তোর নামের রোদ্দুর, পর্বঃ২২

0
1666

তোর নামের রোদ্দুর
পর্বঃ২২

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

“ভালোবাসা”!ভালোবাসা কি শুদ্ধ?কাকে বলে ভালোবাসা?এর সঙ্গা তো অজানা আমার।কি করে একে সঙ্গায়িত করবো আমি?আমার কাছে তো আপনার মতো কোনো মোহনীয় ভাষা নেই শুদ্ধ!না আছে আপনার মতো করে উপলব্ধি করার শক্তি!নাইবা আছে আকড়ে ধরার সাহস!তবে?ভালোবাসাকে চিনতে চাওয়ার যোগ্যতাও কি আছে আমার?

কি নিয়ে ভালোবাসা ব্যক্ত করতে হয় শুদ্ধ?কোনটা ভালোবাসা?একজন পাশে থাকলে পারিপার্শিক আটকে যাওয়া?নাকি সেই মানুষটাই দুরে গেলে পৃথিবীর থমকে যাওয়া?একজনকে দেখতে পেলে বাকিসব ভুলে বসে থাকা?নাকি তাকে না দেখতে পেলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলা?একজন কাছে আসলে অসম্ভব শিহরনের শুরু?নাকি তার থেকে দুরে থাকার অস্থিরতা?কোনো একজনের উপস্থিতিতে বাকিসব ফিকে মনে হওয়া?নাকি তারই অনুপস্থিতিতে রঙিন ক্যানভাসও রঙহীন মনে হওয়া?কারো কথায় মনে শীতল প্রবাহের সৃষ্টি?নাকি মৌনতাতে ঝড়ো হাওয়ার তান্ডব?ভালোবাসায় কোনটা অনুভব হয় শুদ্ধ?কোনটা?

জানিনা আমি।বিশ্বাস করুন,আমি জানি না।কিন্তু যদি এগুলোর একটাও ভালোবাসার সঙ্গা হয়ে থাকে,যদি একটাতেও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে থাকে,তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি।হ্যাঁ।ভালোবাসি আপনাকে আমি শুদ্ধ।ভালোবাসি। ”

-কি বিরবির করছিস?

চমকে উঠে পেছনে তাকালাম।শুদ্ধ এসেছেন ব্যালকনিতে।আজকে অফ ডে ওনার।বাসাতেই আছেন তাই।সে রাতে শুদ্ধর সাথে বাসায় ফেরার পর আরো দুদিন কেটে গেছে।এ দু দিনে তার ব্যবহারে আরো হাজাররকমের কেয়ারিং আর ভালোবাসা দেখেছি আমি।নিজের অদ্ভুত কাজগুলোও বাদ রাখেননি এ দু দিনে।আমাকে জরিয়ে ঘুমোনো,সকালে চুমো দিয়ে ঘুম ভাঙানো,হুটহাট কোমড় জরিয়ে কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসি শ্যামাপাখি বলা,ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে হাচি দিয়ে উঠে আবারো একই কাজ করা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।আর অদ্ভুত লাগে না।ভালোলাগে।সে সন্ধ্যায় আমাকে কিছু না বলতে দিয়ে উনিই কপালে চুমো এটে দিয়ে বলেছিলেন,

-জোর করে এখনই বলতে হবে না।আমি তোর চোখ পড়তে জানি।সে চোখে আমার জন্য ভালোবাসাই দেখেছি আমি।আমার শ্যামাপাখি আমাকেই ভালোবাসে।জানি আমি।

মুগ্ধতা কয়েকশগুন বেড়ে গিয়েছিলো তখন আমার।বাসায় ফিরে এরপর অনেক ভেবেছি।প্রতিবারই আমার মন এটাই বলেছে,ভালোবাসি তাকে।কিন্তু সে কথাটা বলতে পারছে না ওই চোরা মনটাই।মুখে বলাটা নিয়েই যতো অস্বস্তি!

-কি হলো?কথা বলছিস না কেনো?

-ন্ না,কিছু না।

-আজ অফিস নেই আমার,তোর গোসলও নেই দেখছি।

মুচকি হেসে অন্যদিক তাকালাম।শুদ্ধ এগিয়ে এসে কোমড় জরিয়ে ধরলেন আমার।ঈষৎ কেপে উঠে সামলে নিলাম নিজেকে।শুদ্ধ আমার কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললেন,

-ইদানিং শ্যামাপাখি একটু বেশিই লজ্জা পায়।ইচ্ছে করে…

মাথা নিচু রেখেই বললাম,

-কি ইচ্ছে করে?

উনি কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-অনেককিছু।তবে সেটা বলা,করা,তোর বলার জন্যই অপেক্ষা করছে।

-ইনসিয়া ভাবি,ফুপি ডাকছে।

মাহির গলা শুনে তাড়াতাড়ি শুদ্ধর হাতের বাধন ছেড়ে সরে দাড়ালাম।শুদ্ধ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-এই অকাজের ঢেকিটার ট্রেনিং নেওয়া আছে।কি করে বর বউয়ের রোমান্সের সময় এন্ট্রি নিতে হয়।যাচ্ছে না কেনো ও মামাবাড়িতে?আমার এতো অপমান করা সত্ত্বেও এই আজাদ ম্যানশনে পরে আছে কেনো?

আমি ফিক করে হেসে দিলাম।শুদ্ধ মুখ বাকিয়ে বললেন,

-তোকেও বলি হারি।জানিস না?ও রুমে আসবে না।লাফিয়ে দুরে যাওয়ার কি দরকার?

আমি ঠোট টিপে হেসে একবার আঙুল তার দিকে দেখিয়ে নিজের কপালের পাশে ঘুরিয়ে বোঝালাম,সে পাগল হয়ে গেছে।শুদ্ধ হেসে এগুতে গেলেই একছুটে বেরিয়ে আসলাম রুম থেকে।

.
ব্রেকফাস্ট শেষে আম্মুকে নিয়ে বাবা বেরিয়েছেন।আম্মুর চেকাপ করাবেন বলে।মাহিরও নাকি শপিং করতে হবে,ওনাদের সাথেও বেরিয়েছে ও।যেতে চেয়েছিলাম,শুদ্ধর চোখ রাঙানি আর আম্মুর মুখে বারন শুনে যাওয়া হয়নি।রুমে শুদ্ধ ল্যাপটপে কাজ করছেন দেখে ভাবলাম ছাদে গিয়ে ঘুরে আসি।সেখানেও মন টিকলো না।রুমে ফিরে আসলাম আবারো।কিন্তু শুদ্ধ রুমে নেই।ওয়াশরুম,ব্যালকনি,কোথাও নেই।গেলো কোথায় লোকটা?ডাক লাগাতে লাগলাম।সাড়া নেই।এমনিতেও বাসায় কেউ নেই,এরমধ্যে জ্বলজ্যান্ত মানুষটাও হারিয়ে গেলে ভয় তো করবেই।সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে ড্রয়িংরুমেও চোখ বুলালাম।নাহ্!নেই উনি।আরেকবার ডাক দিলাম,

-শুদ্ধ?

-কিচেনে।

কিচেন থেকে তার গলা শুনে অবাক হলাম।কিচেনে কেনো উনি?প্রশ্ন নিয়ে এগুতে এগুতে বাইরে থেকে তাকে দেখতেই পা থেমে গেলো আমার।মেরুন গেন্জিটার উপর কুকিং এপ্রোন,হাতভর্তি আটামাখা,গালেও লেগেছে,কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম,চুলগুলো একদম ধীরে ধীরে উড়ছে কোথাকার কোন বাতাসে,চুলেও লেগে গেছে খানিকটা আটা।মুখ ধরে শব্দ করে হেসে দিলাম।শুদ্ধ মাথা তুলে কপাল কুচকে বললেন,

-হোয়াট?হাসার কি হলো?

হাসতে হাসতে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-এসব কি মশাই?রান্নাঘরে কেনো আপনি?

-হানিমুন প্লান করছি।

ওমন জবাবে কিছুটা হচকিয়ে গেলাম আমি।হাসি থেমে গেলো।শুদ্ধ আটা মাখতে মাখতে বললেন,

-রান্নাঘরে অবশ্যই রান্না করতেই আসে মানুষ তাইনা?

-ত্ তো আসমা খালা কই?

-ছুটি দিয়েছি।আজ তোকে আমি রান্না করে খাওয়াবো।আব্বু আম্মু আর মাহিকে বাইরে থেকেই খাইয়ে আনবে।

চারপাশে তাকালাম।রান্না যে হবে তার কোনো লক্ষনই নেই।বরং মনে হচ্ছে ছোটখাটো ঝড় বয়ে গেছে রান্নাঘরে।শুদ্ধর আটা মাখানোর স্টাইল দেখেও মনে হচ্ছে সে রান্নার র ও বোঝে না,খালিখালি আমাকে খুশি করবে বলে এসব করছে।

-আসলে সবকিছু কোথায় রাখা তা তো জানিনা আমি,এজন্যই একটু এলোমেলো হয়ে গেছে সবটা।

লোকটা ছেলে হয়ে এটুক সাহস দেখাচ্ছে,আমার কি কিছু করা উচিত নয়?রান্না তো আমিও জানি না।তো কি?ইনসিয়া রান্না করলে তা নিসন্দেহে খাওয়ার মতোই হবে।শুদ্ধের যে অবস্থা তাতে যাই করুক,খাওয়ার মতো রান্না হবে না আজ।লান্চের জন্য তা বলে আটা?ভালো হয়েছে,ভাতে পানির হিসাব পারবো না আমি।ভাব দেখিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-হয়েছে হয়েছে।মাস্টারশেফ বিডি অনেক রাধিয়াছেন।আর করতে হবে না।

-তো কে করবে?

-কেনোহ্?আমি কি করতে আছি?

শুদ্ধ যেনো আকাশ থেকে পরলেন।চেচিয়ে বলে উঠলেন,

-কিহ্?তুই?রান্না?

-জ্বী।আমিই।রান্না।সরুন।

শুদ্ধ দুহাতের কব্জি একসাথে করে বললেন,

-মাফ চাই সিয়া,অকালে তোর রান্না খেয়ে অকালে মুখের স্বাদগ্রন্থি খোয়া দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই আমার।এক কাজ কর,আমার হাতের আটা টুক ছাড়িয়ে দে,এটা ছাড়ছে না।আমিই বানিয়ে নেবো খাবার।

-রান্না আমিই করবো।ছাড়াচ্ছি আটা।

এটুক বলে বাম হাতে জগের পানি নিয়ে ঢালতে ঢালতে ডানহাতে তার হাত কচলাতে শুরু করে দিলাম।ওটা ছাড়ছেই না।পানি পেয়ে আরো আটকে যাচ্ছে।শুদ্ধ চেচিয়ে বললেন,

-পরে গেলো সব পানি!

নিচদিক তাকালাম।নিচে আটা গোলানো বোল টা পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে গেছে।আটা সব হাবুডুবু খাচ্ছে তাতে।কাচুমাচু করে শুদ্ধর দিকে তাকালাম।উনি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

-বরই উপকার হইলো।চল,এবার ওই আটার রুটি তুইই বানাবি!

ভাব দেখিয়ে কোনোমতে ছেকে ছেকে আটার দলা তুলে তা আরো একবোল আটাতে চুবিয়ে বেলতে শুরু করলাম।

-মাশাল্লাহ!সুন্দর হয়েছে।একদম মানচিত্র।

বেলনি উচিয়ে বললাম,

-আর আপনি এটাই খাবেন।

শুদ্ধ এতোক্ষন বেসিনের পাশের উচু জায়গায় বসে ছিলেন,হাতটাও ধুয়ে ফেলেননি ঠিকমতো।ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমার পিছনে দাড়িয়ে আগে কানে গোজা চুল সামনে ঠেলে দিলেন।কিছুই বললাম না।এই লোকটা পাগল।নিজের কাজ কর তুই ইনসু।শুদ্ধ সে চুলগুলো আবার কানে গুজে দিয়ে আমার দু পাশ দিয়ে হাত রাখলেন।একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললাম,

-দেখুন!একদম ডিস্টার্ব করবেন না।

উনি আমার গালে তার গাল ছোয়ালেন।হাত থেমে গেলো আমার।পাশ থেকে শুকনো আটা হাতে নিয়ে আমার হাতে স্লাইড করাতে লাগলেন।হার্টবিট জোরে চলতে শুরু করেছে আবারো।একবার চোখ বন্ধ করে নিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে একদম তার চোখে চোখ রেখে বললাম,

-আজ খাওয়া নেই আপনার।জ্বালাচ্ছেন কেনো এভাবে?

-খাওয়া লাগবে না।

আর কি বলবো?হতাশ আমি।নিচ দিয়ে বেরিয়ে এসে কাজে মন দিলাম।শুদ্ধ কিছু না বলে আবারো আগের জায়গায় বসে হাত আপেল ঘোরাতে লাগলেন।কোনোমতে রুটি ছেকে নিলাম।মোটামুটি আধপোড়া।আর যা শেইপ হয়েছিলো!উফ্!কেটে নিয়ে গোল করেছিলাম।ছয় ছয়টা রুটি বানিয়েছি আজ আমি।এটা খাওয়ার জন্য এখন অমলেট বানাবো।ফোনে একবার বেস্ট টিউটর ইউটিউবে ঢু মারলাম।

আড়চোখে শুদ্ধকে দেখলাম সে ঠোট কামড়ে হাসছে।রাগ হচ্ছিলো।আসমা খালাকে ছুটি দিয়ে,নিজে বসে বসে মজা নিচ্ছে আমার হালাত দেখে।ডিম ফাটাতে গিয়ে সারা ফ্রাইং প্যানে ছড়িয়ে ফেলেছি।একদম ছাড়াছাড়া অমলেট।সেটা নিয়েও শুদ্ধের আরেকদফা অট্টহাসি।একদম পেট ধরে হাসছেন উনি।দাতে দাত চেপে সবটা করলাম।ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে বারোটা বাজে।

-নিজের দিকে তাকান।কি অবস্থা!একফোটা রান্না নেই,সারা গায়ে আটা দিয়ে ভর্তি।যেনো রান্না করে উনি দুনিয়া উদ্ধার করেছেন।যান,গোসল করে আসুন।

উনি আরো ভাব নিয়ে বসে আপেলটা দেখতে দেখতে বললেন,

-তোর অবস্থা যে কি সেটা আগে দেখে আয়।যা।

মুখ বাকিয়ে রুমে আসলাম।আয়নায় তাকিয়ে মনটা চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেলো।সত্যিই হালাত খারাপ।আটা দিয়ে গাল ভর্তি,হাতেও লেগে আছে,চুলেও।মনে মনে আম্মুকে কয়েকহাজার বার সরি বললাম,তার রান্নার কষ্টটা আজ টের পেয়েছি।আবার রাগও করলাম কিছুটা,কেনো রান্না শেখায় নি আমাকে এ নিয়ে।অন্তত শুদ্ধের সামনে এভাবে অপমান হতে হতো না।তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নিলাম।শুদ্ধ এখনও রুমে ফেরেন নি।একটা জোরে শ্বাস ফেলে মাথা মুছতে মুছতে আবারো কিচেনেই আসলাম।চোখ কপালে আমার।শুদ্ধ স্টোভের কড়াইয়ে কিছু একটা নাড়ছেন।একদম নিখুতভাবে।এদিক ওদিক গিয়ে এটা ওটা এনে কড়াইয়ে দিচ্ছেন।আমি যে এসেছি,সেটাও খেয়াল করেননি হয়তো।খুব সুন্দর একটা সুগন্ধও আসছে।

-এ্ এসব?আপনি…

-বিরিয়ানি।শুদ্ধ’স স্পেশাল!

-আপনি রান্না জানেন?

-হোয়াই নট?আমার রান্না জানা বারন?

বুকে হাত গুজে অন্যদিক ঘুরে তাকালাম।লোকটা তারমানে সবটা জেনেই আমার সাথে এমন করলো।শুদ্ধ কড়াইয়ে কিছু একটা ছিটিয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে বললেন,

-গোসল করেই চলে এলি?ভেজা চুল নিয়ে?

এই প্রশ্নটা শুনে দাড়িয়ে থাকা দায় হলো আমার।একপলক তার দিকে তাকিয়ে,সেই বাকা হাসি দেখে,একছুটে রুমে চলে আসলাম।বিছানায় হাটু মুড়িয়ে বসে মুচকি মুচকি হাসছি শুধু।পাগল লোক একটা।অদ্ভুত।বেশ কিছুটা সময় পর দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম।মাথা তোলার বিন্দুমাত্র সাহস হলো না।শুদ্ধ বললেন,

-যেদিন আমি তোর কাছে আসবো,তোর এই লজ্জাই তোর শনি হবে দেখিস!এতোটা কাছে আসবো,সব লজ্জা ছিনিয়ে নেবো একদম!

খামচে ধরলাম জামা।কি বললেন উনি এটা?আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখলাম কেউ নেই রুমে।ওয়াশরুমের দরজা লক।কি পান উনি এভাবে বলে?শুধুশুধু আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে?

লান্চের সময় দু চেয়ার দুরে বসেছি শুদ্ধের চেয়ার ছেড়ে।কেনো জানি না হাত পা চলছে না আমার।কিছুক্ষন আগে তার বলা কথায় কেমন কেমন যেনো লাগছে।যেদিন উনি কাছে আসবেন আমার!এই কথা?এটাই তো সহ্য হচ্ছে না আমার।লজ্জার বহর এসে ভর করেছে মন জুড়ে।শুদ্ধের চেয়ারের দিক তাকিয়েও চোখ নামিয়ে নিচ্ছি বারবার।এতো লজ্জা নিয়ে সামনে যেতে পারবো তার?নইলে যাবোই বা কোথায়?

-খাবারটাও কি বেড়ে খাওয়াতে পারবি না?

লাফিয়ে উঠে দাড়ালাম।শুদ্ধ গোসল করে নিচে এসেছেন।গায়ে সাদা চিকন হাতার স্লিভস্,চুলগুলো আংশিক ভেজা,কপালে পরে আছে।চোখ সরিয়ে কিচেনে ঢুকে তার রান্না করা বিরিয়ানি প্লেটে বেড়ে এনে সামনে দিয়ে চলে আসছিলাম।শুদ্ধ হাত ধরে ফেললেন আমার।তারদিক ফিরলাম না।উনি বললেন,

-এটাতো আমার বানানো।তোর বানানো খাবার কই?

পিছন ফিরে ভ্রুকুচকে বললাম,

-ও্ ওই পোড়া রুটি,ছিন্নভিন্ন অমলেট দিয়ে কি হবে?

-নিয়ে আসতে বলেছি,জলদি নিয়ে আয়।আর একটা কথা না।

চুপচাপ দুটো আধপোড়া রুটি,বিছড়ানো অমলেট এনে দিলাম।শুদ্ধ হাত ধরে পাশেই বসিয়ে দিলেন আমাকে।বিরিয়ানির প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-শুরু কর।

-আপনি…

-কোনো কথা না।বলেছি না?খাওয়া শুরু কর।রাইট নাও!

ধমক!বিরিয়ানি তুলে মুখে দিলাম।অসম্ভব ভালো হয়েছে ওটা খেতে।পাশে তাকাতেই শুদ্ধ ভ্রু নাচিয়ে বোঝালেন কেমন হয়েছে।এতোটা ভালো হয়েছে,মুখ দিয়ে কথাই বেরোলো না আমার।মাথা নেড়ে বোঝালাম অনেক ভালো।শুদ্ধ একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে পাশের প্লেটে থাকা পোড়া রুটি ছিড়ে খেতে লাগলেন।আমার খাওয়া আর হলো না।আটকে গেলাম।শুদ্ধ এমন তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন,যেনো কতো ভালো হয়েছে ওগুলো।টুপটুপ করে পানি পরতে লাগলো চোখ দিয়ে।শুদ্ধ একপলক আমাকে দেখে খাওয়া থামিয়ে দিলেন।হন্তদন্ত হয়ে পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-কি হলো?ঝাল লেগেছে?আমি তো কম ঝালেই রেধেছি।সিয়া?খুব ঝাল হয়েছে?পানি খা।ওয়েট!আমি মিষ্টি কিছু আনি।তোর তো…

উনি উঠে যাচ্ছিলেন।হাত ধরে আটকে দিলাম।জলভরা চোখে তার দিকে তাকিয়েই বললাম,

-এগুলো কিভাবে খাচ্ছেন আপনি শুদ্ধ?

শুদ্ধ ঠোট টিপে অন্যদিক তাকিয়ে হাসলেন।তারপর আমার চোখ মুছে দিয়ে দুগাল ধরে বললেন,

-ভালোবাসার মানুষটার হাতে তৈরী যেকোনো জিনিস অমৃততুল্য।আমার বানানোটা যেমন তোর ভালো লেগেছে,তোরটা বানানো রুটি অমলেটও ঠিক তেমনি দুর্দান্ত হয়েছে আমার কাছে।মিচুয়াল ফিলিংস্!

শুধু নিরবে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে।আমাকে নিজহাতে বিরিয়ানি খাইয়ে দিয়ে উনি সেই রুটিই খেয়েছেন।বারন শোনেননি আমার।

——————?

আজ কলেজে প্রথম ক্লাস।রেডি হয়ে আম্মু বাবাকে সালাম করে,মাহির শুভকামনা নিয়ে শুদ্ধর সাথে বেরিয়ে এলাম আজাদ ম্যানশন থেকে।শুদ্ধ আমাকে পৌছে দিয়ে নাকি অফিস যাবেন।কিছুটা পথ আসার পর শুদ্ধ বললেন,

-কানে গোজা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকে গেলি না কেনো?

কপাল কুচকে তাকালাম তার দিক।উনি সামনে তাকিয়েই বললেন,

-কলম বের কর!

আরো বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তার দিকে।শুদ্ধ ব্রেক করে গাড়ি থামালেন।একপলক তাকাতেই তাড়াতাড়ি কলম বের করে দিলাম ব্যাগ থেকে।উনি কলমের হেড খুলে নিয়ে সে চুলগুলো আটকে দিলেন।

-বাসায় থাকতে মনে ছিলো না,এটা দিয়েই কাজ চালা আপাতত।এটা খুলবি না।ফ্রেন্ড বানাবি,তবে খবরদার জোরে হাসবি না।তোর হাসি যেনো দু ইঞ্চি দুরের মানুষও না শোনে!

চোখ গরম করে আঙুল উচিয়ে শেষের কথাদুটো বললেন উনি।চুপচাপ মহারাজের কথায় ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি বোঝালাম।উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন আবারো।কলেজ গেইটে পৌছে নামার সময় বললেন,

-কথাগুলো মনে থাকে যেনো!

সবার বর বলে কোনো ছেলের সাথে মিশবি না,সাজবি না।আমার বর বলে ফ্রেন্ড বানাবি,তবে জোরে হাসবি না,কলমের হেড দিয়ে উল্টো সাজিয়ে দিলো।ঘাড় দুলিয়ে হ্যাঁ বলে ভেতরে ঢুকলাম।শুদ্ধর তাড়া ছিলো জানতাম,উনি চেয়েছিলেন সাথে আসতে,মানা করেছি।উনি চলে গেলেন অফিসে।

প্রথমদিনের ক্লাস!ক্লাস না,পরিচিতি পর্ব ছিলো আজ।তমশা নামের একটা মেয়ের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেলো প্রথম দিনেই।ওর সাথে থাকে মিম আর সামি।ওদের সাথেও কথা হলো।আগে আগেই ক্লাস শেষ আজ।ওদের সাথেই বেরোলাম।ওরা চলে গেছে।আমি বলেছি আমাকে নিতে আসবে তাই আমি দাড়াবো কিছুক্ষন।কিন্তু শুদ্ধর ফিরতে তো সময় লাগবে!এতোক্ষন কি করবো তাহলে?

হুট করেই মুনিয়ার কথা মনে পরে গেলো।হাসি ফুটলো মুখে।এটুকো সময়ে বরং ওকেই দেখে আসি।বেশ অনেকটা দিন কেটে গেছে ওর খবরটাও নেওয়া হয়নি।মেয়েটাকে সেদিন দেখেই কেমন যেনো মায়া পরে গেছে।যেমন ভাবা,তেমন কাজ।সোজা চলে গেলাম মুনিয়ার কেবিনে।কিন্তু ওখানে গিয়ে যা দেখলাম,নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here