তোর নামের রোদ্দুর,পর্ব-১৫

0
1811

ফোনের দুপাশেই নিস্তব্ধতার ঝড়।চুপ থাকাটাই যখন ধ্বংসের পূর্বলক্ষন।মুনিয়ার কেবিনে জানালার ধারে দাড়িয়ে একহাত মুঠো করে দাড়িয়ে আয়ান।শুদ্ধ ব্যালকনির রেলিংয়ে হাত রেখে দাড়িয়েছে।সবটা শক্তিতে যে ওই রেলিং ধরে রেখেছে ও তা হাতের ফুটে ওঠা রগগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে।নিরবতা কাটিয়ে শুদ্ধ বললো,

-কোথায় তুই?

-কাজেই আছি।

-অফিসে না সেটা জানি আমি।কোথায় কোন কাজে সেটাই জানতে চাচ্ছি।

-আমি কি জানতে চেয়েছি আজই তোর রিসেপশন কিনা?

-তুই খুশি না তাতে?

-তোর কি মনে হয়?

-আমার মনে হওয়াটা ধরে বসে থাকলে আজ দিনটা অন্যরকম হতো।যাই হোক,আসবি না তুই?

-না।

-কেনো?

-ব্যস্ততা।

-বেশ।

আবারো কিছুক্ষন নিরবতা।শুদ্ধ কিছুটা শক্ত কন্ঠেই বললো,

-তোর বোন মুন কোথায় আয়ান?

হুট করে মুনিয়ার নাম নেওয়ায় আয়ান অনেকটাই চমকে উঠলো।এভাবে মুনিয়ার খোজ নেয়না শুদ্ধ।শেষ কবে নিয়েছিলো,তাও ওর মনে নেই।তবে আজ কেনো?তবে কি ফাইলগুলো কোনোভাবে…

-কথা বলছিস না যে?

-ও ওর জায়গাতেই আছে।

-ওহ্!মুন কি আ্…

-ইনসিয়াকে আমার শুভকামনা জানাস।ব্যস্ত আমি।রাখছি।

শুদ্ধ থামালো না ওকে।তাচ্ছিল্যে হেসে ফোনটা ঘুরিয়ে শক্ত মুঠোতে ধরলো ওটা।চেহারায় একরাশ ক্ষোভ ভেসে উঠলো মুহুর্তেই।

কলটা কেটে দিলো আয়ান।এবার ওর সন্দেহ হচ্ছে।শুদ্ধ কি তবে ফাইলগুলো দেখেছে?এটা কি জানে,ফাইলগুলো ও পাঠিয়েছে?তাহলে ওর সাথে এভাবে কথা বললো কেনো?এতোক্ষনে তো…না।তারমানে শুদ্ধ জানে না ফাইলগুলো আয়ানের কাছেই ছিলো।কিন্তু যদি ওগুলো ও পেয়ে থাকে তবে তো চুপ করে বসে থাকবে না।নিজের দোষ চাপা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে ও।সেটা হতে দেওয়া যাবে না।তার আগেই ফাইলগুলো যেভাবেই হোক আবার আয়ত্ব করতে হবে ওর।ইনসিয়াকে জানাতে হবে শুদ্ধর অতীত।যে ভাবেই হোক!একপলক তাকালো বেডে পরে থাকা বোনের নিথর দেহটার দিকে,যা শুধু শ্বাসটাই নিচ্ছে,যাকে বলে নামে বেচে থাকা।চোয়াল শক্ত করে বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে।

—————-?

বাগানে অনেক আত্মীয়স্বজনের সমাগম।নিচে এসেই দেখলাম শেহনাজ মন্জিলের সবাই এসেছে।আব্বু,আম্মু,ইরাম,দাদিমা সবাই।আমাকে এগুতে দেখেই কেদে দিলো সবাই।আব্বু তো হাতজোর করতে যাচ্ছিলেন,অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি তাকে।বাবা,সেজোমা,যীনাত আপু সবাই মিলে সামলেছে ওবাসার সবাইকে।ওদের সাথে আমার কলেজের দুই বেস্টফ্রেন্ড মৌনতা আর আলিফও এসেছে।সোনালি রোদ্দুরে বাগানের সাজানো পরিবেশটা সবাই নিজেদের মতো করে উপভোগ করছে।শুদ্ধের কথা বলেছিলো সবাই,আমি বলেছি রেডি হচ্ছেন উনি।

কিন্তু এভাবে কতোক্ষন?স্টেজে চেয়ারটায় বসে হাসফাস করছি শুধু।লোকটা আসবে না তারমানে?চুল তো খোলাই রেখেছি আমি।মাহির রুমে গিয়ে পেছনটা ঢেকে পার্লারের আপুগুলোকে কতো কষ্টে খোলা চুলে স্টাইল করতে বলেছিলাম তা আমিই জানি।তায়্যিবকে দিয়ে বলিয়েও এসেছি ওনাকে।ও দরজায় গিয়ে বলেছে,ইনসু মাম্মাম চুল বাধেনি মামা।তবুও রাগ কমেনি ওনার?

বিয়ের দিন ফটোসেশন হয়নি।সিফাত ভাইয়া ক্যামেরাম্যান হায়ার করেছে।ক্যামেরায় দেড়ঘন্টা যাবত শুধু আমার ছবি তুলছে লোকটা।হাজারটা পোজ দিয়ে মুলত এ কাজে আমি ইচ্ছা করেই আটকে রেখেছি তাকে।শুদ্ধর আসা নিয়ে সময় বাড়াতে।যীনাত আপু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,

-শুদ্ধ আসবে না ইনসু?

ঠোট উল্টে কাদোকাদো লুক দিলাম ওকে।আপু বিরক্তি রাগ দুটোই দেখালো আমাকে।গাল ফুলিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই হুট করে ব্যালকনিতে রেলিংয়ে রাখা কারো হাত ঘড়িতে পড়া সুর্যের আলো চোখে পরলো।কারো কেনো?ওটা আমার রুমের ব্যালকনি।তাহলে ওটা শুদ্ধ।ভালো করে হাতের হাতা দেখে বুঝলাম সুট পরেছেন উনি।মনটা নেচে উঠলো খুশিতে।তারমানে উনি ওখান থেকে সবটাই দেখছেন।আব আয়েগা মাজা!বাকা হেসে ইশান ভাইয়াকে ডাক লাগালাম,

-ইশান ভাইয়া!

ইশান ভাইয়া এগিয়ে আসলেন।আড়চোখে দেখলাম শুদ্ধ ব্যালকনিতে এসে দাড়িয়েছেন।জোরেই বললাম,

-ভাইয়া,আপনি যান তো।আমার রুমে রাখা সুটটা পরে আসুন।দরকার পরলে আপনার মুখে স্টিকার মেরে ছবি ওয়াশ করবো।তাও ছবি চাই আমার।এভাবে কতোক্ষন একা একা ছবি তুলবো?

তাপসী আপু চোখ বড়বড় করে একবার আমার দিকে একবার ইশান ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছে।ইশান ভাইয়া কাদোকাদো ফেইস করে বললো,

-আমাকেই পেলে বোন?আমি না বোন ডাকি তোমাকে?

-এজন্য এটুকো আপনাকেই করতে হবে।ভাইয়াআআআ!

তাপসী আপু ঝাড়া গলায় বললো,

-কেনো?শুদ্ধ কই?

-সে তুলবে না ছবি।

-না ইনসু,ইশান যাবে না।শুদ্ধর রুমে তো নাইই।

-আরেহ্,উনি নাই রুমে।খালি টুক করে সুটটা পরে আসবে।ছবি তুলবো শুধু।প্লিজ!

মিথ্যা বললাম।বেশ অনেকটা তেলাতেলির পর ইশান ভাইয়া মুখ কালো করে হাটা লাগালেন বাসার ভেতরে যাবেন বলে।আমি একটু হেসে ব্যালকনিতে উকিঝুকি দিতে লাগলাম।ইতিমধ্যে মাহি কাধে একটা ধাক্কা লাগালো।ওর দিকে তাকাতেই ও চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বললো।চোখ সেদিকে নিতেই মুখ হা হয়ে গেলো আমার।শুদ্ধ হাজির!

শাদা শার্টের উপর কালো সুট,হাতে ঘড়ি,চুলগুলো আজ সুন্দরমতো সেট করা।দেখতে একদম গোছালো লাগছে তাকে।তায়্যিবকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে স্টেজের দিকে আসছেন উনি।হাসিটা বড্ড মানিয়েছে ওনাকে।যাকে বলে ঘায়েলকরা হাসি।ওয়েট!উনি হাসছেন?এখানে এসেছেন?কাহিনীটা কি হলো?কোনোদিক না তাকিয়ে শুদ্ধ সোজা স্টেজে উঠে আমার পাশে দাড়িয়ে ক্যামেরাম্যানকে বললেন,

-ছবি উঠান।

আমি যেনো কোনো ভ্রমে আছি।নিজের তালুর উপর চিমটি কাটলাম,ব্যথা তো ঠিকই লাগলো।ইশান ভাইয়াকে বলা কথাটা এভাবে ইফেক্ট করবে ভাবি নি।আমি তো কিছু না ভেবেই বলে দিয়েছি।তাহলে?শুদ্ধ বিরবির করে বললেন,

-একটা ছবি খারাপ হলে তোর খবর আছে সিয়া!

নিজেকে স্বাভাবিক করে ছবি তোলাতে মনোযোগ দিলাম।তবে শুদ্ধের ছবি ওঠার সময় এক্সপ্রেশন দেখে মোটেও মনে হচ্ছিলো না উনি রেগে আছেন,বা বিয়েটা এভাবে হয়েছে।যতোবার অবাক চোখে তাকিয়েছি,উনি ধীর গলায় তবে ধমকে হাসতে বলেছেন।ফোকলা হেসে ছবি উঠিয়েছি।ছবি তোলা শেষে স্টেজ থেকে নেমে গেলেন উনি।দেখলাম শেহনাজ মন্জিলের সবার সাথে কথা বলছেন তাও হেসে হেসে।ধুপ করে বসে পরলাম চেয়ারটায়।মাহি,যীনাত আপু,মৌনতা তিনটাই এসে কিছু বলছে।আমার কানে আসলেও মস্তিস্ক কাজ করছে না।একধ্যানে তাকিয়ে রইলাম ওই অদ্ভুত মানুষটার দিকে।এতোটা ভালোমানুষি?এরপর কি হবে?

-কিবে,ডিকিউ!জামাইটা তরই,এম্নে দেহোছ ক্যান?

আলিফ মাথায় মেরেছে আমার।হুশে ফিরে পাশে তাকাতেই সবগুলোকে দাত ক্যালাতে দেখলাম।যীনাত আপু বললো,

-ডিকিউ মানে?

-ড্রামা কুইন।

ওরা সবাই হাসলো।মৌনতা বললো,

-কিরে আলিফ?ওর বর ভাইয়া হয় তোর।ভালোভাবে বল।

-হ হ।ভাইয়াআআআআ!এই ভাইয়া টু ছাইয়া থিওরি আজও বুজলাম না।

আমি আলিফের কাধে চড় মেরে বললাম,

-মনু,এই গাইয়া ভুতটাকে পিটায়া ভাষা ঠিক করা তো ওর।ছিহ্!কি বিচ্ছিরি ভাষা তোর আলিফ!কবে ভালো হবি তুই?

মৌনতা ধমকে বললো,

-ঠিকই তো!ওই আলিফ?থামবি তুই?বান্ধবীর শশুরবাড়ি।শুদ্ধ ভাইয়ার বাড়ি।শুদ্ধ ভাষায় কথা বল।

-পারুম না।ওই মহারানী,দে খাইতে দে।খুদা লাগছে।খাওনডার জন্যই আসা।

-এখন আমি এই বেশে তোকে খাবার বেড়ে খাওয়াবো?

-ক্যান?আরো ফকিন্নি সাজা লাগবো তর?এমনিতেও তো কম রানু মন্ডল সাজোস নাই।

আবারো হাসতে লাগলো সবাই।আব্বু,বাবা একসাথে বসে ছিলেন।তাপসী আপু আর সিফাত ভাইয়াকে দেখলাম এগিয়ে গিয়ে কিছু বললো ওনাদের।যীনাত আপুকে ইশারায় বললাম কি হয়েছে।আপু বললো বিয়েতে কোনো নাচগান হয়নি,তাই এখন ওদের ওসবের প্লান আছে।তাই অনুমতি চাইতে গেছে।বড়রা সবাই নিজেদের মতো একপাশে বসে গেলেন।স্টেজের সামনে সিফাত ভাইয়া এসে সীমা ভাবিকে দেখিয়ে গান ধরলেন,

‘ মৌমাছি ফুলেতে বসে খাটি মধু পায়
তেমনি তুমি আমার মধু,আমার দুনিয়ায়’

ইশান ভাইয়াও তাপসী আপুর হাত ধরে মাঝে দাড় করিয়ে গাইকেন,

” তিতা যতো ছিলো আমার এ জীবনে হায়,মিঠা হয়ে গেলো তোমার চোখের ইশারায় ”

ওরা সবাই একসাথে গাইলো,

” দেখলে তোমায় মনটা আমার গার্ডেন গার্ডেন হয়ে যায় ”

বেশ মজা করছে ওরা।স্টেজে বসে খালি আকুপাকু করছি।সবার বরই রোমান্টিক।খালি আমার বরটাই এমন।পাশে নেই।মাহি,মৌনতা আর যীনাত আপু সোনাকাঠি গানে নাচলো।নাহ্,আর সহ্য হচ্ছে না।নাচটা তো আমিও ডিসার্ভ করি।বিয়েটা আমার।আনন্দটার উপর আমারও অধিকার আছে।আশেপাশে তাকিয়ে শুদ্ধকে দেখলাম না।মৌনতাকে ডাক লাগিয়ে বললাম,

-মনু,বেবি হেল্প!

-কি?

-মনু রে!আমিও নাচবো।

ও চোখ বড়বড় করে নিলো।আবার স্বাভাবিক হয়ে বললো,

-এজ এক্সপেক্টেড্!তো নাচ!

-একটু জোর কর।এমনি এমনি তো আর উঠে নাচা যায় না।আর তোর ভাইয়া দেখলে আমি শেষ।

-তাহলে আমি ভাই পারলাম না।

-এ্যাঁ,কেউ ভালোবাসিস না তোরা আমাকে।

-হুম।ভালোবাসি না।এমনি আসছি এখানে অতোদুর থেকে।

রাগ করে বুকে হাত গুজে পাশ ফিরলাম।আমাকে গাল ফোলাতে দেখে মৌনতা একটু নরম হলো।কিছু ভেবে বলে উঠলো,

-ওয়েট!আলিফকে ফাসাই।

-জিও মনু!উম্মা!

মৌনতা ডাক লাগালো আলিফকে।ও মোচড়াতে মোচড়াতে এসে বললো,

-হ,ক!

-তোকে ইনসু কিছু বলতে চায়।

-কিরে বর ছাইড়া আমারে কি কইবি তুই বিয়াইত্তা মাইয়া?

-ভাই,তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড।উপকার কর একটা।

-কি?

-আমাকে নাচার জন্য জোর কর।

-কিহ্?

মৌনতা বললো,

-ওকে ওর ভাষায় বল।তবেই বুঝবে।

-দোস্ত!আমারে জোর কইরা ধইরা নাচা না প্লিজ!আমার নাচবার মন চাইছে।প্লিজ দোস্ত!তর কাছে চিরঋণী থাকুম আমি।প্লিজ!প্লিজ!প্লিজ!

-খাড়া!দেহি!

ও চলে গেলো।আমি আরেকবার চারপাশে চোখ বুলালাম।শুদ্ধ নেই।ভালোই হয়েছে।ওনার কাজ শেষ।এবার নিজের মতো করে এন্জয় করবো।জোরে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।আলিফ মাউথস্পিকার হাতে নিয়ে মাঝখানে দাড়িয়ে বললো,

-এই ভাই এইযে,ঘুমান ক্যান?বালিশ আনছেন?তা আনবেন ক্যান?এইটা তো বিয়াবাড়ি।সবাই শুনেন।আজ আমরা প্রশুউউর মজা করবো।কজ এইটা আমার একমাত্র বেস্টুর একমাত্র বিয়া।কিন্তু আপনাগো তো ঝিমুনি ধরছে।নাহ্!তা তো হইতে দেওন যায় না।এই ঘুম ছাড়ানোর একটাই উপায়।মিউজিক!

সাউন্ডসিস্টেমে ক্যারাওকে চালু হতেই আলিফ নেচে নেচে গাইতে শুরু করলো,

‘ওই ভাই কেউ ঘুমাইয়েন না
আইছি মহল কাপাইতে,
মুখ দেইখাই থার্মোমিটার
লাগবো যে জ্বর মাপাইতে।
বিয়ার এই শান্ত মহল,দিমু গরম বানাইয়া
ডিজে ভাই গানটা ছাড়ো,বেইজটা মারো বারাইয়া।

চারদিকে সব সুন্দরী,মেকাপ লাগানো পরী
কোনটারে রাইখা আগে,কোনটা ধইরা ইম্প্রেস করি।
এইদিকে বউ নার্ভাস,বেয়াই বেয়ানের সার্কাস
আসছি গানের মাঝখানে,এইবার পরবো ঢেউ
ওই‌ ডিজে সাউন্ড বাড়াও,
ঘোমটা খুইলা নাচবো ওখন বউ ‘

আলিফ তো নাচছেই,ওর সাথে বাকি সবাইও কমবেশি নাচছে।বড়দের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারা নিজেদের মতোই আছেন।আমিও স্টেজে বসে হেলেদুলে নাচছিলাম।যীনাত আপু,মাহি ইশারা করলো নামার জন্য।উঠে দাড়িয়ে সবে স্টেজ থেকে নামবো বলে পা বাড়িয়েছি।কেউ একজন খপ করে হাত ধরে ফেললো আমার।পাশে তাকিয়ে দেখতেই ছোটখাট হার্ট এটাক হয়েই গেলো বলে‌ মনে হলো ।

চলবে…

মিথিলা মাশরেকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here