স্বপ্নচারিণী,পর্ব-২,৩

0
3088

স্বপ্নচারিণী,পর্ব-২,৩
লেখিকাঃ সামান্তা সিমি
পর্ব_২

যূথী বাড়ি গিয়ে কি কি কাজ শেষ করবে তা মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছে।সকালবেলা কলেজ যাওয়ার সময় দেখে গেছে মা’য়ের শরীরটা খুব খারাপ। ঘরে ঢুকেই আগে মা’কে ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়াবে।তারপর অন্য কাজ।মাঠ পেরিয়ে ঝোপঝাড়ে ঢাকা রাস্তায় পৌঁছাতেই সামনের মানুষটাকে দেখে থেমে গেল যূথী।
গ্রামের গুন্ডা নামে খ্যাত যে ছেলেটা সে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কাসেম যূথীর জন্য অপেক্ষা করছে।মুহূর্তেই যূথীর মেজাজটা বিগড়ে গেল।এই গুন্ডাটা তাহলে গ্রামে চলে এসেছে! এতদিন নিশ্চিন্ত মনে সে কলেজে যাওয়া-আসা করেছে।কিন্তু এখন থেকে আবার এই বদ ছেলের নোংরা কথাগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে সহ্য করতে হবে।

—কিরে যূথী! তোর রূপ তো দেখি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।কয়েকদিন গ্রামে ছিলাম না।আর আজ এসেই এমন চমক দেখব ভাবতে পারিনি।

কাসেমের এমন ফাইজলামি কথাবার্তা শুনে যূথীর গা ঘিনঘিন করে উঠল।বইয়ের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে বলল,

—এভাবে রাস্তায় আমাকে বিরক্ত করবেন না এই কথাটা আর কতবার বললে শুনবেন কাসেম ভাই?

—আচ্ছা? তাহলে রাস্তায় না দাঁড়িয়ে তোকে ঘরে গিয়ে বিরক্ত করলে কেমন হয়?

কাসেমের সাথে কথা বলতে গেলেই যূথীর রুচিতে বাঁধে।এই ছেলের মত এমন নোংরা মন-মানসিকতার মানুষ আর দুটা দেখেনি সে।চোখ গরম করে বলল,

—লজ্জা করে না আপনার? গত মাসেও তো চেয়্যারম্যানকে বলে আপনাকে সাবধান করেছিলাম আমি।তারপরও কিভাবে এই মুখটা নিয়ে আমার সামনে আসেন?

—তোর তেজ দেখি খুব বেড়ে গেছে, তাই না? চিন্তা করিস না।মেয়েদের তেজ কিভাবে কমাতে হয় সেটা এই কাসেম খুব ভালো করে জানে।

রাগে গজগজ করতে করতে কাসেম উল্টো পথে হাঁটা দিল।যূথী চোখ-মুখ শক্ত করে কাসেমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।দিনদিন এই বদ ছেলের অসভ্যতামি বেড়েই চলেছে।হঠাৎ করেই যূথীর বাবার কথা মনে পরল।মাথার উপর বাবার ছায়া নেই বলেই হয়তোবা আজকে রাস্তা -ঘাটে এভাবে কাসেমের মত ছেলেদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়।

* বাড়ির সামনে আসলেই তাঁর মনটা কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।তাঁর বাবা এমন এক জায়গায় ঘরটা তুলেছে যে একদম লোকালয়ের বাইরে।পায়ে হেঁটে দুই মিনিটের পথ গেলে তবেই শীলাদের বাড়ি।মাঝেমাঝে নিজের এই বাড়িটাকেই যূথীর ভুতুড়ে লাগে।
ঘরে ঢুকে যূথী মা’কে ডাকতে লাগল।

—মা! শরীর এখন কেমন? উঠে বসতে পারবে?

তাঁর মা’য়ের কোনো সাড়াশব্দ নেই।মনে হচ্ছে যেন চোখ বন্ধ করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।যূথী ভাবল হয়তোবা শরীর এখনো দূর্বল তাই এভাবে ঘুমাচ্ছে।থাক আগে রান্না শেষ করুক তারপর মা’কে ডেকে তুলা যাবে।
টিউবওয়েল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে যূথী রান্নাঘরের ঝুপড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

* রান্না শেষ করে একটা থালায় ভাত,আলু ভর্তা আর একবাটি ডাল সাজিয়ে নিল যূথী।তাঁর মা এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। যূথী ভাতের থালা পাশে রেখে আস্তে করে ডাকতে লাগল,

—আর কত ঘুমাবে মা? মা?

যূথীর কেমন একটা সন্দেহ হলো।।আগে তো এত ডাকাডাকি করা লাগত না।সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় সে পালস্ রেট যাচাই করার জন্য মা’য়ের হাত স্পর্শ করল।তৎক্ষনাত যূথীর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল।
তাঁর মন এবং মস্তিষ্ক দুটোই ভয়াবহ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় উড়না লেগে পাশে রাখা জলের গ্লাস উল্টে পরে গেল।কিন্তু যূথীর সেদিকে ধ্যান নেই।শ্বাস বন্ধ করে সে ছুটতে লাগল লতিফা চাচীর বাড়ির দিকে।

* লতিফা বেগম উঠোনে দাঁড়িয়ে তাঁর আপার সাথে গল্প করছিল।হাতের ভেজা কাপড়গুলো দড়িতে মেলে দিয়ে বলল,

—আরো কয়েকদিন থেকে যাও আপা।কতদিন পর আসলে তুমি!

—না লতু! আমার ছেলেদের তো চিনিস! এখানে আসার আগেই হুমকি দিয়ে দিয়েছে দুইদিনের বেশি থাকা যাবে না।

—তোমার দুই ছেলেকে দেখি না অনেক বছর হলো।

—দেখবি কিভাবে? ওরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পা মাড়াতে চায় নাকি! দুজনই নিজেদের ডিউটি নিয়ে ব্যস্ত।

লতিফা বেগম উত্তরে কিছু বলতে নেবেন তখনই দেখেন যূথী উর্ব্ধশ্বাসে দৌড়ে এদিকেই আসছে।মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে নীলুফা চৌধুরী এবং লতিফা বেগম দুজনেই ঘাবড়ে গেলেন।
লতিফা বেগম যূথীকে কাছে টেনে বললেন,

—যূথী! কি হয়েছে? এমন পাগলের মত ছুটছিস কেনো?

নীলুফা চৌধুরীও একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।এদিকে আতংকে যূথীর মুখ দিয়ে কথা বের হতে চাইছে না।

—মা! মা’য়ের কিছু হয়েছে চাচী।একটু দেখে যাও না!

এই কথা শুনে দুইবোন যূথীর পেছন পেছন যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
তাঁরা যখন ঘরে ঢুকল তখন দেখল ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাতের থালায় কয়েকটা মাছি ভনভন করে উড়ছে।পাশে বিছানাতেই যূথীর মা আধবোজা চোখে শুয়ে আছে।তিনজনের চেঁচামেচিতে অনেক মানুষই ইতিমধ্যে জড়ো হয়ে গেছে।যূথী মা’কে ডেকেই চলেছে। কিন্তু নিষ্প্রাণ দেহটার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না।
কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে গ্রামের ডিসপেনসারিতে সদ্য জয়েন করা ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসলো।
ডাক্তার তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমাপ্ত করে ঘোষণা দিল যূথীর মা আর এই দুনিয়ায় নেই।
“মা” বলে আর্তনাদ করে উঠল যূথী।ঝাপিয়ে গিয়ে পরল তাঁর মা’য়ের প্রাণহীন শরীরটার উপর।গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে সে।
তাঁর এমন গগনবিদারী চিৎকারে সেখানে উপস্থিত সকলেরই চোখে পানি এসে গেছে।
তিন-চার জন মিলেও যূথীকে ধরে রাখতে পারছে না।কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে জ্ঞান হারালো যূথী।

* প্রকৃতিকে মাঝেমাঝে খুবই নিষ্ঠুর মনে হয়।সে তার নিজের নিয়মে চলে।কারো সুখ-দুঃখ, আনন্দ -বেদনা কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে না।নিজের শৃঙ্খলা বজায় রেখেই সকালে পূর্বদিকে সূর্যের কিরণ ফুটিয়ে তুলে আবার দিনশেষে সন্ধ্যায় সেই প্রজ্জ্বলিত সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে দেয়।কে জন্মেছে, কে মরেছে এসব হিসেব রাখার সময় প্রকৃতির নেই।
প্রকৃতির এই নিয়মের বেড়াজালের রেশ ধরেই রসুলপুর গ্রামেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসলো।ততক্ষণে যূথীর মা’য়ের দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
যূথীদের ঘরটাও যেন আজ নিষ্প্রভ হয়ে আছে।এখনো জ্ঞান ফেরেনি যূথীর।মা’কে হারিয়ে সে যেন তাঁর অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলেছে।চেতনাহীন অবস্থাতেও অস্ফুটস্বরে “মা মা” বুলি আওড়ে যাচ্ছে।
তাঁর পাশে বসে লতিফা বেগম এবং নীলুফা চৌধুরী হাতপাখা দিয়ে সমানে হাওয়া দিয়ে চলেছে।
হঠাৎ করেই জেগে উঠল যূথী।যখনই মনে পরল তাঁর মা আর এই পৃথিবীতে নেই তখনই চোখ বেয়ে বুকভাঙা কান্না নেমে আসলো।

_________________

দুইবোন রাতের খাবার খেতে বসে যূথীকে নিয়ে কথা বলছে।নীলুফা বেগমের সেদিন ঢাকায় ফেরার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি।যূথীর মত একটা সহজ সরল মেয়ের এমন দুর্দিনে ফিরে যেতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না।
প্লেটে তরকারি তুলে লতিফা বেগম বলে উঠল,

—মেয়েটার কপালে সুখ নেই আপা।জ্ঞান হওয়ার আগেই জন্মদাত্রী মা’কে হারালো।তারপর বাবা চলে গেল আর এখন…..

নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত মুখে বললেন,

—মেয়েটার এখন কী হবে রে?

—চুনির বাবা তো বলেছে ওকে এবাড়িতেই রেখে দিতে।কিন্তু ওই বেয়াদপ কাসেমের তা হয়ে উঠবে না।শকুনের নজর দিয়ে রেখেছে যূথীর উপর।

—আমার একটা কথা রাখবি লতু?

—ওমা! অনুমতি চাইছো কেনো আপা?

নীলুফা চৌধুরী দ্বিগুণ উৎসাহে বলে বসল,

—আমি যূথীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই।

এমন একটা কথা লতিফা বেগম হজম করতে পারলেন না।চোখ বড় বড় করে তিনি তাঁর আপার দিকে তাকিয়ে আছেন।

—কি বলছো আপা? মানে তুমি ওকে তোমাদের..

—হ্যাঁ! আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাই।ভেবে দেখ বাবা-মা হীন উঠতি বয়সী একটা মেয়ে গ্রামে থাকলে কাসেমের মত এমন হাজারো শকুনের নজরে পরবে।তাঁর চেয়ে ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই।মেয়েটা যে আমাকেও মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে।

লতিফা বেগম ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন,

—ওকে নিয়ে গিয়ে কি করবে? আপা তুমি ওকে কাজের মেয়ে হিসেবে রাখতে চাইছো না তো! তাহলে আমি যূথীকে কিছুতেই তোমার সাথে পাঠাবো না।এটা আমি বলে দিলাম।

এই কথা শুনে নীলুফা চৌধুরীর মুখ বিরক্ততে ছেয়ে গেল।ভাবছে তাঁর এই বোন এখনো আগের মত সন্দেহবাতিক রোগে আক্রান্ত।

—তুই ভাবলি কি করে এমন ফুলের মত একটা মেয়েকে কাজের লোক বানিয়ে রাখব? আমার বাড়িতে কাজের মেয়ের অভাব পরেছে নাকি? চোখের সামনে একটা মেয়ের এমন খারাপ অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না।আমি চাই যূথী আমার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করুক।একটা ভালো কাজ করার সুযোগ যখন পেয়েছি সেটা আমি হাতছাড়া করব না।তুই কিছু ভাবিস না! যূথীকে আমি নিজের মেয়ের মতই রাখব।

এই কথায় স্বস্তি পেল লতিফা বেগম।তাঁর আপার পরিবার বিশাল বড়লোক।উনি যখন নিজে দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছেন তাহলে যূথীকে নিয়ে চিন্তা লাঘব হবে।

* খাবারের প্লেট হাতে দুইবোন কোণার রুমটাতে প্রবেশ করলেন।জানালার পাশে জড়োসড়ো হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যূথী। আর মাঝেমাঝে কি যেন বিড়বিড় করছে।রুমে যে কেউ ঢুকেছে সেদিকে ওর খেয়ালই নেই।
লতিফা বেগম সন্তর্পণে যূথীর দিকে এগিয়ে গেলেন।গত দুইদিন ধরে যূথী এই বাড়িতেই আছে।লতিফা বেগম বুঝিয়ে সুজিয়ে নিয়ে এসেছেন।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল যূথী।

—লতিফা চাচী! কিছু বলবে?

লতিফা বেগম অনুযোগের সুরে বললেন,

—কিছু বললে তুই শুনিস আমার কথা? এভাবে না খেয়ে চেহারার কি হাল বানিয়েছিস দেখ।তোর মা ভালো মানুষ ছিলেন।তাই আল্লাহ তাঁকে তুলে নিয়েছেন।আর মন খারাপ করে থাকিস না আম্মু।এই যে খাবারের প্লেট।আমি খাইয়ে দিব।একদম না করতে পারবি না।দেখি হা কর!

যূথী শুকনো হেসে লতিফা চাচীর কাছে গিয়ে বসল।লতিফা চাচী যেন মায়েরই এক প্রতিরূপ। তাঁর মা ও তো তাঁকে কত এভাবে খাইয়ে দিত।পুরনো স্মৃতি মনে করে যূথীর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল।

চলবে……

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৩
সামান্তা সিমি

ঘনবসতিপূর্ণ একটা এলাকার গলি দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে মতিন নামে শহরের টপ লিস্টে থাকা অপরাধীদের একজন।সকল ধরনের ক্রাইমের সাথে খেলে সে। বস্তিতে বাস করা দশ বছরের এক মেয়ে এবং তাঁর মা’কে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করেছে গতমাসে।কোনো কাজই সে অসম্পূর্ণভাবে করে না।কিন্তু ওইদিনের করা সামান্য একটা ভুলের কারণে এই মুহূর্তে তাকে পালাতে হচ্ছে।মা মেয়ে দুটোকে গলা টিপে মেরে তো ফেলেছে কিন্তু বডিগুলো গায়েব না করেই যত ঝামেলা লাগিয়েছে।ফলাফল স্বরূপ তাঁর পেছনে লেগেছে সিআইডি। বহুবার মতিন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছে।কিন্তু সিআইডি’র হাত তো পুলিশের থেকেও লম্বা মনে হচ্ছে।
সেই কবে ধর্ষণ করেছে আর আজ কেমন টেনে টেনে তাঁকে খুঁজে নিয়েছে।শুনেছে ডিপার্টমেন্টে নাকি আবার নতুন ডেপুটি জয়েন করেছে।মতিন কখনো দেখেনি তাঁকে।কিন্তু নাম শুনেছে।
“নাফিজ ইমতিয়াজ নিশান” নামটা অনেকটা ব্যঙ্গ করেই উচ্চারণ করল মতিন।ক্রাইম লাইনে এতবছর ধরে আছে সে।আর এখন এই নিশান নাকি ফিশান এত সহজে ধরে ফেলবে তাঁকে?
কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে ।পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ঢাকায় ফেরা যাবে।নিশান কেনো নিশানের বাপও তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না।ভাগ্যিস আগে আগে খবর পেয়ে গেছিল আজ।নাহলে ঠিক ধরা পরে যেত।তবে জাল টাকার ব্যবসাটা বোধ হয় জলে গেল।সিআইডি যখন একবার হাত দিয়েছে এত সহজে ছাড়বে না।মনে মনে সিআইডির উদ্দেশ্যে কয়েকটা কুরুচিপূর্ণ গালি ছাড়ল মতিন।
ঘিঞ্জি গলি পেরিয়ে খোলা মাঠের কাছে আসতেই মতিন দাঁড়িয়ে গেল। পথের মধ্যখানে একটা প্রাইভেট কারের সাথে হেলান দিয়ে সাদা শার্ট পরিহিত একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।সামনে ফিরে আছে বলে মতিন শুধু পেছনটাই দেখতে পারছে।ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখে বুঝতে পারল ছেলেটা সমানে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। আজকালকার ছেলেদের কাহিনী সে কিছু বুঝে না।এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে প্রমাণ করতে চায় সে কোনো লাট-বেলাটের ছেলে?
মুখ থেকে পানের পিকটা ফেলে দিয়ে মতিন বলল,

—এ ভাই! সাইডে গিয়ে দাড়ান। চলাচলের রাস্তাটা এভাবে দখল করে রাখলে মানুষ হাঁটবে কিভাবে?

ছেলেটা চুল পরিমাণ না নড়ে একই ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে লাগল।মতিন এবার বেশ বিরক্ত হলো।

—আরে আপনি কি কালা নাকি? কানে শুনেন না? কে ভাই আপনি?

—তোর বাপ শালা !

এটা বলেই সামনের ছেলেটা পিছনে ফিরল।হাতের সিগারেটটা দুমড়ে মুচড়ে নিচে ফেলে এগিয়ে আসলো।মতিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বুঝে উঠতেই উল্টো পথে দৌড় লাগাল।কিন্তু কয়েক কদমও ভালোভাবে এগুতে পারল না।মাথায় প্রচন্ড আঘাত তাঁকে কাবু করে ফেলল।ব্যথার জায়গায় হাত দিয়ে লুটিয়ে পরতেই ছেলেটি এগিয়ে এসে মাটি থেকে টেনিস বলটা হাতে নিল।মতিনের বুকে পা রেখে বলল,

—চরকিবাজির মত অনেক ঘুরেছিস।এবার তোর শ্রীঘরবাস করার পালা।

মতিন যন্ত্রণা-ক্লিষ্ট মুখে বলতে চেষ্টা করল,

—তুই-ই তাহলে নিশান! ভাবতেও অবাক লাগছে এমন দুধের শিশু ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে কি খেলনা গুলি চালাতে এসেছে? শোন নিশান! ভালোয় ভালোয় বলছি যেতে দে আমায়।নাহলে তোর কপালে চরম দুঃখ আছে।

এমন কথা শুনে নিশানের রাগে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল।মতিনের মত একটা জঘন্য অপরাধী তাঁকে ভয় দেখাবে এটা সে একদমই সহ্য করতে পারছে না।মতিনকে কলার ধরে উঠিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চড় মেরে বলল,

—কু***বা***!!তুই আগে তোর দুঃখের কথা ভাব! কোনোদিনও যাতে সূর্যের আলো দেখতে না পারিস সেই ব্যবস্থা আমি করব।

তখনই ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র অফিসাররা দৌড়ে আসলো।দুইজন মিলে মতিনকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতে নিয়ে উঠাল।ডিপার্টমেন্টের সবাই নিশানকে যমের মত ভয় পায়।নিশানের গম্ভীর, কম কথা বলা স্বভাবটা ওদেরকে সবসময় তটস্থ রাখে।কিন্তু জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে হিমেশ নামের ছেলেটা নিশানকে এক ছটাকও ভয় পায় না।উল্টে নিশানের এরকম স্বভাবকে নিয়ে সবার সাথে ট্রল করতে থাকে।কোনো এক কারণে নিশানও হিমেশকে বেশ পছন্দ করে।

—উফ্ স্যার! কি খেলটাই না দেখালেন।আপনি কখন যে গাড়ি নিয়ে শটকার্ট রাস্তায় এখানে এসে পৌঁছালেন আমরা তো ভাবতেই পারছি না।রিয়েলি ইউ আর গ্রেট স্যার!

এই বলে হিমেশ একটা সিটি মারল।নিশান চোখ পাকিয়ে হিমেশের দিকে তাকাতেই সুড়সুড় করে সে গাড়ির দিকে ছুটে গেল।

__________________

গাড়ির জানালার কাচ দিয়ে একের পর এক বিশাল বিল্ডিং দেখে যূথীর চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে।সে কখনো শহরে আসেনি।তবে ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে এত সুউচ্চ দালান ছিল না।এটাই কি তাহলে ঢাকা শহর?
পাশের সিটেই নীলুফা চৌধুরী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু যূথীর সেদিকে খেয়াল নেই।সে বাইরের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত।রাস্তায় একের পর এক গাড়ি দেখে তাঁর মাথা ঘুরে উঠল।তাঁর কাছে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের বাতাসটা কেমন ভারী ভারী।
গ্রামে চারদিকে প্রকৃতির শীতল বাতাস,মাটির গন্ধ আর শত শত নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনে সারাদিন কাটত যূথীর।
কিন্তু এখানে শুধু গাড়ির হর্ন আর কালো ধোঁয়া ছাড়া কিছুই নজরে আসে না।
তার উপর রাস্তায় মেয়েদের শার্ট জিন্স পরিহিত অবস্থায় দেখে তাঁর চোখ কপালে।এসব জামাকাপড় পরে কেমন করে ছেলেদের সাথে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে। কেউ তো ওদের দিকে লক্ষ্যও করছে না।তাহলে এখানের পরিবেশ কি এমনই?সিথি অবশ্য তাঁকে বলেছিল।
যূথীদের গ্রামের রাস্তায় এমন দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে উঠল সে।গ্রামে যদি এগুলো পরে কেউ বের হয় তাহলে একদম দফারফা হয়ে যাবে।নীলুফা চৌধুরীর ডাকে যূথীর ধ্যান ভাঙল।

—আম্মু! কিছু খাবে তুমি? আরো অনেকটা পথ যেতে হবে কিন্তু।

যূথী মাথা নেড়ে না জানাল।
সেদিন রাতে নীলুফা চৌধুরী যখন যূথীকে ঢাকা যাওয়ার কথা বলল তখন সে দ্বিধায় পরে গেছিল।একবার ভাবল না করে দিবে। কিন্তু নীলুফা চাচীর দিকে তাকিয়ে মনটা সায় দিচ্ছিল না।এই কয়দিনেই উনি কত স্নেহ করেছে যূথীকে।আবার তাঁরও এই গ্রামে আর ভালো লাগছিল না।এই গ্রাম তাঁর সব প্রিয় মানুষদের কেড়ে নিয়েছে।পথে পা ফেললেই হাজারো স্মৃতি যূথীকে তাড়া করে বেড়াতো।তাই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল নীলুফা চাচীর সাথে ঢাকায় চলে যাওয়াই উচিত কাজ হবে।
রসুলপুর গ্রাম থেকে আসার সময় যূথী তাঁদের ঘরটাকে তালা দিয়ে এসেছে।স্মৃতি হিসেবে মায়ের একজোড়া চুড়ি সাথে করে নিয়েছে।আসার সময় বারবার পিছন ফিরে ঘরটাকে দেখছিল।ছোট থেকে বড় হয়েছে এখানে।তাই খুব কষ্ট হচ্ছিল তাঁর।

* প্রায় একঘন্টা পর ওরা পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত জায়গায়।নীলুফা চৌধুরী যূথীকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরলেন।
এত বিশাল একটা লোহার গেট দেখে যূথী অনেকটা হকচকিয়ে গেল।তাঁর অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে নীলুফা চৌধুরী হেসে বললেন,

—চল ভেতরে।ভয় পাচ্ছিস নাকি?আমাদের বাড়িতে তোর বয়সী তিনজন মেয়ে আছে।দেখবি ওরা তোকে কেমন আপন করে নেয়।

নীলুফা চাচীর কথায় ভরসা পেয়ে যূথী উনার সাথে ভেতরে ঢুকে পরল।ভেতরে ঢুকে পাহাড় সমান বাড়িটা দেখে যূথী আবার দাঁড়িয়ে পরল।এখন মনে হচ্ছে তাঁর এখানে না আসা-ই ভালো ছিল।যূথী আগে বুঝতে পারেনি নীলুফা চাচীরা এত ধনী।এখানে কি সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? গ্রামের মেয়ে বলে তাঁকে যদি সবাই দূরে ঠেলে দেয়? যূথী কষ্ট সহ্য করতে পারলেও কারো অবহেলা একদমই সহ্য করতে পারে না।
গুটিগুটি পায়ে সে নীলুফা চাচীকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল বিভিন্ন রকম ফুলে পরিপূর্ণ একটা বাগান।বাড়ির চারপাশটা একটা ছোটোখাটো মাঠের মত লাগছে।ফুলগাছে পানি দিচ্ছিল একটা মধ্যবয়স্ক লোক।যূথীদের দেখতে পেয়ে সে দৌড়ে এসে নীলুফা চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—বড় আপা কেমন আছেন? আপনার তো আরো দুইদিন আগে আসার কথা ছিল।

নীলুফা চৌধুরী হালকা হেসে বললেন,

—গ্রাম থেকে আসতে ইচ্ছে করছিল না।তুমি গাড়ি থেকে আমাদের ব্যাগগুলো নিয়ে আসো তো মিঠু।দুটো ব্যাগ আছে।খেয়াল করে নামাবে।

* বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই যূথী আরেক দফা অবাক হলো।সে বুঝতে পারছে না আজ কি তাঁর অবাক হওয়ার দিন? এমন সাজানো গোছানো প্রাসাদের মত বাড়ি জীবনেও সে চোখে দেখেনি।কি সুন্দর ছবির মত বাড়ি!
দুইজন মহিলাকে এগিয়ে আসতে দেখে যূথী নীলুফা চাচীর দিকে একটু চেপে আসলো।অল্প বয়সী মহিলাটা বলল,

—বড়আপা তুমি অবশেষে আসলে? আমি তো ভাবলাম এখন থেকে তুমি গ্রামেই থেকে যাবে।আর এই মেয়েটা কে? গ্রাম থেকে নতুন কাজের মেয়ে নিয়ে এসেছো বুঝি?

যূথী আহত মন নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল।সে ভাবে নি এই বাড়িতে তাঁর আগমন এই রূপে ঘটবে।তবে কি তাঁর ধারনাই ঠিক? এরা তাঁকে দূরে ঠেলে দিবে?
নীলুফা চৌধুরী রেগে বলে উঠলেন,

—এসব কি ধরনের কথা বিথী? গ্রাম থেকে কাউকে আনলেই সে কাজের লোক হয়ে যায়? আর কখনো যেন এসব কথা না শুনি।

তিনি যূথীকে সামনে টেনে এনে বললেন,

—এ হচ্ছে বিথী।আমার ছোট জা।তুমি ওকে ছোট মা বলে ডাকবে।আর এ হচ্ছে আশা। একে ডাকবে মেজো মা।আমাকেও আর চাচী না ডেকে বড় মা বলবে কেমন?
আশা চৌধুরী হেসে বললেন,

—বড়আপা ওকে নিয়ে উপরে যাও।অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো তোমরা।

যূথী বড় মা’র হাত ধরে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল।বাড়ির প্রতিটা জিনিস এত সাদা! তাঁর গায়ের শ্যামলা রঙটা যেন প্রতিটা জিনিসের কাছে হার মেনে বসে আছে।
বড় মা তাঁকে দুতলার কোণার একটা রুমে নিয়ে গেল।দরজা খুলতেই দেখা গেল যূথীর বয়সী তিনটা মেয়ে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পরছে।যূথীর কাছে প্রত্যেকটা মেয়েকে পুতুলের মত লাগছে।বাড়ির মত প্রত্যেকটা মানুষও কি সুন্দর?
কিন্তু যূথীকে দেখেই মেয়েগুলো কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।সে ভীত চোখে পাশে দাঁড়ানো বড় মা’র দিকে তাকাল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here