এখানে এভাবে সামিকে দেখবে ওরা কেউই ভাবতে পারেনি।
আলমগির হোসেন সামি আর সোহেলকে সবটা খুলে বলেন। সোহেলও এব্যাপারে কিছুই জানতোনা। ওর বিয়ে নিয়ে যে ওর বাড়ির লোকেরাই এরকম একটা জঘন্য খেলা খেলেছে সেটা ভাবতেও লজ্জায় ওর মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে।
অর্ণার বাবা সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
” বাবা আমি খুব ভুল করে ফেলেছি। এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের জীবনটা আমি নিজ হাতে শেষ করে দিচ্ছিলাম। তবে এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, অর্ণার সাথে সামির বিয়ে আমরা দেবনা। এতে তুমি যদি রাহির সাথে তোমার বিয়ে ভেঙ্গে দাও তবে তাই সই। ”
সোহেল এবার কাছে এসে আলমগির হোসেনের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে,
” প্লিজ আপনি এভাবে বলবেননা। আমি রাহিকে বিয়ে করবো। আমার ফ্যামিলি যদি অমত করে তাতেও আমার কোন সমস্যা নেই। আর আপনারাও অতো ভাববেন না। এমনিতেও বিয়ের পর রাহিকে নিয়ে আমার আলাদাই থাকতে হতো নিজের কর্মস্থলে। ”
উপস্থিত সবাই বেশ খুশি শুধু সামি ব্যতীত। রাগে ওর মুখ থমথমে হয়ে আছে। রিখিয়া আর অর্ণাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই ও অর্ণাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। রিখিয়াকে ভাগে আনতে পারবেনা তাই অর্ণার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে এভাবে সব ভেস্তে যাওয়ায় ও এটা মেনে নিতে পারছেনা।
অর্ণার বাবা ওর সামনে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ” মা’রে পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস। আজ আমার ভুলের জন্যই তোকে এভাবে সকলের সামনে এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। হয়তো পরে এরজন্যে মানুষের নানান কটূক্তির স্বীকারও হতে হবে তোকে।
উনার কথা শুনে রিখিয়া কিছু বলতেই যাচ্ছিলো তখন অর্ক উনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আংকেল অভয় দিলে একটা কথা বলতে পারি। ”
” হ্যা বাবা বলো। ”
” আংকেল আপনিতো সবই শুনলেন। রায়ান অর্ণাকে ভালোবাসে। ও ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো, তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। আজকে অর্ণার বিয়েটা না হলে আপনাদের সকলকেই একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরতে হবে। তাই বলছিলাম কি আপনাদের অমত না থাকলে রায়ান অর্ণাকে আজকেই বিয়ে করবে। ”
আলমগির হোসেন কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তবে এবার আর তিনি মেয়ের মত না জেনে বিয়ের দিকে এগুবেন না। অর্ণার মাকে তিনি ইশারা করলে অর্ণাকে ওর মা সাথে করে নিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর উনারা আবার ফিরে আসেন। অর্ণার বাবাকে উনি ইশারায় হ্যা বলতেই সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে। রিখিয়া এক লাফ দিয়ে অর্ণাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে, ” হুররে! ”
তবে লাফটা দিতে গিয়ে ও শাড়ির সাথে পেচিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো তখন অর্ক ধরে ফেলে বলে, ” আস্তে। ”
ছেলেটার কণ্ঠটা শুনে যেন রিখিয়া কিছুটা সময়ের জন্য ফ্রিজড হয়ে গেলো। এত পরিচিত কেন লাগলো কণ্ঠস্বরটা ওর কাছে?
—————-
সামি আর সোহেল দুজন চাচাতো ভাই। সামির সাথে অর্ণার বিয়ে দেবেনা বলায় সামির বাবা বেশ চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। শাসিয়েও গেলেন অর্ণার বাবাকে উনি নাকি দেখে নেবেন। সোহেলের বাবা মা’ও প্রথমে সোহেলের সাথে রাগ দেখিয়েছিল তবে একমাত্র ছেলে বলে ফেলে যেতেও পারলেননা। তাছাড়া নিজেদের ভুলটা তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে।
সুষ্ঠুভাবেই দুটো বিয়ে সম্পন্ন হলো। রিখিয়াতো দারুণ খুশি। অবশেষে ওর বেষ্টি হলো কিনা ওর ভাবী। খুশিতে ওর নাচতে মন চাইছে।
তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ক ফিসফিস করে বলে, ” নাচতে মনে চাইলে নাচতেই পারো। ”
ওর কথা শুনে রিখিয়া বিস্ময়ে হতবাক। এ লোকটা ওর মনের কথাটা বুঝলো কিভাবে সেটাই ওর মাথায় ঢুকছেনা।
সকলের থেকে বিদায় নিয়ে ওরা চারজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রায়ান আর অর্ক সামনে বসেছে। আর অর্ণাকে নিয়ে রিখিয়া পেছনে বসেছে।
এবার আর রায়ান নয়, অর্ক চালাচ্ছে গাড়িটা। অর্ক আর রায়ান দুজনেই একটু পরপর ওদের প্রিয়তমাকে দেখছে আড়চোখে।
এদিকে অর্ণা আর রিখিয়া টুকটাক কথা বলতে থাকে।
অর্ণা ভাবছে দুটো দিনের ব্যবধানেই ওর জীবনটা কেমন পাল্টে গেল। আসার সময় যে গাড়িতে করে এসেছিল এখনো সে গাড়িতে করেই যাচ্ছে। পার্থক্য এটাই তখন এসেছিল সাধারণ ভাবে তবে এখন যাচ্ছে রায়ানের বউ হয়ে। ওর ভয় একটা জায়গাতেই তালুকদার বাড়ির মানুষগুলো ওকে মেনে নেবে তো। তবে এর আগে একবার রিখিয়াদের বাসায় ও গিয়েছিল। তখন অবশ্য রায়ান আর ওর বাবা ওখানে ছিলনা বিজনেসের কাজে বাহিরে ছিলো। রিখিয়ার মা আর দাদীর সাথেই ওর দেখা হয়েছিল। বেশ ভালো মানুষ উনারা।
তবে তখন তো গিয়েছিলো ঐ বাড়ির মেয়ের বান্ধবী হয়ে আর এখন যাচ্ছে ওদের বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ হয়ে। বাড়ির বউ হিসেবে কি উনারা ওকে মেনে নেবে? এ ভয়েই একপ্রকার ঘামতে শুরু করে দিয়েছে ও। অর্ণার অবস্থাটা হয়তো রিখিয়া কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই ও অর্ণার হাতে হাত রেখে ওকে আশ্বাস দিয়ে বলে, ” ভয় পাস না অর্ণা। মাকে দেখবি ঠিক সবটা ম্যানেজ করে নেবে। ”
গাড়ি এসে রিখিয়াদের বাসায় পৌঁছালে। অর্ক ওদেরকে বলে চলে আসে।
রিখিয়া রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” দাভাই, তোর এই বন্ধুটা এতো অদ্ভুত কেন? ”
” অদ্ভুত মানে? ” এদিকে রায়ান মনে মনে ভাবছে রিখিয়া আবার অর্ককে চিনে ফেললো কিনা?
” আরে বাড়ি পর্যন্ত এলো, কিন্তু ভেতরে গেলোনা তাই বললাম আরকি। ”
” অহ! ” বলেই রায়ান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।
” আচ্ছা বাদ দে। এখন চল ভেতরে যাই। ”
রিখিয়া গিয়ে কলিংবেলে চাপ দিলে ভেতর থেকে একটা মহিলা এসে দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই রিখিয়া মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” খালা তুমি একটু গিয়ে মাকে ডেকে আনো তো। ”
” ক্যান আফামনি খালাম্মারে ক্যান? আপনে আগে ভেতরে তো আহেন। ”
” আচ্ছা আমি ভেতরে আসবো। তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো আগে। ”
রাহেলা ভেতরে চলে যায় রিখিয়ার মা মিসেস শাহিদাকে ডেকে আনতে।
এতক্ষণ শুধু রিখিয়াই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাই দূরে দাঁড়ানো অর্ণা আর রায়ানকে রাহেলা খালা দেখতে পায়নি।
মিসেস শাহিদা এসে দরজার সামনে মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
” কিরে রিখি দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়। ”
” ইয়ে মা, দাভাই….. ”
” অহ রায়ান, কোথায় ও? ”
রিখিয়া দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেই পেছন থেকে অর্ণা আর রায়ান বেরিয়ে আসে। অর্ণা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস শাহিদা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করেন, ” ও এখানে এই সাজে কেন? ”
রিখিয়া ওর মাকে সবটা খুলে বলে। ভেতর থেকে ততক্ষণে রিখিয়ার দাদীও চলে এসেছে।
মিসেস শাহিদা বলেন, ” এই মেয়েকে নিয়ে আমার বাড়িতে ঢুকবে না। ওকে এক্ষুণি ওর বাড়িতে দিয়ে এসো। ”
রায়ান এবার জবাব দেয়, ” মা, এসব তুমি কি বলছো? ”
” যা বলছি ঠিকই বলছি। ”
(চলবে)———–
জাহানারা রিমা