মাহির সারা রুমে টিস্যু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বিছানায় বসে কেদে চলেছি।আমার ধারনামতে চোখের পানিতে না হলেও,মোচড়ানো টিস্যুতে সারা ঘরের অবস্থা খারাপ।কম অপমান তো জোটেনি কপালে আজ!শুদ্ধ এতোসব কাহিনী করে সেখানেই দাড়িয়ে ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছেন,যেনো আমি মানুষটা ফেলনা।গান গাইয়ে আমাকে ধমকে বললো যা বাসার ভেতরে যা।দরজার কাছে এসে দেখি ওটা বাইরে থেকে লক।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম।সবাই হন্ন হয়ে এগিয়ে আসলো আমার দিকে।সেজোমা বললো,
-ইনসু,তুই ঠিক আছিস?
-ঠিক আছি?তোমার ছেলে ঠিক থাকার কোনো সুযোগ রেখেছে কি?সে আমাকে….এ্যাঁআআআ…!
মাহি বললো,
-শুদ্ধ ভাইয়াটা এতো রাগ করলো?এভাবে ভাবিকে…
মামী বলে উঠলেন,
-হ্যাঁ,আরো জড়াও মেয়েটাকে ওর জীবনে।এভাবেই কষ্ট দেবে আজীবন।কোনোদিনও ওকে শুদ্ধ মেনে….
-তুই এতোটা কাদছিস কেনো যেনো জীবনে প্রথম কান ধরলি?শেহনাজ মন্জিলে তো রেগুলার কান ধরা লাগতো তো দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে,ইরুকে মার লাগানো নিয়ে,আর…
আমি আরো জোরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেদে দিলাম।এবার যীনাত আপু এ বাসায় সবার সামনে সম্মান লুটবে আমার।সেজোমা ধমকে বললো,
-থামো যীনাত।শেহনাজ মন্জিল আর আজাদ ম্যানশন এক হলো না।
সেজোমার কোলে মাথা গুজে দিলাম।কেউতো বুঝলো।যীনাত আপু আবারো বললো,
-সেজোমামী,সেটা ওকেই জিজ্ঞাসা করো।এক হলো কি না।এই ড্রামেবাজ,তোর চোখে একফোটা পানি নাই কেনো?ভ্যা ভ্যা করে তো কেদেই যাচ্ছিস!
আমি আরো জোরে কেদে দিলাম।বললাম,
-হ্যাঁ,হ্যাঁ এখন আমিই ড্রামেবাজ!এতো বাজে ভাবে অপমান করলো আমাকে,নিজেরা তো একপা এগোলে না।
ইশান ভাইয়া এতোক্ষনে মুখ খুললেন।বললেন,
-শুদ্ধ বলেছিলো আমরা কেউ এগোলে তোমাকে সোজা শেহনাজ মন্জিল রেখে আসবে।পরেরবার বেরোনোর সময় তো দরজা লক করেই গিয়েছিলো!
-মা রে,মাফ করে দে।ভেবেছিলাম এ বাসা থেকে তোর চলে যাওয়ার চেয়ে শুদ্ধর রাগটা সহ্য করা সহজ হবে।কিন্তু ও এভাবে বিষয়টা…
-ঠিকাছে আম্মু।ব্যাপার না।
-কি বলছিস তুই ইনসু?
-হ্যাঁ।উনি দেখতে পারলে আমি মানতে পারবো না কেনো?
-দেখতে পেরেছে তো?বাইরে কি করছে কে জানে!
মাহির কথায় ওর মা ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
-কি করবে?অবশ্যই কারা কারা ইনসিয়াকে দেখে হেসেছে তার হিসাব কষছে না?
-হতেও পারে!কাগজটা বাধার কারন এখনো ক্লিয়ার না আমি।
-তুই থাম!আপা,এই মেয়েটা যেনো এই বাসা থেকে স্বেচ্ছায় চলে যায় সেটা ভেবে কিন্তু শুদ্ধের অত্যাচারটা বেশিই হয়ে যাচ্ছে।সকালেই মেয়েটা দরজা লক করে…
-আন্টি প্লিজ!দোষ ইনসুরও আছে।সকালে ওর নাটকে কম ভয় পায়নি শুদ্ধ।শাস্তি তো একভাবে না একভাবে দিতোই ও তোকে ইনসু,জানতি না তুই?আন্দাজে ছিলো না তোর?
সম্মতি মনে মনে জানালাম।সবাই অবাক হয়ে একসাথে বললো,
-নাটক?
-হ্যাঁ।কি বলুনতো?একপাতা খালি স্লিপিং পিলস্ দেখে আপনাদের সবারও কমন সেন্স কি উড়ে গেছিলো নাকি সেজোমামী?সবগুলো খেলে শুধু পানির ঝাপটাতেই চোখ খুলতো ও?শুদ্ধকে বাসায় আনতে ওইসব করেছিলো ইনসু।
সবাই বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালো।মাথা নিচু করে রইলাম।যীনাত আপু আবারো বললো,
-তোকে নিয়ে ভয় পেয়ে ছিলো।এটুকো রাগ খাটাবেই।আর তো আর,ও যে তোকে অপমানে অপমানে এ বাসা থেকে তাড়ানোর ধান্দায় আছে তা তুই জানিস না ইনসু?তুইই তো বলেছিলি,মাটি কামড়ে পরে থাকবি এ বাসায়।এখন এটুকোতেই এমন করছিস কেনো?
কপাল কুচকে ঠোট উল্টে বললাম,
-এটুকো?
-শুদ্ধর ক্ষেত্রে এটুকো নয়?তুই জানিস না ও কেমন?তাছাড়া আমাকে বল তো,হুট করেই বা তোর এতো সম্মান গজালো কবে থেকে?
-তা বলে বাইরের লোকজনের সামনে?
-তুই যে শেহনাজ মন্জিলের আসেপাশে রাজাকারের মতো ঘুরতি,তখন সেগুলো কি তোর পরমাত্মীয় ছিলো?তোর রেকর্ড জানিনা আমি?সেবার শুনেছিলাম তুই আরাধ্যাকে ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালাতে দিতে গিয়ে ধরা পরেছিলি।সেবারের অপমানটা কি নিতান্তই চার দেয়ালে ছিলো?আবার নাকি পাশের বাসার নাইমার বিয়েতে তুই…
-আপুউউউ!
-কি?
-কিসের সাথে কিসব বলছো তুমি?
-জাস্ট তোকে মনে করাচ্ছি তুই লোকের কথায় কতটা সেন্সিটিভ!
-হয়েছে হয়েছে।থামো প্লিজ!
আপু চুপ করলো।কিন্তু ওর কথাগুলো যৌক্তিক ছিলো।মনে পরলো এই লোকটার আসল উদ্দেশ্য তো আমাকে এ বাসা থেকে বের করা।তাই যেভাবেই হোক অপমান করে তাড়ানোর উপায় খুজছে।আমাকে বুঝতে হবে উনি এমনটাই চান যাতে আমি রেগে চলে যাই।কিন্তু তা তো হতে দেওয়া যাবে না!
ওদের কিছু সান্তনাবাণী আর উপদেশ শুনে নিজেকে শক্ত করলাম।পা বাড়ালাম রুমের দিকে। সবাইকে বলে এসেছি, আমাকে নিয়ে না ভাবতে।ওরা অবশ্য মানা করেছিলো এ রুমে আসতে,বলেছি শুদ্ধ যা চায় তা দেবো না ওনাকে আমি।শুদ্ধ ফেরেননি।দরজা খোলা।রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে মোবাইল ঘাটছিলাম।মুলত মৌনতাকে ম্যাসেন্জারে ঝাড়ছিলাম।বেশ কিছুটা সময় পর শুদ্ধ মাথার চুল উল্টাতে উল্টাতে রুমে ঢুকলেন।একনজর তার দিকে তাকিয়ে ফোনে মনোযোগ দিলাম।শুদ্ধও একপলক আমাকে দেখে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলেন,পরপরেই চমকে উঠে তাকালেন আমার দিকে।এগিয়ে এসে বললেন,
-তুই?এ রুমে?
-তো কোথায় থাকবো?এইটাই তো আমার রুম।
আশেপাশে কিছু খুজলেন উনি।বললেন,
-ব্যাগপত্র গোছাস নি?
-না।কেনো?
-এ বাসা ছেড়ে যাবি না তুই?
-সে কথা কখন হলো আমাদের?
-এতোকিছু করলাম,তোর গায়ে লাগেনি?
-শুধু কাগজটা লেগেছিলো।
-এতোটুকো লজ্জা,ঘৃনা,রাগ হচ্ছে না তোর?
-এসব তো আপনার হওয়ার কথা।আপনার বউ কান ধরেছিলো,গান গেয়েছিলো,তাকে দেখে সবাই হেসেছে।
-শুদ্ধর নাম দেখেই ওরা চুপ ছিলো।
-হ্যাঁ,কিন্তু ততক্ষনে আমার মানসম্মান তো শেষ তাইনা?
-তো চলে যাস না কেনো?
-কোথায় যাবো?
-কেনো?শেহনাজ মন্জিল।
-যাবো না।
উনি চেচিয়ে বললেন,
-আর কি করলে যাবি তুই আমার জীবন থেকে?
-সবকিছু ট্রাই করে দেখতে পারেন।
উনি ফুসতে ফুসতে ওয়াশরুমে চলে গেলেন।শব্দহীন হেসে মোবাইল পাশে রেখে বাবু হয়ে বসলাম।এভাবে গান গাইয়ে,কান ধরিয়ে কেনো?আমিতো ঠিক করে নিয়েছি,যদি সবার সামনে মুরগী বানিয়েও বসিয়ে রাখেন আমাকে, তবুও এখানেই থাকবো।এ বাসা ছেড়ে যাচ্ছি না আমি মিস্টার এংরি বার্ড!এতো তাড়াতাড়ি আর নিজের মটো ফুলফিল না করে তো নয়ই!
——————?
আজাদ ম্যানশনের ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে আয়ান।অফিসের কাজ শেষ করে তবে আসতে হয়েছে ওকে।মিস্টার আজাদের সাথেই এ বাসায় এসেছে ও।চোখে মুখে তার উপচে পরা খুশি।অবশেষে ইনসিয়াকে দেখবে ও।এতোগুলো বছরে যার নামে স্বপ্ন বুনেছে ও।তাকে নিজচোখে দেখবে আজ।প্রথমে দুবার দেখার চেষ্টা করেছিলো।হয়ে ওঠেনি।কারনটা আজও অজানা ওর।মুনিয়ার অসুস্থতার পর উপায় থাকলেও ইচ্ছে করেই ইনসিয়াকে দেখার চেষ্টাটুকো করেনি ও।প্লান ছিলো,শুদ্ধকে আজাদ ম্যানশন থেকে বের করে,একা করে দেবে।তারপর বিয়ে করেই ঘরে তুলবে ও ইনসিয়াকে।একদম বধুবেশে দেখবে ওকে।অবশ্য মনের চোখ দিয়ে এ কয় বছরে প্রতিদিনই দেখেছে ও ইনসিয়াকে।ডায়রিতে ওকে নিয়ে লেখা প্রতিটা কথা এতোটাই প্রানবন্ত ছিলো।
মিসেস আজাদ হুইলচেয়ার নিয়ে এগিয়ে আসলেন।আয়ান উঠে দাড়িয়ে সালাম দিলো ওনাকে।উত্তর নিয়ে বসতে বললেন উনি আয়ানকে।আসমা এসে নানারকমের নাস্তা ওর সামনে সাজিয়ে দিয়ে গেলো।ড্রয়িংরুমে যীনাত আর মাহি বাদে বাকিসবাই উপস্থিত।বাসাভর্তি লোক বারবার আয়ানকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এখানে শুদ্ধ আনন্দে আছে আর এটাই ওর প্রেয়সীর শশুড় বাড়ি।মনে মনে ফুসে উঠছে ও,হাতের শক্ত মুঠোয় সে রাগটাকে নিয়ন্ত্রন করে হাসিমুখে কথা বলছে সবার সাথে।তাপসী একবার ডাক ছেড়ে বললো,
-শুদ্ধ!তোর ফ্রেন্ড এসেছে।
শুদ্ধ বেরোলো না।এটা আয়ানও জানে ও বেরোবে না।যতোক্ষন না শুদ্ধর মনে হবে আয়ানের এখানে সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ,ততক্ষন ও বেরোবে না।তারপর একসময় নিজেই এসে বলবে চল রুমে চল।তারপর রুমে গিয়েই কথা বলবে দুজনে।এমনটাই হয়ে আসছে এই তিনবছর হলো।কিন্তু আজ তো ইনসিয়া আছে ওর ঘরে!আজ কি করবে শুদ্ধ?
-তোমার মা ভালো আছেন?
-জ্বী।
-উনি আসলেন না?
-আসলে আন্টি,অফিস থেকেই এসেছি তো!নিয়ে আসবো একদিন।
মিসেস জামান আয়ানকে শুদ্ধের মতোই ভালোবাসেন একথা আয়ান জানে।এ বাসার সবাই আপনজনই ভাবে ওকে।আয়ান বসে সবারর সাথেই কথা বলছিলো।এমন সময় মাহি এসে আয়ানের পেছন থেকে চুল টেনে দিয়ে সামনে বসতে বসতে বললো,
-তুমি ভাইয়া ভালো হলে না কোনোদিনও।মাত্র দেখলাম রুমে, এরমধ্যেই বউয়ের পিছন….
সামনে তাকিয়ে আয়ানকে দেখেই আটকে গেলো মাহি।অপরিচিত এ লোকটির আপাদমস্তক দেখে নিলো ও একবার।বেশ ফর্সাই লোকটা।শার্টের উপর কোট পরা,পায়ে কালো সু,চুল সেট করা,একদম ফর্মাল লুক।পেছনদিক থেকে আয়ানের মাথা দেখে ভেবেছে হয়তো সিফাত বসে,তাই ওমন করেছে।আয়ানের মনে মনে প্রচন্ড বিরক্তি হলেও,বাইরে তা প্রকাশ করলো না।মাহি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
-সরি।আসলে আমি…
-ইটস্ ওকে।
এটুকো বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলো আয়ান।ইনসিয়া ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওর নেই।আয়ানের ভাব দেখেই মাহি বুঝলো ওর কাজে লোকটা বেশ ভালোই বিরক্ত হয়েছে।কিন্তু আয়ানের অমন ব্যবহারে কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করল ওর।তবে কিছু না বলে চুপই রইলো। মিসেস জামান মাহির মা কে বললেন,
-ভাবি,ডিনারের ব্যবস্থাটা…
আসার পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।আয়ান শুধু ভাবছে,শুদ্ধ কখন এসে ওকে ওর রুমে নিয়ে যাবে।ওই চলে যেতো,কিন্তু ইনসিয়া আছে ওর সাথে ও ঘরে।এভাবে ঢুকে পরলে এ বাসার লোকগুলো বিষয়টা বাজেভাবেও নিতে পারে।যা এই মুহুর্তে একদমই চায় না আয়ান।স্বাভাবিকভাবেই বললো,
-না না আন্টি,ব্যস্ত হবেন না।আমি তো…
-না কেনো আয়ান?তুমি ডিনার করেই বেরোবে।
মিস্টার আজাদের কথায় আয়ান গলার স্বর নামিয়ে বললো,
-আসলে স্যার…
-কতোবার বলবো বলোতো তোমাকে আয়ান?আমি অফিসে তোমার স্যার।বাসায় না।ইনফ্যাক্ট আমি তোমার স্যার হতে চাইনা কোথাওই।আঙ্কেল বলে ডাকবে আমাকে।
আয়ান হাসলো।বললো,
-সরি,অভ্যাস।
-পাল্টে ফেলো।আর ডিনার করেই যাচ্ছো তুমি হুম?
-তা আর হবে না স্যার।জানেনই তো বাসায় আম্মু একা।ওয়েট করছে আমার জন্য।
মিস্টার আজাদ কিছু একটা বুঝে বললেন,
-ঠিকাছে।অল্প কিছু খেয়েই নয় বেরিয়ে পরো।
-আমি যতোদুর জানি তুই অফিসিয়াল কাজে আসিস নি আয়ান।এখানকার কথা শেষ হলে রুমে চল?
কথাটা বলতে বলতে শুদ্ধকে সীড়ি বেয়ে নামতে দেখলো আয়ান।হাসি ফুটলো ওর মুখে।আড়চোখে পেছনে তাকিয়ে খুজতে লাগলো ইনসিয়াকে।শুদ্ধ এগিয়ে এসে বললো,
-আসলি তবে?
-জিগরি দোস্তের বউ দেখতে তো আসতেই হতো!
বউ শুনে শুদ্ধের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হলো।বউ!ওর বউ!কথা ঘোরাতে বললো,
-কিছু খেয়েছিস?
-হ্যাঁ।তা সে কই?
-জানি না।
-জানিস না মানে?
-রুমে নেই অনেকক্ষন হলো।
-ও।
শুদ্ধ জোরে ডাক লাগালো,
-সিয়া!!!
শুদ্ধের আওয়াজে চমকে উঠলাম।মাহির রুমে চেন্জ করছিলাম।এই প্রথম নতুন বউ দেখতে এ বাসায় কেউ আসছে,ফকিন্নি বেশে তো আর যাওয়া যায় না।সবথেকে বড় কথা সে আমাকে অপমান করেছে,বলেছিলো নর্মাল বিহেভ করতে।আমিতো মিস চিপকু হবো এবার।একদম উল্টোটাই করবো।একটা জোরে শ্বাস নিয়ে ওড়না দিয়ে মাথায় বেশ বড়সর করে ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলাম।
আয়ানের চোখ পরতেই উঠে দাড়ালো ও।শুদ্ধ আয়ানের চোখ অনুসরন করে তাকালো।কাচা হলুদ রঙের জামাটা উজ্জল শ্যামবর্নের গায়ে বেশ ফুটে উঠেছে।মাথায় ওড়না জরিয়েছে,তবে কানের পাশের একগুচ্ছ চুল তার ফাকেই সামনে দিয়ে উকি দিচ্ছে।পেছনে কোমড় অবদি ঢেউ খেলানো চুলগুলো ওর সিড়ি বেয়ে নামার ছন্দে তাল মিলিয়ে নড়ছে।বা হাত ভর্তি চুড়িগুলোর শব্দ যেনো চারপাশে ঝড় তুলে দিলো।নামিয়ে রাখা চোখের ঘন পাপড়ি,থুতনির বা পাশটায় একদম ছোট একটা তিল দেখলে যেনো তৃষ্ণা বাড়ে।ঠিক যেমনটা ওর শ্যামাপাখিকে চায় ও।কিছুক্ষন আগেও অন্যড্রেসে ছিলো ও।তাহলে চেন্জ করলো কেনো?এভাবে বউবউ সেজেছে কেনো ও?হাত মুঠো করে নিলো শুদ্ধ।
গুটিগুটি পায়ে নিচে নামতেই শুদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন,
-মিট আয়ান।
আমি মাথা নিচু রেখেই ধীর গলায় সালাম দিলাম ওনাকে।উনিও ধীরেই উত্তর নিলেন।শুদ্ধ ওনাকে বললেন,
-আয়ান।ওই ইনসিয়া।
আয়ান কোনো ঘোরে ছিলো।নিজের অন্তরাত্মা এই প্রথমবারের মতো প্রশ্ন করেছিলো ওকে,না দেখে অন্য কারো বর্ননায় সৃষ্ট মোহকে ভালোবাসা ভাবছে না তো ও?হলে হবে।ইনসিয়াকে চাই ওর।ব্যস!নিজেকে সামলে বললো,
-হ্যাঁ হ্যাঁ,দেখেই বুঝেছি।কেমন আছো ইনসিয়া?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-তুমি আমার ছোট,ইনফ্যাক্ট শুদ্ধও চারমাসের ছোট আমার।নাম ধরে বলতেই পারি তোমাকে তাইনা?
-জ্বী অবশ্যই ভাই…
-উহুম।ভাইয়া বলতে হবে না।নাম ধরেই বলো।
-তা কেনো আয়ান।তুই ওর বড়।সিয়া,ভাইয়া বলেই ডাকবি ওকে।
শুদ্ধর দিকে তাকালাম।কপালের রগ,সাদা টি শার্টের নিচে ফর্সা গলার রগ দৃশ্যমান।দাত কেলিয়ে বললাম,
-কি দরকার?উনি নিজেই তো নাম ধরে ডাকতে বলছেন।নাম ধরেই ডাকি না!
শুদ্ধ আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-চল রুমে যাই।
তারপর আমার দিকে আঙুল উচিয়ে বললেন,
-রুমে আসবি না তুই।
ভোলাভালা ফেইস বানিয়ে বললাম,
-কিন্তু উনি তো আমার সাথেই দেখা করতে আসলেন!
আয়ান চুপচাপ সবটা বুঝতে ব্যস্ত।যেখানে শুদ্ধ মুখে বলছে ডোন্ট কেয়ার,আবার ইনসিয়াকে নিয়ে ইন্সিকিউরিটিও দেখাচ্ছে,ইনসিয়া সেখানেই ওর কথার উল্টোটাই বলছে।সম্পর্কে টানাপোড়ন বুঝতে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির এর চেয়ে বেশি কিছু জানার প্রয়োজন হয় না।
শুদ্ধ আয়ান দুজনেই উপরে চলে গেলেন।আমিও যেতাম।বোঝা দরকার লোকটা কেমন বন্ধু শুদ্ধের।কতোটুকো জানেন ওনাকে নিয়ে।কিন্তু যীনাত আপু আটকে দিলো আমাকে।ওরা সবাই সোফায় বসে কথা বলছে।কিচেন আর ড্রয়িংয়ের মাঝে এক পিলারে হেলান দিয়ে আসমা খালার সবজি কাটা দেখছিলাম আর এসবই ভাবছিলাম আমি।কতোক্ষন কেটে গেছে জানিনা।
-আসছি ইনসিয়া।
ধ্যান ভেঙে আয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।শুদ্ধ পাশেই দাড়িয়ে।ফোনটা বেজে উঠতেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-আমি বেরোবো।কখন ফিরবো জানিনা।
আয়ানের দিকে তাকিয়ে মাথা দুবার উপরেনিচে নাড়ালেন।উনিও তাই করলেন।শুদ্ধ ফোন রিসিভ করে একটু সাইডে দাড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন।আর আমি বাকা চোখে তাকে দেখছি।আচমকাই কেউ তুড়ি বাজালো।ঘাড় ঘোরাতেই আয়ান একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলেন আমাকে।হাসিমুখে তবে ধীর গলায় বললেন,
-তোমার গিফট্!
-এটা…
-না বলো না প্লিজ।
-এটার কোনো প্রয়োজন ছিলোনা।আপনি…
-প্রয়োজন ছিলো।তোমার ভালো চাই আমি।কিছু সত্যি তাই জানাতে চাই তোমাকে।জানা দরকার তোমার।উপহার হিসেবে তাই এই সত্যিগুলোই দিলাম।তোমাকে।
অবাকচোখে তাকালাম তার দিকে।উপহার হিসেবে সত্যি?কি সত্যি?কার সত্যি?এভাবে শুদ্ধের থেকে লুকিয়ে কেনো?উনি তো শুদ্ধের ফ্রেন্ড।তবে কি শুদ্ধের সাথে রিলেটেড কিছু?ওনার এমন বিহেভের কারন নিয়ে কিছু?
-স্ সত্যি মানে?আর আমাকে?ঠিক বুঝলাম না।
-দেখলেই বুঝতে পারবে।উপহারটা শুধু তোমার জন্য।শুদ্ধেরটা ও ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।
আয়ান আবারো মাথা নাড়িয়ে ব্যাগটা নিতে ইশারা করলেন আমাকে।কিছু না বুঝে কাপাকাপা হাতে ব্যাগটা হাতে নিলাম আমি।শপিং ব্যাগের মতো রঙিন ব্যাগটা হাতে আসতেই চারপাশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করলো আমার।বুকের ভেতরটায় ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো।সে ঝড়ে সদ্য ফুটন্ত স্বপ্নগুলো ঝরে যাবে না তো সেই ভয় দানা বাধতে শুরু করলো নিজেদের মতো করে।
আজাদ ম্যানশন থেকে গাড়ির চাবির গোছা ঘুরাতে ঘুরাতে বেরিয়ে এলো আয়ান।শুদ্ধও বেরিয়ে গেছে।কোথায় গেছে সেটা নিয়ে বরাবরই মাথাব্যথা নেই ওর।গেছে হয়তোবা,কষ্ট কমাতে।কোনো বারে।গাড়ির কাছে এসে আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকালো সে।সোজা চোখ গেলো ওর শুদ্ধের ব্যালকনির দিকে।সেখানে রেলিংয়ের ফাক দিয়ে বেরিয়ে আসা দুটো ডালে বেশ বড়বড় তিনটে গোলাপ ফুটেছে।সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নেমে আসলেও,বাগানের লাইটের আলোতে নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছে তা একদম।
বৈশাখের এই তপ্ত রোদে একফোটা পানি না পেয়ে যে গাছ মরতে বসেছিলো,সে গাছে গোলাপ ধরতে দেখেই আয়ানের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসলো।বৃষ্টি হয়নি এ দু দিনে।তারমানে ইনসিয়া নামক বর্ষনই সে শুকনো নির্জীব গাছে এতো সুন্দর গোলাপ ফুটিয়েছে।হয়তো এভাবেই শুদ্ধের জীবনকেও ও….
‘ নাহ্!তা হবে না।এই আয়ান তা হতে দেবে না।শুদ্ধকে এতো সুখে বাচতে দেবো না আমি।ইনসিয়া,তুমি শুধু আমার জীবনে নামবে বর্ষন হয়ে।এই হৃদয়ে প্রতিশোধের যে আগুন জ্বলছে,তা নেভাতে তোমাকেই লাগবে আমার।তোমাকেই।শুদ্ধকে আবারো দিশেহারা করে দেবো আমি।আর থেকেই আজ তার শুরু।
#চলবে…
মিথিলা মাশরেকা