মন গহীনে,পর্ব-২৮,২৯
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৮
বহুকষ্টে মনের সাথে যুদ্ধ করে উপস্থিত হলাম ডাইনিং রুমে।এখানে এসেও পড়লাম বিপাকে।তুষার ভাইয়ার পাশের চেয়ারটা বাদে আর কোনো চেয়ার খালি নেই।কি অসহ্য!সবাই কি ইচ্ছে করেই আমাকে যন্ত্রণায় ফেলতে চায় নাকি?
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুপি বলল,
” বসে যা মা।ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ”
আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে বসলাম তুষার ভাইয়ার পাশে।উনি একবারের জন্যও তাকাননি আমার দিকে।তুষ্টি আপুর সাথে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আর একটু পর পর ফুপির হাতের রান্নার বাহবা দিচ্ছেন।
আমি মনে মনে গালি দিয়ে উনার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছি।বদ লোক একটা।একটু আগে রুমে আমায় দম বন্ধ করে মারতে গিয়েছিল। আর এখন দেখো দিব্যি ভালো মানুষ সেজে সকলের সাথে হেসে খেলে ভাত গিলছে।
টেবিলে খাবারের নানা রকমের পদ।মাঝখানে একটা বোলের মধ্যে সর্ষে ইলিশ দেখা যাচ্ছে। মা তাহলে ঠিকই বলেছিল যে ফুপি তুষার ভাইয়ার ফেভারিট আইটেম রান্না করবে।মা’য়ের কথা তো মিলে গেল দেখছি।
খাওয়ার একপর্যায়ে বাম হাতে কারো স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলাম।অন্য একজনের বলিষ্ঠ হাতের বিচরণ টের পাচ্ছি আমার হাতের উপর।সেই অন্য একজনটা যে তুষার ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নয় তা নিমিষেই বুঝে গেলাম।চোখ বাঁকা করে তাকিয়ে দেখি উনি নিজের মত করে খেয়ে যাচ্ছেন।
হাত টেবিলের নিচে হওয়ায় বাকিরা তা দেখতে পারছেন না।তাই আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আরো গভীরভাবে চেপে ধরলেন।কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে সকলের অলক্ষ্যে চোখ গরম করে তাকালাম উনার দিকে।তখনই উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে দিলেন।ব্যস! গলায় খাবার আটকে কেশে উঠলাম আমি।যার ফলে সকলের দৃষ্টি অটোমেটিকলি আমার উপর চলে আসলো।নিজেকে কেনো জানি জোকার মনে হচ্ছে।
তুষার ভাইয়া আমার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” কি আশ্চর্য! কয়টা ভাত মাত্র মুখে দিলি আর এখনই কাশি উঠে গেল?এর আগেও খেয়াল করেছি খাওয়ার সময়ই তোর কাশি উঠে যায়।আমি বুঝি না খাবার তোর পাকস্থলীতে না গিয়ে শ্বাসনালিতে ঢুকতে যায় কেনো?”
তুষার ভাইয়ার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেললাম।রাগের কারণে চোখে আমি অন্ধকার দেখছি।মন বলছে এই খালি গ্লাসটা উনার মাথায় বারি দিয়ে দু টুকরো করে ফেলি।উনার জ্বালায় ভাত খেতেও পারব না।
যাই হোক মাথা ঠান্ডা করে আবার খাওয়ায় মনযোগ দিলাম।কিন্তু তুষার ভাইয়া তো আজ পণ করেছে যে তিনি আমাকে শান্তিতে ভাত খেতে দিবেন না।কোনো না কোনো উপায়ে বিরক্ত করেই ছাড়বেন।
এবার উনি আমার প্লেটে একগাদা তরকারি দিয়ে দিলেন।আমি যে না করব সেই সুযোগটাও পাই নি।
” এটা কি করলেন তুষার ভাইয়া? এত খাবার আমি খেতে পারব না!শুধু শুধু তরকারিটা নষ্ট হবে।”
আমার কথায় ফুপিও সায় দিলেন,
” কেনো ওকে না জিজ্ঞেস করে দিতে গেলি?ইচ্ছে করেই এটা করলি তাই তো!ওর পেছনে না লাগলে তোর শান্তি হয় না?”
আমি প্লেট ছেড়ে উঠতে যাব তখন তুষার ভাইয়া বললেন,
” খাবার নষ্ট করলে গুনাহ্ হয় জানিস না?একদিন একটু বেশি খেলে কিছু হবে না।বস!”
আমি কাঁদকাঁদ হয়ে মা’য়ের দিকে তাকালাম।মা তুষার ভাইয়ার পক্ষ নিয়ে বললেন,
” খেয়ে নে না!এতটুকু খাবার নষ্ট করে কি লাভ।”
শেষপর্যন্ত আমাকে আবার বসতে হলো এবং সবটা খাবার শেষ করলাম। পেটে আর একবিন্দুও জায়গা নেই।এক্ষুনি ব্লাস্ট হবে।তুষার ভাইয়া যে এত বজ্জাত তা তো জানা ছিল না।শুধু বজ্জাত নয়।বজ্জাতের হাড্ডি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাতে হবে নাহলে আবার অন্য কোনো উপায়ে উনি আমায় জ্বালাতে চলে আসবেন।
.
বাসায় যখন ঢুকলাম তখন ঘড়ির কাটা এগারোটার ঘরে।ঘুমের তাড়নায় দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও পাচ্ছি না।অন্যদিন তো এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না।নিশ্চয়ই এতগুলো খাবার খাওয়ার কারণে দুনিয়া অন্ধকার করে ঘুম নেমে আসছে।
চটপট লাইট অফ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।চোখ বন্ধ করতেই বালিশের পাশে থাকা মোবাইলটা ভূমিকম্পের মত ভাইব্রেট করে উঠল।ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।মোবাইলের স্ক্রিনে তুষার ভাইয়া নামটা জ্বলজ্বল করছে।বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে গেল আমার।এই হনুমান এখন ফোনেও জ্বালাবে নাকি?ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু এটা তো অনবরত বেজেই যাচ্ছে।শেষে বাধ্য হয়ে কল রিসিভ করে কানে লাগালাম। সাথে সাথেই তুষার ভাইয়ার কন্ঠ শোনা গেল,
” কি করছিস নীল?”
তুষার ভাইয়ার গলার কন্ঠ শুনে কিছুটা ধাক্কার মত খেলাম।কি সুন্দর সুমিষ্ট পুরুষালি গলা।উনার ভয়েস কি দিন দিন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে নাকি?
তবে যাই হোক।উনার মুখে নীল নামটা খুব মানায়।আমাকে নীল বলে আর কেউ ডাকে না।আমিও চাই না আর কেউ ডাকুক।এই নামটা একমাত্র উনার মুখেই শোভা পাক।
” চুপ কেনো।কথা বল!”
নিজের নাম নিয়ে বিশ্লেষণ করতে করতে কোথায় যে হারিয়ে গেছিলাম।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
” আপনার গলার স্বর চেঞ্জ হয়ে গেছে?”
” মানে?চেঞ্জ হবে কেনো?”
” না আমার কাছে একটু অন্যরকম লাগছে আর কি।”
” অন্যরকম কেমন?ভালো না খারাপ?”
” ভালোই লাগছে।”
তুষার ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন।আমার চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে গেছে।তাই রুমের সাথে অ্যাটাচড্ থাই গ্লাসটা সরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে পড়লাম।
তুষার ভাইয়া বললেন,
” প্রেমে পড়েছিস তো তাই এমন লাগছে।”
” এহ্ মোটেও না।”
” কি মোটেও না?তুই কি বলতে চাইছিস তুই প্রেমে পড়িসনি?”
আমি ঠোঁট টিপে হেসে বললাম,
” ঠিক ধরেছেন।”
তুষার ভাইয়া চুপ করে গেলেন।আমি মোবাইল সামনে এনে দেখি এখনো কল কাটেনি। তারমানে লাইনে আছেন।তাহলে চুপ মেরে গেলেন কেনো?উনি কি আমার কথা সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন?
হঠাৎ করেই উনি বলে উঠলেন,
” ভালোবাসিস তো আমায়?”
এমন প্রশ্ন শুনে এবার আমি থেমে গেলাম।কিন্তু কেনো?উনি তো কঠিন কোনো প্রশ্ন করেনি আমায়!তাহলে বুক কাঁপছে কেনো আমার।সাথে লজ্জা লাগছে ভীষণ।গালদুটো গরম হয়ে উঠছে।
কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,
” আপনি তখন আমার সাথে ওইরকম কেনো করলেন হুম?আপনার জন্য আমাকে এক প্লেটের উপর ভাত খেতে হয়েছে।আপনি তো বাচ্চাদের থেকেও বড় শয়তান।”
” বল্ না নীল!শুনতে ইচ্ছে করছে খুব!”
কথা ঘুরানোর বুদ্ধি কাজে লাগল না।উনি নাছোড়বান্দা হয়ে আছেন।কখনো ভালোবাসার কথাটা উনাকে সরাসরি বলা হয় নি।তাই নার্ভাস লাগছে আমার।ফোনের অপর পাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।আমি জানি উনি অপেক্ষা করে আছেন সেই উত্তর টা শোনার জন্য।
অবশেষে মনে সাহস জুগিয়ে বলেই ফেললাম,
” ভালোবাসি আপনাকে।প্রচন্ড ভালোবাসি।আরো অনেক ভালোবাসতে চাই।”
তুষার ভাইয়া কিছু বলছেন না।কিন্তু আমি স্পষ্ট উনার শ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমি না দেখেও বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে উনার ঠোঁটে সেই মনভোলানো হাসি গেঁথে আছে।
তুষার ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,
” যদি ভালোবেসে থাকিস তাহলে প্রেমেও পড়েছিস।প্রথমে প্রেম তারপর সেটা থেকে ভালোবাসার জন্ম।তুই বলেছিলি না যে তুই বিভিন্ন উদ্ভট কাজ করে বেরিয়েছিলি!তখন তুই প্রেমের রঙিন হাওয়ায় ভাসছিলি তাই এসব করেছিস।”
” আপনি তো দেখি ভালোবাসায় দক্ষ হয়ে গেছেন।”
” হ্যাঁ তোর ভালোবাসায় জড়িয়ে আমি দক্ষ থেকে দক্ষতর হয়ে গেছি।”
প্রশস্ত হাসলাম আমি।এই লোকের সাথে তো কথায় পারা যাবে না।চারদিকে তাকিয়ে দেখি পাশের বিল্ডিং থেকে আসা আলোগুলো আর দেখা যাচ্ছে না।তাই অন্ধকার টা গাঢ় মনে হচ্ছে। এবার বেশ ভয় লাগছে আমার।
” এই যে দক্ষ প্রেমিক! ফোন রাখছি তাহলে।আপনি ঘুমান।”
সাথে সাথেই তুষার ভাইয়ার গর্জন শোনা গেল।
” ফোন রাখবি না নীল!আমার ঘুম নিয়ে তোকে ভাবতে বলেছে কেউ?”
” আরে চিৎকার করছেন কেনো?আচ্ছা আপনি না ঘুমালে নাই। আমি ঘুমাব।আর এমনিতে আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘুম কেটে গেছে।এরপর আর কখন ঘুম আসবে কে জানে! এতরাত পর্যন্ত সজাগ থাকলে আমায় ভূতের ভয় কাবু করে ফেলে।”
” ওকে রিল্যাক্স।যা ঘুমানোর ট্রাই কর।আচ্ছা এক কাজ কর তো! বালিশে মাথা রেখে ফোনটা কানের কাছে ধরে রাখ।আমি তোকে একটা গান শুনাই।তাহলে দেখবি ঘুম এসে যাবে।”
এই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।উনি নাকি আমাকে গান শুনাবে।গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে আমায়?মানে বিশ্বাস হচ্ছে না।
” সত্যিই গান শুনাবেন?”
” এত প্রশ্ন না করে যা করতে বলেছি কর।অযথা প্রশ্ন করা তোর বাজে স্বভাব।”
আমি তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে চলে এলাম রুমে।তুষার ভাইয়া আমাকে গান শুনাবে!ভাবা যায়?
বালিশে মাথা রেখে বললাম,
” শুরু করুন!”
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা শেষে তুষার ভাইয়ার মনোমুগ্ধকর কন্ঠ শুনতে পেলাম আমি।
‘ তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়,নিভৃত,পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম’
মম জীবন যৌবন,মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে,নিশীথিনী -সম
তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে………..
গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।কিন্তু গানের রেশ এখনো কানে ক্ষীণ হয়ে প্রবেশ করছে।ঘুমের মধ্যে থেকেও অনুভব করতে পারছি মাথায় শুধু একটা লাইন প্রতিফলিত হচ্ছে,
‘ তুমি রবে নীরবে’
চলবে…
মন গহীনে
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৯
শুরু হয়ে গেল অ্যাডমিশন টেস্টের প্যারা।প্যারা কত প্রকার ও কি কি তা এখন ভালোই টের পাচ্ছি। গত এক সপ্তাহ ধরে কোচিংয়ে আসা যাওয়া করছি।অনেক চিন্তা ভাবনা করে ভার্সিটির জন্য ভর্তি হয়েছিলাম।তুষার ভাইয়া বলেছিল মেডিকেল ফোকাস করতে। কিন্তু আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি যে মেডিকেলে ঢুকে জীবন তেজপাতা করার ইচ্ছা নেই আমার।এত পড়াশোনা আমার দ্বারা হবে না।আমার ইচ্ছা না থাকায় আর কেউই এই ব্যাপারে জোর করেনি।
এইচএসসি পরীক্ষার জন্য যতটুকু পড়েছি তারচেয়ে বেশি পড়তে হচ্ছে অ্যাডমিশনের জন্য। মাঝেমাঝে মন চায় এসব ছেড়ে বিয়ে করে ফেলি।কি দরকার পড়ালেখার? জামাইয়ের টাকায় খাব বসে বসে।আহা! কি সুখ।
কিন্তু মনের এই লুকায়িত চিন্তা গুলো লুকিয়েই রাখি।বাইরে প্রকাশ করার কথা ভুলেও ভাবি না।তুষার ভাইয়ার কানে এসব গেলে আমার কান আর কানের জায়গায় থাকবে না।উনার এক চড়ে সেটা আকাশে উড়ে যাবে।
তুষার ভাইয়ার সাথে এখন দেখা সাক্ষাৎ কম হয়।এমনিতে রাতের বেলা ফোনে টুকটাক কথা বলি।তা ও খুব অল্প সময়।উনি জোর করে ফোন রেখে দেন।আমার নাকি পড়ার ক্ষতি হবে।উনি এত পাষাণ হলেন কবে থেকে কে জানে।
মাঝেমাঝে উনি এমন সব কান্ড করে যে না হেসে পারি না।যেমন,
সেদিন রাতে ডিনার করার পর উনাকে কল দিয়েছিলাম।বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলেন।আমি কিছু বলার আগেই উনি বলে উঠলেন,
” ডিনার করেছিস নীল?”
উনার কন্ঠ শুনে মনটা শীতল হয়ে গেল।কিন্তু এত ক্ষীণ শোনা যাচ্ছে কেনো?উনি কি অসুস্থ?
” আপনার কি শরীর খারাপ তুষার ভাইয়া? ”
” না।অনেক টায়ার্ড আমি।আজ অফিসে একটু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে।”
” ডিনার করেছেন?”
” এই প্রশ্নটা আগে আমি তোকে করেছি।তাই তুই আগে উত্তর দিবি।”
” জ্বি করেছি।এবার আপনি বলুন।”
” তুই খাওয়া মানেই আমার খাওয়া।”
অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” ফিল্মি ডায়লগ আমার সাথে করবেন না।এগুলো এক সাইডে রেখে আসুন।”
” রেগে যাচ্ছিস কেনো?খেয়েছি। রাতে না খেলে মা কি আমায় আস্ত রাখবে!”
” এখন কি ঘুমিয়ে যাবেন?”
” কেনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে?”
আমি চুপ করে রইলাম।এটা কি আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?উনি তো সবই জানেন।
” তোর পরীক্ষাগুলো শেষ হোক তারপর দেখবি দিনরাত কথা বলব।একটু মন দিয়ে পড় তাহলে দেখবি ভাল একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যাবি।রাখছি এখন।ভালো থাকিস!”
তুষার ভাইয়া কল কেটে দিলেন।মনটাই খারাপ হয়ে গেল।আরেকটু কথা বললে কি এমন হত!যাই হোক উনি যেহেতু অনেক ক্লান্ত তাই এটা নিয়ে মুখ কালো করে লাভ নেই।উনার কষ্টটাও তো আমার ভেবে দেখতে হবে!
বারান্দা থেকে রুমে আসতে নিব তখনই ফোন আবার বেজে উঠল।তুষার ভাইয়া কল করেছেন।সব ভুলে মনটা আবার আনন্দে নেচে উঠল।রিসিভ করে কানে লাগাতে উনি বললেন,
” তুই একবার পরীক্ষাটা দিয়ে নে তারপর সোজা বিয়ে করে ফেলব।এই অপেক্ষা আমার আর সহ্য হচ্ছে না।দেখ না, ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করেছি কিন্তু তবুও তোর মায়াবী মুখটা বারবার ভেসে উঠছে।মন চাইছে ছুটে যাই তোর কাছে।জাপটে ধরে কানের কাছে বলতে থাকি ভালোবাসি ভালোবাসি! এই রোগের মেডিসিন শুধু একটাই।তোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করে ঘরে তুলে আনা।বিয়ের পর কিন্তু রাতে আমরা এক ফোঁটাও ঘুমাব না।অর্ধেক রাত গল্প করব আর বাকি অর্ধেক রাত রোমান্স! আমি আগেই সব ঠিক করে রেখেছি।আচ্ছা তাহলে রাখি কেমন।শুভরাত্রি আমার ভালবাসা।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি কল কাটলেন।হাসব না কাঁদব বুঝতে না পেরে আমি বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি।লোকটা কি পাগল?
নিজের অজান্তেই মুচকি হাসলাম।বেশ লাগে উনার এই পাগলামি গুলো।খেয়াল করলাম মন খারাপ ভাবটা কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে মুহুর্তেই।তাই আমি উনাকে একটা মেসেজ সেন্ড করে দিলাম,
” আমার মন খারাপের কারণ আপনি আবার মন ভালো হওয়ার কারণও আপনি!”
__________________________
সময়ের স্রোতে ভেসে চলেছি আমি।সেই স্রোত তার নিজস্ব গতিতে পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিল আমায়।আমিও আমার প্রস্তুতি অনুযায়ী ভার্সিটির এক্সামগুলো দিয়েছি।এখন দেখা যাক কোথায় চান্স হয়।পরীক্ষা গুলো খারাপ হয়নি।এইচএসসি’র রেজাল্ট এ প্লাস এসেছিল যার জন্য দুশ্চিন্তাটা একটু কম।তাই মনে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা আসতে দিচ্ছি না।নিয়মিত উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছি যাতে আমার মনের আশাটা পূরণ হয়ে যায়।
.
সন্ধ্যায় রুমে বসে আপনমনে ফেসবুকে নিউজফিডে ঘুরছি।ফ্রেন্ড যারা আছে ওদের সাথে তেমন একটা কথা হয় না।আমি তো শুধু তুষার ভাইয়ার সাথে মেসেজিং করার জন্য অপেক্ষায় থাকি।যখনই দেখি সবুজ বাতি জ্বলছে তখনই নক দেই।সবসময় আমিই আগে মেসেজ দিই।মাঝেমধ্যে রাগ লাগে যে উনি কি একদিনও আমাকে আগে দিতে পারে না?
আমি তো ঠেকায় পড়ে প্রথমে মেসেজ দিই কারণ আমি তো সামনাসামনি উনার সাথে তেমন একটা কথা বলতে পারি না।লজ্জা লজ্জা লাগে।উনার চোখে চোখ রাখতে গেলেও বুক ধুকপুক করে।যেভাবে তাকিয়ে থাকেন বাবারে!
মা’কে রুমে ঢুকতে দেখে ফেসবুক থেকে বের হয়ে গেলাম।মা’য়ের মুখে কেমন যেন চিন্তার ছায়া।কিছু হয়েছে নাকি?
মা আমার পাশে বসে বলল,
” তোকে কিছু জরুরি কথা বলব নীলাশা।আগে পুরো ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনবি তারপর সিদ্ধান্ত জানাবি।আগেভাগে চিল্লাচিল্লি করবি না কিন্তু। ”
” কি হয়েছে মা? তাড়াতাড়ি বলো। টেনশন হচ্ছে আমার।”
মা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
” কাল রাতে তো দেখলি তোর বাবা আর আমি তুষারদের বাসায় গেলাম।আসলে তোর ফুপি ডেকেছিল।তো উনারা বলল তুষার এবং তোর বিয়েটা এই মাসেই দিয়ে দিতে চায়।তুষারের চাচাতো ভাই বোন যেগুলো আমেরিকা থাকে ওরা ছুটিতে বাংলাদেশ আসবে।ওদের ভিসা নাকি বেশিদিনের নেই।তাই তোর ফুপা ফুপির ইচ্ছে ওরা থাকতে থাকতেই যেন বিয়েটা হয়ে যায়।ছেলেমেয়ে গুলো আনন্দ করতে পারবে।আবার কবে আসবে না আসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই।জানিসই তো তুষারের বেশিরভাগ কাজিন দেশের বাইরে থাকে।”
মায়ের কথা শুনে খুব দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম আমি।এত জলদি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না আমার।প্ল্যান ছিল আরো দু তিন বছর যাক তখন চিন্তা করা যাবে।কিন্তু এখন তো দেখি পরিস্থিতি উল্টো হয়ে গেছে।
মা অধীর আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন!
আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,
” ত..তোমরা দুজন কি চাও?তোমরা ফুপিদের সিদ্ধান্তে রাজি?”
” দেখ্ আমাদের দিক থেকে তো কোনো সমস্যা নেই।উনারা যদি বলত বিয়ে আরো পাঁচ বছর পর হবে তখনও আমরা রাজি থাকতাম।এখন যেহেতু উনারা চাচ্ছেন বিয়ে এই মাসে হয়ে গেলে সুবিধা হবে তাই তোর বাবা আর আমিও অমত করতে চাইছি না।কিন্তু তোর ফুপি বলে দিয়েছে তোকেও যেন এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়।”
” তোমরা দুজন যেহেতু রাজি তাহলে আমিও রাজি।”
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলেন।আমিও চোখ বন্ধ করে মা’য়ের আদর উপভোগ করছি।
মা মৃদু হেসে বলল,
” পিচ্চি নীলাশা কত বড় হয়ে গেছে।আজ বাদে কাল শ্বশুর বাড়ি যাবে।”
মা’য়ের চোখ ছলছল করছে।এটা দেখে আমিও আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না।মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।
.
সন্ধ্যার পর তুষার ভাইয়াকে কল দিলাম।কল দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো উনাকে রিকোয়েস্ট করে দেখব বিয়েটা আরো কয়েকমাস পেছানো যায় কিনা।অন্তত ভার্সিটিতে ভর্তির ঝামেলা গুলো শেষ হোক তারপর না হয় বিয়ের চিন্তা করা যাবে।তখন তো ঝোঁকের বশে মাকে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম।
একবার রিং হতেই তুষার ভাইয়া রিসিভ করলেন।বরাবরের মত আমি হ্যালো বলার আগেই উনি বললেন,
” নীল! আমি তো বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছি একটু।এখন রেস্টুরেন্টে আছি।ধুমসে খানাপিনা চলবে।তোর জন্য কি আনব বল।পার্সেল করে নিয়ে আসব তোর আর তুষ্টির জন্য। ওই পেত্নী বলেছে পিৎজা খাবে।তুই কি খাবি?”
আমার বিষন্ন মনটা আরো বিষিয়ে গেল।উনি তো দেখি দারুণ ফুর্তিতে আছেন।আর এদিকে আমি বিয়ের চিন্তায় আধমরা।
” আমার কিছু লাগবে না ভাইয়া।আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
” তাহলে বলতে থাক।”
” মা আজকে বলল আপনারা নাকি চাইছেন বিয়েটা এই মাসেই হয়ে যাক।আপনার কাজিনরা নাকি ছুটিতে আসবে বিডিতে।কিন্তু আমার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে মন চাইছে না।আরো এক বছর যাক।আপনি প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করুন না!”
তুষার ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে মোবাইল কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি।একটু আগে কি বলেছিলাম সেটা আরেকবার মনে মনে আওড়িয়ে নিলাম।আমি তো কোনো হাস্যকর কথা বলিনি। তাহলে উনার এমন হেসে উঠার কারণ কি?
” এত বুদ্ধি করে প্ল্যান খাটিয়ে বিদেশ থেকে কাজিনদের নিয়ে আসছি আর তুই বলছিস বিয়ে পেছানোর কথা!”
” মানে?”
” মানে হলো এই প্ল্যান টা আমার।বাবা মাকে বিয়ের কথা নিজের মুখে কিভাবে বলবো।তাই বিদেশ থেকে কাজিনদের হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসা লাগছে।জানিস এর জন্য ওদের প্রত্যেককে দামী দামী গিফট কিনে দিতে হবে।এমনই শর্ত দিয়েছে আমায়।আমার একাউন্টের অর্ধেক টাকা মনে হয় ওরাই খেয়ে দিবে।হাহাহা।যাক এটা কোনো ব্যাপার না।”
হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি।রাগে আমার শিরা-উপশিরা দপদপ করে উঠছে।উনি সামনে থাকলে নিশ্চিত উনার গলা টিপে ধরে ভয়ানক কান্ড বাঁধিয়ে দিতাম।
রাগে বেসামাল হয়ে বললাম,
” আপনি…আপনি এত খারাপ!সবকিছুর মূলে আপনি রয়েছেন আর আমি কিনা আপনার কাছেই সাহায্য চাইতে এসেছি।”
তুষার ভাইয়া উচ্চ শব্দে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন,
” আমি যে তোকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না।সবচেয়ে বড় কথা আমার সব বন্ধু-বান্ধব বিয়ে সাদি করে বসে আছে।একমাত্র আমিই এখনো কুমার।এতগুলো বিবাহিত ছেলের মাঝে আমি এক অসহায় ব্যক্তি নিজের কাছেই তো খারাপ লাগে।ওরা আমাকে নিয়ে ননস্টপ হাসি তামাশা করে এটা কি মেনে নেওয়া যায়!তুই বল!”
” আপনি একটা ধূর্ত ব্যক্তি।আপনি একটা অসভ্য। আমি সিরিয়াস মুডে আছি আর আপনি মজা করে যাচ্ছেন? ”
” তোকে সিরিয়াস মুডে থাকতে কে বলেছে?আর তোর জন্য অসভ্য কেনো অসভ্যের বাপ হতে রাজি আমি।”
” আপনি একটা….আপনি একটা অসহ্য প্রাণী!”
” কুল নীল! এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই।চিল মুডে থাক।বিয়ে হবে আনন্দ কর।এই আমাকে দেখ্ , ফ্রেন্ডদের যখন জানিয়েছি বিয়ের কথা ওরা সবাই ঘাড় মটকে ধরেছে ওদের আজ ট্রিট দিতেই হবে।সেই কারণেই রেস্টুরেন্ট এলাম।তোর জন্য কি আনব বললি না যে?”
আমার এই মুহূর্তে মন চাইছে আছাড় দিয়ে ফোনটা ভেঙে ফেলি।তারপর বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করি।এই শয়তান লোক আমার জীবন তেজপাতা বানিয়ে ছেড়েছে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,
” আপনি আমার জন্য একটা ধারালো ছুরি নিয়ে আসবেন।ওটা দিয়ে আপনাকে খুন করব আমি।আর হ্যাঁ একবোতল বিষও আনবেন।আপনাকে খুন করে আমি বিষ খেয়ে মরে যাব।”
তুষার ভাইয়া আগের মতই উৎফুল্ল মনে হাসতে লাগলেন যা শুনে আমার মাথা আরো গরম হয়ে গেল।
” তাহলে তো ভালোই হবে নীল।তুই হবি পেত্নী আর আমি হব ভূত।আমরা প্রেম করব তারপর বিয়ে করব।ঘুরেফিরে তো একই কাহিনী তাই না?”
নাক মুখ ফুলিয়ে কল কেটে দিলাম আমি।উনার সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বললে আমি পাগল হয়ে পাবনা যাব।সবকিছুর পেছনে যেহেতু উনার হাত তাহলে সেখানে আমি আর কি করতে পারি!
চলবে…