বৃষ্টি!কটকটা রোদ্দুরের উত্তাপে অর্ধদাহ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর একটু স্বস্তির নাম।ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এসেছে পুরো শহর জুরে।ক্যাম্পাসের বিশাল মাঠটার সবুজ ঘাস ভিজে আরো বেশি সবুজ,সতেজ দেখাচ্ছে।ভেজা মাটির সুঘ্রান নাকে লাগছে।আমাকে একটা ছাউনিতে দাড় করিয়ে শুদ্ধ নিজে হাত মুঠো করে বৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছেন।মাথা নিচু রেখে নিচু স্বরে বললাম,
-সরি।এমন হবে না আর কোনোদিন।
ওনার নিরবতা আরো গায়ে কাটা দিলো আমার।আচমকা আকাশ কাপিয়ে বজ্রধ্বনিতে কেপে উঠলাম।মাথা তুলে করুনভাবে বললাম,
-সরি বললাম তো।আপনি এভাবে ভিজছেন,অসুখ করবে।বাসায় চলুন না।
শুদ্ধর স্থির দৃষ্টি,চোয়াল শক্ত।চোখটা লাল হয়ে গেছে।ওই কেবিন থেকে বেরোতেই দেখি আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা।শুদ্ধ যেদিকে গিয়েছিলেন সেদিক হেটেও খোজ পাইনি তার।ফোনটাও আনি নি,ব্যাগসহ গাড়িতেই ছিলো ওটা।হন্ন হয়ে খুজতে খুজতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।একসময় ক্যাম্পাসের মাঠে আকাশের দিকে মুখ করে হাটু গেরে বসে থাকতে দেখলাম তাকে।বৃষ্টির মাঝেই ছুটে গিয়ে ডাক দিতেই উনি একপলক আমাকে দেখে হাত ধরে টেনে এনে এভাবে ছাউনির নিচে দাড় করিয়ে দিলেন।
-চলুন না।
-কোথায় ছিলি?
-আসলে…
-কোথায় ছিলি তুই!
কথাটা শুদ্ধ চেচিয়ে বলায় কেপে উঠলাম কিছুটা।তবে জানতাম এমন কিছু ফেইস করতে হবে আমাকে।নিজেকে শক্ত রেখে বললাম,
-ও্ ওখানে একটা কেবিনে একটা পেশেন্ট…
শুদ্ধ একপা এগিয়ে ছাউনির উচু জায়গাটায় উঠে দাড়ালেন।কিছু বলতে যাবো তার আগেই ওনার পকেট থেকে রুমাল বের করে মুচড়িয়ে পানি ছাড়িয়ে মাথা মুছতে লাগলেন আমার।নিজেও ভিজে গেছেন,আমি তো শুধু ওটুকো যেয়ে একটু ভিজেছিলাম।তার চুলগুলো বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।শুধু অবাক চোখে দেখছি তাকে।চুলগুলো একটু নেড়েচেড়ে মাথার উপর রুমাল দিয়ে বললেন,
-চিতার মতো দৌড়াবি।একদৌড়ে গাড়ি।
হঠাৎই গলার আওয়াজ পাল্টে গেলো তার।পজিটিভলি নেবো কিনা তাই ভাবছি।
-হাইইচ্ছু!
হাচি দিয়ে লাল হয়ে যাওয়া নাক ডলতে লাগলেন উনি।রুমালটা মাথা থেকে নামিয়ে তার মাথায় দিতে গেলেই আটকে দিলেন আমাকে উনি।রাগী গলায় বললেন,
-কতোবার বলবো কেয়ার না দেখাতে?
-আর নিজেরটা?
উনি রুমালটা আবার আমার মাথায়ই দিয়ে দিলেন।হাত ধরে হাটা লাগালেন,একপ্রকার দৌড় যাকে বলে।গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে দিলেন আমাকে।তারপর নিজে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।সারাটা রাস্তা চুপচাপ দেখে গেলাম তাকে।তার আলাদা আলাদা কাজগুলোতে এখন নিজেই গুলিয়ে যাই।পরক্ষনেই মনে হয়,সে তোকে ভালোবাসে ইনসু।তোকে ভালোবাসে।
————-?
রাত হয়ে এসেছে।তবে বৃষ্টিটা আছেই।বিছানায় অবলা নারীর মতো শুয়ে আমি ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে আছি।বাসার সব আমাকে ঘিরে বসে আছে।আর শুদ্ধ ব্যালকনিতে দাড়িয়ে জোরে জোরে হাচি দিচ্ছেন শুনতে পাচ্ছি।বোঝাই যাচ্ছে,বৃষ্টিতে ভেজার ফল।বাসার কেউ তাকে কিছু না বলে হা করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমার নাকি জ্বর হয়েছে।ডক্টর শুদ্ধ নিজে চেক করেছেন।থার্মোমিটারে একশ এক।কাদোকাদো লুক করে যীনাত আপুর তাকালাম।আপু নিজেও বিরক্ত।ধমকে বললো,
-দিলি তো নষ্ট করে কালকের সব প্লান!
-আমি কি করলাম?ঠিকই তো আছি।তোমার ভাইকে গিয়ে দেখো না!নিশ্চিত তার জ্বর হবে আজ।
মাহি দাত কেলিয়ে বললো,
-ইনসিয়া ভাবি?একসাথে ভিজেছিলে দুজন?
মামী,সেজোমা ওখানেই ।ওনাদের দিকে তাকালাম একনজর।সেজোমা শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে।তার কানে যায়নি কোনো কথাই।মামী বিরক্তি নিয়ে মাহীর দিকে তাকিয়ে আছেন।উঠে বসে সেজোমার হাত ধরে বললাম,
-আম্মু,তুমি যাও না ওনার কাছে।তোমার ছেলের নির্ঘাত জ্বর হবে আজ।অনেক ভিজেছেন উনি।
সেজোমা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-ও শুধু তোকে দেখতে মাহিকে দিয়ে সবাইকে ডাকিয়েছে ইনসু।
-তুমি গিয়ে ওষুধ খেতে বলো।ঠিক খেয়ে নেবেন উনি।
টুপ করে জল বেরিয়ে এলো সেজোমার চোখ দিয়ে।হুইলচেয়ার ঠেলে এগিয়ে গেলেন উনি শুদ্ধর দিকে।
-শুদ্ধ।
-শুনছি।
-ইনসু ঠিক আছে।
-ওষুধ খেয়েছে?
-হুম।
শুদ্ধ আর কিছু বললেন না।আবারো বারকয়েক হাচি দিলেন।সেজোমা বললো,
-ওষুধ তোর খাওয়া দরকার শুদ্ধ।
-আমার দরকারটা আমি বুঝে নেবো।
সেজোমা ফুপিয়ে কেদে দিলো এবার।কাদতে কাদতেই বললো,
-কেনো এমন করছিস তুই?কিসের শাস্তি দিচ্ছিস তুই আমাদের?
-শাস্তি তো আমার প্রাপ্য।পাচ্ছিও।তোমাদের কোনো শাস্তি দেই নি তো।
-তুই নিজেও জানিস তা শুদ্ধ।
কিছু না বলে উনি আবারো হাচি দিতে লাগলেন।সেজোমা চলে এলো ওখান থেকে।বললো,
-নিজের খেয়াল রাখিস।আর পারলে ওষুধটা খেতে বলিস ওকে ইনসু।
মামীকে বললো,
-ভাবি,আমাকে একটু রুমে পৌছে দিবেন?
মামী মাথা উপরেনিচে নাড়িয়ে সেজোমাকে নিয়ে চলে গেলেন।তাপসী আপু পাশে বসে বললো,
-আমরা তো গিয়েছিলাম শপিংয়ে।তোমারটার কি হবে?
যীনাত আপু বললো,
-লেহেঙ্গা চেয়েছিলিস না তুই?কাল তোকে শাড়ি পরাবো।
-ইম্পসিবল।শাড়ি ফাড়ি না।
-তো এখন কি করবি তুই?
-অনলাইন শপিং করবো।
মাহী বললো,
-এই ইনসিয়া ভাবি না,জাস্ট আমেজিং!জিও ভাবি!
সীমা ভাবি ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে বললো,
-চলো।শুভকাজে দেরি নাই করি।
বারান্দার দিকে তাকালাম।শুদ্ধ বাইরেই তাকিয়ে দাড়িয়ে আছেন।মুচকি হেসে বললাম,
-আমার ড্রেস আজ শুদ্ধ পছন্দ করে দিবেন।
সবাই অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে।তারপর এর ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিশব্দে হেসে চলে গেলো সবাই।আমার দৃষ্টি শুদ্ধতেই স্থির।ওরা বেরিয়ে যেতেই ডাক লাগালাম,
-শুনছেন?
পিছন ফিরে ভ্রুকুচকে তাকালেন উনি।কিছুক্ষন ওভাবে তাকিয়েই আরো দুবার হাচি দিলেন।এগিয়ে এসে বললেন,
-এটা কি ধরনের ডাক?
লাজুক লাজুক মুখ বানিয়ে বললাম,
-বরকে বউ এভাবেই ডাকে।
বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থেকে বিছানায় এসে দুরুত্ব রেখে শুয়ে পরলেন উনি।আমি বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।উনি উপরের দিকে তাকিয়েই বললেন,
-শুয়ে পর।
-এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না।
-চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক।
-এখানেই ঘুমোবেন?
উনি তাকালেন আমার দিকে।অবাকের স্বরে বললেন,
-মানে?হা্ হা্ হাইচ্ছু!
হাটু জরিয়ে ধরে বসে বললাম,
-আজ তো আপনি ড্রিংক করেন নি।শর্তও প্রযোজ্য না তাই আজ।
মনে পরতেই উনি তৎক্ষনাৎ উঠে বসলেন।হাচি দিয়ে বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হতেই হাত চেপে ধরলাম আমি তার।আমার দিকে মুখ করলেন উনি।
-কিন্তু আমি চাই শর্ত ছাড়াও আপনি আমার পাশেই থাকুন।থাকুন না।প্লিজ?
উনি হাত সরিয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন।বিরামহীনভাবে হাচি দিয়ে যাচ্ছেন,বিছানা কাপিয়ে যাচ্ছেন।ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে গলা উচিয়ে বললাম,
-ইশ্ এইটা পরলে তো পিঠ দেখা যাবে।সো হোয়াট?গেলে যাক।এইটাই নেবো।কি প্রিটি লেহেঙ্গাটা!
শুদ্ধ ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখলেন আমি ল্যাপটপে কিছু করছি।নাক ডলে উঠে বসে ওটা কেড়ে নিলেন আমার থেকে।স্ক্রিনে লেহেঙ্গাটার ছবি দেখে রেগে তাকালেন আমার দিকে।মুলত মডেলের গায়ে পরিয়ে ছবি দেওয়া ওটার।পেট পিঠ সবই দেখা যাচ্ছে।রাগী গলায় বললেন,
-এটা কিনবি তুই?
-হু।নায়েষ না?
শুদ্ধ চোখ পাকিয়ে বললেন,
-তুই এটা পরবি না।
-কেনো বলুনতো?কি সমস্যা?
-বুঝিস না তুই?
-না তো!আপনার কোনো সমস্যা?
-তুই এটা কিনবি না বলে দিলাম।হাইইইচ্ছু!
-ওইটাই কিনবো আমি বলে দিলাম।বাইইইচ্ছুহ্!
কথাটা বলে ল্যাপটপটা ওনার কাছ থেকে নিয়ে নিলাম।উনি আবারো কেড়ে নিলেন ওটা।দুজনের কাড়াকাড়ি চলছে।উনি হাতে ল্যাপটপটা নিয়ে বললেন,
-এটা অর্ডার করবি না তুই।
-করবো!
-না করবি না!
-হ্যাঁ করবো।ওইটাই!
-না এটা না!
-তাহলে অন্যটা চুজ করে দিন।
শুদ্ধ ল্যাপটপ ঘেটে কিছু একটা করে ওটা সরিয়ে রাখলেন।বললেন,
-অর্ডার করে দিয়েছি আমি।খবরদার অন্য কোনোটা দেখে একদম মাতব্বরি করবি না।
ঠোট টিপে হাসলাম।এইটাই চেয়েছিলাম আমি।ওনাকে রাগীয়ে কাজ হাসিল করাটা খুবই সহজ।
-হাসছিস কেনো?
-কি রঙের লেহেঙ্গা?
-গাঢ় গোলাপী।
কনফার্ম হয়ে আরেকদফা হাসলাম।শুদ্ধ ধমকে বললেন,
-দাত ক্যালানি থামা।ঘুমো!
-একটা রিকোয়েস্ট রাখবেন?
-কি?
-আমি তো অসুস্থ্য,কাল প্লিজ বাসায় থাকবেন আপনি?
উনি কপাল কুচকে তাকালেন।পাশ ফিরে শুয়ে বললেন,
-ভেবে দেখবো।ঘুমা তুই এখন।
চুপচাপ শুয়ে পরলাম।যদি না থাকতেন তবে সরাসরিই বলতেন উনি থাকবেন না।এই ভেবে দেখবো কথাটাই সম্মতির লক্ষন ধরে নিয়ে খুশিমনেই শুয়ে পরলাম।
চলবে…
মিথিলা মাশরেকা