ঘর থেকে বেরিয়েছি রাগ নিয়ে।শুদ্ধ আগে আগে যাচ্ছেন,আমি পিছনে পা ছুড়তে ছুড়তে এগুচ্ছি।কেনো জানি না ইচ্ছে করছিলো শুদ্ধর জ্যাকেটের সামনে খোলা চেইনের দিকটা টেনে ধরে বলি,” এতো রাজপুত্তুর সেজে বাইরে যেতে হবে কেনো আপনার?এই ঢংয়ের সানগ্লাস,গুটানো হাতা,বারবার চুল উল্টে দিয়ে সব মেয়েদের ভাষ্যমতে ড্যাশিং লুক!এগুলো কাকে দেখাতে যাচ্ছেন আপনি?কি দরকার এমন করে বেরোনোর? ” বলে উঠতে পারলাম না।সে সাহসটা পাচ্ছি না।নিচে নেমে দেখলাম বাবা,আম্মু বসে কথা চা খাচ্ছেন আর কথা বলছেন।শুদ্ধ তাদের দিকে না তাকিয়ে বেরোতে বেরোতেই বললেন,
-আম্মু,সিয়াকে নিয়ে বেরোচ্ছি আমি।আব্বু,আম্মুর থেরাপিস্ট আসলে হেল্প করো তুমি।আর ওই অকর্মন্য মাহিটাকেও কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো সময়।
আমি একপলক আম্মুর দিকে তাকালাম।সে মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে বোঝালো আয়।বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলাম।শুদ্ধ গাড়ি পাশ কাটিয়ে এগুতে এগুতে ভারী গলায় বললেন,
-গাড়িতে উঠিস না।
তীক্ষ্ম চোখে তাকালাম তার দিকে।এমনিতেও মেজাজটা ভালো নেই।এতো সাজগোজ করে বেরোতে হবে কেনো তাকে?তারউপর গাড়িতে না উঠলে যাবোটা কিভাবে?হেটে?নাকি এই বাসার গেইট দেখাতেই রেডি করিয়েছে কে জানে?রাগটা মিটছে না কোনোমতেই।কই এতো শ্যামাপাখি,শ্যামাপাখি করে,তাকে তো কোনোদিন এভাবে সেজে বললো না দেখতো কেমন লাগছে আমাকে দেখতে।ওয়েট!বলেনি?রিসেপশনের দিন তো…ওইদিনের কথা মনে পরতেই উসখুশ করতে লাগলাম।ভোলার জন্য টপিক পাল্টানো জরুরি।
-তো যাবো কিভাবে?
শুদ্ধ আমার দিক ফিরলেন।সানগ্লাসটা খুলে অকপটে বললেন,
-কোলে করে নিয়ে যাই?
শুদ্ধর সাথে তার বেশ খানিকটা পিছন পিছন পা চালাচ্ছিলাম আমিও।তার কথায় পা থেমে গেলো।আপনাআপনি মুখ হা হয়ে গেলো আমার।কপালে ভাজ পরেছে।উনি আবারো হাটতে হাটতে বললেন,
-চল হাট।রাস্তা অবদি তো চল!
গাল ফুলিয়ে কাধে ক্রস করে ঝোলানো সাইডব্যাগটার ফিতে টানতে টানতে এগোলাম।গেইটের বাইরে দাড়ালাম দুজনে।আড়চোখে শুদ্ধর দিকে তাকালাম।এই লোকটা এভাবে জ্যাকেট পরে আছেন কিভাবে?গরম বলে বস্তুটার অনুভুতি নাই তার?ভাবতে ভাবতেই শুদ্ধ চুলগুলো দুহাতে উল্টে দুবার জ্যাকেটটার কলার ধরে ঝাড়লেন।গুটানো হাতাটাও টান মারলেন আরেকটু।গরম লেগেছে হয়তো।ঠিক হয়েছে।রুমের বাইরে বেরিয়েছে না,এখন টের পাবে এই গরমে জ্যাকেট পরার ফল।কিন্তু সামনে তাকিয়ে কান দিয়ে ধোয়া বেরোতে লাগলো আমার।সেই কাধে ব্যাগ ঝোলানো কোচিংগামী মেয়ের দল এদিকেই আসছে।তিনজন।বেশ সুন্দরী দেখতে।ওদের দেখে ওমন করলেন উনি?
মেয়েগুলোর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছি।ওরা ঠিক কখন শুদ্ধের দিকে তাকিয়েছে তা চোখে পরেনি আমার।কিন্তু শুদ্ধ যে ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছেন,চোখে অবশ্যই পরেছে ওদের।কিছুটা সরে দাড়ালাম।ঠিক যখন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো ওরা,লাথি মেরে পায়ের সামনে থাকা ইটের গুড়ো উড়িয়ে দিলাম।পায়জামায় লেগেছে দুটোর।ওরা হতভম্ব হয়ে নিচদিক তাকিয়ে আমার দিকে মাথা তুললো।শুদ্ধ পাশ থেকে বললেন,
-এটা কি করলি?
মেয়েগুলো তার দিকে তাকাতে যাচ্ছিলো।একলাফে ঠিক সেইপাশে দাড়িয়ে গেলাম।রাগী চেহারা করে তুড়ি মেরে নিজের দিকে আঙুল দিয়ে বুঝালাম আমার সাথে কথা বলো।ওরা কি বুঝে মুচকি হেসে কপালে হাত রেখে চোখ ঢেকেই চলে গেলো।এবার শান্তি লাগছে!শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি পায়ে পরা কেডস্ মাটিতে খোটাচ্ছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন।
বিকেলের তীর্যক রোদ চোখে লাগছে একদম।হাত কপালে দিয়ে,এপাশ ওপাশ ফিরে রোদ আটকানোর চেষ্টা করলাম।নিস্ফল প্রয়াস।টিস্যু বের করার জন্য সবে ব্যাগের চেইনে হাত দিয়েছি,মনে হলো রোদটা থেমে গেছে।দমকা ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলো এতোক্ষনে।পাশে তাকিয়ে দেখি শুদ্ধ ঠিক আমার বরাবর দাড়িয়ে রোদ আটকেছেন।তার ছায়া পরেছে মুখে আমার।আটকে গেলাম কিছুটা।উনি কি ইচ্ছে করে এভাবে দাড়ালেন?কিন্তু সে তো উকিঝুকি দিয়ে আলাদিনের চেরাগ খুজতে ব্যস্ত মনে হচ্ছে।বাজিয়ে দেখতে হচ্ছে!
একপা সামনে এগিয়ে রোদে গিয়ে দাড়ালাম।শুদ্ধ একপলক আমার দিকে তাকিয়ে নিজেও কিছুটা এগোলেন।আমি আবারো সরে দাড়ালে তিনি একইভাবে সরে রোদ আটকালেন।মজা লাগছে!মুচকি হেসে আবারো যেইনা সরতে গেছি শুদ্ধ হাত ধরে ঝাকি মেরে সোজা করে দাড় করালেন।মুখ এগিয়ে এনে দাতে দাত চেপে বললেন,
-খুব রোদে দাড়িয়ে ভিটামিন ডি গেইন করার ইচ্ছা জেগেছে?কাল দুপুরে ছাদে গিয়ে রোদ পোহাতে দেবো তোকে।কি বলিস?
কিছুই হয়নি,উনি কিছুই বলেন নি,আমি কিছুই শুনি নি এমন একটা ভাব করে ফাকা রাস্তা দেখতে মনোযোগ দিলাম।শুদ্ধ হাত ছেড়ে দিলেন আমার।কিন্তু ছায়া করে রেখেছেন ঠিকই।উল্টোদিক হয়ে দাড়িয়ে ভাবছি এভাবে কতোক্ষন।বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেছে।শুদ্ধর বলামতো সত্যিই এখন পরিবেশটা ঠান্ডা।গাছের পাতা নড়তে লাগলো।দুরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো।কিন্তু এ আকাশে কালোমেঘ নেই একবিন্দুও।একটা অভূতোপুর্ব ধ্বনিতে ভাবনার জাল ছিড়ে গেলো আমার।
-স্যার,আপনার বাইক।
বাইক?কার বাইক?বড়বড় চোখ করে রোটেটর ফ্যানের মতো করে পাশে তাকালাম।একজন লোক শুদ্ধর দিকে চাবি বারিয়ে কথাটা বলেছেন।দেখে মনে হচ্ছে লোকটা বাইক সার্ভিসিংয়ের কাজ করে।শুদ্ধ চাবিটা হাতে নিয়ে বললেন,
-থ্যাংকস্।এতো তাড়াতাড়ি রিপেয়ার করে দেওয়ার জন্য।
-ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।
লোকটা চলে গেলো।শুদ্ধ বাইকে উঠে বসলেন।আমি হা করে তাকিয়েই আছি বাইক আর বাইকের মালিকের দিকে।
-দিনভর তোর হা হওয়া মুখ দেখে দেখে আমি ক্লান্ত সিয়া।
জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে মুখ বন্ধ করে নিলাম।শুদ্ধ বাইকের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,
-তিনবছর হলো ধরিনি ওকে।
-এ্ এটা আপনার?
-হুম।
-কোথায় ছিলো এটা?
-গ্যারেজে।
-এই লোক কেনো দিয়ে গেলো?
-একটু ঠিকঠাক করার ছিলো।এতোদিন ওভাবে পরে ছিলো তো।অবশ্য সময় পেলে,তুই চাইলে নতুন কিনবো।কি বলিস?
মুগ্ধতা ছেয়ে গেলো মনপ্রান জুরে।ঠোটের কোনে অজান্তেই হাসি ফুটলো।শুদ্ধ হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-এটা পরে উঠে বস।
তারমানে উনি আমাকে বাইক রাইডিংয়ে নিয়ে যাবেন!খুশিতে লাফাতে গিয়েও হেলমেটটা দেখে আবারো মন খারাপ হয়ে গেলো আমার।হেলমেট ইনসিয়াকে মানায় না এটা বোঝেন না উনি?
-সত্যিই হেলমেট তোকে মানায় না।খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়বে,সেটাই তোকে মানায়।কিন্তু আজ যেভাবে বেরিয়েছিস তুই,সেই সাজটা শুধুমাত্রই আমার চোখদুটোর দেখার অধিকার আছে।অন্যকারো নয়।তাই ঢেকে নিয়ে যাবো।
ও!আমি কি একটা কালো টিপ পরলাম,সেটা পাব্লিকের দেখার অধিকার নাই।আর নিজে যে হিরো সেজে বেরোচ্ছে,সেটা দুনিয়াজুড়ে সব মেয়েদের দেখার অধিকার আছে।
-তো আপনার হেলমেট কই?একটা কেনো?শুধু আমি কেনো পরবো?
উনি ঠোট টিপে হেসে বললেন,
-আমার লাগবে না।
-লাগবে।
-কেনো লাগবে?
-তো আপনাকে যে সব রাস্তার মেয়েরা গিলে খাবে তারবেলায়?আমাকে তো…
শুদ্ধকে ভ্রু উচিয়ে তাকাতে দেখে তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললাম,
-ন্ না মানে স্ সেইফটির জন্য।
-কি ধরনের সেইফটি?
ধরা খেয়েছি জানি।মুখ লুকাতে বুকে হাত গুজে অন্যদিক ফিরে তাকালাম।যেনো রেগে গেছি আমি।শুদ্ধ একটু জোরে বলে উঠলেন,
-ওহ্!সেইফটি!মনে পরেছে।সিয়া,মাস্ক আছে তোর ব্যাগে?
এটা চলবে।এতে তো মুখ দেখা যাবে না তার।খুশিমনে ব্যাগ থেকে মাস্ক বের করে এগিয়ে দিলাম।উনি ওটা হাতে নিয়ে একটু খুতিয়ে দেখে বললেন,
-ওয়ান টাইম এন্ড ইউজড্ মাস্ক।
জিভ কাটলাম।এটা আগেও একবার পরেছিলাম।মাথা নিচু করে হাত বারিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম ওটা,শুদ্ধ সাথেসাথে পরে ফেললেন মাস্কটা।হেলমেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-উঠে বস।
আমি তব্দা মেরে দাড়িয়ে।এভাবে ইউজড্ মাস্ক পরে নিলেন উনি?
-ওঠ!
ধমক শুনে উঠে বসতে যাচ্ছিলাম।সিফাত ভাইয়ার বাইকে উঠেছিলাম এর আগে দুবার।ভালোই লেগেছিলো।শুদ্ধর কাধ ধরে উঠতে গিয়েও উঠলাম না।পিছনে বসে পেছনের দিকটা ধরে বসেছি।মাঝে গ্যাপ।কিন্তু কথা হলো,বাইক একইঞ্চি নড়লেই আমি ধপাস হবো এটা আমি নিশ্চিত।শুদ্ধ বাইকের আয়নাটা ঠিক করতে করতে বললেন,
-সম্মানিতো যাত্রী,অনুগ্রহ করে বর নামক সিটবেল্টকে নিজের সাথে সর্বনিম্ন দুরুত্বে আটকে নিন।অন্যথায় সিটবেল্ট নিজে থেকে আপনাকে তার সাথে আটকে নিতে বাধ্য থাকিবে।
আমি আয়নাতেই ভ্রুকুচকে তাকালাম তার দিকে।উনি বললেন,
-বুঝিস নি তাইনা?শুদ্ধের শুদ্ধ ভাষায় বোঝ এবার।তুই যদি দুহাতে আমাকে জরিয়ে না ধরিস,আমি তোকে সামনে নিয়ে বাইক চালাবো।
থতমত খেয়ে নিচদিক তাকিয়ে কাপাকাপা হাত কাধে রাখলাম তার।শুদ্ধ পিছনে দুহাত দিয়ে আমার দুহাতে সামনে তার জ্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-ভুলে যাস কেনো তুই?এই শুদ্ধ শুধু সিয়ার।শুধুই ওর শ্যামাপাখির।কারো নজর পরা নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না তোকে।আর রইলো এই ইউজ মাস্কের চিন্তা?এতে তোর ঠোটের ছোয়া আছে।যার নেশাকে চাইলেও আমার কাছ থেকে আমি আলাদা করতে পারবো না।আমার যে শুধু বাহানা দরকার এই নেশায় বারবার মাতাল হওয়ার।এতোবড় সুযোগ কি করে ছাড়তাম আমি।
বাইক স্টার্ট দিলেন শুদ্ধ।নিচদিক তাকিয়ে রইলাম।একহাত সরিয়ে নিয়েছি শুদ্ধর বুক থেকে।তবুও তাকে একহাতে জরিয়েই এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে মনপ্রান জুড়ে।বাতাসের সো সো আওয়াজের সাথে কানে সুর তুলে শুধু এটুকোই বাজতে লাগলো,শুদ্ধ শুধু সিয়ার।শুধুই তার শ্যামাপাখির।
#চলবে..
লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা