এক পশলা বৃষ্টি আর সে, পর্ব – 23

0
680

৪৩
,
,

,
বাড়ি ফেরার পর সেদিনের কেনাকাটা গুলো খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে চুরিয়ে উঠিয়ে রেখে দিলাম আলমিরায়……ওনার প্লান ছিলো সবাইকে এক সাথে করে ছোট খাটো একটা খাওয়ার আয়োজন করবেন…… কথা খানা শুনে বেশ খুশিই হয়ে গেলাম….. ফের এক সাথে হবো সবাই…… আম্মুকে একথা জানাতেই ওনি মাস খানেক পর করতে বললেন….. মেঝো ভাইয়ার কি একটা যেন কাজ পড়ে গেছে….. সেই কথাই বহাল রইলো……
,
,
,
সে রাতে আমার উপহার টা আমি পেয়ে গেলাম……. আকাশি রঙা একটা স্বর্নকাতান….. তারউপর গোল্ডেন সুতো বুনা…. মিনা করা পাকা একটা শাড়ি….. শাড়ীটা দেখে আমি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম….. ওনি আলাদা করে অন্যপাশে শাড়ি দেখেছেন সেটা আমিও দেখেছি কিন্তু এই শাড়ি টা কখন কিনলেন ওনি….. মায়ের জন্য আম্মুর জন্য বড় আপু আর মেজো ভাবির জন্য মোটামুটি মহিলা প্রায় সকলের জন্যই শাড়ি কেনা হয়েছে…. কম করে হলেও দেড়শো খানেক শাড়ি ঘাটা হয়েছে কিন্তু এতো সুন্দর শাড়িটা তো চোখেই পড়লো না….আমাকে এতো কিছু ভাবতে দেখে ওনি ফের কি যেন একটা আমার হাতে তুলে দিলেন…. ছোট্ট একটা বক্স… এমা এইটা আবার কি…. তাজ্জব হয়ে দেখতে দেখতেই ওনি আমার হাতেই বক্সটা খুলে দিলেন…. খুব সুন্দর মুক্তোর নাকফুল… আমার বোচা নাকে একেবারে মানানসই যাকে বলে…..সেরাতে ওনার আব্দার রক্ষার্থে বেশ ঘষামাজা করে পুরাতন টা খুলে নতুন টা পড়া হলো…. ঘষামাজাই নাক একেবারে লাল টমেটো হয়ে আছে…. তবে আয়নায় নাকের সেই লাল অংশটার মাঝে নাকফুল টা দেখে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম…. আহামরি কিছু না এই ছোট্ট একটা জিনিসে সৌন্দর্য যেনো আরও বেড়ে গেছে……. ওনি পেছন থেকে এসে কাধে হাত রাখলেন….
,
,
,
——— খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম…
,
,
——— কিছু কষ্ট পেতেও আনন্দ….
,
,
——— আচ্ছা….
,
,
——— হুম…
,
,
,
আর কথা না বাড়িয়ে জিনিসপত্র ঠিকঠাক রেখে ফ্রেশ হয়ে একেবারে শুয়ে পড়লাম…… ওনিও সেই রোজকার মতোই জড়িয়ে ধরলেন….. পেটের উপর হাত দিয়ে কি যেন সব আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছে…..
,
,
——— শিমুল ভাইয়াকে কি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসতে…..???
,
,
,
ওনার কথা শুনে অবাক হতে গিয়েও হই নি……. কারণ শিমুল ভাই আমার জীবনের কোন কালো অধ্যায় না যা নিয়ে আমি লুকোচুরি করবো….. তবে শিমুল ভাইকে নিয়ে ঘটা করে কিছু বলার মতোও আমার কাছে নেই…. কিভাবেই বা থাকবে? আর কিই বা থাকবে?? যা ছিলো তা সবই একপাক্ষিক……. একপাক্ষিক অনুভূতির কি কোন বৈধতা আছে??? নেই….. ওসব আমার……
,
,
,
——— তুলি তোমার এই দীর্ঘশ্বাস গুলো ও কি তোমার শিমুল ভাইয়ের জন্য??
,
,
——— উঁহু আমার দীর্ঘশ্বাস গুলো একান্তই আমার…..এর ভাগীদার আমি কাউকে করি নি….
,
,
——— আগের প্রশ্নের উত্তর দিলে না যে?
,
,
——— একসাথে কি দুজন মানুষকে একই জায়গায় রাখা যায়? আর তুলনা দুটো ভিন্ন জিনিসে হয় না…..শিমুল ভাই হচ্ছে আমার কল্পনার বাস্তব….. যা কেবলি একপাক্ষিক…. তবে একে ভালোবাসা না বলে বিশেষ ভালোলাগা বলা যেতে পারে……
,
,
——— বিশেষ ভালোলাগা!!! তা সে কি এখনো বিদ্যমান!!!
,
,
——— ভালোলাগা তো ভালোলাগাই তার কি কোন এখন তখন আছে নাকি!!
,
,
——— আলবাত আছে….. আমার বউ তার বিশেষ ভালোলাগা দেখে মুখ গম্ভীর করে বসে থাকবে আর আমি সেটার এখন তখন দেখবো না!!!
,
,
,
ওনি কিছুটা রেগে আমাকে ওনার দিকে ফিরিয়ে রাগি রাগি চোখ করে কথা গুলো বলছিলেন…… কেন যযেন আজ এই রাগে ভয় হচ্ছে না…. মনে হচ্ছে চোখ দুটোতে বেশ অভিযোগ জমা হয়েছে….. ওনি আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বলতে শুরু করলেন ———
,
,
,
——— আচ্ছা আমাকে আর তোমার শিমুল ভাইকে যদি অপশনে রেখে বিয়ের জন্য তোমার মতামত চাইতো তাহলে তুমি কাকে সিলেক্ট করতে!!!
,
,
——— পায়েস আর নিমতিতার মধ্যে পছন্দ কোনটা জানতে চাইলে পাগলও তার পছন্দ পায়েস ই বলবে….. সেখানে আমি তো সুস্থ সবল অবলা রমণী….
,
,
——— আমি নিমতিতা!!!
,
,
——— হুম তারসাথে একেবারে মানুষরুপি যমঠাকুর…
,
,
——— তুলি…. আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি…
,
,
——— উফফফফ আমারতো ভীষণ রকমের ভয় করছে এই রাগ দেখে….. বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলাম…..
,
,
,
উনি খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখমুখ কুচকে গায়ের অর্ধেক ভার আমার উপর ছেড়ে দিলেন….. আমি তখন গা কাপিয়ে হেসে যাচ্ছি…..
,
,
——— হাসবে না একদম….. হাসি বন্ধ….
,
,
এই কথা শুনে দাত কেলিয়ে হাসি শুরু করে দিলাম…..
,
,
——— ইশশ ছিঃ…..কি লাল দাত…..আজকে ফেরার সময় এক পাগল ঠিক এইভাবে তুমার মতোই সেইম লাল দাত কেলিয়ে হে হে করে হাসছিলেন…… একেবারে মিলে গেছে….একিইইই দাতে লাল শাক আটকে আছে…..
,
,
,
ব্যাস আমার হাসি উবে গেলো….. শেষ পর্যন্ত কিনা এক রাস্তার পাগলের সাথে তুলনা দিলো…..
,
,
,
——— উফফফ সরেন তো উপর থেকে….. দম বন্ধ হয়ে আসছে…..
,
,
,
এই কথা শুনে বেশ ভালো করে চেপে ধরলেন…… কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে বাহাতে গাল দুটো চেপে ধরে নিয়ে –
,
,
——— আমি নিমতিতা আর কি যেনো যমঠাকুর…… নিমতিতা স্ব্যাস্থের জন্য আর যমঠাকুর পড়াশোনার জন্য খুবই উপকারী বলেই ঠোঁট চেপে ধরলেন……. সেরাতে আর নিস্তার পাওয়া হলো না আমার……. সারারাত খুনশুটি আর ভালোবাসায়ই ভোর হয়ে গেলো…… ভোরের দিকে ওনার ঘামে লেপ্টে যাওয়া লোমশ বুকের উপর খুব চুপচাপ শুয়ে ছিলাম…… বুকের ধুপধাপ আওয়াজ টা যেন চারপাশ ছাপিয়ে যাচ্ছিলো……. একসময় মনে হচ্ছে আমার হৃদস্পন্দন আর ওনার হৃদস্পন্দন ঠিক একি তালে একি সময়ে স্পন্দিত হচ্ছে……মানুষটার সব কিছুতেই যেনো আমি সুখ খোজে পাই খুব সহজে…..বুকের উপর আঁকিবুঁকি করছিলাম আনমনে আর ওনি আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন…… কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি বলতেই পারি না…… বেশ কিছু সময় ধরে ডাকছেন ওনি উঠার জন্য কিন্তু আমি তো ঘুমের জন্য চোখ ই টেনে খুলতে পারছি না শুধু হু হা করে যাচ্ছি…… ওনার উপর থেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফের খুব আদর করে ডাকতে শুরু করে দিলেন ———
,
,
,
——— তুলি….. এই……. এইইইই তুলিইইইই…… আরে আম্মুও মনে হয় উঠে গেছে….. সকাল হয়ে গেছে বউ…. বলছেন আর অসভ্যের মতোন যেখানে সেখানে চুমু খাচ্ছে…… আমার উপর তখন মরার ঘুম ভর করেছে….. হাত পা ছড়িয়ে বেধর ঘুমাচ্ছি….. তবে আধো জাগরণের মধ্যে ওনার কথা গুলো কাজ গুলো বেশ বুঝতে পারছি….
,
,
——— এই বুচি…. নাক বুচি উঠবা নাকি…. বলেই নিজে উঠে হাত টেনে ধরলেন…….
,
,
——— ধুর বাল…..বালের প্যাচাল শুনতে ভাললাগছেনা কিন্ত……. আমারররর সারায়ায়ায়ায়া গায়ায়ায়া ব্যাথায়ায়ায়ায়া করতেছেএএএ প্রচুর…… আমি এখন উঠতে পারবো নায়ায়ায়া…. প্লিইইইজ্জজ্জ
,
,
,
কথাগুলো বলেই গোঙাতে গোঙাতে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম…… ওনিও আর দেরি না করে নিজে ফ্রেশ হতে চলে গেলো…… ফ্রেশ হয়ে এসে আমাকে একেবারে বিনাবাক্য ব্যয়ে টেনে তুললেন……..
,
,
,
——— শরীরের প্রতিটা জয়েন্ট যেনো ব্যাথায় একেবারে পচে আছে….. কোমড়ের শীড়দাড়া বেয়ে একেবার ঘাড় পর্যন্ত…….. হাটু গুলো একেবারে অসার হয়ে আছে….. বিছানা থেকে কাপড় ঠিকঠাক করে নেমে দারিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে আলমিরারর দিকে যেতেই ওনি বলে উঠলেন ওয়াশরুমে আগেই সব রেখে এসেছেন…….. গোসলের পানি গায়ে ঢালতেই বুঝতে পারলাম ঈষৎ গরম পানি….. গরমে গরম পানিটা বেমানান লাগছিলো তবে ব্যাথায় খুব আরাম পাচ্ছিলাম…… গোছল শেষ করে মাথায় টাওয়াল পেচিয়ে শাড়ি টা কাধের উপর ফেলে রুমে চলে আসলাম……. ওনি তখন বেডশিট চেঞ্জ করে বিনে রাখছিলেন…. শাড়ি টা পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম ভালো করে আঁচল জড়িয়ে….. ওনি তখন আমার পেছনে দাড়ানো ছিলেন…….
,
,
,
আম্মু হেটে ফিরেছেন সবে….. ফুলি খালা দুদিনের ছুটিতে আছেন…… রুটি বানাতে একদম ইচ্ছে করছিলো না….. গায়ে কোন বলই পাচ্ছি না………. ঘুমে চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে…… বিস্কুটের বয়ামে পাউরুটির প্যাকেট দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম….. ডিম চারটে সিদ্ধ বসিয়ে সালাদ কেটে টেবিলে গিয়ে দেখি কলাও আছেন….. আম্মু মনে হয় সকালে নিয়ে এসেছেন সাথে আরেকটা প্যাকেট….. নিশ্চিত কেইক হবে…….হলোও তাই…. কেইক গুলো প্লেইটে সাজিয়ে টেবিলের উপর রেখে আবার রান্নাঘরে চলে এলাম।।।। চুলোয় হালকা আছে দুধ বসিয়ে পাউরুটি আর জেলির বয়াম নিয়ে টেবিলে রেখে একে একে ডিম সেদ্ধ আর দুধ ও নিয়ে এলাম….. আম্মু ততক্ষণে চলে এসেছে…..
,
,
,
——— কিরে টুকি হাসপাতালে ব্রেকফাস্ট সাজালি দেখি…..
,
,
——— আম্মু ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে…..
,
,
——— তাহলে বাবুকে বলতি দোকান থেকে নাস্তা কিনে আনতো…. তুইতো এসব খেতে পারিস না…..
,
,
——— নাহ তুমিতো কেইক এনেছো…. ওতে হয়ে যাবে আমার….
,
,
——— এক কাজ করি আমি নাহয় চট করে কয়েকটা পরোটা ভেজে আনি…. ভেতরে চিনি দিয়ে….
,
,
——— নাহ আম্মু তুমি বসো….. একদিন একটু কম খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না….
,
,
,
ততক্ষণে ওনি ও চলে এসেছেন…… কেইক, কলা আর পানি দিয়ে নাস্তা সারতে চেয়ে ও পারলাম না…. আম্মু জোর করে অর্ধেক ডিম খাইয়ে দিলেন….. দুধ খাবার জন্য না করতেই মা ছেলে মিলে বকে ধমকে খাইয়ে ছাড়লেন…..নাস্তা শেষ করে ওনি অফিস চলে গেলেন সেই আগের মতো দরজা অব্দি গিয়ে পানির জন্য ডেকে নিয়ে পানি খেয়ে কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে পরলেন….. যাবার আগে বলে গেলেন টেবিলের উপর প্যারাসিটামল রেখে গেছেন…. গরম পানি দিয়ে যেনো খেয়ে নিই….. আমি কিছু বললাম না….. কিছু বলতেও ইচ্ছে করছিলো না….ব্যাথায় সারা গা টলমল করছে….. ঘুমটা ফের চেপে ধরেছে…. কিচ্ছু ভালো লাগছে না একেবারে…..

,
,
,
,
চলবে

লেখনিতে: চৈত্র রায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here