স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৪,৫

0
3058

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৪,৫
সামান্তা সিমি
পর্ব_৪

যূথীকে দেখেই মেয়েগুলো কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।সে ভীত চোখে পাশে দাঁড়ানো বড় মা’র দিকে তাকিয়ে রইল।কিন্তু বড়মা কিছু বলার আগে মেয়ে তিনটা লাফাতে লাফাতে সামনে এসে বলল,

—হ্যালো যূথী! কেমন আছো? আমরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

কৌতুহলী চোখে যূথী আবার বড়মা’র দিকে তাকালো।সে বুঝতে পারছে না মেয়েগুলো তাঁর নাম জানলো কি করে।
যূথীর মনের ভাব বুঝতে পেরে নীলুফা চৌধুরী বলে উঠলেন,

—ওদের আমি ফোনেই সব বলে দিয়েছিলাম।বাড়ির আর কেউ তোর ব্যপারে জানতো না।এই তিন বান্দর তোর সমবয়সী। তুই এদের সাথে পরিচয় হয়ে নে।আমি একটু আসছি।

নীলুফা চৌধুরী বেরিয়ে যেতেই মেয়ে তিনটা যূথীকে ঘিরে ধরল।যূথীর হাত ধরে বেডে নিয়ে বসিয়ে তিনজনের মধ্যে একজন বলল,

—এরকম জড়োসড়ো হয়ে আছো কেনো যূথী?চলো আমরা পরিচিত হই।আমি মনীষা।এর নাম বিদীষা আর ও হলো নীলিমা৷

যূথী আড়চোখে মনীষা, বিদীষা এবং নীলিমার পোশাকের দিকে তাকালো।তিনজনই থ্রি কোয়ার্টার জিন্স এবং শর্ট হাতার গেঞ্জি পরে আছে।সে নিজে পরে আছে মেরুন কালারের একটা সুতি থ্রি-পিস। ওদের সাথে তাঁর কত ব্যবধান!
যূথীকে চুপ থাকতে দেখে মনীষা আবার বলল,

—বড়মা’র দুই ছেলে।দুইজনই স্টাব্লিস।আর আমি এবং বিদীষা এই বাড়ির মেজো বউ মানে তুমি যাকে মেজো মা বলবে তাঁর ছেলেমেয়ে।বিদীষা এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।নীলিমা এবং শাফা ছোট মা’য়ের।সাফা এখন স্কুলে আছে।তাই ওকে দেখনি।আমি এবং নীলিমা কিন্তু তোমার সমবয়সী।আর বড় আব্বু, আমার বাবা এবং ছোট আব্বু তিনজনই বিজনেস করে।এই হলো চৌধুরী ম্যানশনের পরিচয় পর্ব।

যূথী হা হয়ে তাকিয়ে আছে মনীষার দিকে। এই মেয়ে তো তাঁকে পুরো ইতিহাস শুনিয়ে দিল।তবে মেয়েগুলো বেশ মিশুক।তাদের সাথে যূথীর খুব ভালো ভাব হয়েও যেতে পারে।
মনীষা যূথীর জন্য একটা রুম সিলেক্ট করে রেখেছিল।যূথীকে রুমে রেখে তিন বোন নিচে চলে গেল।
ছোট ছিমছাম একটা কামরা।সাথে লাগোয়া বারান্দা এবং ওয়াশরুম। ওয়াশরুম দেখতে পেয়েই গোসলে যাওয়ার জন্য যূথীর মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।এমনিতেই ঘামে ভেজা শরীরের সাথে জামা লেগে আছে।

গোসল শেষ করে যূথী ওড়না দিয়ে সুন্দর করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিল।অচেনা বাড়ি কখন কার সামনে পরে যাবে বলা যায় না।
গুটিগুটি পায়ে সে মনীষার রুমে হাজির হলো।কিন্তু তিনবোনের একজনও নেই এখানে।যূথী বেডে বসে রুমের আসবাবপত্র গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

—“বিদীষা আমার ল্যাপটপ কোথায় লুকিয়েছিস! আজ যদি হসপিটাল যেতে লেট হয় তাহলে তোদের তিনোটার কান আমি ছিড়ে নেব।”

এমন পুরুষালি কথার আওয়াজ শুনে যূথী স্টিল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।পেছন ফেরে দেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে উক্ত কথা গুলো বলতে বলতে একটা ছেলে রুমে প্রবেশ করেছে।
ফোন থেকে মাথা তুলে যূথীকে এমন ভয়ার্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেটাও চুপ করে গেল।
যূথীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহমিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করল,

—হু আর ইউ?

যূথী কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরেনি।ছেলেটার প্রশ্নের কি উত্তর দিবে বা কি উত্তর দেওয়া উচিত কিছুই সে বুঝতে পারছে না।উড়নার কোণা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। যদি তিনবোনের কেউ একজন এসে যায় তো বেঁচে যাবে সে।এই ফর্সা ছেলেটার ভ্রুকুটি দেখে তাঁর অস্বস্তি আরো বেড়ে যাচ্ছে।
ছেলেটা আবার প্রশ্ন করে বসল,

—হ্যালো মিস! আপনি কে? এখানে কি করছেন?

তখনই বিদীষা নুডুলসের বাটি হাতে রুমে প্রবেশ করল।বিদীষা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—ভাই! যূথী আপুকে এমন জেরা করছো কেনো? সে ভয় পেয়ে যাচ্ছে তো!

ছেলেটি কিছু একটা ভেবে বলল,

—ওহ্! আই সি।তুমিই যূথী।তোমার কথাই আম্মু তখন বলছিল।আ… স্কিপ ইট।হ্যালো যূথী! আই এম মাহির।মাহিরুজ্জামান মাহির।এ বাড়িতে এসে তোমার ভালো লাগছে?

যূথী মাথা নাড়তেই বিদীষা বলল,

—তুমি এখন যাও ভাইয়া।আমি একটু পর আসছি তোমার রুমে।

—তাড়াতাড়ি আয়।ল্যাপটপ কোথায় লুকিয়েছিস ফাজিলের দল! দিনদিন বেশি শয়তান হয়ে যাচ্ছিস।মেজোমা’কে বলে তোদের কানমলা না খাইয়েছি!

বকবক করতে করতে মাহির বের হয়ে গেল।নুডুলসের বাটি যূথীর হাতে দিয়ে বিদীষা বলল,

—খেয়ে নাও।আর এই যে ছেলেটাকে দেখলে ও হচ্ছে বড়মা’র ছোটটা।মাহির ভাইয়া।পেশায় একজন ডক্টর। কিন্তু আচার-আচরণে একটা বাচ্চার থেকেও অধম।দেখলে না কিভাবে নিজের মত করে থোরোলি কথা বলে গেল।ওকে দেখলে বুঝা যায় ও ডক্টর? তবে এমনিতে আমাদের সাথে একদম ফ্রি মাইন্ডে থাকে।

যূথী হালকা হেসে খাওয়ায় মন দিল।পরক্ষণেই বিদীষা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,

—এই বাড়ির আরেকজন সম্পর্কে তো তোমায় এখনো কিছুই বললাম না।

—কে?

—মাহির ভাইয়ার বড় ভাই নিশান ভাইয়া।বাপরেহ্! নাম উচ্চারণ করলেও আমার গলা শুকিয়ে উঠে।এ বাড়ির সব ভাই-বোনদের মধ্যে বড় সে।ভাইয়া যতক্ষণ বাড়িতে থাকে আমরা চার বোনের কেউই দরকার ছাড়া রুম থেকে বের হই না।সাপোজ ভুলক্রমে ভাইয়ার মুখোমুখি হয়ে গেলাম খুব আতংকে থাকি তখন।কখনো কখনো পড়াশোনার খবর জিজ্ঞেস করে।আবার মাঝেমধ্যে রুমে এসে আমাদের তিনজনের পড়া নেয়া শুরু করে।সেদিন তো আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়।পড়া না পারলে ঠাস ঠাস চড় খেতে হয়।সাফা ছোট বলে বেঁচে যায়।

যূথী অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল।কে এই রাক্ষস লোক যে নিজের বোনেদের এভাবে মারে? এত বড় মেয়েগুলোর উপর হাত তোলা যায় নাকি?একটা ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,

—কি ভয়ানক ব্যপার! উনি দেখতেও বুঝি ভয়ংকর?

—নো নো বেবি। ভাইয়াকে দেখলে তো মেয়েরা ফিদা হয়ে যায়।ভাইয়াদের ডিপার্টমেন্টে মিমি নামে একটা মেয়ে আছে।উনি ভাইয়াকে একদম চোখে হারায়।কিন্তু নিশান ভাইয়ার রাগী স্বভাবের জন্য ধারে কাছে যাওয়ার সাহস পায় না।

—ডিপার্টমেন্ট মানে?

—ও তোমাকে বলা-ই হয় নি ভাইয়া সিআইডি ডিপার্টমেন্টে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল পদে আছে।নিজের দক্ষতা দিয়ে একদম ডেপুটিতে উঠে গেছে।আচ্ছা বাদ দাও।এখন নিচে চলো।

* সারদিন যূথী চারবোনের সাথে হেসে-খেলে কাটিয়ে দিল।নীলিমার ছোট বোন সাফা এবার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।খুব মিষ্টি মেয়েটা।যূথীর সাথে সহজেই মিশে গেছে।এ বাড়ির সবাই খুব ভালো।শুধু ছোট মা যূথীর সাথে প্রায়ই কড়া করে কথা বলছে।
দুপুরে যখন যূথী নিচে গিয়েছিল ছোট মা তাঁকে দেখেই ধমকের সুরে বলেছিল,

—এই মেয়ে! গোসল করেছো তো? এত জার্নি করে এসেছো।ধুলাবালি গায়ে মেখে এই রুম সেই রুম ঘুরঘুর করবে না।

যূথী মাথা নিচু করে উত্তর দিয়েছে,

—আমার গোসল করা হয়ে গেছে ছোট মা।

যূথী ভাবল হয়তোবা ছোট মা তাঁকে অতটা পছন্দ করে নি।
রাতে খাওয়ার টেবিলে বড় আব্বু, মেজো আব্বু এবং ছোট আব্বু সবার সাথেই যূথীর পরিচয় হয়ে গেছে।উনারা যূথীর কলেজে ভর্তির ব্যাপারেও আলোচনা করেছে।মনীষা নীলিমা যে কলেজে পড়ে সেখানেই অনার্সে যূথীর ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে।
শহরের মানুষ সম্পর্কে যূথীর একটা বিদঘুটে ভাবনা ছিল।সে মনে করত যে মানুষ যত বড় শহরের হয় সে তত অহংকারী হয়।কিন্তু এ বাড়িতে এসে তাঁর সেই ভুলটা একেবারে ভেঙে গেছে।
রাতে নিজের রুমে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যূথী।কিন্তু পরক্ষণেই মা’য়ের স্মৃতি মনে করে মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল।মা আজ কতদিন হয়ে গেল মা তাঁর পাশে নেই।
_________________

নিশান প্রতিদিনই বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে।অফিসে বিভিন্ন কেসের ফাইল দেখতে দেখতে বেশ লেট হয়ে যায়।মেইন ডোর দিয়ে ঢুকেই ডাইনিং টেবিলের দিকে নজর গেল।নীলুফা চৌধুরী খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে।নিশান কিছুটা বিরক্তবোধ করল।প্রত্যেকদিন অফিস যাওয়ার আগে বারবার করে বলে যায় কেউ যাতে তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে।অথচ তাঁর মা ডেইলি এই কাজটা করবে।
নিশান কিছুটা শব্দ করেই ডাইনিং টেবিলের দিকে গিয়ে এগিয়ে গেল।
নীলুফা চৌধুরী ডাইনিংয়ে বসে ঝিমাচ্ছিলেন। শব্দ হতেই চোখ মেলে নিশানকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল।আজ কতদিন পর ছেলেটাকে দেখলেন।
নিশান জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,

—আমার খাবারটা প্লেটে দাও।রুমে খেয়ে নিব।ডেইলি এভাবে বসে না থেকে ঘুমিয়ে পরলেই পারো।

নীলুফা চৌধুরী হাসি মুখে বললেন,

—তুই রুমে যা। আমি নিয়ে যাচ্ছি। বাবু শোন! একটা কথা বলার ছিল।আমি আজ একটা খুব বড় কাজ করে ফেলেছি।বাড়ির সবাই এটাতে কোনো আপত্তি করেনি।শুধু তোর মতামত জানার বাকি আছে।

নিশান চেয়ার টেনে বসতেই নীলুফা চৌধুরী উৎসাহের সহিত যূথীর ব্যপারে সমস্ত কথা খুলে বললেন।
সব শুনে নিশান শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,

—ভালো করেছো।আমি রুমে যাচ্ছি।

নিশান সিড়ি দিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দিল।নিশানের এরকম শটকার্ট কথা শুনে নীলুফা চৌধুরী অবাক হননি।কারণ এ বাড়ির সবাই জানে নিশানের স্বভাব।কিন্তু নীলুফা চৌধুরী তাঁর বড় ছেলের প্রতি একটু বেশিই মমতা বোধ করেন।চাপা স্বভাবের ছেলেটা সব কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে।
রাগী মানুষরা কখনো মন খুলে কোনো কথা প্রকাশ করতে পারে না।

* ডিনার করে নিশান ছাদে রওনা দিল।ডেইলি ঘুমানোর আগে সিগারেট টানা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস।এই একটা জিনিসই তাঁর অন্তরঙ্গ সঙ্গী। এমনও হয়েছে সারারাত সে চেইন স্মোকারদের মত সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে।তাঁর এমন নেশাখোরের মত অভ্যাস দেখে যে কেউ ভাবতে পারে হয়তো নিশান কোনো গভীর কষ্টে আক্রান্ত।কিন্তু আসলে তা না।
তাঁর মাথায় অলওয়েজ ঘুরতে থাকে ক্রাইম,ক্রিমিনাল এবং ক্রিমিনালদেরকে উদ্দেশ্য করে অসংখ্য গালিগালাজ। ?
ছাদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে নিশান সিগারেটে একের পর এক টান দিয়ে শুন্যে ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে।

* এদিকে যূথী বিছানায় এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে। তাঁর চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই।নতুন জায়গায়,নতুন পরিবেশে এসে তাঁর ঘুম হাওয়া হয়ে গেছে।
রাতের বেলা গ্রামে ঝোপের আনাচে-কানাচে বেসুরে গলায় ডাকতে থাকা ঝিঝি পোকার গান, মাঝে মাঝে পাশের জঙ্গল থেকে রক্ত হিম করা কানাকুয়া পাখির ডাক শুনে ঘুমাতে অভ্যস্ত সে।
যূথী ঠিক করল একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? বিকেলে তো নীলিমাদের সাথে ছাদে গিয়েছিল একবার।তাহলে এখনও ঠিক চিনে চলে যেতে পারবে।যেই ভাবা সেই কাজ।যূথী দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

চলবে……….

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_৫

আকাশে চাঁদ ডুবে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।ছাদের চারপাশটা আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে।শুধু একপাশে ফেইরি লাইটের আলো জ্বলছে।
যূথী পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে ছাদের দরজার সামনে চলে আসলো।ছাদের দরজা খোলা দেখে সে কিছুটা অবাক হলো।ভাবছে এরা কি রাতে দরজা খোলা রাখে নাকি!
ছাদে পা রেখে ডানে মোড় নিতেই থেমে গেল যূথী।অপর পাশের ফেইরি লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রেলিঙে হেলান দিয়ে কোনো পুরুষ লোক সামনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ে যূথীর কপালে ঘাম জমে উঠল।লোকটা কি এই বাড়ির? একটা মানুষ এত্ত লম্বা কি করে হতে পারে? বাড়িতে তো এত লম্বা কাউকে দেখেনি। কোনো জ্বীন-ভূত নয়ত আবার!
যূথী বড়সড় একটা ঢোক গিলল।
কিন্তু পরক্ষণেই বাতাসের সাথে সিগারেটের কটু গন্ধ তাঁর নাকে লাগল।সাথে সাথেই চোখ মুখ কুচকে ফেলল যূথী।তাঁর মানে এটা জ্বীন-ভূত নয়।ভূতেরা কখনো সিগারেট টানতে পারে না।
ছোটবেলা থেকেই যূথী সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না।তাঁর বাবা যখন এই পঁচা জিনিসটা খেত তখন সে দূরে দূরে থাকত।সিগারেট খাওয়ার ছয়-সাত ঘন্টা পরও সে বাবার আশেপাশে যেত না।
এই লোকটা তো তাঁর থেকে কত দূরে দাঁড়িয়ে আছে তবু অসহ্যকর গন্ধটা তাঁর নাকে এসে হামলা করছে।যূথী সিদ্ধান্ত নিল রুমে ফিরে যাবে।
সিড়িতে পা রাখতে গিয়েই হঠাৎ তাঁর পা ফসকে গেল।ব্যথা পেয়ে যূথী “আহ্” শব্দ করে উঠল।

* দূরে টাওয়ারের মাথায় জ্বলজ্বল করতে থাকা লাল বাতিটার দিকে তাকিয়ে কোনো এক ভাবনায় বিভোর ছিল নিশান।তখনই মেয়েলি কন্ঠের অস্পষ্ট একটা আর্তনাদ কানে আসলো তাঁর।ব্রেইন বলছে শব্দটা সিড়ির মাথা থেকে এসেছে।হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সেখানে এগিয়ে গেল নিশান।
আধো অন্ধকারে দেখতে পেল কেউ একজন উবু হয়ে ফ্লোরে বসে কিছু একটা করছে।অন্ধকার থাকার কারণে চেহারা ভালেভাবে দেখতে পারছে না।
সাথে সাথেই সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল,

—হো ইজ দেয়্যার?

যূথী চমকে মাথা তুলে উপরে তাকাল।একজোড়া রক্তচক্ষু নিয়ে সামনের লোকটা দেখছে তাঁকে।পায়ে ব্যথা পাওয়াতে নিচু হয়ে পা ঘষায় ব্যস্ত ছিল সে।কিন্তু এখন এসব ফেলে রেখে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে পরল।এই লোকটাই কি তাহলে নিশান? যার ভয়ানক কাহিনী তখন বিদীষা থেকে শুনেছিল!নিশ্চয়ই তাঁর গলা শুনে ফেলেছে লোকটা!
নিশান এখনো যূথীর চেহারা স্পষ্ট দেখেনি।তবে এটুকু বুঝেছে এই মেয়েটা তাঁর তিন বোনের একজনও নয়।ওরা এত রাতে ছাদে আসার সাহস দেখাবে না।তাঁর মানে এটা যূথী নামের সেই মেয়েটা।
যেখানে মনীষারা তাঁর ভয়ে এত রাতে ছাদের কিনারাও মাড়ায় না তো এই মেয়েটা কিভাবে আসলো।

—এটাই লাস্ট! আর যেন কখনো রাতের বেলা ছাদে না দেখি।

এমন একটা হুমকি শুনে যূথী ভয়ে জমে গেল।কোনো উত্তর না দিয়ে দৌড়ে চলে এল ছাদ থেকে।রুমে এসে দরজা বন্ধ করেই হাঁপাতে লাগল।ভাবছে নিশান নামের লোকটা তো পুরোই যমের মত।যূথী তো এই বাড়িতে নতুন এসেছে।সে কি আর জানে যে রাতের বেলা ছাদে যাওয়া নিষেধ! মাহির ভাইয়া আর এই লোকটা তো একদম ভিন্ন গ্রহের মানুষ।কি হাসিখুশি মাহির ভাইয়া!অথচ উনার কথা শুনে তো তখন যূথীর গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিল।দুনিয়াতে যে কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষ আছে সেটা এ বাড়ির লোকজনদের দেখলেই বুঝা যায়।

____________________

দরজায় ধুমধাম আঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যূথীর।লাফ দিয়ে উঠে বসে আগে ঘড়ি দেখল।গ্রামে থাকতে তো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেত।কিন্তু এখানে এসে তাঁর ঘুমের নিয়ম একদম পাল্টে গেছে।
দরজার খুলে দিতেই মনীষা, বিদীষা এবং নীলিমা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পরল।
নীলিমা যূথীর গাল টেনে বলল,

—গুডমর্নিং যূথী!

যূথী মুচকি হেসে উত্তর দিল,

—গুডমর্নিং নীলিমা।

—গোসল করে চটপট রেডি হয়ে নাও।আমাদের সাথে কলেজে যাবে তুমি।আব্বু তোমাকে ভর্তি করিয়ে দিবে আজ।

যূথীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।কত ভালো মানুষগুলো! কিভাবে ওদের ঋণ শোধ করবে সে?
কাল রাতের কথা মনে পড়তেই যূথী বলে উঠল,

—মনীষা কাল রাতে আমার ঘুম আসছিল না।তাই ভাবলাম ছাদ থেকে ঘুরে আসি।কিন্তু ছাদে গিয়ে দেখি…

তিনবোন একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠল।কারণ ওরা জানে নিশান রাতের বেলা ছাদে নিজের মত করে সময় কাটায়। কেউ গেলে সে খুবই বিরক্তবোধ করে।
যূথী আবার বলল,

—ওটাই নিশান ভাইয়া ছিল তাই না?আমাকে দুটো কড়া করে শুনিয়ে দিয়ে বলেছে রাতে যেন আর কখনো ছাদে না যাই।

—জোর বাঁচা বেঁচে গেছ যূথী।তোমার জায়গায় আমরা হলে নির্ঘাত থাপ্পড় খেতাম।যাই হোক এই কাজটা আর কখনো করো না।

মাথা নেড়ে যূথী ” আচ্ছা ” বলল।সে বুঝে গেছে তিনবোন নিশানকে বাঘের মত ভয় পায়।অবশ্য ভয় পাওয়ারই কথা।রাক্ষস লোক একটা!

* ভর্তির কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরতে বারটা বেজে গেল।মনীষা বিদীষার ক্লাস থাকায় ওরা আসেনি।যূথী একাই ড্রাইভারের সাথে চলে এসেছে।
রুমে এসে গোসল করে বের হতেই দেখল বিছানায় সাফা বসে আছে।যূথীকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

—নিচে চলো যূথী আপু! বড়মা তোমাকে ডাকছে।

—কোনো জরুরি দরকার বুঝি?

—এটা তো আমি জানি না আপু।

যূথী ভেজা চুলগুলো ঠিক করে সাফার সাথে নিচে চলে এল।নীলুফা চৌধুরী এবং বিথী চৌধুরী সোফায় বসে গল্প করছিলেন।বিথী চৌধুরীকে দেখে যূথী কিছুটা অস্বস্তিতে পরে গেল।যূথীর সবসময়ই মনে হয় ছোট মা তাঁকে দেখলেই বিরক্ত বোধ করে।
বড়মা যূথীকে কাছে ডেকে বললেন,

—বিকেলে মনীষাকে নিয়ে আমি শপিংয়ে যাব।তোর জন্য কিছু জামাকাপড় কিনতে হবে তো!কি ধরনের জামা তোর পছন্দ বল।

—জামা লাগবে না বড়মা।আমার যেগুলো আছে ওতেই হবে।

তখনই ছোটমা চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠল,

—শোনো মেয়ে, এটা তোমার সেই অজপাড়াগাঁ নয়।এটা হলো ঢাকা শহর।যেহেতু এখন থেকে ঢাকা শহরে থাকবে তাহলে এখানকার কালচারের সাথে মিলিয়ে তোমায় চলাফেরা করতে হবে।তুমি যে ধরনের জামাগুলো পরো এগুলো আমার একটুও পছন্দ না তাই আপা যা বলছে সেটাই করো।

যূথী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।এটাতো সে ভেবেই দেখেনি। এ বাড়ির লোকজন কত হাই ফাই জামাকাপড় পরে।সেখানে তাঁর এইসব সুতি থ্রি-পিস কারোরই ভালো লাগার কথা নয়।
যূথী আস্তে করে বলল,

—তোমার যা পছন্দ হয় তা-ই নিয়ে এসো বড়মা।

* সন্ধ্যায় নিজের রুমে বসে নতুন বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল যূথী।তখনই তিনবোনের দলটা হৈচৈ করতে করতে যূথীর রুমে আসলো।মনীষার হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ।বিছানার উপর ব্যাগগুলো রেখে মনীষা বলল,

—এখন থেকে এরকম থ্রি-পিস আর পরা যাবে না।আমরা বাড়িতে থ্রি-পিস পরি না। তাই তুমিও পরবে না।

—তাহলে কি পরবো আমি?

নীলিমা ব্যাগ থেকে একটা ড্রেস বের করে বলল,

—এই যে এটা।এখন থেকে এই শর্ট টপস্ আর লং স্কার্ট পরবে তুমি।আশা করি তোমার পছন্দ হয়েছে?

যূথী হাত বাড়িয়ে জামাটা দেখল।এত কালারফুল আর সফট্ জামা সে কখনো দেখেনি।হঠাৎই তাঁর চোখের কোনে জল জমে উঠল।
যূথীকে কেঁদে উঠতে দেখে তিনবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।ওরা বুঝতে পারছে না এখানে কাঁদার কি আছে।নতুন জামা পেলে কেউ কখনো কাঁদতে পারে এটা ওদের জানা নেই।
যূথীকে জড়িয়ে ধরে বিদীষা জিজ্ঞেস করল,

—কাঁদছো কেনো আপু?

হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে যূথী উত্তর দিল,

—তোমাদের এত ভালোবাসা পাব এটা কখনো ভাবতে পারিনি।তোমরা সবাই খুব ভালো।বাবা-মা হীন এতিম ছেলেমেয়েদের সবাই বোঝা মনে করে।কিন্তু তোমাদের আদর ভালোবাসা দেখে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হয়।

যূথীর এমন কান্নামাখা কথা শুনে মনীষা কিছুটা ধমকের সুরে বলে উঠল,

—নিজেকে কখনো এতিম ভেবো না যূথী।আমরা সবাই তোমার সাথে আছি।

তিনবোন মিলে যূথীকে জড়িয়ে ধরল।

________________

সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই।যূথী আজ কলেজে যাবে।তাই মনীষা আর নীলিমার সাথে রেডি হয়ে নাস্তা করতে চলে এসেছে।
মুখে পাউরুটির টুকরো ঢুকিয়ে যূথী সবার দিকে একবার চোখ বুলালো। বাড়ির মহিলারা যার যার স্বামীর প্লেটে এটা ওটা তুলে দিছে।বড় আব্বু, মেজো আব্বু আর ছোট আব্বু নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনায় ব্যস্ত।মাহির ভাইয়া তো একবার সাফার সাথে একবার বিদীষার সাথে কি যেন বলে একটু পরপর হেসে উঠছে।
যূথী এবার নিশানের দিকে নজর দিল।লোকটা কেমন স্টিল হয়ে বসে আছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খাবার মুখে ঢুকিয়েই যাচ্ছে।যূথী ভাবছে লোকটার চেহারায় একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে কিন্তু সবসময় মুখটাকে পেঁচার মত করে রাখার কারণে সেই সৌন্দর্য ম্লান হয়ে থাকে।এমন কেন লোকটা?
যূথী যখন নিশানকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ঠিক ওই মুহুর্তে নিশান চোখ তুলে একদম সরাসরি যূথীর দিকে তাকাল।
এমন রক্তিম চোখের তাকানো দেখে যূথীর গলায় খাবার আটকে গেল।ব্যস্! ফলাফলস্বরূপ জোরে জোরে কাশতে লাগল সে।
বিথী চৌধুরী তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এনে ধমকের সুরে বললেন,

—একটু আস্তে কি খাওয়া যায় না? কি যে করো তুমি!

যূথী ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল।একে তো নিশান নামের রাক্ষস লোকটা তাঁকে দেখে ফেলেছে তার উপর সবার সামনে এভাবে কাশি উঠে গেল।সে তো ভুলেই গেছে সিআইডিদের মাথার সবজায়গাতেই অদৃশ্য চোখ থাকে।নিশ্চিত লোকটা বুঝে ফেলেছে সে লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছিল।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here