এক পশলা বৃষ্টি আর সে, পর্ব – 29

0
1928

৪৯
,
,
,
রাতে ওনি বাসায় ফেরার পর বেশ খাতিরদারি শুরু করে দিলাম…. ব্যাপার টা ওনার কাছে যদিও অস্বাভাবিক ঠেকছিল…. বারবার তো জিজ্ঞেস ই করছিলো কিছু হয়েছে কি না…. বা কিছু ভুল করেছি কি না!! কিন্তু সেরকম তো কোন কিছুই ছিলো না…… আমি উত্তরে হেসে আহ্লাদী করে ওনাকে জড়িয়ে ধরে না করলাম….আমার না শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন ———
,
,
,
——— এতোক্ষণ কনফিউজড ছিলাম কিছু হয়েছে কি না!! তুমি জড়িয়ে ধরে একেবারে কনফার্ম করলে ব্যাপারটা…..
,
,
,
লোকটা এমন কেন…. কেমন করে যেন সব বুঝে যায়….. সেদিনের পর টানা আটদিন তৈলমর্দন করেও কোনভাবেই তাকে রাজি করানো গেলো না….. সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তার নাকি কি সব কাজ থাকে …. ছুটি একেবারে পসিবল না…. না মানে না…. কিন্তু আমিতো ছাড়ার পাত্রী না….. শুধু মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করছি মাত্র….এবং আমি খুব ভালো করেই জানতাম সেই সময় টা আমার খুব বেশি দূরে নয়….. তাই সুযোগের সদব্যাবহার করেও ফেললাম……
,
,
,
——— আচ্ছা তুলি আমাদের এই ঘনিষ্ঠ মূহুর্তেই কি তোমার এই কথা সেই কথা নানা হাবিজাবি মনে পড়ে…..?? মানে আমি যখন তোমাকে একটু আদর করতে যাবো ঠিক তখনি তোমার এটা ওটা চাই?
,
,
——— এমন করছেন কেনো!!।।। একদিনের ছুটিই তো….
,
,
——— আমি কিন্তু এইবার খুব রেগে যাচ্ছি….. কান্নাকাটি করেও কিন্তু কোন লাভ হবে না তখন বলে দিলাম….
,
,
ওনার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো….. তাই কিছুটা সরে এসেই একপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম….. ওনিও আর কথা বাড়ালেন না…..
,
,
——— আমি কাল মায়ের কাছে গিয়ে কয়টা দিন থেকে আসবো….. আপনাকে আর কষ্ট করে ছুটি নিতে হবে না…..
,
,
,
জবাবে ওনি কিছুই বললেন না…. কিন্তু নিরবতায় ওনার পর পর ফেলা দুটো দীর্ঘশ্বাস আমি বেশ স্পষ্ট শুনলাম….. আজকাল এতোই কাজপাগল হয়েছেন যে বাসায় ও লেট করে ফিরে….. বেশী সময় আর মন খারাপ করে থাকতে হলো না……
,
,
——— কোথাও যাওয়া চলবে না কাল…. আগামীকাল ছুটির এপ্লিকেশন করবো দেখি কি হয়…. বেশ গম্ভীর ভাবেই কথাটা বললেন…..
,
,
,
আমি তো খুশিতে বাকবাকম করতে করতে ওনার বুকের উপর চেপে বসে জড়িয়ে ধরলাম…. কিন্তু ওনি ধরলেন না আমায়….
,
,
,
———রাগ করেছেন??? ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে
,
,
——— না ভাবছি… দিনকে দিন আমার সংস্পর্শে থেকে থেকে তুমি কতটা চালাক হচ্ছো…. বেছে বেছে আমার ওয়িক টাইমে…
,
,
——— আপনার এতোদিনের কোলেপিঠে করে মানুষ করার ফলই তো…. আপনার নাক কাটতে দেই কি করে বলেন তো….
,
,
——— ওরেব্বাস।।।।
,
,
,
খুনশুটি আর ছোট ছোট ভালাওবাসাবাসিতেই কেটে গেলো সে রাত…. পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ওনাকে বারবার ছুটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম…..প্রথমত এতো সকালে আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে খানিকটা অবাকই হলেন…..সকাল থেকেই কি হলো জানি না তার একটু সুযোগ পেলেই জড়িয়ে ধরছে…. লুকিয়ে চুমু খেয়ে নিচ্ছে আবার বেশি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ গলায় বুকে কালসিটে দাগ ফেলে দিচ্ছে…. সকালে আম্মু আর ফুলি খালা মিলে ওনার প্রিয় ভূনা খিচুড়ি আর আলুভাজি করেছিলেন….. দেখে তার সেকি খুশি…. বেশ আয়েশি করেই সকালের নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ আল্লাদ করলেন…… বের হবার সময় ফের রুটিন মোতাবেক পানি চেয়ে নিয়ে শেষ চুমুটা কপালে তুলে দিয়ে বেরিয়ে পরলেন….. আর বলে গেলেন সাবধানে থেকো…..আম্মুকে দেখো…. আমি মিস্টি হেসে তাকে ফের ছুটির কথা মনে করিয়ে দিলাম….. ওনি আচ্ছা আচ্ছা করতে করতে মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন…….
,
,
,
সারাদিনের একাজ সেকাজ করে সেদিন আর ঘুমুতে ইচ্ছে হলো না….. একটা উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে….. আল্লাকে ডেকে মনে মনে মানত করে নিলাম আজ যেনো ছুটি নিয়েই ফেরে…..হাবিযাবি ভাবতে ভাবতেই আলমিরার কাপড় চোপড় ঘেটে পিকনিকের জন্য ড্রেস পছন্দ করছিলাম…… এর মধ্যেই আম্মু খানিকটা হন্তদন্ত হয়ে রুমে এলেন…..
,
,
,
——— টুকি মা চলতো একটু…
,
,
——— কি হয়েছে আম্মু… কোথায় যাবো…. একটু পর তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে….
,
,
——— আহ… এতো কথা…
,
,
,
আম্মু কথা শেষ করার আগেই ফোন বেজে উঠলো ওনার হাতের….. আমাকে কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন…. হাতের কাপড় বিছানার উপর রেখে আমিও আম্মুর পেছন পেছন গেলাম….. কি হয়েছে…. কোথায় যাবো বারবার বলার পর ও কিছুই বলছিলেন না…. তবে খুব টেনশনে আছেন তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম…… প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাড়ির গেইটের দিকটায় হবে এম্বুলেন্স এর আওয়াজ….. আমার সাথে আম্মুর চোখাচোখি হতেই ওনি একপ্রকার ছুটে বেড়িয়ে গেলেন…. আমি কিছু না বুঝেই ওনার পেছনে দৌড় দিলাম….. নিচে নামতেই দেখি সাফি ভাই আর রফিক ভাই ওনার বন্ধু পেছনের দরজার দিকে ওয়ার্ডবয় দের সাথে স্ট্রেচার বের করছে…. খুব আগ্রহ থাকা স্বত্তেও আমি সামনে এগুলাম না…. আম্মু ওনাদের চিল্লিয়ে যেনো কি বলছেন….. রফিক ভাই আম্মুকে এক হাতে ধরে আরেক হাতে নিজের চোখের জল মুছেই আমার দিকে তাকালেন…. আমার দৃষ্টি স্ট্রেচারের সাদা কাপড়ে মোড়ানো মানুষটার উপর ই নিবদ্ধ……. আমার সামনে দিয়েই সবাই মিলে স্ট্রেচার সহ সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলেন…. মুখ ঢাকার কারণে চেহারা দেখতে পেলাম না….. ওনাদের পেছন পেছন উপরে চলে এলাম….. আম্মু ও এলেন…. রফিক ভাইকে ছেড়ে স্ট্রেচারের রাখা মানুষ টার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়লেন কান্নায়…. আম্মুর জন্য আমি তখনো মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না….. সামনে এগুতেই মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি…. কোনভাবেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না…… সকালে ও তো মানুষ টাকে দিব্যি প্রাণোচ্ছল দেখেছিলাম….. পড়নের শার্ট নেই….. সারা শরীর জুড়ে শুধু ব্যান্ডেজ….. মাথায়….. হাতে…. এখানে সেখানে সারাশরীরে…. কপালের ব্যান্ডেজের জন্য চোখ দুটো ও কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে….. হাতটা দেখে মনে হচ্ছে ভেঙেই গেছে।।।।আচ্ছা আম্মু এভাবে মানুষ টার উপর শুয়ে আছে কেনো…. ব্যাথা পাচ্ছে তো….আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আম্মুকে ডাকলাম…
,
,
,
——— আম্মু উঠো….. ওনি ব্যাথা পাবেন….
,
,
আম্মুর কি হলো জানিনা ওনি আমাকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন….. দেখতে দেখতে ফাকা ঘরটা মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো….. আম্মু আর কাদতে পারছিলেন না…. ওনার বুকের সাথে মিশে ছিলেন একেবারে….. আমি আম্মুকে ডাকি….কেনো কাদছে জিজ্ঞেস করি….. কিন্তু আম্মু তাও কান্না থামায় না….আমি একপ্রকার বিরক্ত হয়েই আম্মুর কাছ থেকে উঠে এলাম…….. সাফি ভাইয়ের কাছে যেতে নিয়েও গেলাম না… ওনিও দেখি সোফায় বসে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছেন…. অগত্যা আমাকে রফিক ভায়ের কাছেই যেতে হলো…..
,
,
,
——— রফিক ভাই ওনাকে একটু রুমে দিয়ে আসুন না…. এতো মানুষের মাঝে মানুষটার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে…… আপনারা মিলে ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিন….ঘুম খুব পাতলা ওনার….. একটু আওয়াজ হলেই উঠে যায়….
,
,
——— আল্লারে বলেন ভাবি তাই যেনো হয়….. ওর ঘুমটা ভেঙে যাক….. ওরে ফিরায়ে দিক….. ভাবি এই দিন আসবে জানলে কোনদিন ও আল্লার কাছে সকাল দেখার ফরিয়াদ করতাম না……..
,
,
,
রফিক ভাই আমার দুহাতের মাঝে নিজের কপাল রেখে কথা গুলো বলছিলেন আর ফুফাচ্ছিলেন….. ছেলে মানুষের কান্না টা দেখতে বড়ই অস্বস্তি হয়…. রফিক ভাইকে বসিয়ে দিয়ে আমি ফের ওনার কাছে চলে এলাম…. ইশ মুখটা মলিন হয়ে আছে একেবারে….. চেহার সেই জৌলুশ টাই যেনো নেই…. অথচ মানুষ টা হাসলে আমি নির্দিধায় একশো বছর তাকিয়ে থাকতে পারবো…. কথাগুলো ভেবেই শাড়ির আঁচল দিয়ে ওনার মুখটা মুছিয়ে দিলাম….. ততক্ষণে মা-বাবা চলে এলেন…. কান্নায় কান্নায় ঘড়ের পরিবেশ টাই যেন পালটে যাচ্ছিলো….. আমি তখন মেনে নিতে পারি নি মানুষ টা আর নাই….. চলে গেছে না ফেরার দেশে….. কর্মস্থল থেকে ছুটি আনার ওছিলায় একেবারে জীবন থেকেই ছুটি নিয়ে নিলেন চিরকালের জন্য …. আমি তখনও ভাবতে পারি নাই যে আমার দুই বছর দশ মাস সতেরো দিনের সংসার তার নিশ্বাসের সাথেই শেষ হয়ে গিয়েছে….. আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বসে ছিলাম সবাইকে দেখছিলাম….. আস্তে আস্তে বড় আপু, মেজো ভাইয়া ভাবিও চলে এলেন…. কান্নার রোল যেনো তাদের আগমনে আরো নতুন করে ভারি হলো…..
,
,
,
ওনাকে গোছলের জন্য নিতে চাইলে আমি বাধ সাধলাম…. সবার সাথে খুনোখুনি ঝগড়া করলাম….
,
,
,
——— আপনারা পাগল হয়ে গেছেন কিসের গোছল…. মানুষটার সারা গায়ে ব্যান্ডেজ….. এই অবস্থায় ওনাকে গোছল করাবেন!!! আম্মু তুমি চুপ করে আছো কেন???
,
,
কেউ আমার কথা শুনলো না…. ফুলি খালা… মেজোভাবি আর মা মিলে আমাকে আটকে রাখলেন…..
,
,
,
——— টুকিরে….. বাবু আর নাইরে মা…… ছেলে আমার শেষ হয়ে গেছেরে মা…… বাবু আর নাই….. আমারে এতিম কইরা রাইখা গেছেরে মা….. আমারে কে জড়ায়ে ধরবে বল….. আম্মু ডেকে এটা সেটা বলে কে আল্লাদ করবে….. আমার সব শেষ হয়ে গেছে….. আল্লাহ আমারে কেন দেখে না….. আমার কলিজা ছিড়ে নিছে আল্লাহ….. তোমার গায়ে যেনো এই আহাজারি সয়……আল্লাহ….. আমার সোনার টুকরা ছেলেটারে তুমি এতো কষ্ট দিলা…৷ কি পাপ করছিলাম আমি…… এই মেয়ের মুখের দিকে তাকাইয়াও তোমার আত্মা কাপে নাই……..
,
,
,
আম্মুর কথায় আমি খুব রেগে গেলাম…..আবল তাবল বকতে শুরু করে দিলাম…. নেই মানে কি…. ওনাকে গোছল করানোর পর মা আমাকে টেনে ওনার সামনে নিয়ে গেলেন।।।।।
,
,
——— তুলি শেষ দেখা দেখে নে মা….. ছেলেটাকে শেষ বারের মতোন দেখে দে….
,
,
,
মায়ের কথা শুনে বেশ জুড়েই।একটা ধমক দিলাম…. তারপর মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওনার কাছে চলে এলাম…. কপালে আর ব্যান্ডেজ নাই…. সেলাই দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট….. খুব চুপটি করে ওনার বুকে মাথা রেখে বেশ জোরে জড়িয়ে ধরলাম …. রোজ রাতেই তো ওনি এভাবে জড়িয়ে ধরে…… ওনার বুকের ধুকপুকানির আওয়াজ টা আমার খুব পছন্দের কিন্তু আজ একেবারে শান্ত…. কোন আওয়াজ পাচ্ছি না…..আমাকে জড়িয়ে ও ধরছে না…..
,
,
——— মা একটু দেখবা…. ওনার বুকে কোন আওয়াজ পাচ্ছি না…. কি হয়েছে আপনার…. আমাকে শক্ত করে একটু জড়িয়ে ধরেন না….আমি ভয় পাচ্ছিতো…. আচ্ছা আমরা না পিকনিকে যাবো….. ছুটি এনেছেন আপনি???আপনি সুস্থ হলেই যাবো কিন্তু ….
,
,
,
কেমন যেনো কথার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম…… আমাকে ফের কয়েক জন ছাড়িয়ে নিতে এলেন…. আমি ওদের বকে ধমকে সরিয়ে দিলাম….. তখন আম্মুকে ধরে আমার পাশে বসানো হলো…. আম্মুর ওনার বুকের উপর হামলে পড়লেন…. কেমন যেনো ফ্যাচফ্যাচ করে কাদছিলেন…. গলা বসে গেছে হয়তো….. ওনার কপালে খুব সসন্তর্পণে চুমু খেলেন….. সারা মুখে বুকে চুমু খেয়ে যাচ্ছেন অনবরত …..
,
,
,
——— আল্লাহ তরে কেন কেরে নিলো বাপ….. আমারে একবার আম্মু বলে ডাকনা বাবু…. একবার ডাক….. আর বকবো না…. তুই ভুল করলেও না….একবার ডাক….. আল্লাহ তুমি আমারেও নিয়া নাও…. আমি আর কিসের জন্য বাচবো আল্লাহ……
,
,
,
আমাকে আম্মুকে সরিয়ে মেজো ভাইয়া, বাবা, বড় আপুর হাসবেন্ড, রাফি ভাইয়া ওনার খাটিয়া নিয়ে বেরোনোর জন্য রেডি হয়ে নিলেন…. দরজা দিয়ে বেরোনোর আগেই আমি দৌড়ে গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে বাবার সামনে গেলাম…..
,
,
,
——— বাবা ওনাকে পানিটা খাইয়ে নিয়ে যাও…. ওনি কোথাও গেলে আমার হাতে পানি না খেয়ে বের হন না….
,
,
,
আমার কথা শুনে বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন…… তারপর ছলছল চোখেই বেড়িয়ে পড়লেন….. বড় আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেদেছিলো সেদিন…. আমি তখন ওনার খাটিয়া দেখে যাচ্ছিলাম যতদুর দেখা যায়….. মানুষ টা চলে গেলেন….. আমাকে আর আম্মুকে একলা করে দিয়ে চলে গেলেন……
,
,
,
মেজো ভাবি আর বড় আপু মিলে আমাকে রুমে নিয়ে এলো…. আমি তখন ভাবলেশহীন….. রুমের আবওহায় যেনো নিশ্বাস নেওয়া দায় হয়ে পড়েছে আমার…. আমাকে গোসলে দিয়ে ওনারা দরজায় দ্বাড়িয়ে রইলেন কাফনের মতো সাদা কাপড় হাতে….. ঘাড়ে বুকে তখনও ওনার ভালোবাসার চিহ্ন গুলো জীবন্ত….. অথচ মানুষ টাই নাকি নাই….. আমাকে শাড়ি পড়ানোর সময় মেজোভাবি আর আপু নিজেকে সামলাতে পারলেন না…..হয়তো কখনো ভাবেননি আমাকে এইবেশে দেখবে…… দুজনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে যাচ্ছেন….. অথচ আমার কান্না পাচ্ছে না….. হয়তো আমিই কাদতে পারছিলাম না…..
,
,
,
বাবা সাফি ভাইয়ারা বৃষ্টি ভিজে বাড়ি ফিরলেন…… সারারাত বৃষ্টি হয়েছিলো সেদিন….আম্মু ওনাদের আসতে দেখেই বাবার দিকে ছুটে গেলেন…..
,
,
,
——— আমার বাবুরে ঠামায় আসছেন ভাইজান…… এই বৃষ্টিতে ওরে একলা রাইখা আসছেন…… আমার ছেলেটা একদম বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না ভাইজান……. ও কেমনে থাকবে….. ও রফিক…. আমার বাবু আমারে কেমনে একলা রাইখা চলে গেলো রফিক….
,
,
,
তখনো ঘরভর্তি মানুষ….. কিছু মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলতে লাগলেন গায়ের গয়না এক এক করে সব খুলে ফেলার জন্য…. আমি দিলাম না….. তখন শুরু হলো নানা কথার গুঞ্জন……
,
,
——— আম্মু….. ওনি আমাকে কখনো এগুলো খুলতে বারণ করেছেন….. ওনার কথার খেলাফ করলে ওনি খুব রেগে যায় আম্মু…. তুমি চেনো না তুমার ছেলেকে…..
,
,
,
আমার কথা শুনে আম্মু আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললেন যেনো আমাকে কোন কিছু নিয়ে জোড় না করা হয়…. আর ইসলামে স্বামী চিহ্ন বলে কোন রীতি নেই…. যা নেই তা নিয়ে আম্মুর কোন মাথা ব্যাথা নেই…. আম্মুর এই কথায় কেউ কিছু বললো না…..আস্তে এক এক করে পাড়া প্রতিবেশী শান্তনা দিয়ে চলে গেলেন…… শুধু রয়ে গেলেন কাছের মানুষ গুলো…… কেমন যেনো একটা নিরোবতা…. কান ধাধিয়ে যাচ্ছে….. বারবার মানুষ টার কথা মনে পড়ছে….. ইশ বাইরে কিভাবে বৃষ্টি হচ্ছে…. এইভাবে ভিজে নাজানি ফের জ্বর বাধায়…..
,
,
,
ওনার মৃত্যুর তিন দিনেও আমি স্বাভাবিক সত্যটা মানতে নারাজ…… সেদিন হসপিটালের এক ওয়ার্ড বয় এসে ওনার অফিস ব্যাগ…. ফোন… রক্তে ভেজা আকাশি রংা শার্ট আর হাত ঘড়িটা দিয়ে গেলেন…. বাসায় তখন সবাই রয়ে গেছে…. আমি একে একে ওনার জিনিস গুলো ছুয়ে দেখিছিলাম বুকের সাথে মিশিয়ে ধরছিলাম….
,
,
,
আম্মু নিজেকে খুব শক্ত করে নিলেন…… সাফি ভাইয়া আর রফিক ভাইয়াকে ডাকালেন বিস্তারিত সব শুনার জন্য….. ওনার তাদের সাথে সন্ধ্যায় দেখা করার কথা ছিলো…. অফিস থেকে নাকি কিছুটা এগিয়ে বের হয়েছিলেন….. শেষ বিকাল পাচটায় ফোনে কথা হয়েছিলো…. কোথায় তোরা থাক…. আমি আসছি এই ধরনের…. কিন্তু ঘন্টা পার হয়ে গেলো….. আসার খবর নেই দেখে সাফি ভাইয়া ফোন ধরতেই হসপিটালের একজন নার্স ধরলেন এবং তাদের ঠিকানা দিলেন….. ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখেন ওনার ট্রিটমেন্ট চলছে…. দুই তিন জন লোক ওনাকে নাকি ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন….. এক্সিডেন্ট কেইস বলে ভর্তি নিচ্ছিলো না…. এর মধ্যে তাদের একজন নাকি থানায় ফোন করিয়ে ব্যাপার টা সামলে নেয়…. কিন্তু সাফি ভাইয়ারা তাদের কাউকেই পেলেন না….. ডাক্তার বাড়ির লোকজন খবর দিতে বললে তারা আম্মুকে ফোন দেয়…. ডাক্তার জানায় সারা গায়ে জখম…. আর মাথায় অনেক ছোট ছোট আলপিন ধরনের পেরেক পাওয়া গেছে…. যা মস্তিষ্কেও আঘাত করেছে…. সাফি ভাইয়াদের দেখা করার অনুমতি দিলে ওনারা ভেতরে যান…. আবছা ভাবে আমার আর আম্মুর নাম নিতে নিতেই নাকি তিন শ্বাসে শেষ নিশ্বাস ছাড়েন…… আম্মু খুব সাধারণ ভাবেই চশমা খুলে চোখের জল মুছলেন….. আমি তখনও ওনার জিনিস পত্র ঘেটে যাচ্ছি…..
,
,
,
৫০
,
,
,
দিন চলছে তার নিজস্ব গতিতে আর তার সাথে যোগ হচ্ছে মানুষ টাকে হারিয়েছি তার দিনের হিসেব….. আম্মু এখন আর কাদেন না….. আপু আর মেজোভাবিরা সপ্তাহ খানেক থেকে ফিরে গেলেন….. মা-বাবা আমাদের সাথেই আছেন….. এখান থেকেই মা রোজ অফিস করছেন…. রাতে আম্মু আর মা আমাকে মাজখানে রেখে ঘুমোয়….. রোজ রাতে তাদের কাছে আবদার করি জড়িয়ে ধরার…. কিন্তু তাদের জড়িয়ে ধরাটা ওনার মতো হয় না…. আমি চোখ বুঝি…. ঘুমানোর চেষ্টা করি….. আর ভাবি সকালেই হয়তো ওনি চলে আসবেন…. তারপর আমাকে ঠিক আগের মতো জড়িয়ে ধরবেন….. রাতের পর সকাল আসেন ঠিকই কিন্তু ওনি আর আসেন না…. মাঝেমধ্যে অকারণেই দরজা খুলে অপেক্ষা করি…. সিড়িতে পায়ের আওয়াজ পেলেই ছুটে দরজায় কান পাতি আর ভাবি দরজা খুলে মুখটা বের করলে নিশ্চিত ওনি দুষ্টুমির ছলে চুমু খেয়ে বসবেন….. নিজে নিজেই ভাবি আর একা একা হাসি……কখনো মনেই হয় নাই ওনি নেই…. সব সময় মনে হতো আশেপাশে আছেন….. নাহয় মনে হতো অফিসে গেছেন….. একদিন দুপুরে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমার হাতে অফিসের ব্যাগটা দিয়ে বলছেন…. জলদি একগ্লাস পানি আনোতো তুলি….. ওমনিই আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো……
,
,
,
সেদিন সন্ধ্যায় ফুলি খালা রয়ে গেলেন…. আম্মু এখন প্রায়ই ফুলি খালাকে রাতে রেখে দেন…..বাবা ছাড়া সবাই আমার রুমে….. ওনারা নিজেদের মতন করে কথা বলছেন….. আমি শুনছি…. হুট কিরেই স্বপ্নটার কথা মনে হতেই আমি আলমিরা থেকে ব্যাগটা বের করে আনলাম….. আম্মুরা আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তখন….. ওনার কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্রের মাঝে দুটো খাম পেলাম…. একটাতে দুই দিনের ছুটি গ্রান্ট করা এপ্লিকেশন আরেকটা খাম খুলে আমার ভেতর ওলট পালট হয়ে গেলো….. ওটাতে আমার পজিটিভ প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট….. লাস্ট চেকাপে গিয়েছিলাম মাস তিনেক হয়ে গেছে….. তখনকারই রিপোর্ট এটা….. ভেতর টা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিলো যেনো….. এই সময়টার কতো অপেক্ষা করেছি দুজনে মিলে….. কতো কিছু সাজিয়েছি প্লেন করেছি….. আল্লাহ আমাকে যে এইভাবে অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা দিবে আমি কখনো ভাবতে পারি নাই….. আমার কাঙ্কিত সুখ অথচ যাকে ঘিরে আমার সব কিছু সেই মানুষটাই নেই…… বারবার ওনার হাসিমাখা মুখটা চোখে ভাসছিলো….. হুট করেই শেষ দেখা মলিন মুখটা মানষপটে ভেসে উঠলো…… মা-আম্মু আমার কাছে আসতেই আমি বিছানায় লুটিয়ে গেলাম…..
,
,
,
——— আমার এতো বড় সর্বনাশ কে করলো আম্মু….. আল্লাহ আমার সব কেড়ে নিলো আম্মু….. আমার এই সুখ চাই না….. ওনাকে ফিরিয়ে দাও তোমরা….. আমার এতো কষ্ট সহ্য হচ্ছেনা….. ও মা…. তুমি ওনাকে ফিরিয়ে দাও না মা….. আমাদের সন্তান আসবে….. তুমিই বলো সে তার বাবার আদর পাবে না….. তার কোলে উঠবে না….. ওনি…..
,
,
,
এতো চাপ নিতে না পেড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম…… তখন থেকে আমার কাঠখোট্টা চোখ দুটো সজল হতে শুরু করলো….. ওনাকে ডাকি…. এখানে সেখানে খুজি……কিন্তু পাই না…. আমি আদৌ জানি না মানুষ টা জেনেছিলো কিনা সে যে বাবা হতে চলেছে….. আল্লাহ তাকে বাবা ডাক শুনার সৌভাগ্য টা দিলো না…… আম্মু সেদিন ঠিকই বলেছিলেন ওনি যে কি আমি একদিন ঠিকই বুঝবো…. আসলেই আমি বুঝছি…. কিন্তু এভাবে ওনাকে হারিয়ে সত্যিই আমি ওনার মূল্য বুঝতে চাই নি….. মাঝেমধ্যে আর নিজেকে আটকাতে পারি না…. খুব কষ্ট হয়…..ওনাকে খুব বকি…. এতো ভালোবাসার কি দরকার ছিলো…. এখন তো সেসব আমাকে প্রতিনিয়ত পুড়ায়…..
,
,
,
‌মা-বাবা আমাকে ওনাদের সাথে নিতে চেয়েছিলেন….. আমি যাই নি করেই বা যাবো….. আমাদের প্রথম মিলনের রাতে ওনাকে জড়িয়ে ধরে আমি কথা দিয়েছিলাম এ বাড়ি এঘড় আর আম্মুকে একা ফেলে আমি কোথাও যাবো না…. ওনি নাহয় আমার সাথে সারাজীবন কাটানোর কথা রাখতে পারলেন না কিন্তু আমি রাখবো….. সে তো স্বার্থপর মানুষের মতো আমার উপর সব শর্ত জারি করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে…..ওনার আমাকে বলা শেষ কথাটা এখনো কানে বাজে আম্মুকে দেখো…… মানুষ টা তো মা বলতে অন্ধ ছিলো….. তার এতো প্রিয় জিনিসটার অবহেলা কি করে করি আমি….
,
,
,
সাতমাসের আল্টাসনোতে ধরা পড়লো আমি জমজ বাচ্চার জন্ম দিতে চলেছি…..ডাক্তারের মুখে কথাখানা শুনে আমি প্রথম চোখ বুঝে মনে মনে ওনাকে ডাকলাম…..
,
,
,
———শুনছেন….. আপনি টুয়িনদের বাবা হতে যাচ্ছেন….
,
,
ফের নিজে হেসেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি…..সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো মানুষ টা আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার হাতটা চেপে ধরতো…..জমজ বাচ্চা বলে ডাক্তার আর রিস্ক নিলেন না…. সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমেই আমাদের ছেলে মেয়েকে সুস্থ ভাবেই পৃথিবীতে নিয়ে এলেন….ওনার খুব মেয়ের শখ ছিলো…. যখন যখন আমি ওসামার মতন একটা ছেলে লাগবে বলতাম তখন তখন ওনি বলতেন ———
,
,
,
——— আমার মেয়েই লাগবে….. মেয়েরা মা-বাবার জন্য আশীর্বাদ বুঝলে…. ওরা কখনো কষ্ট দেয় না…. ছেলেরা পাজি বুঝলে…. ওরা অলওয়েজ সবকিছুতেই উদাসীন…..
,
,
,
আমি হাসতাম আর একেকটা যুক্তি টেনে এনে ওনার সাথে ঝগড়া করতাম….. ছেলে -মেয়ে দুটো একেবারে বাবাকে কপি করে এসেছে…. কিন্তু আমি পোড়াকপালি তাদের জন্মের ১৫ দিন পরেই মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললাম….. হঠাৎ করে শ্বাস কষ্টের মতন হয়ে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো…. মেয়াটাও বাবার মতোন ই স্বার্থপর….. বাপ মেয়ে একসাথে ফন্দি এটে করেছে এসব…. তারপর থেকে ছেলেকে বুকে আগলে আর আম্মুকে পাশে নিয়ে নিজের পথ চলেছি…. পড়াশোনা শেষ করে…. দুবছর একটা স্কুলে চাকরি করেছি…. ছেলেকে সময় দিতে পারছিলাম না বলে চাকরি ছেড়ে দিলাম….. তার বাবার রেখে যাওয়া নামেই দুই ভাইবোনের নাম রেখেছিলাম সাদাত আর তুস্মি….মেয়েটাতো বাবার কাছে চলে গেলো সেই কবে….. সাদাত কে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম….. সেই নাক সেই হাসি সেই রাগ….. একটু চুপচাপ স্বভাবের….. আম্মুকে দেখতাম প্রাই লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল মুছতেন….. আর আমি তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম…… এখনো তার কথাগুলো কানে বাজে…. ডায়নিং টেবিল থেকে এখনো পানি খেয়ে হাতে করে রুমে নিয়ে যাই…. সে পানি চাইছে বলে…. বছরের পর বছর যোগ হয় মানুষ টা চলে গেছে খাতায়…. কিন্তু সে আমার কাছে ঝাপসা হয় না…. ঠিক আগের মতোই অমলিন…..
,
,
,
সাদাত যখন ক্লাস ফাইবে পড়েন একদিন বাবা ফোন দিয়ে জানালেন চাচা নাকি আমাকে দেখতে চাইছেন….. খুবই অসুস্থ…. ব্লাড কেন্সারের সাথে লিভার ক্যান্সার আর তার সাথে হার্টের ব্লক তো আছেই…. চাচার সাথে আমার বিয়ের পর থেকেই কোন যোগাযোগ নেই…. বলা যায় তিনিই রাখতে দেন নি….. আম্মু কে নিয়ে সাদাত কে কুলে করেই চাচাকে দেখতে গেলাম…. সেখানে যে আমার জন্য এতো বড় চমক অপেক্ষা করছিলো জানা ছিলো না…..
,
,
,
সাদাফ কোন এক্সিডেন্ট করে নি তাকে প্লান করে খুন করা হয়েছে…. আর তার সবই হয়েছে আমার চাচার ইচ্ছে অনুসারে….. কারণ হচ্ছে বাবার ভাগের সম্পত্তি…. যা তিনি তার ছেলেকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন…… আমার বিয়ের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীর কিছুদিন পর বাবা নাকি ওনাকে একপ্রকার জোর করেই সব সম্পত্তি ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন ওনার ভবিষ্যৎ নাতি নাতনির জন্য….সেই ক্ষোভের থেকেই এতো কিছু….. চাচা আমাকে সব খুলে বলে হাত জোর করে মাফ চাইলেন….. আমি উল্টো ওনার পা জড়িয়ে ধরে বললাম ———
,
,
,
——— আপনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ থাকবে না চাচা…. প্রতি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে আমি আপনার সুস্থতা কামনা করবো…. ওনি আমার আয়ু ও আপনাকে দিয়ে দিক…. আপনি শুধু আমার ছেলের বাবাকে ফিরিয়ে দিন…. বেশি না একদিনের জন্য….. তাকে বাবা ডাক শুনার সুযোগ করে দিন…..
,
,
,
আমি জানি আমার এই চাওয়া মূল্যহীন…… যার কোন অস্তিত্ব নেই….এই মানুষ টাকে আমি কি করে কি ভেবে ক্ষমা করবো তা আজ ও ভেবে পাই না…. তবে সত্যি এই যে আমি আমার আপনজন দ্বারাই অতিপ্রিয়জনকে হারিয়েছি…..এরকিছুদিনের মধ্যেই একদিন খবর পেলাম চাচা মারা গেছেন…..
,
,
,
আম্মু এই শেষ শোকটা আর মেনে নিতে পারলেন না….. খুব ভেঙে পড়েছেন….. সাদাত যখন সবেমাত্র ক্লাস ফাইবে তখনকার এক সকালে আম্মুকে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ওনিও আমায় ফাকি দিলেন…… তারপর থেকে মা-বাবাই আগলে রেখেছেন আমাদের….. ভাসুর দুজনি বিনা বাক্যে ঢাকার বাড়িটা আমার নামে লিখে দিলেন….. সাদাতের কলেজ পড়া কালিন সমিয়ে বাবা আর তার বছর দুয়েক পর মা …… চলে গেলেন সবাই এক এক করে…… এর মধ্যে কতো মানুষ এসেছে তার জায়গা নিতে….. অমন একটা মানুষের জায়গা কি কাউকে দেওয়া যায়!!! যায় না….
,
,
,
অবশ্য এখানে আমি একা না…. আমার মতো আরো অনেক মানুষ আছেন এখানে….. আসার সময় ওনার সব জিনিসপত্র আর পুরাতন এলবাম টা নিয়ে এসেছি…. এখকার সঙ্গী তো এগুলোই….রোজ রাতে মানুষটাকে স্বপ্নে দেখি….. সে সবার খোজ খবর নেয়…. এমনকি সাদাতের দুবছ্রের ছেলেটার ও….. বাচ্চাটার কথা খুব মনে পড়ে…. আধো আধো বুলিতে কি সুন্দর করে দিদুই ডাকতো…..
,
,
,
——— জানেন আপনার ছেলেকে মনে হয় আমি আপনার মতো করে মানুষ করতে পারি নি….. আর একা ভালো লাগে না….. একটা কাধের খুব প্রয়োজন….. আমাকে আপনার খুব প্রয়োজন……
,
,
জবাবে ওনি যেনো ফিসফিসিয়ে কি বলে…. তা শুনে আমি হাসি….. ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু মুখের হাসিটা ঠিক বজায় থাকে….. ব্যাগ থেকে পুরানো এলবাম টা বের করে আমাদের খুব প্রিয় ছবিটা দেখি….. ওইযে শিমুল ভাইয়ের তুলা…. আম্মু যেদিন আঙটি পড়িয়ে দিলেন….. ওনার পাশে বসে কাদছি আর মানুষ টা অবাক হয়ে দেখছে আমায়….. হাত বুলিয়ে ছবিটাতে বুকে চেপে ধরে বসে থাকি….. বাইরে মেঘ ডাকছে…. বৃষ্টি হবে হয়তো…… কেনো যেনো আজকাল বৃষ্টি বড্ড ভয় করে….. আগে করতো না…. জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষ গুলো তো এই বৃষ্টি সাথেই জীবনে এসেছিলেন….. কিন্তু তারা ছিলেন এক পশলা বৃষ্টির মতোন ক্ষনিকের …… দমকা হাওয়ায় সব ধুয়ে মুছে শেষ……. আজকাল বৃষ্টি দেখলে ছেলেটার জন্য মন কাদে……এমন কতো বৃষ্টিতে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেদেছি……. যতই হোক নাড়ি ছেড়া ধন তো…. শত ভুলের পর ও মায়া কাটাতে পারি না……এসব কথা ভাবতে ভাবতেই বারান্দার আবছা আলোতে এসে বেঞ্চে বসে ঝাপসা দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম….. বৃষ্টির জলে পা ভেজালাম তার পরিয়ে দেওয়া নূপুর এখনো আমার পায়ে…… এই নূপুর আর বাজে না…..সুতোয় ক্ষ্য়ে যাওয়া অংশ জোড়ে দিয়েছি খানে খানে…….. মানুষ টা আমায় বড্ড পুড়ায়…….বারবার কষ্টের জ্বালা সইতে না পেরে শুরু থেকে ভাবি…… বারংবার ভাবি…… আমার জীবনের এক পশলা বৃষ্টি…. হ্যাঁ….. এক পশলা বৃষ্টি আর সে❤

,
,
,
লেখনিতে: চৈত্র রায়

~~~~~~~~~~~~♥সমাপ্ত ♥~~~~~~~~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here