অদ্ভুত_সম্মোহনী❤
PART_17
#FABIYAH_MOMO?
?
ঝড় চলে যাওয়ার পর মানুষের গগনবিদারী আর্তনাদ শুরু হয়। কি কি ক্ষতি হলো তা নিয়ে কপাল চাপড়ে বেহাল কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। আমার সামনেও ঠিক তাই হচ্ছে। স্যালাইন লাগানো অবস্থায় সাদ ভাই আমার বিছানার কাছে লুটিয়ে পড়েছেন। আমার ঝিমুনি মাথা নিয়ে উনাকে টেনেও বিছানায় উঠাতে পারছিনা। আমার কাধের অবস্থা নাজুক বাম হাত নাড়াতে পারিনা। জানালা খুলে রুম স্বল্প আলোতে উজ্জ্বল করে উনার কাছে ফ্লোরে যেয়ে বসলাম। সাদ ভাই ফ্লোরে বসে বিছানায় মুখ লুকিয়ে আছেন। গায়ে সাদা রঙের হাসপাতালের পোশাক। উনার এলোমেলো চুলে হাত ঢুকিয়ে শান্তসুরে বললাম,
— বিছানায় উঠে বসুন। ফ্লোর প্রচুর ঠান্ডা। আর হাতের নলটা খুলেননি কেন?
উনি আগের মতোই চুপ করে বিছানায় মুখ লুকিয়ে আছেন। আমি আস্তে করে নলটা ধরে দিলাম টান। সূচ খুলে স্যালাইনের তার হাতের মুঠোয় চলে আসলো। সেটাকে দরজার দিকে ছুড়ে মারলাম। উনার চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,
— আপনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছেন তাইনা? এলেন কেন? ট্রিটমেন্ট ছেড়ে এভাবে বেকুবের মতো আসাটা ঠিক হলো?
উনি আলতো করে মাথা উঠিয়ে স্বল্প আলোতে আমার দিকে তাকালেন। উনাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। তবুও ঝাপসা আধারে আমার দিকে থরথর করে কাপা হাত এগিয়ে আমার গালের উপর রাখলেন। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে গালের উপর ছুয়ে বললেন,
— রাহাত তোমাকে খুব মেরেছে না? গালটা কেমন দাগ বসিয়ে দিয়েছে। আমাকেই শেষ করে দিতো,
গলা ধেয়ে কান্না আসছে আমার। প্রচণ্ডরূপে বুকফাটা কান্না। কি জানি উনার ওমন কন্ঠস্বর শুনে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে! আকাশচুম্বী কান্না। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— কি কপাল এনেছিলাম দুনিয়ায়! বন্ধুর মতো পাশে থেকে সাহায্য করলাম সেই বন্ধুই আমাকে কুত্তার মতো মারলো। মানুষ কুত্তাকেও একপর্যায়ে ছেড়ে দেয় কিন্তু বন্ধুটা আমায় সেটুকুও ছাড়তে চায়নি। কি দোষ করেছি রাহা? তোমাকে খারাপ ভাবে নিয়েছি? কোনো অনৈতিক কাজ ছাড়াই কেনো দোষী সাবাস্ত করলো?
আমি মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে অশ্রু ফেলছিলাম। এই মূহুর্তে আমি কিছুই বলার মতো অবস্থায় নেই। সাদ ভাই আবার বললেন,
— তুমি তো ওর বোন। তোমাকে কেনো জানোয়ারের মতো মারলো? মেয়েদের উপরে হাত…. ছিহ্! থু মারি ওর উপর!
সাদ ভাইয়া গালের উপর হাতটা সরিয়ে আমার কাধের দিকে তর্জনী তুলে ইশারা করে বললেন,
— হাড় ভাঙেনি?
আমি চোখ নিচু রেখেই বললাম,
— শুধু নাড়াতে পারিনা। হাড় ভাঙেনি।
সাদ ভাইয়া শব্দযোগে শ্বাস ছাড়লেন। আবারো নিবরতা আমাদের জেকে ধরলো। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,
— আমার জীবনে যতগুলা বন্ধু ছিলো তার মধ্যে রাহাতকে বেশি ভালো লাগতো। কতো আনন্দ নিয়ে বিয়েতে ওর ভাগের কাজগুলি করে দিলাম। আমারই ভুল হয়েছে। আগেই যদি দূরে দূরে থাকতাম তাহলে তোমার উপর শয়তানটা হাত তুলতো না।
— আপনি হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন কেন?
— তো কি করবো? বসে বসে নার্সদের গল্প শুনবো? হুঁশ ফেরার পরে যদি তোমার কাছে আসতে চাই! তখন যদি তোমার বাবা এসে ঠাটিয়ে দুটো কানে লাগিয়ে তোমার কাছে ভিড়তে মানা করে! তখন কি করবো? চেহারা গিলবো?
— কি বলতে চাইছেন আপনি? আব্বু আপনাকে থাপ্পর মেরেছে?
— আমাকে উলঙ্গ করে জনসম্মূখে খুন করাটা শুধু বাকি আছে। দেখো কালকেই আমার লাশ দাফন হয় নাকি।
— আপনি এসব কি বলছেন!
— প্রস্তুত থাকো রাহা। এখন থেকেই প্রস্তুত থাকো। তোমার বিয়ের সাধ যে পূরণ হবেনা সেটার জন্য তোমার পরিবার দায়ী।।
— আরেকবার পালাতে পারবেন?
সাদ ভাই আশ্চর্য হয়ে বললেন,
— কি বলতে চাইছো?
— আরেকবার পালানোর সাহস আছে আপনার?
— দুঃখিত রাহা। আমি তোমাকে কোনো বিপদে ফেলতে চাই না। উনারা আমাকে মেরে ফেলতে চায়! মেরে ফেলুক। তোমার উপর দিয়ে আর ঝড় ঝামেলা চাই না।
— স্বার্থপর হয়ে গেলো না ব্যাপারটা?
— হোক যেটা খুশি সেটা! আপাতত তোমাকে আর কষ্টে ফেলতে চাই না। ভেবেছিলাম খুব সুন্দর করে নিজের মনমতো সব করবো কোত্থেকে এই ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিলো।
— আপনার জন্য এরকম আরো দশটা ঝুঁকি নিলেও আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু আপনিই যদি আমার পাশে না থাকেন বেঁচে থেকে কি লাভ?
— পাগলামো করবে না রাহা! এটা মোটেও এসব কথা বলার সময় না।
— আপনি নিজের মনমর্জি খাটাতে পারেন! তাহলে আমি করলে দোষ কি?
— আমাকে জিন্দা মেরে ফেললেও সমস্যা হতো না। কিন্তু যেই ভাই নিজের আদরের বোনকে শয়তানের মতো মারতে পারে তার দ্বারা যেকোনো বিপদ ঘটাতে তুড়ি বাজানোর মতোই সহজ।
— আমি ভাইয়াকে প্রচুর ভয় পেতাম। কিন্তু এখন পাই না। এখন বললে ভুল হবে, আমি আজ থেকে পাইনা।
— মানে?
— বড় ভাইয়া আমাদের দু’বোনকে খুব মারতো। রূপ আপুকে মারতে ধরলে আমার উপরও বেল্টের বারি পড়তো। এগুলো এখন গা সওয়া। পুরোনো কথা। কলেজে উঠার পর থেকে তেমন হাত তুলতেন না। মাঝেসাঝে রেগে গেলে আমার উপর রাগ ঝাড়তেন এই আর কি।
— তোমার বাবা কি অন্ধ? তোমাকে রাহাত এইভাবে পশুর মতো মারতো!
— আব্বু কিছু জানলে তো! ভাইয়া আমাদের দুজনকে এমন ভাবে শাষিয়েছে কখনো মরে গেলেও হয়তো আব্বুর সামনে মুখ খুলে বলার সাহস পাবো না।
— আল্লাহ রাহা আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছিনা !
— এটাই সত্য।
সাদ ভাই হুট করে আমাকে জাপটে ধরলেন। আমি থতমত খেয়ে চমকে উঠলাম। উনি হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরবেন বুঝে উঠতে পারিনি। সাদ ভাইয়া মাথায় পাচঁ আঙ্গুলের কঠোর চাপে শক্ত করে ধরেছেন। কানের কাছে ঠোট এনে অস্থির গলায় বললাম,
— তোমাকে আমি নরকে থাকতে দিবো না। কিছুতেই না। তুমি এক্ষুনি এই মূহুর্তে আমার সাথে চলবে! তোমাকে এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। চলো!
আমি শান্ত সুরে বলাম,
— এই রাতে বের হওয়াটা রিস্ক। আব্বু তো নিচে…
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন,
— টেনশন করো না। আমি দেখছি…
হঠাৎ রুমের দরজা খুলার শব্দটা খুব নিরিবিলি এবং শান্ত তরিকায় শোনা গেলো। আমি ওদিকে তাকাবো তার আগেই সাদ ভাইয়া উনার অসুস্থ শরীরে আমাকে একহাতে আগলে ধরলেন। অন্যহাতে মাথাটা উনার বুকের কাছে চেপে ধরলেন শক্ত হাতে। নিচু স্বরে বললেন, ‘চুপ চুপ কেউ আসছে’।
কে আসলো রুমে? কি হাল করবে আমাদের কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছেনা! আব্বু যেখানে উনার সাথে আমার দেখা করাই মানা করে দিয়েছেন সেখানে উনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এখানে এসেছেন তা এতক্ষনে সবাই জেনে গেছে হয়তো। হঠাৎ সাদ ভাই বলে উঠলো,
— তোমরা?
আমি ভ্রুকুচকে ফেললাম কথা শুনে! ‘তোমরা’ আবার কে? তুমি তুমি করা কোন পাব্লিকের আগমন হলো রুমে? এসব নিয়ে ভাবতেই ভাবতে সাদ ভাইয়া আবার বলে উঠলেন,
— তোমরা যদি আমাকে মারতে আসো তাহলে মেরে ফেলো প্লিজ! এক্ষুনি মেরে ফেলো! অনেক হয়েছে এই লুকোচুরি তামাশা! আসো! মেরে ফেলো!
একটা পুরুষালী শান্ত কন্ঠ শোনা গেল। এবং অভয় বাণিতে বললো,
— তোমাকে মারতে আসিনি সাদ। তুমি আমায় ভুল বুঝছো।
— কি ভুল বুঝবো? কি ভুল বুঝার বাকি আছে? তোমার হাতে চাকু!আবার বলছো ভুল বুঝছি?
— লেট মি ফিনিশ ম্যান! শেষ করতে দাও। নিচে সবাই খবর পেয়ে গেছে তুমি হাসপাতাল থেকে পালিয়েছো। কিন্তু পালিয়ে যে এখানে চলে এসেছো সেটা এখনো জানেনা। কেউ কিছু জানুক তার আগেই তুমি ফটাফট বিদায় হও। এই চাকুটা সেইফটি হিসেবে রাখো!
অনুযোগের সুরে মেয়েলি ভয়ার্ত গলা শোনা গেলো,
— সাদ ভাইয়া আপনি চলে যান প্লিজ! অন্তত জান বাচান!
সাদ ভাইয়া তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন,
— হোয়াট এ্যা জোক বাডি! আমার সাথে ভালোই মজা করছো তুমি। আমি পালিয়ে এখানে কিসের জন্য এসেছি জানো না? বাচ্চা সেজে বসে আছো কেন?
নিবির ভাই গরম গলায় বললেন,
—সাদ মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি জানি তুমি এখন প্রচণ্ড রাগে আছো তাই বলে আমার সাথেও উগ্র বিহেভ করবে নাকি! তোমার ভালোর জন্যই বলছি তুমি আপাতত বিদেয় হও। নাহলে যাকে বুকে ধরে আছো না? তার অবস্থা ভালো থাকবে না।
— হুমকি দেওয়া খুব ইজি রাইট? খুব মজাই লাগে সামনের মানুষকে থ্রেড দিতে? আমার সাথে পাঙ্গা নিও না। আসল রূপে আসলে সবগুলাকে খুন করতে পিছপা হবো না।
— সাদ! প্লিজ ইয়ার একটু বুঝো! নিচে সবাই হন্য হয়ে তোমার জন্য খোজাখুজি চালাচ্ছে। যদি জানতে পারে তুমি রাহার সাথে! রাহার সিচুয়েশন টাফ হবে।
— ক্যান ইউ হেল্প?
— কি হেল্প লাগবে?
— পারলে বলবো!না পারলে তোমার সাথে কথা বলে টাইম ওয়েস্ট করবো না।
— নিবির পারবেনা এমন কিছু আপাতত ক্রিয়েট হয়নি। বলো,
— আই নিড এ্যা সাপোর্ট!
— কিসের সাপোর্ট?
— আমি যা যা বলবো তুমি ঠিক সেরকম কাজ করবে। একটা উচ-নিচ কাজ বা পাকনামি করতে যাবে না। রাজি?
নিবির কিছুক্ষণ ভেবে মাথা চুলকিয়ে বললো,
— আচ্ছা ডান। কি করতে হবে,
সাদ রূপ ও নিবিরের দিকে তাকিয়ে সব কথা বর্ণনা করে বোঝালো। সাদের প্ল্যান শুনে নিবির ও রূপ দুজনই হতবাক! সাদের মাথায় এতো সলিড বুদ্ধি আসলো কি করে? সাদের সামনে নিবিরের খুব লজ্জা লাগলো। বয়সে ছোট কিন্তু কি বুদ্ধি ছেলেটার! একেই বলে স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। দারুণ মেধাবী! রূপ তো ফট করে বলেই ছাড়লো,
— সাদ ভাইয়া তুমি কি টেলেন্টেড! ইউ আর জাস্ট ফ্যান্টাস্টিক!
সাদ মৃদ্যূ হেসে রাহাকে ছেড়ে দিতেই বললো,
— থ্যাংকস। ইটস মাই অনার।
রাহাকে ছেড়ে দিয়ে সাদ আরো কিছু বলবে তার আগেই ঢুলু দেহে রাহা সাদের কাধে ঢলে পড়লো। সাদ ভ্রুকুচকে রাহার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গেলে দেখে রাহা ঘুমে বিভোর। সারাদিন মেয়েটার উপর প্রচুর তোলপাড় হয়েছে তার উপর রাহাতের নিষ্ঠুরতা! জাগানোটা ঠিক হবেনা। সাদ শান্ত ভঙ্গিতে ওকে আগলে ধরে রূপের উদ্দেশ্যে বললো,
— রূপ প্লিজ একটু হেল্প করো। তোমার বোনটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে একটু কষ্ট করে বিছানায় শোয়াও।
রূপ দ্রুত সাদের আদেশমতো রাহাকে বিছানায় শুয়িয়ে কাথা মেলে দিলো। সাদ বেডে ভর দিয়ে উঠতে গেলেও উঠতে পারেনা, ফ্লোরে ছিটকে পড়ে যায়। শরীর খুব দূর্বল। ভর পাচ্ছেনা শরীরে। নিবির সাদের অবস্থা বুঝতেই সাদের হাত নিজের কাধে নিয়ে ওকে সোজা করে দাড় করালো। সাদ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে নিবিরের মুখের দিকে। আচ্ছা নিবির এতো ভালো সাজছে কেনো? কোন প্রয়োজনে এরকম হু হা করে হেল্প করছে? রাহাকে ভালোবাসে এমন টাইপ ফিলিং ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছেনা। নিবিরের চোখ তো অন্যকিছু বলছে! কোনটা বিশ্বাস করবো? সাদের তাকানোটা আড়চোখে লক্ষ করেছে নিবির। সে সাদকে নিয়ে হাটা ধরতেই বলে উঠলো,
— আমাকে নিয়ে ভেবো না সাদ। তুমি যে আমাকে নিয়ে অনেক কিছুই উদঘাটন করেছো তা কিন্তু জানি।
সাদ চমকে উঠলো। পরক্ষনে বলে উঠলো,
— তুমি তাহলে আমার ব্যাপারেও ঘাটাঘাটি করেছো।
— হ্যাঁ তা তো করতেই হয়। একমাত্র ছোটবোনের হবু বর বলে কথা।
সাদ এখন অনেককিছু আচঁ করতে পারলেও চুপ করে থাকলো। এদিকে রূপ এসে ওদের সামনে দাড়ালে দুজনের মধ্যে চোখাচোখি ইঙ্গিতে কিছু কথার আনাগোনা চললো। সাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের ভাষা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে। সাদ কতটুকু বুঝতে পারলো তা বুঝার পূর্বেই রূপ মুখ ফুটে বললো,
— কিছু জরুরী কথা আছে সাদ ভাইয়া। আপনি শুনবেন?
— জরুরী হলে বলতে পারো।
নিবির সাদকে এবার বেডে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। রূপ ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে নিবিরের পাশ ঘেঁষে বসলো। সাদের চোখ সচকিত। নিবির মুখ নিচু করে আছে। গলা পরিস্কার করে রূপ বলে উঠে,
— সাদ ভাইয়া আমরা একটা বাজে কাজ করেছি। আমাদের বাজে কাজটার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনি ক্ষমা করবেন?
সাদ সরুচোখে রূপের দিকে তাকিয়ে বলো,
— রাহাতকে আমাদের কথা তোমরা বলেছো! রাইট?
রূপ আশ্চর্যজনক চাহনিতে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকে। সাদ জানলো কিভাবে এই ব্যাপারে জানলো? আরো কিছু জানে নাকি? রূপকে আড়চোখে বিষ্মিত হতে দেখে নিবির রূপের উদ্দেশ্যে বলো,
— সাদ যে মাত্রাতিরিক্ত চালাক তোমায় কথাটা বলছিলাম না? দেখছো কাটায় কাটায় মিলছে?
রূপের হা করা মুখ কিছু সংযত হয়ে চুপসে গেলো। ঠিকই সাদ বেশ চালাক। ওরা কিভাবে কিভাবে কাজ করলো তাও হয়তো ধরে ফেলেছে ইতিমধ্যে। নিবির বললো,
— একচুয়েলি সব দোষ আমার। আমিই রূপকে বলেছিলাম রাহাতকে যেয়ে তোমাদের কথা বলতে। রাহাত তোমার সাথে বেস্টফ্রেন্ড টাইপ ক্লোজ তাই ভেবেছি ও হয়তো ব্যাপারটা জেনে খুশি হবে। কিন্তু এভাবে সিনক্রিয়েট করে মামলা ভয়ংকর বানাবে ভাবতে পারিনি। সরি ব্রো। জানি সরি দিয়ে হয়তো ক্ষত পূর্ণ হবেনা।
— তোমার একটা বোকামিতে আমরা কতটা ইন্জুর্ড হয়েছি দেখছো? রাহার গাল দুটো দেখলে আমার কান্না আসে ভাই! জানোয়ারের মতো ওকে গালে মেরেছে। আমাকে পিটিয়ে যখন চোখের সামনে ওকে ধাক্কাটা মারলো ওই ধাক্কা আমার রূহ কাপিয়ে দিছিলো ব্রো। বেচারি হাত নাড়াতে পারেনা। হাড়গোড় ভাঙলেও আমাকে বলবে নাকি! আর তুমি জাস্ট সরি বলছো?
— বিলিভ মি ম্যান আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি। রাহাত কখনো গুন্ডার মতো বিহেভ করবে ভাবতেও পারিনি।
— বাদ দাও। এখন কি তুমি রূপকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হতে চাইছো?
— হু,
— ফ্যামিলি জানে? আর কাজিনের মধ্যে কখনো লাভ সাভ সম্পর্ক হয় নাকি?
— কাজিনের মধ্যে সম্পর্ক হয় কিনা জানিনা। বাট আই লাভ হার।
— ওকে। কথা টেনে লাভ নেই। বরন্ঞ্চ তুমি ফ্যামিলিকে জানাও। দেখো কি বলে,
— তুমি আমার বেশ ছোট বাট কথা শুনলে তোমাকে সিনিয়র সিনিয়র লাগে। হোয়াই?
— ইউ নো বেস্ট। আমি এখানে সিনিয়র-জুনিয়র কথা বলতে আসিনি। মূলকথায় ইতি টেনে ঘটনার এন্ডিং চাচ্ছি। পরিবাকে জানাও।
— পরিবার তো মানবে না,
— কেনো মানবে না? না বলে কেনো আগেভাগে ডিশিসন নিচ্ছো?
— তো কি করি? আম্মু রূপকে পছন্দ করেনা। ওর এক্সের সাথে আম্মুর কিভাবে কিভাবে যেনো কথা হয়েছে এরপর থেকে আম্মু ওর সাথে চলাফেরা একদম সহ্য করতে পারেনা।
— ওই এক্স এমনে এমনেই তোমার আম্মুর সাথে যোগাযোগ করে ফেললো? ঘাপলা লাগে না?
— লাগে তো কিন্ত কি করবো, সবই কাকতলীয় ভাবে ঘটে যাচ্ছে। প্ল্যান মোতাবেক কিচ্ছু হচ্ছেনা।
— বেকুবের মতো ফাউল প্ল্যান বানালে ওগুলোকে প্ল্যান না বলে নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারা বলে।
— ব্রো কিছু করো প্লিজ। আই বেগ ইউ।
— হাতজোড় করতে হবেনা। তুমিও যেই নৌকায় পা দিয়েছো আমিও সেই নৌকার সাফারী। দ্যাটস হোয়াই আমাদের যা করতে হবে সব একজোট হয়ে করাই বেস্ট। এম আই ক্লিয়ার?
— ইয়েস।
— শোনো তোমার বাইকের চাবিটা কিছুদিনের জন্য আমার কাছে থাকবে। আমি জাস্ট এক সপ্তাহ টাইম নিবো। এই সময়ের ভেতরে যদি সব ঠিক করতে পারি তাহলে আমাদের গন্তব্যে পৌছানোর চান্স আছে। ক্লিয়ার?
— তুমি কি করতে চাচ্ছো?
— নাথিং!
সাদ কিছু খোলামেলা বলতে চাইলো না। নিবির ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো গাধা তা বুঝা শেষ। বাইরে এখন যাওয়া যাবে না। আর বাসায় না পৌছলে মা টেনশন করবে। অনেকদিন হলো মাকে দেখতে যাওয়া হয়না। সাদ বাইরে যাওয়ার মতো বুদ্ধি এঁটে রূপের উদ্দেশ্যে হন্তদন্ত হয়ে বললো,
— রূপ! বাড়িতে পুরোনো নিউজপেপার হবে? এক কার্টুন পরিমান?
— হ্যাঁ কিন্তু কেনো?
সাদ রূপকে সবটা বলে যথাযথ কাজ করতে পাঠালো। এদিকে নিবিরকে বললো প্রস্তুত থাকতে। ঠিক পাচঁ মিনিটের মাথায় নাকে কাগজ পোড়ার গন্ধ এলো। গলা উচিয়ে ‘আগুন আগুন লেগেছে!!!’ বলে চিল্লাচিল্লি শুরু হলো। সাদ নিবিরকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো বাইরে নিয়ে যেতে।
‘কোথায় আগুন লাগলো, কিরে?’ বলতে বলতে সবাই ছুটে গেলো কিচেনের দিকে। ওমনেই নিবির দ্রুতবেগে পা পালিয়ে সবার চোখে ধূলো মেরে সাদকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চালিয়ে সাদকে নিজের বাসার গেটে ছেড়ে গাড়ির সিটে বসে নিবির সাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
— বাসায় কেউ আছে? তুমি একা এই একতলা বাসায় থাকবে?
সাদ গেটের জালি দরজা আটকাতে আটকাতে বললো,
— ভেতরে মা আছে। আমি একা থাকবো না।
নিবিরের কৌতুহল জাগলো সাদের মাকে দেখার জন্য। সাদ কখনো ওর মাকে নিয়ে কথা উঠায় না। কারন কি? নিবিরের একঝাক প্রশ্ন ছুড়ার ইচ্ছা হলেও কেবল একটা প্রশ্ন করতে পারলো।
— তোমার মা কি করে সাদ? সে কি হাউজওয়াইফ?
সাদ মৃদ্যূ হেসে বললো,
— নো, সি ইজ এ্যা ফাইটার ওমেন। ফায়ার ফাইটার। আচ্ছা আল্লাহ্ হাফেজ। চলি।
সাদ খুড়িয়ে খুড়িয়ে দরজার দিকে হাটা ধরলো কিন্তু একজোড়া চোখ এখনো সাদের কথায় থমকে আছে। সাদের বাবা নেই! ওর মা একজন বিধবা! কিন্তু বিধবা হয়েও ফায়ার ইউনিটে কাজ করে? মাই গড! সাদের মা একজন ভয়ঙ্কর মহিলা! অবশ্যই ছেলের এই অবস্থা দেখলে উনি ছাড়বেন বলে মনে হয়না। চকচক করা নকশাকার দরজা খুললো একজন তীক্ষ্ম চেহারার মহিলা। লম্বা হাইট, পড়নে আকাশী রঙের ঢোলা মেক্সি, মাথায় ঘোমটা, চোখে বর্গাকার গ্লাসের চশমা। মহিলাটা শক্ত কন্ঠে কপাল কুচকে বললো,
— তোর এই অবস্থা কেন?
সাদ কাধ বাকিয়ে নিবিরের উপস্থিতি আড়চোখে বুঝলো, নিবির উন্মুখ দৃষ্টিতে ওদের দেখছে। সাদ মায়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
— মা? ভেতরে যেয়ে কথা বলি?
সাদের মা সাইয়েদা আফরোজ দরজা ছেড়ে সাদকে ঢুকলেন দিলেন। সাদ ভেতরে চলে গেলে নিবির আরেকবার স্পষ্ট নজরে সাদের মাকে দেখতো পেলো। খুবই ধারালো চেহারা মহিলার। খুবই কঠোর স্ট্রিক্ট চাহনি! চোখের মনিতে যেনো আগুনে ছটা পুষে রাখা। এমন মহিলা যদি একবার শুনে, সাদ রাহাতের কাছে ধোলাই খেয়েছে! রাহাত পটল তুলে কিনা কে জানে? মেরে গুম করে ফেলতেও পারে! নিবির দ্রুত চোখ সরিয়ে থতমত খেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে প্রস্থান করলো। কেনো যেনো সাদের মাকে দেখে বুকের ধুকপুকনি বেড়ে গেছে…ভয়ে গা ছমছম করছে…এসির ভোল্টেজ ফুল দেয়ার পরেও গা চুবিয়ে ঘাম হচ্ছে…ড্রাইভ করা অবস্থায় নিবিরের চোখে বাসার নেমপ্লেটটা ভাসলো। বড় বড় অক্ষরে বোল্ড কালিতে লিখা ছিলো,
‘সাইয়েদা মন্জিল’
—- স্টাফ অফিসার,
—- ফায়ার সার্ভিস।
-চলবে
(সাদের পরিবার নিয়ে যারা উৎসুক ছিলেন না? এইযে শুরু হলো পার্ট)