এক পশলা বৃষ্টি আর সে, পর্ব – 26

0
960

৪৬
,
,
,
একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি ওনি নামাজে বসে দুহাত তুলে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে আমার সুস্থতার আহাজারি করে যাচ্ছেন……. ওনার শরীরের প্রতিটা কাপুনি যেন বুকে গিয়ে ঠেকছে আমার…… ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওনার বুকে নিজেকে পিষে ফেলি….. আর জড়িয়ে ধরে বলি
,
,,
,
——— দেখুন আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি….. আপনি দয়া করে কাদবেন না আমার খুব কষ্ট হচ্ছে……. এভাবে কেউ কাদে বলেন…….

,
,
,
মনে মনে এসব বলে কষ্ট পেলেও কোথাও যেনো এই কষ্টের সুতোটা কেটে গিয়ে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে…… কয়জন মেয়ের এমন ভাগ্য হয় যে সে তার অসুস্থতার জন্য স্বামীর মোনাজাতে অশ্রু হয়ে ঝড়ে……… বাবা ঠিক বলেছিলেন সেদিন……. মানুষটা কোন হিরে মানিকের থেকে কম না…….. এমন একটা মানুষকে কেউ হয়তো বর্ননায় ও চাইতে পারে না….. আমার কোন জন্মের পূন্যের ফল হিসেবে আমি এমন একটা মানুষের সার্নিদ্ধ্য পেয়েছি…… নাহলে তো ওনাকে চাইবার মতো ক্ষমতা ও আমার নাই……..মা সবসময় বলতেন ——— যখন উপরওয়ালার কাছে তুমি কোন কিছু চেয়ে না পাও মনে রাখবে সেই জিনিস তোমার জন্য তিনি তৈরীই করেন নি আর যা করেছেন তা তোমার চাহীদার চেয়ে হাজার গুন ভালো……..
,
,
,
ভোর থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো……. প্রায় দু’সপ্তাহের ভ্যাপসা গরমের পর এই এক পশলা বৃষ্টির ঘনঘটা ঠিক অমৃতের মতোই দূর্লভ…….. জানালা ফুড়ে বৃষ্টি দেখাটা তখন আমার পোষাচ্ছিল না…… তাই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম বারান্দায়…… জানি হাত বাড়ালেও অভিমানীদের ছুতে পারবো না….. তারপরও বেহায়ার মতোন হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম সেদিন গ্রিল গলিয়ে……. বৃষ্টি ছুতে না পারার কষ্ট টা কেটে গেলো আবছা গায়ে লাগা বৃষ্টির ছাটে…… প্রায় দু’সপ্তাহের উপর হতে চললো আমার গোসলের কোন হদিস নেই…… সেক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টি টা আমার কাছে ঠিক কতটা প্রিয়…….. আনমনে বাইরে অভিমানীনিদের ঝড়ে পড়া দেখতে দেখতেই ধাতস্থ হলাম আর নিজেকে পেলাম ওনার কোলে…… স্বজ্ঞানে সেই প্রথম তার কোলে চড়া আমার…… আলতো করে বিছানায় বসিয়ে দিলেন…… মহাশয়ের আজ যে ছুটির দিন আমার তো খেয়াল ই ছিলো না……. জানি ভেতরে ভেতরে খুব রেগে ফেটে পড়ছেন কিন্তু আমাকে দেখাবেন না…… অদ্ভুত রকমের সত্যি টা হলো আজকাল আর ওনি আমাকে বকাবকি করে না…… বিগত তেরো দিনে তাকে আমি খাবার নিয়ে যে কি পরিমাণ জ্বালিয়েছি তা শুধুমাত্র আমি আর তিনিই জানি……. কি জানি তখন কি হতো আমার এক কথা দুবার বললেই মনে হতো ঘ্যানঘ্যান করছে…… ভালো করে কথাও বলতাম না কারো সাথে…… মাঝে মাঝে আম্মু আর ফুলি খালার উপর ও খুব বিরক্ত হয়ে যেতাম…… কিন্তু তারা হতেন না….. একবার তো এমন ও হয়েছে ওনি আস্ত আপেল ধুয়ে নিয়ে এসেছেন আমাকে খেতে দেবার জন্য….. কারণ কাটা আপেল আমি খেতে পারি না…… আমার কি হলো জানি না ওনার হাত থেকে আপেল টা নিয়ে আমি জানালা দিয়ে ঢিল দিয়ে ফেলে দিয়ে ওনাকে রুম থেকে বের করে দরজার নব লক করে রেখেছি….. তারপর কতক্ষণ নিজেই একা একা বসে কেদেকেটে ঘুমিয়ে পড়েছি…… দরজা খুলেছিলাম ঘুম থেকে উঠে সেই রাত আটটায়…… ভেবেছিলাম হয়তো খুব বকা খাবো কিন্তু ওনি একদম স্বাভাবিক ছিলেন…… রুমে ঢুকে সবার আগে কিসের চাবি খুজে বের নিজের চাবির গোছায় রাখলেন…… এরপর থেকে যতবার রুম থেকে আমাকে ছাড়া বের হতেন ততোবারই অই গোছা সাথে নিতেন….. তার থেকে বেশ বুঝতে পারলাম রুমের চাবি ওটা…….
,
,
,
পক্স গুলো অনেকটা শুকিয়ে এসেছে বলে আম্মু আর ফুলি খালা ডাক্তারের কাছ থেকে কনফার্ম হয়ে নিজেদের যাবতীয় নিয়মকানুন মেনে আমাকে গোছল করালেন…… সেই সাথে আমাদের রুমের বিছানার কভার থেকে শুরু করে জানার পর্দা এমনকি পাপোশ পর্যন্ত বদলিয়ে ফেললেন……… তার সাথে আমার আর ওনার গামছা টা ও নতুন হলো……. পুরো ঘড় ডেটল আর গরম পানি দিয়ে ফুলি খালা আর ওনি মিলে পরিষ্কার করলেন সাথে আরও একজন মানুষ নিয়ে…….বাড়ির সবাই কাজ নিয়ে ব্যাস্ত আর এদিকে আমি বসে বসে এটা খাই তো সেটা……
,
,
,
পক্স এখনো পুরোপুরি শুকায় নি বলে আম্মু নতুন কাপড়ের কয়েকটা লম্বা ফ্রক বানিয়ে দিলেন পায়ের পাতা পর্যন্ত…….গোছলের পর থেকেই একটা পড়েছিলাম……. আয়নায় নিজেকে দেখে পুরাই টাস্কি……খেয়ে খেয়ে গাল দুটো একেবারে টেনিস বল হয়ে গেছে……. চুল থেকে গামছা খুলে বারান্দায় মেলে দিয়ে রুমে আসতেই ওনি বাথরুম থেকে গোছল সেরে বেরুলেন…… আমার দিকে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে আয়নার সামনে চলে গেলেন……..
,
,
,
আমার গোছল করার দিন দুয়েক পর মা এলেন হুট করে হাতভর্তী এটা সেটা নিয়ে…… কয়দিন ধরেই নাকি আমাকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখছেন খুব…… সময় করে উঠতে পারছিলো না বলেই সেদিন একেবারে অফিস থেকেই চলে এসেছেন……… এসে সবকিছু শুনে খুব রাগ করলেন ওনাকে কিছু না জানানোর জন্য……..
,
,
,
——— তুলি বিয়ে দিলে মেয়েরা কেনো এতো পর হয়ে যায় তা আমি হাড়ে হাড়ে আজ বুঝলাম……. আর কেউ না হোক তুই কি আমাকে একটু জানাতে পারতি না……
,
,
,
মা সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সাথে আমিও……. মনে হচ্ছিলো যেনো একেকটা কাচের টুকরো থলথলে হৃতপিন্ডে ক্রমশ গেথে যাচ্ছে…… আসকে মাকে যে এ ব্যাপারে জানানো হয় নি তা আমি জানতাম না….. আর ওনারা জানান নি মা খামোখা টেনশন করবেন বিধায়।।।।। মা যাবার আগেই ওনি অফিস থেকে ফিরে এলেন…… তারপর খুব আয়েশ করে শ্বাশুড়ি তার জামাতাকে বকলেন।।।।। জামাতাও খুব ভালো ভাবে শ্বাশুড়ির রাগ ভাঙালেন……. সেবার মা আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আমার ও খুব বাড়ি বাড়ি করছিলো মনটা….. কিন্তু ওনি খুব সুন্দর করে মাকে মানিয়ে সাত পাঁচ চৌদ্দ দেখিয়ে যাওয়া টা নাকচ করে দিলেন…..রাতে ঘুমুতে গিয়ে মায়ের কথাগুলো ভেবে খুব খারাপ লাগছিলো…… আসলেই হয়তো খুব স্বার্থপর মানুষ আমি……এসব ভেবে যখন মন খারাপে মশগুল আমি তখন ওনি পেছন থেকে খুব করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন…….
,
,
,
——— মন খারাপ….
,
,
——— উঁহু
,
,
——— তাহলে কষ্ট হচ্ছে কেনো এখানটায়…..
,
,
,
ওনার কথাশুনে ওনার দিকে তাকানো মাত্রই ওনি ওনার বুকের বা পাশ টা হাতে ইশারা করলেন……আমি ভ্রু কুচকে তাকাতেই…..
,
,
,
——— আসলে হেডকোয়ার্টার এ কিছু একটা সমস্যা হয়েছে….. তাই আমার ব্রাঞ্চে ঝামেলা হচ্ছে…..
,
,
,
আমি ফিক করে দিলাম…..ওনার দিকে ঘুরে স্মিত হেসে বললাম ———
,
,
——— ঝামেলা!!! আগুন লাগলো কিনা চেক করেন শিগগির……
,
,
,
——— মনে হয় লাঘবে…. বলেই আমাকে ঠিক আগের মতো করে বুকের সাথে পিষে ফেললেন….
,
,
——— উফফফ…. ব্যাথা পাই তো….
,
,
——— কিচ্ছু করার নাই আগে আগুন নিভানো ফরজ কাজ……
,
,
,
,
,
চলবে

লেখনিতে: চৈত্র রায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here