আসক্ত?
জান্নাত
পর্ব : ১৩
ভোর হতেই সবাই বেরিয়ে পরলো বর্ষার শশুর বাড়ি থেকে! লাজুকদের বাড়িতে পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে! তাই তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পরেছে সবাই!
দুটো গাড়ি করে রওনা দিলো তারা!
একটাতে আছে নিশু রিমি বর্ষা আর আবির! আবির ড্রাইভ করছে তার পাশে বসে বর্ষা!বাকি দুজন পেছনের সিটে গল্পে মশগুল!
বর্ষাদের গাড়ির সামনের গাড়িতে লাজুক ড্রাইভ করছে, টায়রা তার পাশে বসে! আর তাদের পরছনের সিটে রিমপি তিতলি!
চুপ করে সিটে মাথা বা দিকে এলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে টায়রা! কোনো কথা বলছে না সে! কালকের সেই ঘটনার পর থেকেই টায়রা কেমন যেনো হয়ে আছে! হয়তো মাথার মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুর পাক খাচ্ছে তার!
লাজুক টায়রার থেকে চোখ সরিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো! সে টায়রার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে, কিন্তু সে এখন টায়রাকে কিছুই বলতে চাইছে না!
টায়রাকে এমন চুপচাপ দেখে পেছন থেকে রিমপি লাজুকের দিকে কিছুটা ঝুকে গিয়ে আস্থে করে জিগ্গেস করলো,
– ভাই কি হয়েছে? তুমি কি কিছু বলেছো ওকে?
রিমপির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো লাজুক, মানে কিছুই হয়নি!
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে রিমপি তিতলি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে দিলো!
এভাবে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলো! দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো! লাজুক গাড়ি রাস্তার এক সাইড করে নিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিলো!
তা দেখে পেছনে আবিরও গাড়ি থামালো! টায়রা অবাক হয়ে লাজুকের দিকে তাকিয়ে! সে ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে!
– সবাই বাইরে বেরিয়ে এসো!
লাজুকের কথায় রিমপি তিতলি বেরিয়ে এলো, সাথে টায়রাও!
পেছনের গাড়ি থেকে আবির বর্ষা রিমি নিশু তারাও এগিয়ে এলো ওদের কাছে!
– কি হলো শালাবাবু গাড়ি থামালে কেনো এখানে?
আবিরের কথায় লাজুক বলল,
– সকাল থেকেই তো সবাই একই ভাবে বসে আছে! একটু ব্রেক নেওয়া দরকার এখন! নয়তো বাড়ি পৌছে বেশি ক্লান্ত হয়ে পরবে!
লাজুকের কথা শুনে রিমপি বলল,
– ঠিক বলেছো ভাই! [ কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে ]সে কখন থেকে বসে থাকতে থাকতে আমার কোমড় শেষ হয়ে গেছে!
সবাই গিয়ে রাস্তার পাশে বসার জন্য ব্যাঞ্চ রাখা আছে সেখানে বসলো! লাজুক গিয়ে গাড়ির উপরে পা ঝুলিয়ে বসে পরলো!
আর তাদের থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার কিনারায় গিয়ে দাড়িয়ে টায়রা আকাশের দিকে তাকিয়ে! শো শো বাতাস তার খোলা চুল গুলো এলো মেলো করে উরিয়ে দিচ্ছে! সে দিকে এ দৃষ্টিতে তাকিয়ে লাজুক!
এদের দুজনের এই অন্যরকম ব্যাবহারটা নজরে পরছে সবারই! কিন্তু ঠিক কি হয়েছে ধরতে পারছে না কেউই!
লাজুক হঠাৎ গাড়ির উপর থেকে নেমে কোথাও একটা চলে গেলো! বর্ষা এগিয়ে গিয়ে টায়রার পাশে দাড়ালো নিঃশব্দে! বুঝতে পারলো না টায়রা যে কেউ এসে ওর পাশে দাড়িয়ে!
– টায়রা!
বর্ষার ডাকে ঘুরে তাকালো তার দিকে!
– কি হয়েছে তোর?
বর্ষার কথায় মুখে কৃত্তিম হাসি ফুটিয়ে টায়রা জবাব দিলো,
– কই দি, কিছু তো হয়নি!
– বাহহ! ভাইয়ের পিচ্চি এতো বড় হয়েগেছে যে মিথ্যে বলতেও শিখে গেছে!
বর্ষার দিকে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে টায়রা! হঠাৎই তার বুকটা কেপে উঠলো!
বর্ষা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে টায়রার গালে হাত দিয়ে বলল,
– কাল রাতের সব কথাই ভাই আমায় বলেছে!
মাথা নিচু করে ফেললো টায়রা! তার গাল বেয়ে পানি পরছে!
টায়রার চোখের পানি মুছে দিয়ে বর্ষা আবারও বলতে লাগলো,
– যখন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন ছেলে একটা ১৪ বছরের পিচ্চি মেয়েতে আসক্ত হয়, সেটা কতটা যন্ত্রনার হয় ছেলেটার জন্য যানো? নিজেকে কতটা হেল্প লেস লাগে, নিজের উপরে কতটা ঘৃনা হয় যানো? যানো না!
কিন্তু আমার ভাই যানে! কারন সেও যে একটা পিচ্চি মেয়েতে আসক্ত হয়েছে!
অবাক চোখে তাকিয়ে টায়রা বর্ষার দিকে! তার বুকের মধ্যে যেনো কেমন করছে!
বর্ষা আবার বলতে শুরু করলো,
– অবাক হচ্ছো না? অবাক হওয়ারই কথা! আমি যখন প্রথম বুঝতে পারি তখন আমিও অবাক হয়েছিলাম! ভাইকে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পেতে দেখে কতটা খারাপ লাগতো বোঝাতে পারবো না! আমার ভাইয়ের মত একটা ছেলে সে কি না দুনিয়াতে এতো মেয়ে থাকতে একটা টিন এইজের মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পরেছে!
ওকে অনেক বার জিগ্গেস করার পরেও ও কখন শিকার করেনি! কিন্তু আমি তো বুঝি আমার ছোট্ট ভাইটার মনের মধ্যে কি চলছে! প্রতিটা মুহূর্তে যে সে ধূকে ধুকে মরছে! তার পিচ্চির আসেপাশে কোনো ছেলে সহ্য করতে পারতো না সে, এখনো পারে না! তার দিকে কোনো ছেলে বদ নজর পরুক সেটা সে সহ্য করতে পারে না! কেনো পারবে? সে যে তার পিচ্চি কে অতিরিক্ত ভালোবাসে!
ভাই যার প্রতি আসক্ত ছিলো সে কে যানো? সে তুমি ছিলে টায়রা! আমার ভাইয়ের পিচ্চি! তার আসক্তি!
বর্ষার কথা গুলো শুনে মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাদছে টায়রা! কেনো জানি তার কষ্ট হচ্ছে! খুব কষ্ট হচ্ছে! সেটা কেনো যানা নেই তার!
বর্ষা মুচকি হেসে টায়রার চোখের পানি গুলো মুছে দিলো!
– এভাবে কাদছিস কেনো? ভালোবাসিস কি আমার ভাইকে?
মুহূর্তেই কান্না থেমে গেলো টায়রার! সে অবাক হয়ে বর্ষার দিকে তাকালো!
বর্ষা হালকা হেসে টায়রার গাল টেনে দিয়ে বলল,
– মন খারাপ করে থাকিস না! তোকে এভাবে দেখলে আমার ভালোলাগে না! তোর হাসি মুখটা মিস করছি আমি!
বর্ষার কথা শুনে ভেজা চোখেই হেসে দিলো টায়রা!
পিছনে আবিরের ডাক শুনে সে দিকে চলে গেলো বর্ষা!
সেখানেই দাড়িয়ে টায়রা! তার পুরো শরীর যেনো নিজতেজ হয়ে আছে!
কিছুক্ষন পর লাজুক ফিরে এলো হাতে করে অনেক গুলো আইসক্রিম নিয়ে!
আইসক্রিম দেখতেই তিতলি নিশু রিমপি রিমি হামলে পরলো তার উপর! যে যারটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো!
বর্ষা আর আবির কে আইসক্রিম দিয়ে, বাকি দুটো আইসক্রিম নিয়ে এগিয়ে গেলো টায়রার দিকে!
চুপ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে আছে টায়রা! লাজুকের আওয়াজ পেতেই সে দিকে ফিরে তাকালো!
হাতের আইসক্রিম টায়রার দিকে এগিয়ে দিয়ে,
– কি হয়েছে?
লাজুকের হাত থেকে আইসক্রিম নিয়ে নিরবে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো টায়রা! আড় চোখে দেখতে লাগলো তাকে!
এই লোকটা ওকে ভালোবাসে?সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না!
টায়রার পাশে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো লাজুকও! নিঃশ্বচুপ সে সামনে তাকিয়ে,
– কেদেছো কেনো?
হঠাৎ লাজুকের প্রশ্নে টায়রা ফিরে তাকালো তার দিকে!
– কক..কই না তো! কা..কাদছিলাম না!
লাজুক দৃষ্টি টায়রার ফোলা লাল চোখের উপর!ডান হাত দিয়ে টায়রার বাম গালে স্পর্শ করতেই একটু কেপে উঠলো সে!
লাজুক শান্ত কণ্ঠে বলল,
– গালের উপর চোখের পানির দাগ রয়ে গেছে এখনো!
লাজুকের কথার কোনো জবাব দিতে পারলো না সে,মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো!
খানিক পরেই লাজুকের স্পর্শে পেতেই চোখ তুলে তার দিকে তাকালো টায়রা! লাজুক দু হাতে টায়রার মুখ নিয়ে উপরের তুলে,টায়রার ফোলা দু চোখের পাতায় আলতো করে চুমু খেতেই চোখ চেপে বন্ধ করে নিলো সে!
লাজুক টায়রার থেকে সরে আসতেই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো সে!
– গাড়িতে উঠে বস! আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে!
মাথা নাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলো টায়রা! লাজুক বাকিদের ডাকতেই তারাও এসে পরলো গাড়িতে!
_________________
সবাই ফিরতেই পুরো বাড়িতে ধুম পরে গেলো আনন্দের! খাবার দাবারেরও হল হরেক আয়োজন!দুদিনের নিছতেজ হয়ে পরে থাকা বাড়িটা আবার হর্টোগোলে ভরে গেছে!
রাত নয়টার পর প্লান হলো সবাই মিলে ছাদে আড্ডা দিবে! সেই অনুযাই একটা বড় ম্যাট্রেস নিয়ে বিছিয়ে দিলো ছাদের মাঝে! তিতলি টায়রা নিশু রিমপি রিমি পাচ জনে হাতে করে কিছু বালিশ আর টুল নিয়ে এলো বসার জন্য!
বর্ষা আর আবির চলে আসতেই সবাই গোল হয়ে ম্যাট্রেসের উপর বসে পরলো!
টুকটাক বিষয়ে কথা শুরু হলো! সবার কথার মাঝেই রিমপি বলে উঠলো,
– বর্ষা দি আমাদেরকে তোমার আর জিজুর লাভ স্টোরিটা বল না!
রিমপির কথায় সায় দিলো বাকি চার জন!
– হ্যা হ্যা, জিজু তুমিই বল না, কি ভাবে কি হলো?
আবির বর্ষার দিকে তাকাতেই সে লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেললো!তা দেখে হেসে ফেললো আবির!
– আমাদের তেমন কোনো লাভ স্টোরি ছিলো না! যা ছিলো তা একে বারেই বরিং!
আবিরের কথা শুনে তিতলি বলল,
– যাই হোক জিজু আমরা তাই শুনবো, তুমি বল!
আবির মুচকি হেসে বর্ষার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
– আমাদের প্রথম দেখা হয় ভার্সিটিতে! বর্ষা তখন কেবল ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়, আর আমি ফাইনাল ইয়ারে!
প্রথম দেখাই ভালোবেসে ফেলি ওকে! কিন্তু কখনো প্রকাশ করা হয়নি! মাঝে সাজে ভার্সিটিতে দেখা হলে দু একটা কথা হতো ওর সাথে শুধু! সে ভাবেই দিন পারহতে লাগলো! বর্ষাও কখনো কিছু বলে নি! কিন্তু যখন আমি বুঝতে পারলাম ও ও আমাকে ভালোবাসে, তখন ওকে বলার সিদ্ধান্ত নেই! কিন্তু….
এতটুকু বলেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো আবির! বর্ষাও মুখ অন্ধকার করে তাকিয়ে রইলো আবিরের দিকে!
আবির সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
– হঠাৎই তখন আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হয় কিছুদিনের জন্য! কিন্তু দেশে ফিরে বর্ষাকে আর খুজে পাইনি! ও ওখান থেকে চলে এসেছিলো! অনেক খুজেছি!কিন্তু তারপর এতোবছর পর আবার দেখা হলো আমাদের! আমাদের ভালোবাসার জোর ছিলো তাই আবারও দেখা হয়েছে আমাদের! আমি ফিরে পেয়েছি বর্ষাকে!
অবাক চোখে শুনে যাচ্ছে টায়রা আবিরের কথা গুলো! কত গুলো বছর অপেক্ষা করেছে তারা একে অপরের জন্য! তাও কোনো কিছু না যেনে! কে কোথায় আছে, বিয়ে করেছে কিনা? কিছুই জানতো না! ভালোবাসা এতো গভীর হয় বুঝি?
টায়রার চোখ চলে গেলো ছাদের গেটের কাছে, লাজুক এগিয়ে আসছে ওদের দিকে,তার নজর টায়রার দিকে! হঠাৎ কেমন যেনো লাগতে লাগলো টায়রার! বার বার লাজুকের দিকে চোখ যাচ্ছে তার!
লাজুক কে দেখতেই রিমি বলে উঠলো!
– তুমি এতক্ষনে এসেছো! কখন ডেকে আসলাম তোমায়!
টায়রার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে লাজুক জবাব দিলো,
– একটু কাজ ছিলো, তাই শেষ করে আসলাম!
আবির মুচকি হেসে বললো,
– শালাবাবু এসো এসো বস এখানে!
লাজুক পাশ থেকে একটা টুল নিয়ে সেখানে বসে পরলো!
তিতলি বলল,
– জানো জিজু ভাই না খুব সুন্দর ভায়লিন বাজাতে পারে! আগে প্রাই বাজাতো কিন্তু এখন আর দেখি না!
টায়রা অবাক চোখে তাকালো লাজুকের দিকে!
আবির বললো,
– বাহহ! তাই নাকি ? তাহলে শালাবাবু আমাদের কেও একটু বাজিয়ে শোনাও!
রিমি লাফিয়ে উঠে বললো,
– আমি ভায়লিন নিয়ে আসছি!
বলেই ছুটলো নিচে!
লাজুক রিমিকে আটকাতে গিয়েও পারলো না তার আগেই চলে গেলো সে! তা দেখে বর্ষা বললো,
– আরে ভাই এমন কেনো করছিস? বাজা না একটু!
– দি কত আগে বাজাতাম, তা কি এখন মনে থাকে?
লাজুকের কথায় বর্ষা নাক ফুলিয়ে বললো,
– তুই ভুলে গেছিস, আর সেটা আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলছিস?
বর্ষার দিক তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো লাজুক!
রিমি নিচ থেকে ভায়লিন এনে লাজুকের কাছে দিয়ে বসে পরলো তিতলির পাশে!
টায়রা আড় চোখে তাকিয়ে লাজুকের দিকে!
চোখ বন্ধ করে ভায়লিন বাজাচ্ছে লাজুক! আর টায়রা এক ধ্যানে তাকিয়ে লাজুকের দিকে! সে লাজুকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একমন একটা ঘোরে ঢুবে যাচ্ছে! চম্বুকের মত টানছে লাজুকের মুখ তাকে! টায়রা চাইতেও চোখ সরাতে পারছে না লাজুকের থেকে!
ভায়লিন বাজানো শেষ হতেই লাজুক চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো টায়রা তার দিকে একই ভাবে তাকিয়ে! যেনো চোখের পলকও পরছে না! পাশ থেকে তিতলি রিমির আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো টায়রা! ফের লাজুকের দিকে তাকাতে সে ভ্রু নাড়িয়ে টায়রা কে ইশারায় জিগ্গেস করলো, কি হয়েছে?
মাথা নাড়িয়ে কিছু না বলে লাজুকের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিচের দিকে তাকালো টায়রা!
To be continue….