তোর নামের রোদ্দুর,পর্ব-১০

0
1875

একটা মানুষে এতোটা গভীরতা কিভাবে থাকতে পারে?কিভাবে একজন মানুষ এতোটা ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে পারে?যতই দেখছি শুদ্ধকে,ততই অবাক হচ্ছি।রাতে চুপচাপই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।কিন্তু গভীর রাতে মাথায় শুদ্ধের হাতের স্পর্শ পেতেই জেগে গেলাম আমি।পাশ ফিরতেই দেখি সো কলড্ মাতাল বর আমার ঘুমানোর নাটক করছে।ওনার হাত আরো ভালোভাবে জরিয়ে মাথার নিচে নিতেই ছিটকে উঠে বললেন,

-এতো গায়ে পরা কেনো হচ্ছিস তুই?আগে তো ও বাসায় পালিয়ে পালিয়ে বেরাতি!

উঠে বসলাম হাটু ভাজ করে।দুহাত হাটু জরিয়ে ধরে বললাম,

-আগে তো আর আপনি আমার বর ছিলেন না।

উনি আটকে গেলেন।তারপর নিজেকে সামলে ধমকির গলায় বললেন,

-এখনো না আর ভবিষ্যতেও থাকবোও না।দুরে থাক।

-কি ছাতার মাথার ব্রান্ড খেয়ে আসেন বলুনতো?নেশাই চড়ে না আপনার।একদম হুশে আছেন এমনটাই মনে হয়।আর স্মেলটা শুধু গায়ে থেকে আসে,মুখ থেকে না।

জবাব না দিয়ে চাদর জরিয়ে উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে পরলেন উনি।গলা উচিয়ে বললাম,

-এখন আবার এটা জিজ্ঞাসা করবেন না প্লিজ,মুখে স্মেল করলাম কখন বা কিভাবে।ঘুমন্ত ছেলেমানুষের সুযোগ নেয় না ইনসিয়া।

রেগে উঠে বসলেন উনি।গায়ের চাদর মেঝেতে ছুড়ে বললেন,

-চুপ!একদম চুপ!বের করে দেবো রুম থেকে একদম!

-লে!এতোদিন বলতেন,বেরিয়ে যাবো।এখন বলছেন বের করে দেবো।আপনার নেশা করা নিয়ে সত্যিই ডাউট হচ্ছে আমার।

-তুই থামবি না?

-ডায়…

বলতে গিয়েও বললাম না।ডায়রিটা নিয়ে আর ঝামেলা পাকিয়ে লাভ নেই।যা জানার,জেনে গেছি।এবার শুধু উগরানোর পালা।শুয়ে পরে বললাম,

-ভালো মতোন গুড নাইট বললেই কখন ঘুমিয়ে যেতাম।খালি ঝগড়া করবে।হুহ!গুড নাইট!

সকালটা যেনো তার টিশার্ট খামচেই শুরু হয়।প্রথমদিনের মতো আজও তার বুকে মুখ গুজে থাকবো এমনটাই আশা করেছিলাম।কিন্তু ঘুম ভাঙতেই দেখি সে লোক বিছানায় নেই।জোরে শ্বাস ফেলে ফ্রেশ হয়ে তাকে প্রতিদিনের মতো ব্যালকনিতেই পেলাম।সেই পাখিটাও এসেছে।উনি কিছু খাবার ছিটিয়েছেন ওখানে।ইচ্ছা করেই শব্দ করে এগিয়ে গেলাম ওখানে।পাখিটা উড়ে যেতেই কটমট করে তাকালেন উনি আমার দিকে।ফোকলা হেসে বললাম,

-গুড মর্নিং!

মুখ ঘুরিয়ে নিলেন উনি।পাশে দাড়িয়ে বললাম,

-পাখিপালনের শখ আমারও ছিলো।যদি বলেন খাচা কিনে পাখিটাকে পুরে দেবো।আর উড়ে যাবে না।

-এমনিতেও যাবে না দেখছি,যতোদিন আমি না সরে যাই।তাইতো নিজেই সরে যাওয়ার চেষ্টায় আছি।

কথার অর্থ পুরোটাই বুঝলাম।বললাম,

-মিস করেন,ভালোবাসেন,ছেড়ে যাবেন কেনো?

-ওর যোগ্য না আমি।আমি তো সে নইই যাকে…

উনি আমার দিকে তাকিয়েই থেমে গেলেন।বললাম,

-এমন না হয় আপনার ধারনা কখনও ভুল হয়ে যায়।ধরুন,আপনি বুঝতে পারেন ওর জন্য আপনিই যোগ্য ছিলেন আর ঠিক তখনই ও আপনার থেকে দুরে সরে গেলো।কেমন লাগবে?

ভাষাহীনভাবে একপলক তাকালেন উনি আমার দিকে।তারপর চলে আসলেন ওখান থেকে।আপনাকে বুঝতে আর বোঝাতে খুব বেশিই দেরি না হয়ে যায় শুদ্ধ-কথাটা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো একটা।

ব্রেকফাস্ট শেষে মাহির রুমে গিয়েছিলাম।যীনাত আপু আর মাহি ছিলো ওখানে।পরদিনই বৌভাত।এসব নিয়েই আলোচনা করছিলো ওরা।তাপসী আপু আর সীমা ভাবি এখনই নাকি শপিংয়ে চলে গেছে।আমরা বিকেলে যাওয়ার প্লান করছিলাম।যদিও মাহি শুদ্ধর বাসায় থাকা নিয়ে টেনশন করছিলো,যীনাত আপু বুঝিয়েছে ওকে।আমি নাকি সামলে নেবো বিষয়টা।কিন্তু যা ভেবেছি তা করার কথা ভাবলেও আমার হাত পা ঠিকই অসাড় হয়ে আসছে।তবুও সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ওদের প্লানিংয়ে মন দিলাম।

-সিয়া!

শুদ্ধর ডাক শুনে উঠে দাড়ালাম আমি।যীনাত আপু বললো,

-বাব্বাহ্!শুদ্ধ একটু বেশিই চোখে হারাচ্ছে তোকে ইনসু?

ভাব নিয়ে বললাম,

-কারন আছে বেবি।সময় নিয়ে বলবো তোমাকে।

-মানেহ্?

-সারপ্রাইজ।আসছি।

ছুটে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে।রুমে গিয়ে দেখি উনি আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘড়ি পরছেন।তারমানে আজও বেরোবেন উনি।মনে মনে ছক কষতে লাগলাম,ফলো করবো ওনাকে আজ।তারপর যা হয় হোক ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-ডেকেছেন?

-হুম।রেডি হ।

বিস্ময়ে তাকালাম তার দিকে।উনি আয়নায় একনজর আমাকে দেখে চুল ঠিক করতে করতে বললেন,

-তোর কানে সমস্যা হয়েছে?নাকি চোখে?ইন ডিটেইলস্,মাথায় সমস্যা হয়নি তো?

চোখ আরো বড়বড় হয়ে গেলো আমার।উনি পেছন ফিরে বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-তোকে রেডি হতে বললাম।বেরোবো আমরা।চল যা!

শুদ্ধ বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।নিজের কানকে বিশ্বাস না করে ওভাবেই ঠায় হয়ে দাড়িয়ে আছি আমি।উনি আবারো এসে সামনে দাড়িয়ে বললেন,

-ইউ ওয়ান্ট মি টু গেট ইউ রেডি?

শিউরে উঠলাম।তাড়াহুড়ো করে আলমারী থেকে জামা বের করে চেন্জ করতে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।বেরিয়ে এসে দেখি বেডে বসে মোবাইল ঘাটছেন উনি।সোজা তার সামনে দাড়িয়ে গিয়ে বললাম,

-কোথায় যাচ্ছি?

-শেহনাজ মন্জিল।

-হোয়াট?

-নিজের বাবার বাসায় যাবি না তুই?

-আগেও বলেছি যাবো না।

উনি বিরক্তি নিয়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন।সেটা খুলে একটা ফাইল বের করে বললেন,

-কাল ভর্তির লাস্ট ডেট তোর।সে খেয়াল আছে?

খুশি যেনো পায়রার মতো ডানা ঝাপটে উঠলো ভেতরটায়।উনি তারমানে মনে রেখেছেন আমার পড়াশোনার কথা।খালি খালি রাগ দেখাবে এংরি বার্ডটা।ভালোবাসা উপচে উপচে পরছে তার কথায়!তবুও এই শ্যামাপাখিকে শুধুশুধু কষ্ট দেওয়ার কি দরকার?

-কলেজে নিয়ে যাবেন আমাকে আপনি?

-কেনো প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হবি তুই?

-কিন্তু আমার একাডেমিক কাগজপত্র তো ও বাসায়।

-আনিয়েছি।

-কাকে দিয়ে?

-আমার পালিত জ্বীন আছে।তাকে দিয়ে।

-সম্ভব।যে রাগ আপনার,একমাত্র জ্বীনই সহ্য করতে পারবে।

-রাগটা দেখাই তোকে?

কিছু না বলে ওনার হাত থেকে ফাইল নিয়ে কাগজগুলো চেক করলাম।সবই ঠিকঠাক।বড়সড় হাসি দিলাম একটা।ফটাফট রেডি হয়ে সোজা গিয়ে ওনার হাত ধরলাম।ভ্রুকুচকে তাকালেন উনি মোবাইল ছেড়ে।ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

-দুরে থাক।

আবারো শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম তার হাত।বললাম,

-কি বলুনতো আপনার মুখে আলাদা আলাদা দুটো ফেচার দেখে আমি পক্ত।

-হোয়াট?

-হুম।তা নয়তো কি?মুখে বলবেন দুরে থাক।আবার চেহারাটা বলে সিয়া,আজ ক্লোজাপ দিয়ে ব্রাশ করেছি।পাস আও,পাস আও না।

উনি এবার জোরেসরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

-ফালতু কথা কম বল।চল!

গাল ফুলিয়ে বেরিয়ে এলাম ওনার সাথে।আসার সময় সেজোমা,মামীকে সালাম করে এসেছি।বাবা অফিসে ছিলেন।অবশ্য ব্রেকফাস্টের সময় শুদ্ধের উপস্থিতি তার চেহারায় বিস্ময় এনে দিয়েছিলো।হয়তো সেজোমা রিয়্যাক্ট করতে মানা করেছিলেন,চুপ ছিলেন উনি।বাকি সবাই আড়চোখে দেখলেও স্বাভাবিকভাবেই খেয়ে নিয়েছিলো।

গাড়ির কাছে এসে ওড়না দু হাতের আঙুলে পেচাতে পেচাতে হাসি দিয়ে দাড়ালাম।শুদ্ধ গাড়ির দরজা খুলে কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন।আমাকে ওভাবে থাকতে দেখে বললেন,

-সঙের মতো দাড়িয়ে আছিস কেনো?যাবি না?গাড়িতে ওঠ!

-আপনি দরজাটা খুলে দিবেন না?

শুদ্ধ আধখোলা দরজাটা পুরোপুরি খুলে ভেতরে ঢুকে দুম করে লাগিয়ে দিলেন।ড্রাইভিং সিটে বসে স্টেয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনে তাকিয়েই বললেন,

-কি ঠিক করলি?উঠবি না?

মাটিতে একবার পা ছুড়ে ফুসতে ফুসতে ঘুরে গিয়ে ফ্রন্টসিটেই বসলাম।

-সিটবেল্ট লাগা।

-পারি না।

-আমি লাগিয়ে দিচ্ছি না।ডোন্ট এক্সপেক্ট দ্যাট!

-বয়ে গেছে এক্সপেক্টেশন রাখতে আপনার কাছে!

মুখ বাকিয়ে কথাটা বলে বুকে হাত গুজে বসে রইলাম।আচমকা শুদ্ধ একদম সামনে ঝুকে গেলেন আমার।এটা আশা করেছিলাম আমি।সেইফটি কামস্ ফার্স্ট!ইচ্ছা করেই বলেছি সিটবেল্ট লাগাতে পারি না।উনি বেশ অনেকটা কাছেই আমার।কিছু না ভেবে নিজের অজান্তেই ফু দিলাম তার মুখে।কপালের সিল্কি চুলগুলো উড়ে উঠলো তার।ওভাবে থেকেই বাকাচোখে তাকালেন উনি আমার দিকে।দুহাতে মুখ ঢেকে নিয়ে বললাম,

-ইশ্!ওভাবে কেউ তাকায়?

সিট সহ পুরো শরীর ঝাকি দিয়ে উঠলো।বুঝলাম রাগটা বেচারা সিটবেল্টের উপর ঝেরেছেন উনি।হাত নামিয়ে তাকালাম।শুদ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিলেন কোনোদিক না তাকিয়ে।

—————-?

ভর্তির ফর্মালিটিজ শেষ।পরের মাসের এক তারিখে ওরিয়েন্টেশন ক্লাস।তারপরই আমার স্বপ্নের মেডিকেল লাইফ।কিন্তু এতোদিন ক্যাম্পাসে আসতে পারবো না ভেবে খারাপ লাগছে।সব কাজ শেষে শুদ্ধর পিছন পিছন বেরিয়েই আসছিলাম।একজায়গায় দাড়িয়ে গিয়ে বললাম,

-আমি ক্যাম্পাস ঘুরবো।

-তো ঘুরবি।ক্লাস শুরু হোক।

-না।আজই ঘুরবো।প্রতিটা কোনাকানি দেখবো আমি।

-কি ধরনের বাচ্চামো এগুলো সিয়া?

-আপনি ঘুরাবেন?নাকি অন্যকারো সাথে আসবো?

উনি বিরক্তি নিয়ে কপালে ডানহাতের তিনআঙুল স্লাইড করালেন।কিছু একটা ভেবে বললেন,

-আচ্ছা,চল।

আমার হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে ঢুকলেন উনি।এটাতে রাগ লাগলো আমার।এমনভাবে টানছেন,যেনো আমি কোনো গরুছাগল।

-হাত ছাড়ুন না!

-হোয়াই?

-এটাকে ঘোরা বলে?

-তো কি বলে?

-প্যারা বলে!প্যারা!

শুদ্ধ তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,

-সি!যে নিজেই এক প্যারার দোকান,সে নিজেই প্যারার কথা বলছে।এনিওয়েজ,এভাবেই ঘুরবি তুই।নইলে সোজা বাসা।এবার বল।

রাগ হলো আরো।একটু ভেবে বাকা হেসে হাত ছাড়িয়ে নিলাম।শুদ্ধ ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

-ক্যাম্পাস ঘোরার ভুত নেমেছে মাথা থেকে?

সুন্দরমতো ওনার হাত জরিয়ে ধরে বললাম,

-এভাবে চলুন না!

আবারো হাত ছাড়িয়ে নিলেন উনি।হাটতে হাটতে বললেন,

-ইশানের বড় আপু ডিউটি করে এখানে।মেবি ক্লাসও নেবে তোদের।

-রিয়েলি?তাপসী আপুর ননদ?বাহ্,ভালোই হলো।

-হ্যাঁ।ভালোই হলো।ইচ্ছামতো সুযোগ নিবি,ফাকিবাজি করবি।

-ও হ্যালো!আমাদের না সুযোগ নেওয়ার সুযোগ আছে,না ফাকিবাজির।

-তাই নাকি?তবে তো তুই আদুবোন হয়ে থাকবি আজীবন।যে পড়াশোনার অবস্থা তোর।না পারবি সেমিস্টার এক্সামে পাশ করতে,না পাবি এইচএসসির মতো অটোপাশ।

-দেখুন,আপনি কিন্তু…

-শব্দ কম কর।ইটস্ হসপিটাল।

চুপ করে পিছনপিছন যেতে লাগলাম।একটা করিডোর দিয়ে এগোচ্ছিলাম আমরা।শুদ্ধ এগিয়ে গেছেন।করিডোরের পাশের চেয়ারে বেশ কয়েকজন বসে ছিলেন।হয়তো প্রিয়মানুষের,আপনজনের অপেক্ষা করছিলেন।তাদের দেখতে দেখতেই কাচের জানালার ওপারে একটা মেয়েকে খুবই উত্তেজিত হতে দেখলাম।দাড়িয়ে গেলাম আমি।কিছুই শোনা যাচ্ছে না,তবে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ও আমাকেই কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর,তবুও চোখ দিয়ে আমার সামনের কিছু বোঝাচ্ছে আর ঘাড় খুব দ্রুত নাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে বলছে।মেয়েটার আশেপাশে কোনো নার্স নেই,ওভাবে ছটফট করছে,ওদিকে শুদ্ধও বেশ অনেকটা দুর এগিয়ে গেছে।বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক কি করা উচিত!

চলবে…

মিথিলা মাশরেকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here