স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৭,৮

0
3006

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৭,৮
সামান্তা সিমি
পর্ব_৭

যূথী খালি পায়ে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল।দূর থেকে যত না সুন্দর লাগছিল কাছে এসে মনে হচ্ছে সে কোনো ফুলের রাজ্যে এসে পরেছে।এখনো বাড়িতে কারো সাড়াশব্দ নেই।তারমানে কেউ ঘুম থেকে উঠে নি।
যূথী চারপাশে ভালোভাবে তাকাল। না কেউ নেই।
অতি সন্তপর্ণে সে গাছ থেকে একটা গোলাপ ফুল তুলে ফেলল।গোলাপের ঘ্রাণ তাঁকে পাগল করে দিচ্ছে।
যূথী ফুলটাকে সুন্দর করে তাঁর কানের পাশে খোলা চুলের গভীরে ঢুকিয়ে দিল।

* নিশান সূর্য উঠার সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠে পরেছিল।সকালের খোলা বাতাসে এক্সারসাইজ দিয়েই তাঁর দিন শুরু হয়।
কানে হেডফোন লাগিয়ে সে বারান্দায় রানিং মেশিনে এক্সারসাইজ করে যাচ্ছে।
সেই মুহূর্তে নিশানের চোখ গেল বাগানে ফুল গাছের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা যূথীর দিকে।
রানিং মেশিন বন্ধ করে সে একটু সামনে এগিয়ে গেল।ভুল দেখছে না তো! এত সকালে এই মেয়ে কোত্থেকে আসবে?
নিশানের চোখ আবার যূথীর উপর আটকে গেল।সকালের আলোয় মেয়েটাকে কতটা শান্ত স্নিগ্ধ লাগছে! তার উপর চুলে আবার ফুল গুঁজেছে।
এতগুলো ফুলের মাঝে যূথীকেও যেন একটা ফুটন্ত ফুল লাগছে।
নিশান জোর করে তাঁর চোখ অন্যদিকে ফেরাতে চাইল।কিন্তু পারল না।কোনো এক অদৃশ্য বন্ধন যেন চোখ দুটোকে চুম্বকের মত টেনে যূথীর উপর নিয়ে ফেলছে। এ কোথায় ফেঁসে গেল নিশান?

যূথী নিচু হয়ে একটা একটা ফুলের গায়ে স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে।সূর্য এখন তাঁর সবটা আলো বাগানের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশের পরিবেশটা যূথীর কাছে খুবই মনোরম লাগছে।
সামনে তাকাতেই দেখে মিঠু চাচা বাগানে পানি দেওয়ার জন্য পাইপ নিয়ে এগিয়ে আসছে।
যূথীকে দেখতে পেয়ে মিঠু চাচা কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,

—এত সকালে এইখানে কি করো মামণি?

—এই একটু হাঁটতে বের হয়েছি চাচা।আমাকে পাইপটা দিন আমি পানি দিচ্ছি।

দাঁত দিয়ে জিভ কেটে মিঠু চাচা বলে উঠল,

—না মামণি।এইটা তোমার কাজ না।বাড়ির কেউ দেখলে আমারে অনেক কথা শুনাইব।

—কেউ দেখবে না।সবাই এখন ঘুমে।দাও আমায়।

যূথী অনেকটা জোর করেই পাইপটা নিয়ে আনমনে গান গাইতে গাইতে পানি দিতে লাগল।মিঠু চাচা কাঁচি নিয়ে গাছের নিচের আগাছা পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।
একজোড়া প্রজাপতি ফুলের উপর বসতেই যূথীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।সে প্রজাপতি খুব ভালোবাসে।তার উপর এমন রঙ বেরঙের হলে তো কথাই নেই।
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই প্রজাপতি দুটো ফুড়ুৎ করে আকাশে উঠে গেল।
যূথীও উপরের দিকে তাকাল কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নিশানের দিকে চোখ পরতে মুহূর্তেই তাঁর মুখের হাসি উবে গেল।
নিশানের গায়ে হাতকাটা একটা হোয়াইট গেঞ্জি যেটা অর্ধেক ঘামে ভিজে আছে।লোকটার বলিষ্ঠ বাহু বুকেও ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা জমে আছে।
যূথী কখনো কোনো ছেলের এমন রূপ দেখেনি।তাঁর চেতনা তাঁকে বলছে এই মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।কিন্তু পা দুটো যেন অসার হয়ে গেছে।যূথীও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।

“—আরে আরে মামণি এইটা কি করতাছো? আমারে ভিজাও কেন? পাইপটা সরাও তাড়াতাড়ি! ”

মিঠু চাচার এমন চেঁচানো কন্ঠ শুনে হুঁশ ফিরল যূথীর।সে যে কখন পানির পাইপটা ফুল গাছে থেকে সরিয়ে মিঠু চাচার উপর দিয়ে দিয়েছে খেয়াল নেই।
যূথী আবার বারান্দার দিকে তাকালো।নিশান এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

—আমি দুঃখিত চাচা।

এটা বলেই যূথী পানির পাইপ ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।রুমে এসে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরল।
বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছে যূথী।একটু আগের ঘটনাটা কি ছিল এটা? নির্লজ্জের মত সে নিশান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল! উনি এখন কি না কি ভাববে।সকাল সকাল মাইন্ড ফ্রেস করার জন্য বাগানে গিয়েছে উল্টে এমন একটা লজ্জাকর ঘটনা ঘটে গেল।যূথী মনে মনে ঠিক করে নিল আজকের পর থেকে নিশান ভাইয়ার সামনে কোনোমতেই যাওয়া যাবে না।

_________________

থালার আকারের বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে।নিঃসন্দেহে রাতের এই সৌন্দর্য ছুয়ে যাবে সকলের মনে।পূর্ণিমার এমন অপরূপ চাঁদের আলো দেখে যে কেউই বলে উঠবে -“বাহ্! চমৎকার তো!”
কিন্তু আশেপাশের এই সৌন্দর্য স্পর্শ করছে না নিশানকে।তাঁর হৃদয়ে আগুন জ্বলছে। এর কারণ একমাত্র যূথী।
হাতে ড্রিংকসের বোতল নিয়ে ছাদে বসে আছে নিশান।আজ অনেকদিন পর এই জিনিসটা হাতে নিয়েছে।কিন্তু তবুও তাঁর মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না।অফিসের কাজেও ঠিকমতো মন বসাতে পারেনি।তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল।ভেবেছিল খাওয়ার সময় ডাইনিং টেবিলে যূথীর দেখা পাবে।কিন্তু মেয়েটার ছায়াও দেখেনি সেখানে।নিশ্চিত সকালের ঘটনার কারণে তাঁর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে।
তখন যূথীকে দেখতে না পেয়ে মাথাটা আরো বিগড়ে গেছে।নিশান অনেক ভেবে চিন্তেও কোনো যুক্তি বের করতে পারে নি।একটা পিচ্চি মেয়ের এত ক্ষমতা যে নিশানকে কাবু করে ফেলল? তবে কি সে যূথীকে ভালোবেসে ফেলেছে? কিন্তু এ ভালোবাসার পরিণতি কি?
হঠাৎই নিশানের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল।ড্রিংকসের বোতলে একটা চুমুক দিয়ে বলতে লাগল,

—খুব বড় একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছো যূথী! ইউ হ্যাভ টু পে ফর ইট।এখন দেখো শুধু তোমার সাথে কি কি ঘটতে থাকে!

ছাদের এককোণে ড্রিংকসের বোতলটা ফেলে টলতে টলতে সিড়ি দিয়ে নেমে গেল নিশান।

———————-

পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে মনীষা, বিদীষা,নীলিমা এবং যূথী।ওরা দুপুর থেকেই প্ল্যান করছিল আজ বিকেলে ঘুরতে বের হবে।বড়দের থেকে পারমিশন নিয়ে চারজন চলে এসেছে পার্কে।
প্রত্যেকের হাতে একটা করে কোণ আইসক্রিম। কিন্তু যূথী তাঁর আইসক্রিম হাতে নিয়ে কাচুমাচু মুখে বসে আছে।অনেকক্ষণ আগেই তাঁর আইসক্রিম অর্ধেক গলে মাটিতে পরে গেছে। সেদিকে ওর খেয়ালই নেই।
আজ বিকেলে পার্কে আসার সময় যত অঘটন ঘটল।মনীষা আর নীলিমা যূথীকে জোর করে জিন্স এবং টপস্ পরিয়ে দিয়েছে।যূথী বারবার না করেছিল।কিন্তু শুনেনি ওরা। পার্কে আসার পর থেকেই সে ভীষণ অস্বস্তিতে পরে গেছে।একবার বাম হাতে একবার ডান হাতে টপস্ টাকে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে।
যূথীর এমন অসহায় চেহারা লক্ষ্য করে মনীষা বলল,

—ইস্ যূথী! এরকম টানাটানি করো না।তুমি নিজেও জানো না কতটা সুন্দর লাগছে তোমাকে।

যূূথী ঠোট উল্টে উত্তর দিল,

—দেখো আশেপাশের মানুষ কিভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে।

—কোথায় তাকাচ্ছে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।

যূথী নিজেও জানে কেউ তাঁকে দেখছে না।কিন্তু তবু তাঁর খুব বিরক্তবোধ হচ্ছে। আজকের পর থেকে এমন পোশাক সে আর কখনোই পরবে না।
হঠাৎই বিদীষা খুব জোরে “ওহ্ নো!” বলে চিৎকার করে উঠল।এমন চিৎকার শুনে সবার রীতিমত ভয় পাওয়ার অবস্থা।

—মনীষা আপু! ওটা নিশান ভাইয়ার গাড়ি না?

বিদীষার কথা শুনে মনীষা রাস্তার দিকে ভালোভাবে তাকাল।হ্যাঁ এটা নিশানেরই গাড়ি।মনীষাও বেশ ভয় পেয়ে গেল।ভাবছে নিশান ভাইয়া এখানে আসার কারণ কি?
বাকীদের আশ্বস্ত করে মনীষা বলল,

—রিল্যাক্স গার্লস্। ভাইয়া যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবি ঘুরতে এসেছি।সত্যি কথাই বলে দিব।

চারজন উৎসুক চোখে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।ওরা ভালোই বুঝতে পারছে গাড়িটা ওদের লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে।
ডার্ক ব্লু কালারের গাড়িটা থেমে যেতেই নিশান বেরিয়ে আসলো।ক্ষিপ্র গতিতে সে এগিয়ে আসছে।নিশানের এমন রূপ দেখে চারজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
নিশান ওদের সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল,

—কি করছিস এখানে?

এমন প্রশ্ন শুনে মনীষা, বিদীষা এবং নীলিমা বেশ ঘাবড়ে গেল।ওরা নিশানের রাগের কোনো কারণ খুজে পাচ্ছে না।এর আগেও তো কতবার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে তখন তো নিশান ভাইয়া এমন রিয়্যাক্ট করেনি!
নীলিমা আমতাআমতা করে বলার চেষ্টা করল,

—আ…আসলে ভাইয়া একটু ঘুরতে বের হয়েছি আর কি!

নীলিমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে যূথীর দিকে আঙুল তাক করে নিশান বলে উঠল,

—ওকে এসব ড্রেস কেনো পরিয়েছিস?

চমকে উঠলো যূথী।নিশান আসার পর থেকে সে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল।একবারও নিশানের চোখে চোখ মেলায় নি।কিন্তু এমন একটা কথা শুনে একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে উপরে তাকাল।নিশানও তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। একটু আগে নিশানের বলা কথাটা যেন যূথীর বোধগম্য হলো না।
বিদীষা আস্তে করে জবাব দিল,

—আসলে ভাইয়া আমরাও পরেছি তাই ভাবলাম আমাদের সাথে মিল রেখে যূথী আপুকেও পরিয়ে দিই।

—কমনসেন্সের অভাব তোদের? দেখতে পাচ্ছিস না সে আনইজি ফিল করছে এই পোশাকে? কোনো কথা না বলে চুপচাপ সব-কয়টা গাড়িতে গিয়ে উঠ।

নিশানের এমন ধমক মাখা কন্ঠ শুনে চারজন ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে গেল।কোনো দিকে না তাকিয়ে গাড়ির দিকে ছুটছে ওরা।এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই ইজ্জতের ফালুদা হওয়া।আশেপাশের সবাই হা করে ওদের দেখছিল এতক্ষণ। কি অসম্মানের ব্যপার।
মনীষা,বিদীষা আর নীলিমা দৌড়ে গিয়ে পেছনের সিটে বসে পরল।বেচারি যূথী পরল বিপদে।সে কিছুতেই এই এটম বোম লোকটার পাশে বসতে পারবে না।যদি রেগে গিয়ে তাঁকে জানালা দিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেয়?
নীলিমা ইশারায় যূথীকে সিটে বসে যাওয়ার জন্য বলছে।কিন্তু যূথী করুণ মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিশান যূথীকে পাশ কাটিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পরল।যখন দেখল যূথী একইভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তখন দাঁত কটমট করে বলে উঠল,

—তোমাকে গাড়িতে উঠার জন্য ইনভাইট করতে হবে?

যূথী তড়িৎ বেগে দরজার হাতল ধরে টানতে লাগল।কিন্তু খুলছে না।দুইহাতে সর্বশক্তি ব্যবহার করেও সে দরজা খুলতে পারছে না।
নিশান কয়েক সেকেন্ড শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল যূথীর দিকে।নিশানের এমন চাহনি দেখে যূথী ভয়ে ভয়ে বলল,

—খুলছে না দরজা।

মনে মনে দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে নিশানের।ভয়ে মেয়েটার কপালে ঘাম ঝরছে।ভাবছে তাঁর লাইফলাইন তাঁকে এত ভয় পায়? তাহলে সারাজীবন তাঁর সাথে থাকবে কি করে?
গাড়ি থেকে বেরিয়ে নিশান যূথীর পাশে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।

চলবে………….

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_৮

সিআইডি অফিসের সামনে সাংবাদিকদের ভিড়।আজ মতিন ভূঁইয়া নামক নামকরা অপরাধীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।মতিন তাঁর সকল অপরাধ স্বীকার করেছে।মতিনের সকল অবৈধ ব্যবসা এবং কালো টাকার খবর সিআইডিদের হাতে চলে এসেছে।
নিশান ভেতর থেকে বের হতেই সকল সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরল।নিশানও খুব সুন্দরভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।আজও তাঁর মা ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে।
খাবার রুমে পাঠিয়ে দিতে বলে নিশান উপরে চলে গেল।

* ডিনার শেষে বারান্দায় বসে আছে নিশান।আজ দুইদিন হয়ে গেল সে যূথীকে দেখতে পাচ্ছে না।নিজে এত রাত করে বাড়ি ফেরে যে মেয়েটার আর দেখাই পাওয়া যায় না।প্রত্যেকদিন সকালে একবার করে বাগানে চেক করে।কিন্তু যূথীকে সেখানেও দেখা যায় না।
শত ব্যস্ততার মাঝেও মেয়েটার হাসোজ্জ্বল মুখটা নিশানের চোখে ভেসে উঠে।তাঁর মন চাইছে এখনই ছুটে গিয়ে দেখে আসে যূথীকে।
নিশান বারান্দায় প্রায় দশ মিনিটের মত পায়চারি করল।যূথীকে না দেখলে আজ রাতে তাঁর চোখে ঘুম আসবে না।
কোনোকিছু না ভেবেই সে রওনা দিল যূথীর রুমের দিকে।
দরজা পুশ করে বুঝল ভেতর থেকে বন্ধ। মুহূর্তেই তাঁর মেজাজ চড়ে গেল।তাঁকে পাগল বানিয়ে মেয়েটা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে!
দরজায় হালকা নক করে অপেক্ষা করতে লাগল।নিশান ভাবতেও পারেনি তাঁকে কোনোদিন এভাবে চোরের মত একটা মেয়ের রুমের বাইরে দাড়িয়ে থাকতে হবে।এখন যদি বাড়ির কেউ এই দৃশ্য দেখে তাহলে তাঁর সামনে তো কিছু বলার সাহস পাবে না তবে আড়ালে ছোটখাটো একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে।
দুই-তিন বার নক করার পরও যূথী দরজা খুলছে না।নিশানের মন চাইছে এক লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে দেয়।কিন্তু এত রাতে এটা করতে গেলে বাড়ির লোকজন ভূমিকম্প ভেবে হৈচৈ শুরু করবে।

বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমে কাদা হয়ে আছে যূথী।দরজার খটখট শব্দটা হালকাভাবে কানে যেতেই চোখ মেলল।বিছানার পাশে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেখল ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে।এত রাতে তাঁকে কি দরকারে ডাকা হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না।
গলায় উড়না জড়িয়ে যূথী দরজার দিকে এগুলো।দরজা একটু ফাঁকা করে মাথা বের করতেই সামনের মানুষটাকে দেখে তাঁর চোখ থেকে ঘুম উধাও। নিশান ভাইয়া এত রাতে তাঁর রুমের দরজার সামনে ব্যপারটা তাঁর হজম হচ্ছে না।
যূথীকে দেখামাত্র নিশান আদেশের সুরে বলল,

—ছাদে আসো।

যূথী কোনো উত্তর না দিয়ে নিশানের দিকে তাকিয়ে আছে।তাঁর মনে হচ্ছে নিশান বোধ হয় পাগল টাগল হয়ে গেছে।নয়তো ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছে।
যূথী মিনমিনে গলায় বলল,

—এখন ছাদে যাব কেন নিশান ভাইয়া?

—নো আর্গুমেন্ট।ছাদে আসো ইন ওয়ান মিনিট।

কথাটা বলেই নিশান হনহন করে চলে গেল।

যূথী ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে কিন্তু একটু পর পর আবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। বাড়ির কেউ যদি এই মুহূর্তে তাঁকে ছাদে দেখে তাও নিশান ভাইয়ার সাথে তাহলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।আর এটাই তো স্বাভাবিক। এমন গভীর রাতে একটা মেয়ে বাড়ির ছেলের সাথে ছাদে ব্যপারটা সত্যি দৃষ্টিকটু।
যূথী একবার ভেবেছিল আসবে না।পরক্ষণেই নিশানের রাগের কথা মনে পরতেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল।নিশান ভাইয়া নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলার জন্য ডেকেছে।

ছাদে পা রেখে যূথী আশেপাশে তাকাতে লাগল।কই কাউকেই তো দেখছে না।আশপাশটা কেমন নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে।নিশান ভাইয়া কোথায়?
হঠাৎই তাঁর মনে একটা অজানা ভয় এসে জমল।তখন কি ওটা সত্যিই নিশান ভাই ছিল নাকি কোনো অশরীরী নিশানের রূপ নিয়ে এসেছিল!
রাত একটা বাজে নিশান ভাইয়া কেনো তাঁকে ডাকতে যাবে এটাতো মাথায়ই আসেনি। যূথীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।সে কি শেষমেষ ভুতের খপ্পরে পরল।গ্রামে এমন অনেক কাহিনী শুনেছে ভুতেরা নাকি মানুষের রূপ ধরে গভীর রাতে ডেকে নিয়ে যায়।
যূথী ফিরে যাওয়ার জন্য পেছনে মোড় নিতেই কেউ তাঁর হাত টেনে ধরল।আচমকা এমন হওয়ায় যূথীর আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার উপায়।
সে বিকট এক চিৎকার দিতেই হাত চেপে ধরা লোকটা এবার তাঁর মুখ চেপে ধরল।
যূথী ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।তাঁর কাছে মনে হচ্ছে চোখ খোলা মাত্রই ভয়ানক কিছু দেখবে।

—চোখ খুলো।

পরিচিত কন্ঠস্বর কানে যেতেই ঝট করে চোখ খুলল যূথী।এইতো নিশান ভাইয়া সামনে দাঁড়িয়ে।
নিশান আরেকটু ঝুঁকে এসে বলল,

—ভয় পেয়েছিলে? আমি ভুত নই।

যূথী সাথে সাথে চোখ মুখ কুচকে ফেলল।নিশানের মুখ থেকে সিগারেটের সেই পঁচা গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে।
দূরে যাওয়া চেষ্টা করতেই যূথীর খেয়াল হলো তাঁর একহাত এখনো নিশানের শক্ত মুঠোয় বন্দী।
সে নিশানের ভাব-গতিক কিছু বুঝতে পারছে না।হঠাৎ নিশান ভাইয়া এমন আচরণ করছে কেনো?একে তো সিগারেটের গন্ধ তার উপর নিশানের এভাবে কাছে আসাটা তাঁকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না।
হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দূরে ফেলে নিশান বলে উঠল,

—সিগারেটের গন্ধ ভালো লাগে না? অভ্যাস করে নাও।ফিউচারে দিনরাত এই গন্ধটার মাঝেই থাকতে হবে।

নিশানের কথার কোনো আগামাথা খুঁজে পাচ্ছে না যূথী।এই কথাগুলো বলার মানে কি!
নিশানের ক্যারেক্টারের যেমন বর্ণনা শুনেছিল তাঁর সাথে এই রূপটা ঠিক মানাচ্ছে না।
হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে যূথী বলল,

—আমায় যেতে দিন নিশান ভাইয়া।আপনি এসব কি কথা বলছেন? কেউ এসে এভাবে দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নিশান যেন যূথীর কথা শুনতেই পায় নি।যূথীর কোমড়টা আরো একটু চেপে কাছে টেনে নিল।তৎক্ষনাৎ যূথীর সমস্ত শরীরে যেন কারেন্টর শক লাগল।জীবনে এই প্রথম কোনো ছেলের স্পর্শ!তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পরবে।
দুইহাতে নিশানকে ধাক্কা দিয়েও লাভ হচ্ছে না।
যূথীর এমন অবস্থা দেখে নিশান ফিসফিস করে বলল,

—এটুকুতেই এই অবস্থা? তোমার করা ভুলের শাস্তি তো এখনো বাকি।

যূথী কিছু না বুঝেই মোহাচ্ছন্নের মত জবাব দিল,

—আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তাঁর জন্য ক্ষমা চাইছি ভাইয়া।কিন্তু এখন আমাকে যেতে দিন প্লিজ!

যূথীর গলায় কথা জড়িয়ে আসছে।শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
নিশান তাকিয়ে আছে যূথীর ঠোঁটের দিকে।মেয়েটার ঠোঁট একটু পর পর কেঁপে উঠছে। ইচ্ছে করছে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে।কিন্তু সেটা যূথীর জন্য একটুও ভালো হবে না।নিশানের সম্পর্কে তাঁর মনে নেগেটিভ ধারণা জন্মাবে।
নিশান যূথীকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাড়ালো।
যূথী যেই মুহূর্তে অনুভব করল নিশান তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছে আর এক সেকেন্ড দেরি না করে সিড়ির দিকে দৌড়ে নেমে গেল।
পকেটে হাত দিয়ে নিশান যূথীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।ঠোঁটে ফুটে আছে মুচকি হাসি।যূথী কি কখনো তাঁর অনুভূতিগুলো বুঝতে পারবে? সে তো আর পাঁচজন প্রেমিকের মত ভালোবাসাকে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারে না।এই মেয়েটাই তো তাঁর সাদা-কালো জীবনটাতে রঙিন প্রেমের জোয়ার নিয়ে এসেছে।সে নিজেও জানতো না তাঁর মনে যে এত প্রেম আছে।তাহলে নিশানের না বলা অনুভূতি গুলো বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব তো যূথীরই।

___________________

ভারী কাঁচের চশমা পরা মধ্যবয়স্ক একজন শিক্ষক ক্লাসে পড়া বুঝিয়ে চলেছে।ক্লাসের ছেলেমেয়েরা মনযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনে যাচ্ছে।
কিন্তু যূথীর সেদিকে মন নেই।স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকা সত্বেও তাঁর মনে চলছে অন্যকিছু।
সেদিন রাতে ছাদে নিশানের বলা কথাগুলো ভাবাচ্ছে তাকে।সে তো কোনো অবুঝ মেয়ে নয় যে ওই কথাগুলোর মানে বুঝবে না!
কিন্তু এটা হতে পারে না! নিশান ভাইয়া যদি এরকম কিছু ভেবে থাকে তাহলে কিছুদিন পরই তা ভয়াবহ রূপ নেবে।
নিশান ভাইয়ার মত একজন মানুষের সাথে যূথীকে মানায় না।এ বাড়ির মানুষ তাঁকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছে।পড়ালেখা করার সুযোগ পর্যন্ত দিয়েছে।সে কখনোই এ বাড়ির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না।তাঁর মত মেয়েদের জীবনে এসব প্রেম-ভালোবাসা নামক জিনিসগুলো মানায় না।
তাঁর মন বলছে হয়তোবা নিশান ভাইয়া তাঁর প্রতি শুধুমাত্র একটা আকর্ষণ অনুভব করে যার স্থায়িত্ব সাময়িক।এমন চাল-চুলোহীন মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।
এখন থেকে নিশান ভাইয়াকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলবে।বড় কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই তাঁর সাবধান হয়ে যাওয়া দরকার।শত হোক সে একজন মেয়ে।পান থেকে চুন খসলেই সব দোষ তাঁর ঘাড়ে এসে পরবে।এমনটা কখনোই হতে দেবে না।সে তো কোনো বোকা মেয়ে নয়।

—এই যে যূথিকা।আমার মনে হচ্ছে কোনো কারণে তুমি ডিসটার্ব ফিল করছো।এম আই রাইট?

স্যারের ডাকে যূথী ভাবনার জগত থেকে বের হলো।এই স্যারটার নাম মুশতাক রহমান।ক্লাসের সবার সাথেই খুব মার্জিত আচরণ করে।কলেজে এই টিচারকেই যূথীর সবথেকে ভালো লাগে।এতবড় কলেজের শিক্ষক হওয়া সত্বেও কোনো অহংকার নেই।

—নো স্যার।আ’ম ফাইন।

মুশতাক রহমান সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে লাগলেন,

—ইউ নো গার্লস এন্ড বয়েজ সি ইজ যূথিকা জাহান।গ্রাম থেকে এসে এখানে ভর্তি হয়েছে।এমন ভদ্র আর সুন্দর ব্যবহারের মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।

যূথী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।কেউ সামনাসামনি তাঁর প্রশংসা করলে সে খুব বিব্রত বোধ করে।তখনই যূথীর পাশে বসা মেয়েটা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

—একটা কথা বলি যূথীকা! কিছু মনে করো না।এই স্যারটা থেকে সবসময় দূরে থাকবে।নতুন এসেছো তাই কিছু জানো না।

মেয়েটার কথা শুনে যূথীর একটু রাগ হলো।তাঁর তো স্যারটাকে দেখে খারাপ মনে হয় না।শুধু শুধু স্যারদের নামে কুৎসা রটিয়ে মেয়েগুলো যে কি মজা পায়!
সব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে যূথী পড়ায় মন দিল।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here