মন গহীনে,পর্ব_৭
সামান্তা সিমি
তুষার ভাইয়া এবং আমি দীঘির পাড়ে বেঞ্চিতে বসে আছি।দুজনের মধ্য অনেকটা দূরত্ব। আমার হাতে বাদামের প্যাকেট।
প্রায় আধাঘন্টার মত হলো এখানে বসে আছি।বেশ ভালোই লাগছে।চারদিকে আলো আঁধারের খেলা।আকাশে গুটিকয়েক তারা উঁকি মারছে।সাথে আছে মৃদুমন্দ বাতাস।এত চমৎকার একটা সময়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা যায় নাকি।কিন্তু তুষার ভাইয়ার মুখে সেই কখন থেকে কথা নেই।আমার তো সন্দেহ হচ্ছে উনি বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কিছুটা নড়েচড়ে বসতেই তুষার ভাই বলে উঠলেন,
” আচ্ছা নীল! তোকে যে মাঝেমধ্যে এত ধমকাই, কখনো কখনো রুড বিহেভ করি তোর খুব কষ্ট হয় তাই না?”
উনার কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।কি জবাব দেওয়া যায়?রুড বিহেভ করলে কিছুটা কষ্ট তো লাগেই।তবে সেটা সাময়িক।এসব আমি কিছুক্ষণ পরই ভুলে যাই।বরাবরই আমি এমন।
উত্তর দিতে যাব তখনই উনি আবার বললেন,
” সাদনান কে দেখলে এড়িয়ে যাবি।ও কথা বলতে চাইলেও পাশ কাটিয়ে চলে আসবি।বুঝা গেল?”
” হঠাৎ সাদনান ভাই কোথা থেকে আসলো?”
” যেখান থেকেই আসুক।তোকে যেটা বললাম সেটা মাথায় ঢুকিয়ে নে।”
উনার রাগ মিশ্রিত ধমক শুনে চুপসে গেলাম।এখন বেশি প্রশ্ন না করাই ভালো।একে তো উনার মন ভালো নেই তার উপর বেশি প্রশ্ন করতে গেলে যদি ঠাটিয়ে চড় মেরে দেয়!
” ঠিক আছে।আপনার কথা মাথায় রাখব।কিন্তু এখানে আর কতক্ষণ বসে থাকবেন?বাসায় গেলে তো মা আমায় বকতে বকতে ফালা ফালা করে দেবে।”
তুষার ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
” আমি বুঝিয়ে বলব মামীকে।টেনশন করিস না।চল।”
ভাইয়ার মুখের হাসি দেখে আমিও হাসলাম।রাস্তার লাইটের আলোয় আর রাতের অন্ধকারে উনাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
উনি সামনে হাঁটছেন। আমি কিছুটা পিছনে।পেছনে থেকেই ভাইয়াকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।
উনি আমার থেকে বেশ লম্বা।চোখে চোখ রাখতে গেলে মাথা কিছুটা উপরে করে দিকে তাকাতে হয়।
বাতাসের কারণে উনার হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো উড়ছে।গায়ের নেভেব্লু টি-শার্টে খুব মানিয়েছে।হাতের ঘড়িটা…..
হঠাৎই থেমে গেলাম।আমি কেনো উনাকে এত সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছি?ছি ছি! কি লজ্জার ব্যাপার।ভাগ্যিস একজনের মনের কথা অন্যজন শুনতে পারে না।নাহলে তো আমার সব গোপনীয় চিন্তা ভাবনা এক্ষুনি ফাঁস হয়ে যেত।
চৌরাস্তা পেরিয়ে খোলা মাঠের কাছে আসতেই তুষার ভাইয়া দাঁড়িয়ে পড়লেন।পেছনে ফিরে আমার ডান হাতটা উনার হাতের মুঠোয় নিয়ে আবার হাঁটা দিলেন।আমি তো পুরো বোকা বনে গেলাম।
উনি কখনো এভাবে হাত ধরে হাটেন নি।
তাই সোজা প্রশ্ন করে বসলাম,
” হাত ধরেছেন কেনো? আমি কি কোনো বাচ্চা যে হাতে ধরে হাঁটতে হবে? ”
তুষার ভাইয়া ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
” তুই কি মনে করিস তুই বড় হয়ে গেছিস?মাত্রই তো ইন্টারে পড়ছিস।”
উনার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম।ইন্টারে পড়ুয়া মেয়ে বাচ্চা হয় কিভাবে?এত বড় মানুষ টাকে উনার চোখে লাগে না নাকি।যত্তসব!
” শুনুন! আমি কোন ক্লাসে পড়ি বড় কথা নয়।বড় কথা হলো আমি আঠারোতে পদার্পণ করেছি কিনা।হিসাব মতে যেহেতু আমার আঠারো হয়ে গেছে সো আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। বুঝে শুনে কথা বলবেন আমার সাথে।”
” মারব ধরে এক চড়।এইটুকুন মেয়ে তাঁর সাথে আবার বুঝে শুনে কথা বলতে হবে।কি স্টাইল কথার! কলেজে গিয়ে এসবই শিখিস তাই না।বড়দের কিভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে আগে সেইটা আয়ত্ত কর তারপর ভাষণ দিতে আসিস।”
আমি মুখ কালো করে ফেললাম।উনি উনার ফুল ক্যারেক্টারে চলে এসেছেন।এখন মনে হচ্ছে উনি তখনের মত মন খারাপ করে বসে থাকলেই ভালো ছিল।যেই মন ভালো হল অমনি আমাকে পচানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
আজকে বাসায় গিয়েই মায়ের সাথে একদফা যুদ্ধ করতে হবে।এখন থেকে প্রাইভেট, কলেজ সবজায়গায় আমি একা চলাচল করব।মা এবং তুষার ভাই এই দুজন মিলেই তো আমাকে বড় হতে দিচ্ছে না।যেখানেই যাই সেখানেই গার্ড দিয়ে রাখে।এমন পরাধীন জীবন মেনে নেওয়া যায় না।
________________________
বিছানার এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছি। একটু পর পর খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারছি।ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার।আবহাওয়া ঠিক লাগছে না।যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড় হানা দিতে পারে।তখন আমার অবস্থাটা কি হবে!কেউ বাঁচাও আমায়।
ড্রয়িংরুম থেকে তুষার ভাইয়া এবং মা-বাবা’র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রুমে থেকে বুঝতে পারছি ওদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু আমি এবং আমার টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট।
গতকাল রেজাল্ট দিয়েছিল।আমার পয়েন্ট আসছে ৩.৯৫। এটা দেখেই সবার প্রথমে তুষার ভাইয়ার ভয়ানক রাগী চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল।উনি যদি রেজাল্টের এই হাল দেখে তাহলে জায়গাতেই আমায় কতল করে দেবে।সাথে অপমানজনক কথা তো আছেই।আমি জানতাম রেজাল্ট বেশি সুবিধার আসবে না।কারণ পরীক্ষা গুলো তো একটাও ভালো হয় নি।
ভেবেছিলাম আরো কয়েকদিন যাক ধীরে সুস্থে বাবা’কে খবরটা জানাব।কিন্তু আমার প্ল্যানে কাঁদা ছিটিয়ে দিল তুষার ভাই।উনি কিভাবে যেন জানতে পেরে গেছে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে।তাই আজ সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় হামলা দিয়েছে।
রুমে ঢুকেই এমন জেরা শুরু করে দিল যে আমার পুরো দিশেহারা অবস্থা। শেষপর্যন্ত উনার চাপে পড়ে সেই নিম্নমানের পয়েন্টের খবরটা প্রকাশ করতে হলো।সাথে সাথে মাথা নিচু করে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছিলাম।এই বুঝি তুষার ভাইয়া থাপ্পড় মেরে গাল ফাটিয়ে দিলেন।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।উনি চুপচাপ উঠে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।এরপর থেকেই বসার ঘরে মা বাবা এবং উনার কথার সুর ভেসে আসতে লাগল।আমি নিশ্চিত উনি সব বলে দিয়েছে তাঁদের।
আতঙ্কে অস্থির হয়ে একবার বিছানায় বসছি আবার রুমে পায়চারি করছি।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পরল।ড্রয়িংরুম থেকে মা জোর গলায় ডাকছেন।ঘূর্ণিঝড় তাহলে হানা দিয়ে দিল।
তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হলাম।নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি গায়ে উড়না নেই।দৌড়ে আবার রুমে গেলাম উড়না আনতে।আমার নিজেকে এখন পাবনা থেকে পালিয়ে আসা পাগল মনে হচ্ছে।
টলমলে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বসার ঘরে পৌঁছলাম।মা বাবা দুজনই গম্ভীর মুখে বসে আছেন।তুষার ভাইয়া আমার দিকে একপলক তাকিয়ে হাতে থাকা ফোনে মনযোগ দিলেন।নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামী লাগছে। একটু পরই বিচার শুরু হবে আমার।
বাবা শান্তস্বরে বলতে লাগলেন,
” তুষার থেকে তোমার রেজাল্টের খবরটা শুনলাম নীলাশা। তোমার তো পয়েন্ট ভালো আসে নি।রেজাল্ট এত খারাপ আসার কারণ কি?”
আমি মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোরে খুঁচাচ্ছি। এসির নিচে থেকেও খুব গরম লাগছে।
বাবা’র প্রশ্নে মা তেতে উঠে বলল,
” তোমার মেয়ে বাসায় কি পড়ালেখা করে?সে তো টিভি দেখা নিয়ে ব্যস্ত।কি যেন এক কার্টুনের চ্যানেল আছে সারাক্ষণ সেখানে মটু পাতলু দেখবে।তাহলে রেজাল্ট ভালো আসবে কি করে।দেখো গিয়ে পরীক্ষার খাতায় মটু পাতলু’র ডায়লগ লিখে দিয়ে এসেছে।”
লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। মা সবসময় একটু বেশি বেশি করে।বকবে ভালো কথা অন্য কিছু নিয়ে বকো।মটু পাতলু’র কথা তুষার ভাইয়ার সামনে না বললেই নয়?এমনিতেই উনি আমায় বাচ্চা বলে ক্ষেপায়।এখন তো আরো একটা ক্লু পেয়ে গেল।
বাবা চোখের ইশারায় মা’কে থামতে বলে আমাকে কাছে ডাকলেন।
” তোমার নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ঘাটতি আছে নীলাশা।হয়তো তুমি পড়ায় ভালোভাবে মনযোগ দিচ্ছো না আর নয়ত যেখানে প্রাইভেট পড়ছো সেখানে পড়াটা ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারছো না।তোমার সমস্যা টা কোথায় সেটা তুমিই ভালো বুঝবে।ফাইনাল পরীক্ষা তো এসেই গেল।এখন একটু সিরিয়াস হওয়া দরকার না?আমার মনে হয় তোমাকে গাইড দেওয়ার জন্য বাসায় একজন শিক্ষক রাখলে ভালো হবে।সেটা নিয়েই এতক্ষণ তুষারের সাথে আলোচনা করছিলাম। তুষার বলল যে এখন ওদের অফিসে কাজের চাপ কিছুটা কম। তাই সে তোমাকে বাসায় কয়েকঘন্টা টাইম দিতে পারবে।তাহলে সমস্যা তো মিটেই যায়।তুষার তোমাকে বাসায় ইম্পর্টেন্ট বিষয়গুলো পড়াবে।আবার তুমি যদি বাইরে দুয়েকটা বিষয় পড়তে চাও তাহলে পড়তে পারো।কিন্তু বাসায় তুষারই তোমাকে গাইড দেবে।”
বাবা’র গুছিয়ে বলা কথাটা আমাকে এলোমেলো করে দিল।গত কয়েকমাসেও এত বড় শক পাইনি।যার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাই তাঁর কাছেই পড়ব।ওহ্ আল্লাহ! আমার সাথেই কেনো এমন হয়?এই অসহায় দুঃখী মেয়েটার উপর দয়া করো।
এখন তো বাবা’র কথার উপর দিয়েও কিছু বলতে পারব না।একে তো রেজাল্টের এই অবস্থা অন্যদিকে তুষার ভাই আমার সামনে বসে আছে।
উনি এখনো জানপ্রাণ দিয়ে ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে ফোন ছাড়া এই মুহূর্তে উনার সাথে কেউ নেই।কিন্তু আমি জানি উনি কান খাড়া প্রত্যকেটা কথা শুনছে।
বাবা কিছুটা জোরে বলে উঠল,
” কি বলেছি বুঝতে পেরেছো তো নীলাশা।তোমার রেজাল্ট দেখে কিন্তু আমরা সবাই বেশ হতাশ।তাহলে এবার দম নিয়ে পড়া শুরু করে দাও।কাল থেকেই তুষার তোমাকে পড়াতে আসবে।”
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম ‘ঠিক আছে’।রুমে যাওয়ার জন্য সামনে এগুতেই আবার পেছনে ফেরলাম।তুষার ভাইয়া হিংস্র বাঘের মত চেয়ে আছেন।আমি তাড়াতাড়ি ঘাড় ফিরিয়ে নিলাম।উনার চাহনি দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছেন।আমাকে একা পেলে হয়তোবা ঠাসঠুস মেরে দিতেন।
কাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে আমার প্যারাময় জীবন।উনার হাতের কত মার যে খাওয়া লাগবে কে জানে।ভাবলেই আমি টুরু ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি।
চলবে….