তোর নামের রোদ্দুর, পর্বঃ২৫

0
2261

#তোর_নামের_রোদ্দুর
পর্বঃ২৫

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

একটা একটা বাজ পরা শব্দে চমকে উঠে আরো মিশে যাচ্ছি শুদ্ধের পিঠের সাথে।কিছুটা সময় পর থমকে থেকে শুদ্ধ ছাড়ানোর চেষ্টা করেছেন আমাকে।ছাড়িনি।সামনে যেতে পারবো না তার।এবার উনি একটানে তাকে জরানো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে দাড় করালেন আমাকে।মাথা নিচু করে আছি।কিভাবে চোখ তুলে তাকাবো তার দিকে?কিভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন?সহ্য হবে তোর ইনসু?বলে তো দিলি ভালোবাসি,তার কাছে আসা সইবে তোর?ইশ্!কোথায় যাবি তুই এখন?কিভাবে লুকাবি নিজেকে?

শুদ্ধ দুহাত দুগালে রাখলেন আমার।অস্ফুট স্বরে বললেন,

-সিয়া?তুই…

মুচকি হাসি ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি তাকে।কথা বেরোবেই না মুখ দিয়ে আমার।শক্ত করে জরিয়ে ধরলেন উনি আমাকে।ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে আছেন উনি।বৃষ্টির পানি তার চোখমুখ ছুইয়ে আমার গায়ে স্পর্শ করছে,পবিত্রতায় ছেয়ে যাচ্ছে মনপ্রান।মনে হচ্ছিলো,থাকি না এভাবেই!পরপরই লক্ষ্য করলাম শুদ্ধ ফোপাচ্ছেন।বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে বললাম,

-শুদ্ধ?আপনি কাদছেন?

-তুই দেখেছিস আমি কাদছি?ছেলেরা কোনোদিন কাদে?শুদ্ধ কোনোদিন কেদেছে যে আজ কাদবে?

-মিথ্যে কেনো বলছেন শুদ্ধ?এই বৃষ্টির ধারায় আপনার চোখের জল দৃষ্টিগোচর না হলেও ভেতরটা তো শুনতে পাচ্ছি আমি।আপনি আপনার সিয়াকে এভাবে মিথ্যে বলবেন না প্লিজ!সিয়া যে শুদ্ধকে পড়তে শিখেছে।আপনার মিথ্যে সইবে না আপনার সিয়ার।

উনি ঠোট কামড়ে আশেপাশে তাকিয়ে আবেগ লুকাচ্ছিলেন।এর ভালোবাসার একেকটা ধরন দেখলে নিজেকে পাগল পাগল লাগে আমার।উনি সত্যিই কেদেছেন।খুশিতে।হঠাৎই পাগলের মতোই চোখেমুখে ঠোট ছোয়াতে লাগলেন উনি আমার।তার বুকের দিকের গেন্জি খামচে ধরে মাথা উচু করে চোখ বন্ধ করে রইলাম।শান্তি লাগছে।প্রচন্ড শান্তি লাগছে।আবারো দুগাল ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,

-ভালোবাসি শ্যামাপাখি।খুব ভালোবাসি তোকে।

চোখ মেলে তার চোখে চোখ রেখেই বললাম,

-আমিও ভালোবাসি শুদ্ধ।আপনার শ্যামাপাখিও আপনাকে ভালোবাসে।

শুদ্ধর ঠোটে এক অদ্ভুত হাসি।কিছুক্ষন চেয়ে রইলাম ওই সিক্ত ঠোটজোড়ায়।উনি আমার কপালের ভেজা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললেন,

-এবার বাসায় চল।অসুখ করবে।

তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে তার সাথে চলে আসলাম।ভেবেছিলাম চোরের মতো রুমে ঢুকে যাবো,কিন্তু সারাটা রাস্তার মতো বাসাতেও হাত ধরে ঢুকলেন উনি।পিছন পিছন মাথা নিচু করে হাটছিলাম।তবে টের পাচ্ছি ড্রয়িংরুমে সবাই বসে।শুদ্ধ সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললেন,

-বৃষ্টি দেখেই সিয়া ভিজতে বেরিয়েছিলো।ওকে ধরতে গিয়ে আমিও ভিজে গেলাম।

কপাল কুচকে তাকালাম তারদিক।আমি বেরিয়েছিলাম?ও!এবার যখন ভালোবাসি কথা আদায় করা শেষ,সব দোষ এখন সিয়ার।আড়চোখে একবার সোফার দিকে তাকালাম।বাবা আম্মু স্বাভাবিকভাবে আলোচনায় মত্ত্ব।আচ্ছা?এগুলো কি খুব স্বাভাবিক কথা?হয়তো ওনারা জানেন যে ওনাদের ছেলেটাই অস্বাভাবিক।তই রিয়্যাক্ট করেন না।

.
চেন্জ করে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলাম।শুদ্ধ সবে ওয়াশরুমে ঢুকেছেন।এ ঘরে থাকা সম্ভব না আমার এখন।কি ঘটিয়েছি ভাবতেই শিহরন বয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে।মাহির ঘরে গেলে কিছুটা বাচবো।উনি ভেতর থেকেই চেচিয়ে বললেন,

-হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নে সিয়া।

-অব্ দ্ দরকার নেই।

-দরকার আছে।আমার দরকার আছে।

-কেনো?

-তোর ওই ভেজা চুলই তোর জ্বরের কারন হবে।যেটা কষ্ট দেবে তোকে।সইতে পারবো না।আর এমনিতেও,আমাকেও পাগল করে দেবে।নিজেকে আটকাতে পারবো না।

পাগল করে দেবে মানে?একপলক ওয়াশরুমের বন্ধ দরজায় তাকালাম।রুমে না থাকলে কিসের কি?কোনো পাগলামি টাগলামি দেখতে হবে না।নিজেকে সামলে বেরিয়েই যাচ্ছিলাম,পিছনে হাত আটকা পরলো।একটা ছোট শ্বাস ফেলে পিছনে তাকালাম।শুদ্ধ আজও খালি গায়ে,কিন্তু থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে।সাথেসাথে খিচে বন্ধ করে নিলাম চোখ।উনি একটানে এগিয়ে এনে কোমড় জরিয়ে ধরলেন আমার।কানে গোজা ভেজা চুল ছাড়িয়ে তাতে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন,

-লজ্জায় লাল হওয়া টমেটো সস?খেয়ে নেই আপনাকে?

দুহাতে তার বুক ঠেলে দুরুত্ব খুসতে ব্যস্ত আমি।উনি ওভাবে থেকেই বললেন,

-কোথায় যাবি?হাইচ্ছু!

মাহির রুমে বললে বেচারি মাহিকে আবার কথা না শোনায়।এই ভেবে বললাম,

-র্ রুমের ব্ বাইরে।

-ধুরু!হানিমুন রুমের বাইরে করে কেউ?

বড়বড় চোখ করে তাকালাম।হানিমুন?উনি ওনার লাল হয়ে থাকা নাকটা ডলে আমার চুলগুলো গুজে দিলেন।কপালে একটা চুমো দিয়ে বললেন,

-এইতো তাকিয়েছিস।

তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলাম।পারেও এই লোক!ধ্যাৎ!শুদ্ধ আমাকে উল্টোদিক ঘুরিয়ে বরাবরের মতো চুলে নাক ডুবিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,

-এবার আমি নিজেকে কি করে আটকাই সিয়া?

শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।শুদ্ধ ছেড়ে দিলেন আমাকে একটু পরই।

-এই ভেজা চুলে থাকিস না।জ্বর হবেই তোর আজ।

কথাটা বলেই উনি হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে নিজেই হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাতে বসলেন আমার।তার কাজ শেষে চাদর টেনে শুইয়ে দিলেন আমাকে।

.
-ওভাবে হাত বাড়িয়ে আছিস কেনো?কাছে আসতে বলছিস?কাছে আসবো?হাইচ্ছু!

শুদ্ধর কথায় লজ্জায় আবারো নুইয়ে গেলাম।সত্যিই তো।ওভাবে হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি?আমাকে শুইয়ে চুলগুলো ঝাড়া মেরে গেন্জি পরে নিলেন উনি।ব্যালকনির কাচের সামনে পকেটে দুহাত গুজে দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন।বৃষ্টি এখনো।ইচ্ছে করছিলো তাকে জরিয়ে ধরে বৃষ্টি দেখি।অজান্তেই কখন তারদিকে হাত বাড়িয়েছি,নিজেও জানি না।তার কথা আর কুচকানো ভ্রু দেখে হুশে ফিরলাম।হাত নামাতে গেলেই উনি ধরে ফেললেন আমার হাত।তাড়াতাড়ি ঝুকে তার গেন্জির কলার খুসে দিলেন দু হাতে।একদম চোখে চোখ রেখে বললেন,

-এবার বল।

চোখ সরিয়ে নিলাম।উনি আবারো বললেন,

-তুই নিজেও জানিস না সিয়া,আজ কি দিয়েছিস তুই আমাকে।বল না?কি বলবি?হাইচ্ছু!

ওনার গেন্জি মুঠো করে অন্যদিক চোখ রেখেই বললাম,

-ঠান্ডা লেগেছে আপনার।

-ও সেরে যাবে।তোর যে জ্বর হবে?

-হবে না।হলেও সেটা আপনার নামের…

-এবার আমার তীর আমাকেই তাক করছিস?আমি কিছু করলে সহ্য করতে পারবি তো?

-ইনসিয়া ভাবি!!!

তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলাম শুদ্ধকে। উঠে বসছিলাম।উনি ধরা গলায় বললেন,

-শুয়ে থাক তুই।আ’ম ড্যাম শিওর তোর জ্বর হবে আজ।আর এই মাহিকে তো…হাইচ্ছু!

বলেই হনহন করে দরজার দিক এগোলেন উনি।আমি আধশোয়া হয়ে বসে গলা অবদি চাদর উঠিয়ে নিলাম।শুদ্ধ দরজা খুলতেই মাহির সবগুলো দাত বের করা হাসি।উকি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-হাই!

-সোয়াগ সে সোয়াগাত তোকে মাহি।আয় না?ভেতরে আয়?

মাহির মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।একবার আমার দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে শুদ্ধের দিকে তাকালো ও।আমি উঠে আসতে যেতেই,

-তুই বেড থেকে শাস্তির জন্য রেডি হয়ে নাম!হাইচ্ছু!

থেমে গেলাম।শুদ্ধ দরজা ছেড়ে হাত বিছিয়ে মাহিকে ভেতরে আসতে বললেন।মাহি কাদোকাদোভাবে বললো,

-আমি কি সাধে ডাকতে আসি?ফুপি ডিনারের জন্য ডাকছে।

-তোর বাহানা আমার জানা আছে।আয় না ভেতরে?আজ ব্যালকনিতে জমা সব পানি মোছার দায়িত্ব তর।টবগুলোও পরিস্কার করবি।

-শুদ্ধ ভাইয়া আমি…

-শুদ্ধ?ইনসুকে নিয়ে খেতে আয়!

আম্মুর গলা শুনে শুদ্ধ একবার আমার দিকে তাকালেন।আমি দরজার বাইরে মাহির দিকে তাকিয়ে।বেচারি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে।শুদ্ধ ওরদিক ঘুরে বললেন,

-বেচে গেলি।যা আসছি।

মাহি ভো দৌড়।আমিও শ্বাস নিলাম।ও কেনো ওসব করতে যাবে?সকাল হলে আমিই করে দিতাম।এমনিতেও রাতেও বৃষ্টি হবে আরো।শুদ্ধ নাক ডলতে ডলতে বললেন,

-কি খাবি তুই?

-মানে?

-ডিনারে কি খাবি?হাইচ্ছু!

-অব্ নিচে চলুন।ডাইনিংয়ে গিয়ে…

-না।যেতে হবে না তোকে।এখানেই খাবার আনছি আমি।

-কিন্তু শুদ্ধ…

-আম্মুকে বলবো তুই আমার হাতে খেতে চেয়েছিস,ডাইনিংয়ে সবার সামনে লজ্জা করবে তাই যাসনি।

কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।উনি শব্দ করে হেসে দিয়ে বললেন,

-এই ক্যাবলা ক্যাবলা লুক তোকে খুব মানায় সিয়া।ট্রাস্ট মি।

-যাই না ওখানে!

-না।

-জ্বর হয়নি তো!

-প্রি ফিভার সিচুয়েশনেই আছিস।আপাতত টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস্ শুদ্ধ গুড বয়।এতোগুলো বছর অপেক্ষা করেছি।চব্বিশ ঘন্টা,ইটস্ নট আ বিগ ডিল!শুধু একবার সুস্থ্য হয় তুই,তারপর না হয়….

কথা শেষ না করেই বাকা হেসে উনি চলে গেলেন।আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।প্রি ফিভার সিচুয়েশন?এই নামে কোনো মেডিকেল টার্ম আছে?আর চব্বিশ ঘন্টার গুডবয় মানে?চব্বিশ ঘন্টায় জ্বর এসে সেরে যাবে?তারপর কি???

————?

-হ্যাঁ,বলো সজিব।হঠাৎ?এ সময়?

-আ্ আয়ান পালিয়েছে স্যার!

ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না।ওপাশের ফোন ভেঙে কলটা কেটে গেছে কি না সেটা চেক করার জন্য ফোন কান থেকে নামিয়ে দেখলো সজিব।কিন্তু না,কল কাটে নি।ভয়ার্ত গলায় বললো,

-স্ স্যার আসলে…

-সেন্ড মি দ্যা সিসিটিভি ফুটেজ।

-স্যার বিকেলে….

-জাস্ট ডু ইট ইউ ফুল!

ধমকে কেপে উঠলো সজিব।কলটাও কেটে গেছে ততক্ষনে।কাপাকাপা হাতে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে নিলো সে।ওখানে স্পষ্ট,আয়ানকে দেখতে আসা ডক্টরের গলায় ছুড়ি ধরে ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সবাইকে ভয় দেখিয়েছে আয়ান।ওরাও পিছিয়ে ছিলো না।রিভলবার দেখিয়েছিলো।যদিও তা শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্যই।এভাবেই বলা ওদের।আয়ানের কোনো ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না।হয়তো তা টের পেয়েছিলো আয়ান।একসময় নিজেই একটা গুলি ছিনিয়ে নিয়ে একপ্রকার উন্মাদের মতো এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।দুজনের লেগেছে।ওর নিজেরও হাতে ব্যান্ডেজ।পালিয়ে গেছে আয়ান।

এ কয়দিন কাকে,ঠিক কেনো,কিভাবে জিম্মি করে রেখেছিলো সে উত্তরটাও নেই সজিবের কাছে।একজন লোককে তুলে এনে প্রথমদিন তার বাসায় এমনভাবে কথা বলিয়ে দেওয়া,যাতে সেখানে কেউ চিন্তা না করে।পরদিনই সবরকমের সুবিধাসম্বলিত ফ্লাটে তাকে শিফট করানো,পাহারায় চারজনকে রেখে তার সেবায় আরো দুজনকে রেখে যাওয়া।আর সবথেকে বড় কথা রেগুলার ডাক্তারি চেকাপ করানো।অপহরনের পর কোথাও কেউ এসব করে জানা ছিলো না সজিবের।

যতটুকো জানে,এই আয়ান ওর বসের অনেকবড় কোনো ক্ষতি করেছে,তবে তার সাথেই এতো ভালো ব্যবহার কেনো?আয়ানেরই বা এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেনো?রেগে গিয়ে পাগল হয়ে যায় ও।কিছু তো সমস্যা আছে ওর মাঝে।তবে কি এজন্যই আলাদা রেখে ডাক্তারি চিকিৎসা‌ দেওয়া হচ্ছিলো ওকে?তাহলে তো সেটা ওর ভালোর জন্যই ছিলো।পালালো কেনো ও?আবারো কারো ক্ষতি করতে?এবার তো ছাড়া পেয়েছে লোকটা।এই লোক নাকি শুধু ধ্বংসই জানে।না জানি কার জীবনকে নষ্ট করে দিতে উদ্যত হচ্ছে এখন!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here