মন গহীনে,পর্ব_৯
সামান্তা সিমি
ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিক।সকাল ছয়টা বাজে।বারান্দায় বসে আছি আমি।প্রকৃতিতে শীতের আনাগোনা।ডিসেম্বর মাসে যেমন শীত থাকার কথা তেমন নেই।এবার এত দেরি হচ্ছে কেনো কে জানে।তবে সকালবেলায় কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার উপস্থিতি ভালোই টের পাওয়া যায়।আমার গায়ে একটা পাতলা চাদর।হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া চাদর ভেদ করে গায়ে লাগছে।শরীরে হালকা কাঁপুনি টের পাচ্ছি। আর বসে থাকা যাবে না এখানে।মা দেখতে পেলে আবারো বকা লাগাবে।
কয়েকদিন ধরে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসে থাকা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মা আমার এই অভ্যাসটাকে দু চোখে দেখতে পারেন না।এভাবে বারান্দায় বসে থাকলে নাকি ঠান্ডা লাগবে,জ্বর হবে হেনতেন কত কিছু। আমার কাছে এই সময়টা বেশ ভালো লাগে।বাতাস ঠান্ডা হলেও সেখানে একধরনের স্নিগ্ধতা আছে।কিন্তু এতসব কাব্যিক ভাষা মা’কে কে বুঝাবে।
ঝটপট পড়ার টেবিল গুছিয়ে নিলাম।সাতটা বাজতেই আমার মা-বাবা’র দু চোখের মনি তুষার ভাইয়ার আগমন ঘটবে।আজ পনেরদিন পূর্ণ হলো উনি আমায় পড়াচ্ছেন। ভাইয়ার হোমওয়ার্ক করতে করতে আমার রাত দিন খবরও থাকে না।সকাল বিকাল একঘন্টা উনি পড়িয়ে যান।এরপরও ফোন দিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেন আমি পড়ছি নাকি ঘুমাচ্ছি।ভালো লাগে এসব?জীবনটা আমার শীতের মৌসুমে হাওয়ায় উড়ে আসা শুকনো পাতার মত হয়ে গেছে।
অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে খেতে বসলেও আমার চোখের সামনে ফিজিক্সের সূত্র ভাসে।ঘুমাতে গেলে মাথায় ইন্টিগ্রেশনের সূত্র দৌড়াদৌড়ি করে।মাঝে মাঝে তো লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসি। কতদিন হলো টিভির রিমোট হাতে নেই না।।ভাবলেই কষ্ট কষ্ট ফিল হয়।
ঘড়ির কাটা সাতের ঘরে আসতেই কলিংবেল বেজে উঠল।আমি তাড়াতাড়ি করে ভদ্র এবং শান্ত মেয়ের মত টেবিলে বসে গেলাম।
তুষার ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে রুমে ঢুকলেন।চোখমুখ কিছুটা ফুলে আছে।উনি বোধ হয় মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছেন।এমনিতে সকালবেলা ভাইয়া এক্সারসাইজ, জগিং কোনোটাই বাদ দেন না।এগুলো শেষ করেই আমাকে পড়াতে আসেন।আজ মনে হয় ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।
হঠাৎই দেখি তুষার ভাইয়ার হাতে সেই নীল ডাইরিটা। কি ব্যাপার! আজ উনি ডায়রি নিয়ে আসলেন কেনো?কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” ভাইয়া এটা সেই ডায়রিটা না যেটা ওইদিন আপনার রুমে দেখেছিলাম?”
তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।আমিও তাকিয়ে আছি।আজব লোক তো!একটা সাধারণ প্রশ্ন করেছি উত্তর দিয়ে দিলেই তো হয়।এভাবে জহুরির মত চেয়ে থাকার কি মানে!
” হ্যাঁ।ওই ডায়রিটাই।কিন্তু তুই এটাতে হাত দেওয়ার পর থেকে আমি আর কিছুই লিখতে পারছি না।ডায়েরিটার উপর কোনো জাদু টোনা করিস নি তো আবার?”
আমি হতভম্ব। ভাইয়া মাঝেমধ্যে এমন আশ্চর্যজনক কথাবার্তা বলে যে কি উত্তর দেব খুঁজে পাই না।
” কি যা তা বলছেন ভাইয়া।দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে খামোকা আপনার ডায়রির উপর জাদু করতে যাব কেন?আর আমি একজন সাধারণ মেয়ে।জাদু করার মত ক্ষমতা আমার নেই।হুহ্!”
তুষার ভাইয়া ডায়রিটা টেবিলের একপাশে রেখে সোজা হয়ে বসলেন।আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন,
” সাধারণ মেয়ে হয়েই তো তুই আমার উপর অসাধারণ জাদু করে বসে আছিস।তোর কারণে আমার রাতে ঘুম হয় না,ঠিকমতো কাজে মন দিতে পারি না।তুই তো মহা ধুরন্ধর মেয়ে।আমাকে যন্ত্রণায় রেখে দিব্যি আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছিস।”
” ভাইয়া…আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।একবার বলছেন ডায়রির উপর জাদু করেছি আরেকবার বলছেন আপনার উপর।”
” বুঝতে হবেও না।আজ সব পড়া কমপ্লিট হয়েছে?দিন দিন কিন্তু তুই চরম বেয়াদপ হচ্ছিস।মামী’র থেকে শুনলাম তুই নাকি ভোরে উঠে বারান্দায় বসে থাকিস?প্ল্যান কি তোর?ঠান্ডা লাগিয়ে, জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকবি।সবই পড়া ফাঁকি দেওয়ার ধান্ধা তাই না?”
আমি মুখ কালো করে ফেললাম।মা তাহলে এই খবরটাও উনার কাছে সাপ্লাই করে দিয়েছে।দিয়েছে ভালো কথা।এক লাইন বাড়িয়ে বলার দরকারটা কি?আমি ভোরবেলায় কবে উঠলাম।বুঝেছি মা ও এখন আমার শত্রু হয়ে গেছে।কেউ ভালোবাসে না আমায়।
মনে একরাশ অশান্তি নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পরই মা ভাইয়ার জন্য কফি নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে গেল।
দুটো ম্যাথ কমপ্লিট করার পর টের পেলাম ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে।কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ফলাফলস্বরূপ এখন চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আর এমনিতেও অঙ্কের সাথে আমার একটা শত্রুতা কাজ করে।আমি খেয়াল করেছি যখনই অঙ্ক করতে বসি তখনই আমার ঘুমটা বুলেট গতিতে এসে হানা দেয়।গতরাতে না ঘুমানোর কারণে এই মুহূর্তে চোখ দুটো অনায়াসে বন্ধ হয়ে আসছে।
হাই চেপে রাখতে গিয়েও পারলাম না।তুষার ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই দেখি উনি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবার অঙ্কে মনোনিবেশ করলাম।
কিন্তু তুষার ভাই মাঝপথে ব্যাঘাত ঘটালেন।কফির মগটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” তোর মতিগতি তো ঠিক লাগছে না আমার।রাতে কি ঘুমাস না নাকি?আবার ভোরবেলা বারান্দায় বসে থাকিস।কাহিনী কি?ভুতে টুতে ধরেছে নাকি তোকে?নে কফিটা খা।আমার তো মনে হচ্ছে ঘুমের চোটে ঢুলতে ঢুলতে চেয়ার উল্টে পড়ে যাবি।তারপর দেখব হাত -পা’য়ে ব্যথা পেয়ে হুলুস্থুল কান্ড করেছিস। জলদি কফির কাপ হাতে নে।”
আমার একবার বলতে মন চাইল আপনার থেকে বড় ভুত আর আছে নাকি।সারাক্ষণ মাথার উপরে বসে কলকাঠি নাড়াতে থাকেন।আপনার জন্য জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা লাগে।
মনের তীব্র ইচ্ছাটা চেপে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললাম,
” না ভাইয়া।ওটা মা আপনার জন্য বানিয়েছে। আপনি তো এক চুমুকও খান নি।”
” কফির মগে কি আমার নাম লেখা আছে যে এটা আমাকেই খেতে হবে?মগটা যখন যার হাতে থাকবে সেটা তাঁর হয়ে যাবে।আমি তোর হাতে দিলাম এখন এটা তোর।”
তুষার ভাইয়ার কথা শুনে হেসে দিলাম।আজব মানুষের যত আজব কথাবার্তা।
” এটা কি আপনার তৈরি নিয়ম ভাইয়া?”
” ধরে নে তাই।কিন্তু কফিটা নিয়ে বসে আছিস কেনো?তোকে কি আর শুধু শুধু বাচ্চা বলি?যে মেয়ে কফিকে শরবত বানিয়ে খায় সে কি পরিমাণ নির্বোধ ভাব একবার।”
বিরসমুখে কফির মগটা হাতে নিলাম।উনি আমাকে নিবোর্ধ বলে সেটা নিয়ে আবার আমাকেই ভাবতে বলছে।আর রইল বাকি বাচ্চা। এই শব্দটা শুনতে শুনতে আমার কানের মেশিনে মরিচা ধরে গেছে।তাই এখন আর তত গায়ে লাগাই না।
কফির মগ অর্ধেক খালি হতেই তুষার ভাইয়া এক কান্ড করে বসলেন।তিনি কফির মগটা আমার হাত থেকে একপ্রকার কেড়ে নিয়ে চুমুক বসালেন।
আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনাটায় হতবাক আমি।কিন্তু উনার মুখে কোনো রিয়্যাকশন দেখা যাচ্ছে না।যেন এটা আগেই ঠিক করা ছিল যে অর্ধেক কফি আমার অর্ধেক কফি উনার।
প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি আমার খাওয়া কফিটা খাচ্ছেন কেনো?”
তুষার ভাইয়া শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন,
” তুই হলি একটা কুটিল মেয়ে।কিছুটা স্বার্থপর টাইপ।তোর চোখে ঘুমঘুম ভাব দেখে দয়াবশত কফিটা খেতে দিয়েছিলাম।কিন্তু তুই কি করলি?ঢকঢক করে পুরোটা কফি খেয়েই চলেছিস।আমি কি পুরোটা খেতে বলেছি?একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারতিস ভাইয়া আপনি কি কফি খাবেন?”
” আজব তো!আপনি আমার খাওয়া কফিটা কেনো খাবেন?একজনের খাওয়া কফি অন্যজন খায় এটা তো শুনিনি কখনো।”
” ভুলে গেছিস একটু আগেই বলেছিলাম মগ যার হাতে থাকবে কফি তাঁর।এতক্ষণ তোর হাতে ছিল এখন আমার হাতে আছে।হিসেব মতে কফিটা এখন আমার।”
ভাইয়ার হিসাব-নিকাশের ধরণ দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল।হোমওয়ার্কের জন্য যে পড়াগুলো ব্রেইনে জমিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো উনার বলা কথাটার সাথে মিলেমিশে জগাখিচুরি হয়ে যাচ্ছে। আজকে নির্ঘাত একটা পড়াও দিতে পারব না।তারমানে প্রচুর মার খেতে হবে। জীবনটাই প্যারাময়।
‘
‘
‘
পড়া শেষ করে বিকেলের দিকে নিজের রুমটা গোছগাছ করছি।আমি সাধারণত এসব কাজে কখনো হাত দিই না।ভালো লাগে না এসব করতে।এলোমেলো থাকতে থাকতে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।আজ মা’য়ের বকুনিতে অসহ্য হয়ে ঘর গুছানোতে হাত দিলাম।
আমার রুম নাকি গবাদি পশুর খোয়ারের থেকেও খারাপ।এই রুমে থাকতে থাকতে নাকি আমি নিজেও দিন দিন পশুতে পরিণত হচ্ছি।এগুলো আমার শ্রদ্ধেয় মা’য়ের মুখনিঃসৃত বাণী।
রুম গুছানোর একপর্যায়ে মা প্রবেশ করল।নিশ্চয়ই আবার কোনো কাজের অর্ডার দিয়ে বসবে।
আমার অনুমান কে সত্যি করে দিয়ে মা বলল,
” একটু ছাদ থেকে ঘুরে আয় তো নীলাশা।ফুলগাছ গুলোতে আজ পাঁচ ছয়দিন হলো একফোঁটাও পানি দেওয়া হয় না।তুই গিয়ে পানি দিয়ে আয়।”
ছাদে যাওয়ার কথা শুনতেই মন আনন্দে নেচে উঠল।কত্তদিন হয়ে গেল আমি ছাদে যাই না।তুষার ভাইয়ের কড়া নিষেধ ছিল আমি যেন ছাদে পা ও না রাখি।সেদিন ইয়াসির ভাইয়ার ঘটনাটার কারণেই ভাইয়া রেগে এই কথা বলেছিল।কিন্তু এখন তো ইয়াসির ভাইয়া নেই।তাহলে তুষার ভাইয়াও আমাকে আর কিছু বলতে পারবে না।
ছাদে পৌঁছাতেই সাদনান ভাইয়ার সাথে দেখা।উনি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিলেন।আমাকে দেখতে পেয়েই দ্রুত কল কাটলেন।দৃশ্যটা কিছুটা সন্দেহজনক মনে হলেও আমি তা পাত্তা দিলাম না। গুনগুন করে গান গাইছি আর গাছে পানি দিচ্ছি।
একটু পরেই সাদনান ভাইয়াকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
উনি সামনে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি খবর নীলাশা!অনেকদিন পর দেখা হলো।ছাদে মনে হয় বেশি একটা আসো না।”
মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম।আমি ছাদে আসি না আসি এতে উনার কি!উনাকে কে খবর রাখতে বলেছে।সেদিন তুষার ভাইয়া বলেছিল সাদনান ভাইয়াকে যেন এড়িয়ে চলি।কিন্তু আমি তো গুছিয়ে কোনো কথা বলতে পারি না।কি করে উনাকে এভয়েড করা যায়!
হালকা হেসে বললাম,
” পরীক্ষা আসছে তো তাই এত একটা আসা হয় না।আচ্ছা ভাইয়া।মা আবার খুঁজবে আমায়।যাই এখন।”
” দঁড়াও নীলাশা।তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
এবার আমি ঘাবড়ে গেলাম।শীতের বিকাল এটা।তাই কুয়াশা পড়া শুরু হয়ে গেছে।যার কারণে চারদিকটা ধোঁয়াটে লাগছে।তার উপর ছাদে কোনো জনপ্রাণী’র চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।এই সময়ে সাদনান ভাইয়া কি এমন কথা বলবেন!চরম অস্বস্তি নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
চলবে…