স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৪,১৫

0
3399

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৪,১৫
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৪

নাস্তা বানাতে গিয়ে বেহাল দশা হয়েছে যূথীর।গ্রাম থেকে এখানে আসার পর রান্নাঘরের ধারে কাছেও যায় নি সে।এতদিন পর হঠাৎ রান্নায় হাত দিতে গিয়ে ভীষণ জ্বালায় পরে গেছে।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে ডালপুরি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেষের পুরিটা তেল থেকে তুলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যূথী। অবশেষে নাস্তা বানানো সম্পন্ন। এখন শুধু ওদের আসার অপেক্ষা।
গরম তেলের কড়াই চুলা থেকে নামিয়ে নিচে রাখতে গিয়েই যত বিপত্তি ঘটল।অসাবধানতা বশত খানিকটা গরম তেল ছিটকে পরল যূথীর বাম হাতের কব্জিতে।
অসহ্য জ্বলুনিতে চিৎকার দিয়ে উঠল সে।মনে হচ্ছে তাঁর হাত কেউ গনগনে আগুনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।দেখতে দেখতে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর জায়গাটা ফোসকা পরে গেল।

উপরে যাওয়ার জন্য মাত্রই সিড়িতে পা রেখেছে নিশান।তখনই রান্নাঘর থেকে যূথীর চিৎকার শুনে দাঁড়িয়ে পরল।ওইসময় ফোন আসাতে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরেছিল যে ভুলেই গেছিল যূথী কিচেনে আছে।
নিশান দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখে যূথী হাত নিয়ে লাফালাফি করছে।চোখ মুখ ব্যথায় জর্জরিত।

“—হোয়াট হ্যাপেন্ড যূথী! হাতে কি হয়েছে?”

যূথী ঠোঁট টিপে জ্বলুনি সহ্য করার বৃথা চেষ্টা করছে।এই মুহূর্তে নিশান কি বলছে কিছুই তাঁর মাথায় ঢুকছে না।

ফ্লোরে তেলের চিহ্ন দেখেই নিশান বুঝে গিয়েছে আসল ঘটনা কি!সে তাড়াতাড়ি যূথীর হাত টেনে ট্যাপের পানির নিচে দিয়ে দিল।

“—এত পাকনামি করতে কে বলেছে তোমায়?কে বলেছে এসব বানাতে? বাড়িতে আর কেউ ছিল না? ওদের বললে কি বানিয়ে দিত না?”

এমনিতেই হাতের জ্বলুনিতে যূথীর চোখে পানি জমা হয়েছিল।এখন নিশানের ধমক শুনে সেই পানি দ্রুত গতিতে গড়িয়ে পরল।সে ব্যথা পেয়েছে এর মধ্যেও লোকটা বকে চলেছে।এত নির্দয় হয় কিভাবে মানুষ?
যূথীকে চুপ থাকতে দেখে নিশান আবার বলল,

“—এখন চুপ কেনো? ইচ্ছে করছে কানের নিচে ঠাস করে একটা বসিয়ে দেই।”

করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় নিচ থেকে চিল্লানোর আওয়াজ শুনতে পেল কারিমা।ভাবছে কারো কোনো দুর্ঘটনা হলো না তো!
কিচেনের সামনে গিয়ে দেখল নিশান যূথীর হাত ট্যাপের পানির নিচে দিয়ে রেখেছে আর যূথী একটু পর পর চোখের জল মুছছে।
নিশানকে কিচেনে দেখে কারিমা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইল।ভেতরে ঢুকল না।বাড়ির অন্য সবার মতো সেও এই মানুষটাকে ভয়ের চোখে দেখে।কখন যে হুট করে রেগে যায় কেউ বলতে পারে না।তার উপর মাহিরের বড় ভাই উনি।
নিশান একপলক কারিমার দিকে তাকিয়ে যূথীকে বলল,

“—চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।আমি বার্নল ক্রিম নিয়ে আসছি।”

নিশান যেতে নিলেই তক্ষুনি কারিমা বলে উঠল,

“—ভাইয়া আপনি উপরে যান।আমি না হয় ওঁর হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিই?”

আর কিছু না বলেই নিশান চলে গেল।এদিকে যূথী এখনো চোখের জল মুছে যাচ্ছে। কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।কারিমা যূথীর পুড়ে যাওয়া হাতটা দেখে বলল,

“—বেশ খানিকটা পুড়ে গেছে দেখছি।কেনো একা একা এসব করতে গেলে।আমাকে তো ডাকতে পারতে!”

“—মনীষাদের জন্য বানিয়েছিলাম ভাবী।”

“—আচ্ছা চলো। ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছি আমি।”

“—দেখেছো ভাবী! নিশান ভাইয়া আমাকে কেমন বকল।উনি সবসময় আমার সাথে এমন করে।”

সামান্য হাসল কারিমা।নিশান ভাইয়াকে নিয়ে কত জনের কত অভিযোগ। অথচ ওই মানুষটার এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই।সে চলে নিজের গতিতে।মন যেটা চায় সেটাই করে।

“—ভাইয়া একটু রাগী এটাতো জানোই যূথী।আর উনি যে প্রফেশনে আছে সেখানে সারাদিন চিল্লানোর উপর থাকতে হয়।তো স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে আসলে একটু মাথা গরম থাকে।তুমি আর মন খারাপ করো না।চলো আমার ঘরে।”

* ডিনারের পর নিজের রুমে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে যূথী। কিন্তু তাঁর চোখ চলে যাচ্ছে বিছানায় রাখা প্রিয় মোবাইলটার দিকে।হাত নিসপিস করছে ছুটে গিয়ে একটু মোবাইলটা ধরার জন্য।
কিছুক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করার পর হেরে গিয়ে তড়িৎ গতিতে ফোনটা হাতে নিয়ে নিল।হয়তোবা কতগুলো নোটিফিকেশন এসেছে।না জানি কতগুলো মেসেজ জমা হয়েছে।
কয়েক সপ্তাহ হলো মনীষা তাঁকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে।প্রথম দিকে ফেসবুকের কিছু না বুঝলেও এখন তাঁর মারাত্মক নেশা ধরে গেছে।পড়ার ফাঁকে একবার ফোন হাতে না নিলে ভালো লাগে না।
মনের সুখে যূথী ফেসবুক চালিয়ে যাচ্ছে। তখনই,

“—পড়া বাদ দিয়ে হাতে মোবাইল কেনো?”

চমকে উঠল যূথী।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিশান দাঁড়িয়ে আছে।মুহূর্তেই বিষিয়ে উঠল তাঁর মনটা।মোবাইলের ধান্দায় তো দরজাটা লাগাতেই ভুলে গেছে।আর সেই সুযোগে এই জল্লাদ রুমে প্রবেশ করে নিয়েছে।

“—পড়তে আর ভালো লাগছিল না।তাই একটু ফোনটা হাতে নিয়েছি।”

নিশান যূথীর হাত থেকে ছো মেরে মোবাইলটা নিয়ে নিল।যূথী বাধা দেওয়ার সুযোগই পেল না।রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

“—মোবাইলটা কেনো নিলেন।দিন আমার মোবাইল। ”

ফোন ফেরত দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না নিশানের মধ্যে।যূথী ছুটে এল ফোনটা নেওয়ার জন্য।কিন্তু নিশান একহাতে যূথীকে আটকে অন্য হাতে মোবাইলে কি যেন ঘাটাঘাটি করে যাচ্ছে।
যূথী চিল্লিয়ে বলতে লাগল,

“—দিন আমার ফোন।অন্যের মোবাইলে হাত দেওয়া কিন্তু অন্যায় কাজ। দিন বলছি।”

“—তুমি এখন আমাকে ন্যায়-অন্যায় শেখাবে?হাউ ফানি!ভুলে গেছো আমি কে?বেশি তিড়িংতিড়িং করলে কিন্তু আছাড় দিয়ে মোবাইল ভেঙে ফেলব।”

মুখ কালো করে যূথী চেয়ারে গিয়ে ধুপ করে বসে পরল।সে চায় না তাঁর মোবাইলটা এত নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস হয়ে যাক।তাই চুপচাপ বসে রইল।
ভীষণ রাগ হচ্ছে তাঁর।মাঝেমাঝে মনে হয় এই লোক প্ল্যান করে তাঁকে জ্বালাতে চলে আসে।নাহলে এত রাতে না ঘুমিয়ে তাঁর রুমে এসে মোবাইলের উপর তদন্ত চালাচ্ছে কেনো।ভালো লাগে এসব!
পাক্কা পাঁচ মিনিট পর মোবাইলটা ফেরত দিল নিশান।যূথী তাড়াতাড়ি লক খুলে দেখতে লাগল এতক্ষণ কোথায় কোথায় নির্যাতন চালিয়েছে ।ফেসবুকে ঢুকে মুহূর্তেই তাঁর মেজাজ হাইপার হয়ে গেল।

“—আমার ফেসবুক আইডি কোথায়?কি করেছেন আমার আইডিটার?”

যূথীর কথা পাত্তা না দিয়ে নিশান বেশ আয়েশ করে বিছানায় এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে বসল।এমন একটা ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি।
যূথী আবার বলল,

“—আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? আমার আইডি কোথায়?”

“—নেই। ডিলিট করে দিয়েছি।”

“—কেনো করলেন এটা?”

নিশান হাত দিয়ে সামনের চুলগুলোকে পেছনে নিয়ে বলল,

“—কয়েকদিন পর পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ করে তারপর আইডি খুলবে।তোমার ভাগ্য ভালো কোনো ছেলের সাথে মেসেজ পাই নি।তাহলেই না বুঝতে নিশান কি চিজ।”

যূথী থম মেরে বসে রইল।তাঁর ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় বসা লোকটার চুল টেনে ছিড়ে ফেলে।তাঁর সুন্দর সময়গুলো এই মানুষটা সবসময় নষ্ট করে দেয়।কিসের এত শত্রুতা তাঁর সাথে!

“—হাতের জ্বলুনি কমেছে?দেখি হাতটা!”

নিশানের কথা গায়ে মাখল না যূথী।যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে রইল।কথা বলবে না সে।মাথায় বজ্র পরলেও সে নিশান ভাইয়ার সাথে আজ কথা বলবে না।
যূথীর নড়নচড়ন না দেখে ধমকে উঠল নিশান।

“—আমি উঠে আসলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।”

ভয় পেয়ে উঠে এল যূথী।হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিতেই নিশান নেড়েচেড়ে দেখে বলল,

“—লাল হয়ে আছে এখনো।ক্রিমটা ডেইলি লাগালে ঠিক হয়ে যাবে।”

কিছু বলছে না যূথী।তাঁর আইডি ডিলিট করে এখন দরদ দেখাতে আসছে।
হঠাৎ নিশান যূথীর হাতের উল্টো পিঠে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে নিল।
কেঁপে উঠল যূথী।নিশানের এমন কান্ডে থ হয়ে গেছে। হাত ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল সে।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।

“—মাই সানফ্লাওয়ার! ”

মুচকি হেসে নিশান যূথীর দিকে চোখ মেরে বেরিয়ে গেল।

_________________

* বছর ঘুরে আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। পুরনো দিনের জড়তা, তীক্ততা কাটিয়ে সবার প্রাণে নিয়ে এসেছে উচ্ছ্বসিত আনন্দ। সূর্যের প্রখর তাপ কারোরই বিরক্তিকর কারণ হচ্ছে না।সবাই রাস্তা-ঘাটে মেতে উঠেছে বৈশাখের আনন্দে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যূথীদের কলেজে আজ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।কলেজ প্রাঙ্গণ ছাত্র-ছাত্রীদের কলহাস্যে মুখরিত।ছেলেদের লাল পাঞ্জাবি আর মেয়েদের রঙিন শাড়ীতে আশপাশটা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
যূথী,মনীষা এবং নীলিমা কমনরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনের পরনেই লাল সাদা সংমিশ্রণের উজ্জ্বল শাড়ি।খোঁপায় গোঁজা হলুদ ফুল।
আজ বাধ্য হয়েই শাড়ি পরতে হয়েছে যূথীকে।মনীষা নীলিমা এত জোর করল যে আর না করতে পারেনি।কিন্তু এখন পরেছে মহা ঝামেলায়।এভাবে শাড়ি জড়িয়ে হাঁটা চলা করতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বোধ হয় শাড়ি খুলে গেল।
যূথী নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি কুচি খুলে গেছে।একটু না অনেকখানিই। ব্যস! এটারই বাকি ছিল এতক্ষণ পর্যন্ত।

“—আমি আর একমিনিটও শাড়ি পরে থাকতে পারব না মনীষা।দেখো কি হাল হয়েছে শাড়ির।”

“—তাই তো দেখছি।আচ্ছা এক কাজ করো।কমনরুমে এখন কেউ নেই।তুমি শাড়ি পাল্টে জামা পরে নাও।জামা নিয়ে এসেছো না?”

“—হ্যাঁ বুদ্ধি করে এনেছি।”

“—বাহ্! তাহলে চটপট চেঞ্জ করে আসো।আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি।ভেতরে কেউ ঢুকবে না।”

“—দারুণ একটা বুদ্ধি দিয়েছো।অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

দুই মিনিটের মধ্যে শাড়ি পাল্টে বাইরে আসল যূথী।যূথীকে আসতে দেখে মনীষা বলে উঠল,

“—আর কলেজে থেকে কাজ নেই যূথী।নিশান ভাইয়া নাকি গেইটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এক্ষুনি ফোন করে বলল আমাদের বাসায় নামিয়ে দিবে।”

যূথী কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বলল,

“—অনুষ্ঠান তো এখনো অনেক বাকি।এত তাড়াতাড়ি চলে যাব?”

“—কি আর করবে বলো।মহারাজা হুকুম দিয়েছে না মানলে কতল করে দেবে। চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

যূথীর চিল্লিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।এই লোক তো তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল।কোথায় ভাবল নাচের প্রোগ্রামটা দেখে বাড়ি ফিরবে কিন্তু তা আর হলো কই।আনন্দ মাটি করতে একজন হাজির হয়ে গেছে যে। আজকাল তো তাঁর দিন শুরু হয় নিশান ভাইয়ার মুখ দেখে আবার রাতও শেষ হয় নিশানের হুমকি ধমকি শুনে।ভালোই গেঁড়াকলে পরেছে সে।
গেইটের সামনে যেতেই দেখে নিশান গাড়িতে বসে আছে।মনীষাদের দেখতে পেয়ে ধমকে উঠে বলল,

“—কখন ফোন দিয়েছি তোদের? এতক্ষণ সময় লাগে আসতে? কাজ ফেলে এখানে এসেছি আমি।জলদি উঠ গাড়িতে। ”

“—কে বলেছে আপনাকে কাজ ফেলে আসতে?সেধে কেউ নিয়ে আসেনি। আবার মেজাজ দেখানো হচ্ছে। ”

মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নিল যূথী।এছাড়া উপায় কি! সামনাসামনি এগুলো বলার দুঃসাহস সে কখনো দেখাবে না।
যূথীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুচকে নিশান জিজ্ঞেস করল,

“—সকালে তো দেখলাম শাড়ি পড়ে বের হয়েছো।এখন শাড়ি কোথায়?”

যূথী মাথা নিচু করে উত্তর দিল,

“—ভালো লাগছিল না তাই খুলে ফেলেছি।”

“—বেশ করেছো।গাড়িতে উঠো এখন।”

নিশান মুখ শক্ত করে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখল।সকালে যূথীকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে তাঁর হুঁশ উড়ে গেছিল।অফিসে গিয়েও ঠিকমত কাজে মন বসাতে পারেনি।তাঁর ইচ্ছা করছিল যূথীকে তুলে এনে সামনে বসিয়ে রাখে।শেষমেষ আর সহ্য করতে না পেরে কলেজে এসেছিল একনজর দেখার জন্য।কিন্তু মহারানী তো সেই আশাটা পূরণ হতে দিল না।

চলবে…………

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৫

একসপ্তাহ ধরে পরীক্ষা চলছে যূথীর।আজ লাস্ট পরীক্ষা। ফুরফুরা মেজাজে হল থেকে বের হলো যূথী।কয়েকদিন কি যে ঝড় গেছে তাঁর উপর দিয়ে।ঠিকমতো পড়াশুনা না করার ফলে পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছিল।আজ আর সেই প্যারা নেই।বাড়িতে গিয়েই আগে ফেসবুক আইডি অ্যাক্টিভেট করে নিবে।এখন তো আর নিশান ভাইয়া কিছু বলতে পারবে না তাঁকে।তবুও ওই লোকের কথা কিছু বলা যায় না।সাবধানে রাখতে হবে মোবাইলটা।
এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মনীষা ও নীলিমা’র হলের সামনে গেল যূথী।
এখন বাজছে বারটা।সকালে দুটো পরোটা খেয়ে বের হয়েছিল কিন্তু এখনই খিদের জ্বালায় পেটে আগুন জ্বলছে। বাড়ি যেতে যেতে তো একটা বাজবে।মনীষা এবং নীলিমা’র পরীক্ষা এখনো শেষ হয় নি।যূথী বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে।

“—তুমি যূথিকা জাহান? ”

পেছন থেকে নিজের নাম শুনতে পেয়ে সেদিকে তাকাল যূথী।একটা মেয়ে পরীক্ষার ফাইল হাতে তাঁরই দিকে তাকিয়ে।কিন্তু সে মেয়েটাকে চেনে না।ক্লাসেও তো দেখেনি।হয়তোবা অন্য ডিপার্টমেন্টের।

“—হ্যাঁ আমিই যূথিকা।কোনো দরকার?”

“—মুশতাক স্যার ডেকেছে তোমায়।যাও দেখা করে এসো।”

“—আমাকে কেনো ডেকেছে?”

“—এটাতো জানি না।”

“—আচ্ছা যাচ্ছি।”

যূথী একবার নীলিমা এবং মনীষা’র দিকে তাকিয়ে ডান দিকে হাঁটা দিল।ওরা পরীক্ষা শেষ করে বের হওয়ার আগেই স্যারের সাথে দেখা করে আসা যাবে।কেনো ডেকেছে কে জানে!

“—স্যার আসবো?”

মুশতাক রহমান হালকা হেসে বললেন,

“—হ্যাঁ এসো।তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম।এখানে চেয়ারটায় বসো।”

মুশতাক রহমানের মুখে এখনো মৃদু হাসি ঝুলছে।যূথী ঠিক বুঝতে পারছে না তাঁকে কেনো ডাকা হয়েছে।আজ যেন স্যারের হাসিটাও অন্যরকম।

“—কোনো দরকার ছিল স্যার?”

“—দরকার? হ্যাঁ… দরকার ছিল বলেই তো ডেকেছি।একটু অপেক্ষা করো।”

মুশতাক রহমান মোবাইলে কিছু খুঁজে যাচ্ছেন। যূথী কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।ওর কাছে স্যারের হাবভাব কেমন যেন ঠেকছে।
মোবাইলে একটা ভিডিও চালিয়ে মুশতাক রহমান যূথীর দিকে বাড়িয়ে বললেন,

“—এর জন্যই ডেকেছিলাম।একটু ভালোভাবে দেখো।”

যূথী মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল।শরীরের স্নায়ুশক্তি যেন দুর্বল হয়ে আসছে।চারপাশের কোনোকিছু তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না।এসব কি দেখছে সে?
সেদিন কমনরুমে তাঁর শাড়ি পাল্টানোর সম্পূর্ণ দৃশ্য মোবাইলে দেখা যাচ্ছে।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল যূথী। চোখের কোনা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। চোখ তুলে সামনে তাকানোর শক্তিও নেই।শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে যেন গরম ভাপ বের হচ্ছে।

“—কি ব্যপার যূথীকা! বেশ ঘাবড়ে গেলে মনে হচ্ছে? ”

মুশতাক রহমান টান মেরে যূথীর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল।
যূথী এখনো পাথরের মূর্তির ন্যায় চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে বসে আছে।পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।মাথায় শুধু ওইদিনের মেয়েটার বলা কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন মেয়েটার কথা সে বিশ্বাস করেনি।
যূথী কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,

“—শিক্ষক হয়ে এ…এটা আপনি কিভাবে করতে পারলেন সা..স্যার?”

যূথীর সামনে বসা ভালো মানুষের মুখোশ পরা লোকটি হু হা করে হেসে উঠল।এমন ক্রুর হাসি শুনে যূথীর মন অজানা আতঙ্কে কেপে উঠছে বারবার।তাঁর সাথে কি খারাপ কিছু হতে চলেছে?

“—ভয় পেয়ো না যূথীকা।এটা কেউ দেখবে না।শুধু আমাকে একটু খুশি করে দিও তাহলেই হবে।আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছো।অতটাও বোকা নয় তুমি তাই না?”

স্যারের বলা কথাগুলো যূথীর কানে অগ্নিবর্ষণের মত প্রবেশ করতে লাগল।কোনো শিক্ষক যে তাঁর মেয়ের বয়সী ছাত্রীর সাথে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে এটা ভাবতেই যেন তাঁর মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।এতদিন পর্যন্ত যাকে একজন আদর্শ শিক্ষক বলে জেনে এসেছে সেই মানুষটার মুখ থেকে কখনো এমন কুরুচিপূর্ণ কথা শুনতে হবে এটা সে কল্পনাও করেনি।
যূথী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল,

“—আপনি একজন অসুস্থ মানুষ স্যার।চিকিৎসা দরকার আপনার।তারপর না হয় কলেজে ছেলেমেয়েদের পড়াতে আসবেন।”

মুশতাক রহমান যূথীর কথা গায়ে মাখলেন না।সামান্য হাসলেন তিনি।সমস্ত ব্যপারটাতেই যেন খুব মজা পাচ্ছেন।
যূথী চলে যেতে নিলেই তিনি বলে উঠলেন,

“—যদি এই ভিডিওটা সকলকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয় তাহলে কেমন হবে?ছেলেরা লুটেপুটে দেখবে তাই না?”

থেমে গেল যূথী।পিছনে ফিরে ওই মানুষটার দিকে ফিরে তাকাতেও ঘেন্না লাগছে তাঁর।বুক ফেটে কান্না আসছে।এ কোথায় ফেঁসে গেল সে?তাঁর জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে!

“—সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানিও যূথীকা।অপেক্ষা করব আমি।”

যূথী আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়ালো না।চোখের জলে সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে।কিচ্ছু চিন্তা ভাবনা করার শক্তি নেই।মাথা ফাঁকা হয়ে আছে।
চারপাশের ছেলেমেয়ে গুলো অদ্ভুত চোখে দেখছে তাঁকে।কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে তোমার। কিন্তু কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় সে নেই।এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা হলো যূথী।



দুপুরের আগে চৌধুরী ম্যানশন কিছুটা নীরব থাকে।বাড়ির মহিলারা নিজেদের ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত এবং পুরুষরা যার যার কর্মস্থলে থাকে।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
মনীষা,নীলিমা এবং যূথী কলেজে।বিদীষা গেছে প্রাইভেটে।বিথী চৌধুরী সাফাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছেন।
আশা চৌধুরী দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখছেন।পাশেই নীলুফা চৌধুরী মেজো জা’কে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। এখনই মেয়েগুলো কলেজ থেকে বাড়ি আসবে।
সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছে এখন নিশ্চয়ই প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে ফিরবে।
মেইন ডোর দিয়ে কারো প্রবেশ করার আওয়াজ পেতেই দুইজন সেদিকে তাকালেন।আঁতকে উঠল তাঁরা।
কান্নাভেজা মুখে যূথী দৌড়ে আসছে।মেয়েটার চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
যূথী কোনোদিকে না তাকিয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল।নীলুফা চৌধুরী তাঁকে পিছু ডাকছেন কিন্তু যূথী সেই ডাক কানে তুলে নি।
যূথীর রুমের সামনে গিয়ে আশা চৌধুরী এবং নীলুফা চৌধুরী এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন।
যূথী ফ্লোরে বসে হিচকি তুলে কান্না করছে।চুল সব এলোমেলো। পরীক্ষার ফাইলটাও পায়ের কাছে পরে আছে।দুইজন অনেকটা ঘাবড়ে গেলেন।
নীলুফা চৌধুরী দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন যূথীকে।

“—এভাবে কান্না করছিস কেনো যূথী?কি হয়েছে আমাকে বল!”

যূথীর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল।নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত গলায় বললেন,

“— এখন কি করব আশা? নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ঘটেছে মেয়েটার সাথে।বাড়িতে কেউ নেই কাকে ডাকব এখন?”

আশা চৌধুরী’র কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ।যূথীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“—এভাবে কেঁদো না যূথী।সব খুলে বলো আমাদের।না বললে তোমার সমস্যাটা কি করে বুঝবো?”

যূথী আগের মতই হিচকি তুলে কাঁদছে।আশেপাশের কোনো কিছুই যেন তাঁর মাথায় ঢুকছে না।কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।

“—আপা নিশানকে খবর দাও।সে পারবে যূথী থেকে কথা বের করতে।”

জা’য়ের কথায় অনেকটাই ভরসা পেলেন নীলুফা চৌধুরী।তাঁর ছেলেই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।

“—ঠিক বলেছিস আশা।আমি এখনই ফোন করছি।”

* হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে যূথী।চোখ বন্ধ করতেই মোবাইলের সেই ভিডিওটা ভেসে উঠছে।একটা মানুষ এত খারাপ কিভাবে হতে পারে! মেয়েদের কাছে তাঁর সম্মানের থেকে বড় কিছু নেই।কার কাছে সাহায্য চাইবে সে?কাউকে জানাতে গেলে হাজারটা লোক জানবে ঘটনাটা।তখন বাইরের মানুষদের সামনে কি করে মুখ দেখাবে।কলেজের ছেলেমেয়েগুলো তাঁকে দেখলেই প্রশ্ন ছুড়ে মারবে।
কোনো উপায় ঠাওর করতে না পেরে দুইহাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের চুল চেপে ধরছে যূথী।ঠোঁট টিপে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

“—যূথী! ”

অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটার ভারী গলার আওয়াজ শুনেই ঝট করে মাথা তুলল যূথী।নিশান ভাইয়া করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।চাউনিতে হাজারো প্রশ্ন।

যূথীর চোখে জল দেখে নিশানের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখের পাতায় জলের বিন্দুগুলো চিকচিক করে উঠছে।নিশানের ইচ্ছে করছে একটানে যূথীকে বুকের মাঝে নিয়ে নেয়।

“—কাঁদছো কেনো যূথী? আমাকে বলো কি হয়েছে?”

নিশান এগিয়ে এসে যূথীর পাশে ফাঁকা জায়গাটা দখল করে নিল।নীলুফা চৌধুরী এবং আশা চৌধুরী দরজার সামনে উৎকন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নিশান যূথীকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।কিন্তু যূথীর কোনো হেলদুল নেই।
বাধ্য হয়ে নিশান তাঁর গান বের করে যূথীর মাথায় ঠেকিয়ে ধমকিয়ে বলল,

“—কানে কথা যাচ্ছে না?লাস্ট বার জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে বলো।নাহলে একদম মাথায় সুট করে দিব।চেনো না আমায়।”

নিশানের হাতের অস্ত্র দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল যূথী।একবার নিশানের দিকে আরেকবার বড়মা’র দিকে ভীত চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু ওঁরা সবাই একই ভঙ্গিতে চেয়ে আছে তাঁর দিকে।
গায়ের উড়নাটার কোনাটা শক্ত করে চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে একে একে সব ঘটনা বলে দিল।

রুমে পিন পতন নীরবতা।কেউ কোনো কথা বলছে না।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই জা আতঙ্কে একে অপরের হাত জড়িয়ে ধরছেন।নীলুফা চৌধুরী চোখের কোনা দিয়ে একবার ছেলেকে দেখে নিলেন।
দেয়ালে টাঙানো বড় পেইন্টিংটায় নিশানের স্থির চোখের দৃষ্টি আবদ্ধ।নীলুফা চৌধুরী ভয়াবহ কোনো ঝড়ের আভাস পাচ্ছেন।নিশানের এমন শান্ত হয়ে থাকা কোনো ভাল লক্ষণ নয়।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে যূথীকে একটান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল নিশান।তাঁর চোখে রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে। যূথী কিছু বলার সুযোগই পেল না।নিশান তাঁর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে যাচ্ছে।রুমের নীরবতার মাঝে এ যেন হঠাৎ বিস্ফোরণ। নীলুফা চৌধুরী পেছন থেকে নিশানকে ডেকে চলেছে।কিন্তু সে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

________________

নিজের কেবিনে চেয়ারে বসে আছেন মুশতাক রহমান।মনের সুখে পান চিবিয়ে যাচ্ছেন। চেহারায় এক ধরনের প্রশান্তির আভাস।কিছু একটা ভেবে ক্ষণে ক্ষণে মুখে হাসি ফুটে উঠছে।তিনি নিশ্চিত যূথীকা নামের মেয়েটা অবশ্যই তাঁর কাছে আসবে।এবারের প্ল্যানটা একদম সুপরিকল্পিত ছিল।আর এই মেয়েটাই সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।তবে তিনি বেশ আনন্দিত।গ্রামের মেয়েরা এমনিতেও কিছুটা ভীতু প্রকৃতির হয়।একে নিয়ে কোনো ঝামেলা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে রেকর্ড করা ভিডিওটা চালু করে দিলেন।এ পর্যন্ত কয়েকবারই দেখা হয়ে গেছে কিন্তু এরপরও তাঁর দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে।
প্রচন্ড শব্দে দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই মুশতাক রহমান ভয় পেয়ে গেলেন।হাত থেকে মোবাইলটা টেবিলের একপ্রান্তে ছিটকে পরল।দরজার দিকে তাকাতে নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,

“—নাফিস ইমতিয়াজ নিশান! ”

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here