া বাদাম খাব।এনে দিন না।অনেকদিন থেকে খাই না।দশ টাকার কিনবেন।অর্ধেকের বেশিগুলো আমি খাব।যেহেতু বাদাম আমার পছন্দের। আর আপনি অল্প খাবেন।আমার থেকে ভাগ বসাতে পারবেন না কিন্তু। ”

তুষার ভাইয়া ভাবলেশহীন চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই হেসে উঠলেন।আমার গাল টেনে বললেন,

” এত কিউট কেনো তুই?”

উনি উঠে চলেে গেলেন বাদাম কিনতে।জানি না কেনো আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here