অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব -৩

0
1187

ঘুমের মাঝেই রিখিয়া এপাশ ওপাশ করতে করতে ছটফট করে চলেছে। এক পর্যায়ে ও ‘নায়ায়ায়ায়া’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে।

রিখিয়ার চিৎকারে অর্ণারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। অর্ণা নিজের বেড থেকে উঠে ছুটে আসে রিখিয়ার কাছে। রিখিয়াকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘ কিচ্ছু হয়নি রিখি। প্লিজ তুই একটু শান্ত হো। ‘

রিখিয়ার সমস্ত শরীর এখনো থরথর করে কাঁপছে। ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ফ্যানের বাতাসেও কোন কাজ হচ্ছেনা।
রিখিয়া বিড়বিড় করে বারবার শুধু একটা কথাই বলছে,

” আগুন! আগুন! আগুনটা নেভাও, তোমরা কে কোথায় আছো ? আগুনটা নেভাও। ”

বেশ অনেকটা সময় পর রিখিয়া কিছুটা শান্ত হয়। সবটা মাথায় আসতেই অর্ণাকে জড়িয়ে ধরে রিখিয়া কাঁদতে শুরু করে। ও কি করে সবাইকে বোঝাবে ওর ভেতরে কি রক্তক্ষরণটা হচ্ছে। বাইরের কাঁটাছেড়া মানুষকে দেখানো যায় তবে ভেতরটা যদি জ্বলে পুড়ে খাঁকও হয়ে যায় তাও সেটা কাউকে দেখানো সম্ভব নয়।

অর্ণাকে জড়িয়ে ধরেই রিখিয়া বলতে থাকে,

” কেন এমনটা হলো বলতো? অর্ক আর আমার মণিতো কোন দোষ করেনি তাহলে কেন তাদের সাথে এমনটা হলো। আমার চোখের সামনে ওরা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। আর কিই’বা করতাম তখন আমি, আমিতো নিতান্তই একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলাম। দাভাইয়ের পর আমার একমাত্র খেলার সাথী আর বন্ধু ছিলো অর্ক। অর্কও তো তখন ছোট ছিলো, এটুকু একটা বাচ্চা ছেলে আগুনে জ্বলসে…… ”

আর বলতে পারলোনা রিখিয়া আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও। রিখিয়াকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা অর্ণার জানা নেই। অর্ক আর ওর মায়ের করুণ মৃত্যুর ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণই ও রিখিয়ার কাছ থেকে শুনেছে। অর্কের বাবা এক্সিডেন্টে মারা যায় এর কিছুদিনের মাথায়ই আগুনে পুড়ে মারা যায় অর্ক আর অর্কের মা।

রিখিয়া আর অর্কদের বাসা পাশাপাশিই ছিলো। ওদের দুই পরিবারের সবাই যেন ওকে অপরের প্রাণ ছিলো। হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো?
সেদিন অর্কদের বাসায় আগুন লাগলে আশেপাশের মানুষজনসহ রিখিয়াদের বাসার সবাই বেরিয়ে আসে। আগুন এতোটাই বেশি ছিলো যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও কিছু করে উঠতে পারেনি। লাশগুলোর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সকলের ধারণা হয়তো গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেই এই আগুনের উৎপত্তি।

সেদিনের পর রিখিয়া মাঝেমাঝেই দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই রাতের ঘটনাটারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ওর স্বপ্নে।

কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে রিখিয়া ঘুমিয়ে গেলে অর্ণা ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে নিজের বেডে চলে যায়। রিখিয়া কারো সাথে বেড শেয়ার করতে পারেনা তাই দুজনেই দুইটা সিংগেল বেডে আলাদা আলাদা থাকে।

____________

অর্ক অফিসে বসে নিজে নিজের কাজ করছে। আজ খুব তাড়াতাড়ি কাজ কমপ্লিট করতে হবে। কারণ কাল একটা বিশেষ দিন।
চাইলেও সে সকলের সাথে গিয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাসের সাথে এ দিনটাকে পালন করতে পারবেনা। শুধুমাত্র কিছু নিকৃষ্ট মানুষের জন্যেই ওকে সবার থেকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।

অর্ণা আর ওদের বাকী বন্ধুরা মিলে ক্যান্টিনে বসে প্লান করছে কিভাবে সবাই মিলে রিখিয়ার জন্মদিনটা সেলিব্রেট করবে।

রিখিয়া ক্যান্টিনে প্রবেশ করার সময়ই বাকীদের কিছু কথা ওর কানে আসে। ওদের কথাবার্তা শুনে রিখিয়ার আর বুঝতে বাকী থাকেনা যে ওরা ঠিক কী করতে চাইছে। রিখিয়ার ভীষণ রাগ হলো অর্ণার উপর। অর্ণা কিভাবে সবটা জেনেও বাকীদের সাথে প্লানে শামিল হচ্ছে।

রিখিয়া গিয়ে অর্ণার হাতটা ধরে টানতে টানতে ওকে ক্যান্টিনের বাহিরে নিয়ে আসে।

” অর্ণা তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি কেন এদিনটাকে উৎযাপন করিনা। তাও তুই কিভাবে….?”

” হ্যা, তারপরেও আমি চাই তুই সব ভুলে এবার নিজের জন্মদিন পালন করবি। ”

” অর্ণা, তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস কালকে আমার সাথে আরো একজনেরও জন্মদিন। ”

” রিখি আর কতো অতীত নিয়ে পড়ে থাকবি বলতো। যে চলে গেছে সেতো আর ফিরে আসবেনা। তারজন্য তুই কেন নিজের আনন্দগুলো এভাবে নষ্ট করবি। ”

” আমি পারবোনা অর্ণা, পারবোনা আমি, কিছুতেই পারবোনা। ” এটুকু বলেই কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে ছুটে চলে যায় রিখিয়া।

_______________

রিখিয়া অর্ণা সবসময়ই রাত এগারোটার মাঝে শুয়ে পড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা এগারোটা বাজতেই দুজনেই শুয়ে পড়ে। তবে রিখিয়া ঘুমোলেও অর্ণা ঘুমোয় নি। অর্ণা যখন বুঝতে পারলো রিখিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে তখন অর্ণা বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে দেয়। দরজাটা খুলে দিতেই রায়ান ভেতরে প্রবেশ করে।

রায়ান আর অর্ণা মিলে অল্প সময়ের মাঝেই অর্কিড ফুল দিয়ে পুরো ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলে। রায়ানই আসার সময় সব নিয়ে এসেছে। সাথে রিখিয়ার পছন্দের চকলেট কেকও এনেছে।

রিখিয়া এখনো গভীর ঘুমে মগ্ন। রায়ান অর্ণাকে ইশারা করে বলে ছাদে চলে আসতে। এখানে থাকলে নির্ঘাত রিখিয়ার হাতের পিটুনি খেতে হবে দুজনকেই।

অর্ণা আর রায়ান বের হয়ে যেতেই অর্ক ভেতরে প্রবেশ করে। অর্ণা অর্ককে ভেতরে প্রবেশ করতে না দেখলেও রায়ান ঠিকই দেখেছে। আর ইশারায় অর্ককে অল দ্য বেষ্ট বলে ছাদের দিকে পা বাড়ায় রায়ান।

রিখিয়া ঘুমের মাঝেই সেই চেনাপরিচিত কণ্ঠের গান শুনতে পায়। শুয়ে শুয়েই গানটা শুনতে থাকে ও। একটাবারের জন্যেও চোখ মেলে তাকায়নি, ভাবছে চোখ মেললেই হয়তো ওর স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে। তবে ও চায়না এ স্বপ্নটা ভাঙ্গুক।

গানটা শেষ হতেই শুনতে পায় সেই কণ্ঠস্বর, ” শুভ জন্মদিন মোটি। দোয়া করি জন্মদিনের কেক খেয়ে যেন আরো মোটি হোস, আর আমি এসে তোর নাদুসনুদুস গালদুটো টেনে দিতে পারি। বলেই হি হি করে হেসে উঠে ছেলেটা।
এই কণ্ঠস্বরটা শুনেই রিখিয়ার ঘুম ছুটে গেছে। চারিদিকে ছুটে ছুটে সেই কণ্ঠের মালিককে খুঁজে চলেছে। কিন্তু কি আশ্চর্য কেউ নেই তবে কণ্ঠস্বরটা ঠিকই শোনা যাচ্ছে। আরো অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও কাউকে খুঁজে না পেয়ে একটা হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে।

তখন আবার সেই কণ্ঠস্বরটা শুনতে পাওয়া গেলো।
” কিরে খুঁজে পেলিনা তো। হা হা! খুঁজে লাভ নেই এভাবে খুঁজে তুই আমাকে পাবিনা। আচ্ছা শোন, কেক কাটার পর কিন্তু রাক্ষসীর মতো সবটা খেয়ে নিসনা আবার। আমার ভাগেরটা আমার জন্যে আলাদা রেখে দিবি নইলে কিন্তু তোর খবর আছে! ”

এ কথাটা শুনে রিখিয়া খিলখিল করে হেসে উঠে। হঠাৎ ওর মনে পড়ে, ঠিক এ কথাগুলোইতো ও আগেও শুনেছে। সেবার যখন ওর চতুর্থ জন্মদিন ছিলো তখন অর্কের বাবা মাকে অফিসের কি একটা কাজে দেশের বাইরে যেতে হয়েছিলো। অর্ক আর ওর জন্মদিন কাকতালীয় ভাবে একই দিনে। সবসময় একসাথেই পালন করা হতো। তবে সেবার ওরা কাজ মিটিয়ে ওদের জন্মদিনের আগে দেশে ফিরতে পারেনি। তাই রিখিয়ার বড্ড মন খারাপ ছিলো। তবে জন্মদিনের দিন সকালবেলা একটা সারপ্রাইজ পেয়েই ওর সব মন খারাপ দূরে কোথায় পালিয়ে গেলো।

(চলবে)————

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here