অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব – ৪

0
1116

সেদিনটার কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন সকালবেলা আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মু আব্বু কেউই আমার পাশে নেই। হয়তো উঠে গেছে। আমিও উঠতে যাবো তখন পাশে তাকিয়ে দেখি একটা গিফট বক্স রাখা। ভেবেছিলাম হয়তো আম্মু বা আব্বু দিয়েছে। মন খারাপ থাকায় গিফট বক্সটা খুলবো না ভেবে এক সাইডে রেখে দেই। তবে বেশিক্ষণ নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। তাই শেষ পর্যন্ত খুলবো না খুলবো না করেও খুলেই ফেললাম। খুলেতো আমি চরম অবাক বক্সটায় মাটির তৈরি একটি ঘোড়া রাখা। ঘোড়াটা দেখে অবাক হওয়ার কারণ কিছুদিন আগেই অর্ক একই রকম দেখতে আমার ঘোড়াটা ভেঙ্গে ফেলেছিলো। ঘোড়াটা দেখেই মুহূর্তে আমার মন ভালো হয়ে গেলো।

হঠাৎ করে ঘরের মাঝে অর্কের গলা শুনতে পেলাম। অর্কের গলাতো শুনতে পাচ্ছিলাম কিন্তু অর্ককে কোথাও খুঁজে পেলামনা। কিছুক্ষণ ইতিউতি করে ঘরের সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজলাম তাও অর্কের টিকিটিও পেলামনা। ঘরের জানালার পর্দাটা একটু সরে যেতেই সেখানে কিছু একটা আছে মনে হলো। তাই সেখানে যাই, গিয়ে দেখি একটা টেপ রেকর্ডার রাখা। এটা দেখে আর বুঝতে বাকী রইলো না যে অর্কের বলা কথাগুলো এতক্ষণ এটাতেই বাজছিল। অর্কের কথামতো সেদিন আমি ঠিকই অর্কের জন্য কেকের প্রথম টুকরোটাই ওর জন্য রেখে দিয়েছিলাম।

সেদিনের সেই কথাগুলো মনে পড়তেই চোখের জলগুলোকে আর আটকে রাখতে পারলামনা। ভালোভাবে খুঁজে দেখলাম আমার ধারণাই ঠিক ড্রেসিং টেবিলের উপর সেই টেপ রেকর্ডারটা রাখা। তবে আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে আমার হারিয়ে যাওয়া টেপ রেকর্ডারটা এখানে এলো কোথা থেকে। এতক্ষণ ঘরটা একদম খেয়াল করিনি, পুরো ঘরটা অর্কিড ফুল আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো। ঠিক এমনটাই আমি অর্ককে বলেছিলাম আমার ষষ্ঠ জন্মদিনের সময়। বলেছিলাম অর্কিড ফুল আর মোমবাতি দিয়ে সারাঘর সাজিয়ে পরের বছরের জন্মদিনটা একসাথে পালন করবো আমরা। কিন্তু পরের বছরটা আসার আগেই সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।

অর্ক আমার থেকে পাঁচ ছয় বছরের বড় ছিলো। তাও আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা খুব গাঢ় ছিলো বলে আমি ওকে নাম ধরেই বলতাম। অর্ক আর দাভাই দুজনে ছিলো সমবয়সী।

————
রায়ান আর অর্ণা দুজনেই ছাদে এসেছে অনেকক্ষণ হলো। তবে কেউই কোন কথা বলছেনা। অর্ণা কি বলবে বুঝতে পারছেনা তাই ছাদের রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর রায়ান কি করে অর্ণার সাথে কথা শুরু করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা।

অনেকক্ষণ ইতস্তত করে শেষে ঠাস করে বলেই ফেললো, ” অর্ণা আমি তোমাকে পছন্দ করি। এক্সুয়ালি পছন্দ না আই থিঙ্ক আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ”

রায়ানের বলা কথাটা যেন অর্ণার কাছে বাজ পড়ার মতো মনে হলো। মুহূর্তেই ওর চোখদুটি স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হয়ে গেলো।
অর্ণা কি বলবে ভেবে পেলোনা।
” আমাদের মনে হয় এবার যাওয়া উচিৎ “, কোনরকম এ কথাটা বলেই ছুটে নিচে নেমে এলো অর্ণা।

রায়ান কিছুক্ষণ অর্ণার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ও অবশ্য অর্ণার কাছ থেকে এখুনি কোন জবাব আশা করেনি। তাই অর্ণার এভাবে চলে যাওয়ায় অতোটা ব্যথিত হলোনা ওর মন। ও জানে অর্ণার একটু হলেও সময় প্রয়োজন আর সে সময়টা ও দিবে অর্ণাকে। শুধু নিজের মনের কথাটা অর্ণার কাছে প্রকাশ করতে চেয়েছিলো আর সেটা করতে পেরে এখন ওর নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে।

—————
রায়ান নিচে নেমে দেখে অর্ণা এখনো ভেতরে প্রবেশ করেনি। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান অর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে তাকালে দেখতে পায় রিখিয়া এখনো কেকটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাবারের ছুরিটা হাতে নিয়ে। তবে কাটছেনা। রিখিয়ার চোখমুখের অবস্থা দেখে রায়ানের আর বুঝতে বাকী থাকেনা যে রিখিয়া এতক্ষণ কান্না করেছে।

রায়ান ইশারা করলেই অর্ণা গিয়ে রিখিয়ার পাশে দাঁড়ায়। রিখিয়ার হাতটা ধরে কেকটা কাটে। আর রায়ানও ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে, ” হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ছুটকি “।
রায়ানকে দেখে রিখিয়াতো চরম অবাক। এসবকিছু যে রায়ান আর অর্ণার কাজ সেটা এবার ওর কাছে পরিষ্কার।
কেকের প্রথম টুকরোটা রিখিয়া আলাদা করে রেখে দেয়।
রিখিয়া কেকের আরেককটা টুকরো নিয়ে প্রথমে অর্ণাকে পরে রায়ানকে খাইয়ে দেয়। অর্ণা আর রায়ানও রিখিয়াকে খাইয়ে দেয়। দূর থেকে সবটাই দেখছে অর্ক। তবে চাইলেও রিখিয়ার সামনে ও যেতে পারছেনা। না পারছে রিখিয়াকে কেক খাইয়ে দিতে আর না পারছে ওর হাত থেকে নিজে খেতে। তবে এবার অন্তত দূর থেকে দেখতে পারছে এটাই ওর কাছে প্রশান্তির কারণ। চোখের কোণে জমে থাকা জলটা মুছে অর্ক বাহিরে চলে আসে।

রিখিয়া কিছুক্ষণ রায়ানকে জেরা করে যে কিভাবে রায়ান ভেতরে এলো।
” এখানে তো ছেলেরা এলাউড না। তুমি ভেতরে কি করে এলে দাভাই? ”
” তোর ওসব নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি তোদের বাসার মালিককে বলেই এসেছি। আর এই নে ধর, এটা তোর বার্থডে গিফট। ” বলেই রায়ান একটা চকলেটের বক্স ধরিয়ে দেয় রিখিয়ার হাতে।

আসার সময় রিখিয়া আর অর্ণার অলক্ষে রিখিয়ার আলাদা করে রাখা কেকের পিচটা হাতে করে নিয়ে আসে। আর অর্ণার জন্যে যে চকলেটের বক্সটা এনেছে সেটাও ওর বেডের উপর চুপিসারে রেখে বেরিয়ে আসে।

————
রায়ান বাহিরে এসে দেখে অর্ক গাড়িতে হেলান দিয়ে উদাস নয়নে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের কোণে জলরাশি উঁকি মারছে। রায়ানের মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিকর শব্দ বেড়িয়ে আসে।
” এই তোরা দুটিতে মিলে কি আজ কান্নার ভাণ্ডার খুলে বসেছিস নাকি বলতো? মেয়েদের মতো একদম প্যাচপ্যাচ করে কান্নাকাটি করবিনা বলে দিলাম। ”

রায়ানের কথায় কান না দিয়ে অর্ক বলে, ” আমার চোখের সামনে আমারি জন্যে ও কান্না করলো আর আমি কিছুই করতে পারলামনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া। ”
রায়ান অর্কের কাধে নিজের বা হাতটা রাখে।
” আচ্ছা বাদ দে তো। তোর মতো স্ট্রং ছেলেকে এতো সেন্সেটিভ হওয়া মানায় না। এখন হা কর। ”
” হা করবো কেন? ”
“সেটা দেখতেই পাবি। আগে হা কর। ”
অর্ক হা করতেই রায়ান কেকের টুকরোটা অর্কের মুখে পুড়ে দেয়।
মুহূর্তে আবারো অর্কের চোখ ছলছল করে উঠে।

————–
রিখিয়া আর অর্ণা সব গুছিয়ে যে যার বেডে শুয়ে পরে। অর্ণা শুতে গিয়েই লক্ষ করে ওর বেডে একটা চকলেটের বক্স রাখা।
এটা যে রায়ানের কাজ সেটা ও বেশ বুঝতে পারছে।মুহূর্তেই ওর চোখেমুখে একটা লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে।

(চলবে)———-

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here