স্বপ্নচারিণী,পর্ব_২১,২২

0
2607

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_২১,২২
সামান্তা সিমি
পর্ব_২১

গুটিগুটি পায়ে যূথী নিশানের রুমের সামনে এলো।উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে কেউ নেই।ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল নিশান ফ্রেশ হতে গেছে।যূথী দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে রইল।ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
নিশান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে যূথী চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে নিশানের।মেয়েটার চেহারা এই মুহূর্তে দেখতে কার্টুনের মত ট্যারাবাঁকা লাগছে।
কোনোরকমে হাসি চেপে নিশান গম্ভীর গলায় বলল,

“—তোমাকে বলেছিলাম বাড়ি আসার পর যেন রুমে দেখি।কোথায় ছিলে এতক্ষণ! ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো।ভেতরে আসো।”

যূথী নিচের দিকে তাকিয়ে রুমে প্রবেশ করল।নিশান তাঁর গলায় ঝুলানো টাওয়ালটা যূথীর হাতে দিয়ে কিছু একটা ইশারা করল।যূথী কিছুই বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে।

“— চুল মুছে দাও।”

নিশানের কথা শুনে যূথীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।এই লোক তাঁকে চুল মুছে দিতে বলছে!
যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন সে নিশান ভাইয়ার আজব আজব কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত হচ্ছে।

“—পারব না আমি।আপনি কি বাচ্চা নাকি।আপনার দুইটা হাত আছে না! ওইগুলো কাজে লাগান।”

“—বেশি বকবক না করে যা বলছি করো।নাহলে…”

যূথী মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
“—সবসময় আমাকে হুমকি দিবেন তা তো হবে না! এখন আর আপনার হুমকি’কে আমি ভয় পাই না।”

হু হা করে হেসে উঠল নিশান।যূথী চমকে নিশানের দিকে তাকাল।লোকটার হাসির আওয়াজ যূথীর কানে মধুর এক ঝংকারের মত লাগছে।কখনো এত জোরে হাসতে দেখেনি নিশান ভাইয়া’কে।ইস! ছেলেদের হাসির শব্দ কি এত সুন্দর হওয়া উচিত!

“—চিন্তা ভাবনা শেষ হলে আমার চুল মুছে দাও। চুলের পানিতে আমার শরীর ভিজে যাচ্ছে। নাহলে পরে কিন্তু তোমাকে শরীরও মুছে দিতে হবে।”

যূথীর ঘোর কাটতেই দেখে নিশান দুষ্টু চোখে তারই দিকে চেয়ে আছে।লজ্জা পেয়ে গেল যূথী।নিশান ভাইয়ার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় তাঁর মনের কথাগুলোও যেন লোকটা লাইন বাই লাইন পড়ে নিচ্ছে।

টাওয়াল নিয়ে নিশানের চুলে হাত দিতে গিয়েই যূথী বুঝতে পারল সামনে দাঁড়ানো লোকটা থেকে সে কতটা পিচ্চি। পা উঁচু করেও ভালোভাবে নাগাল পাচ্ছে না।যূথীর অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে নিশান।সেদিকে নজর দিতেই যূথীর কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গেল।তার মানে এই শয়তান লোকটা ইচ্ছে করেই তাঁকে এই কাজটা করতে দিয়েছে।
শেষমেষ বিরক্ত হয়ে যূথী বলল,

“—এরকম টাওয়ারের মত দাঁড়িয়ে থাকলে আমি কি করে মুছবো!এত লম্বা কেনো আপনি?”

“—তোমার তো গর্ব করা উচিত। এত হ্যান্ডসাম একটা বর পেয়েছো।তা না করে জিজ্ঞেস করছো এত লম্বা কেনো!”

রাগে ফুৃঁসছে যূথী।এই লোকটাকে সে কখনো কথায় হারাতে পারে না।এমন পাল্টা জবাব দেয় যে তার বদলে যূথী অন্য কিছু বলার সুযোগও পায় না।
নিশান যূথীর হাত থেকে টাওয়ালটা টেনে নিয়ে বলল,

“—তোমার দ্বারা হবে না কিছুই।শুধু একটা কাজই পারো তুমি।সারাদিন ভীতু একটা চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।”

যূথী চোখ রাঙিয়ে তাকালো নিশানের দিকে।
“—আপনি আমাকে অপমান করছেন নিশান ভাইয়া?কি পেয়েছেন আপনি?যখন মন চাইবে……..”

“—গুলি করে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিব।নিজের জামাইকে ভাইয়া ডাকছো!কালকে বলেছো আমি কিচ্ছু বলিনি।আজকের পর থেকে ভাইয়া ডাক শুনলে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাব।”

যূথী মুখ ভার করে ফেলল।আজকাল নিশান ভাইয়া পান থেকে চুন খসলেই তাঁকে গুলি, থানা, অ্যারেস্ট এসবের ভয় দেখায়।সে কি শুধু শুধু লোকটাকে রাক্ষস বলে নাকি!নিজের চারপাশে এমন এক দেয়াল তৈরি করে রাখে যে কেউ তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।কাছে গেলেই আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতে হয়।যেটা যূথী এখন অনুভব করছে।নিশানের ওমন ভয়াবহ ধমক শুনে চোখ তুলে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না।সে ভাইয়া ডাকবে না তো কি ডাকবে!সকলের সামনে নিশান নিশান বলে চেঁচাবে নাকি।সে আগেও ভাইয়া ডাকত এখনো ভাইয়া ডাকবে। এটাই ফাইনাল ডিসিশান।
ভাইয়া ডাকে ফোবিয়া থাকলে বিয়ে করেছে কেনো তাঁকে!ওই ঐশী মেয়েটাকে বিয়ে করলেই পারত।তাহলে বাড়িতে আর এত ঝামেলা হত না।
ঝামেলার কথা মনে হতেই যূথীর নিশানের বাবা’র চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল।তিনি তো এখনও নিশান ভাইয়ার উপর প্রচন্ড রেগে আছে।তিনি কি কখনো এই বিয়েটা মেনে নেবে! যূথীর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।



রাতে ডিনার করে নিজের রুমে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে যূথী।আজ ডাইনিং টেবিলে যায় নি সে।ওখানে সবার সামনে বসে ভাত খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। বিশেষ করে বড় আব্বু’র কথা মনে পরতেই ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়।
ভাগ্যিস বড়মা তাঁকে এখানে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে।নাহলে নিশান নামক বদ লোকটা তাঁকে হিড়হিড় করে টেনে নিচে নিয়ে যেত।তাঁর তো কোনো ভয়ডর নেই।এমনভাবে চলাফেরা করছে যেন কিছুই হয় নি।কি ধাতু দিয়ে তৈরি উনি!
হঠাৎ করেই একটা কথা মনে পরতে যূথীর চিন্তা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।কাল তো নিশান ভাইয়া বলেছে এখন থেকে উনার রুমে ঘুমাতে হবে।কিন্তু আজ তো সে কিছুতেই ওই রুমে যাবে না।মরে গেলেও না।লোকটা কাছে আসলেই তাঁর কেমন যেন উথাল-পাতাল অবস্থা হয়ে যায়।গতকাল রাতটা আধোঘুমে আধো জাগরণে কাটিয়েছে।
এই রুমে আসার সময় একবার নিশানের রুমে উঁকি দিয়ে দেখেছে লোকটা ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত।কাজ শেষ হলে নিশ্চয়ই যূথীকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে।কি করা যায় এখন!
যূথী হাতের নখ কামড়াচ্ছে আর রুমের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পায়চারি করছে।একটা বুদ্ধি তো বের করতে হবেই।হঠাৎ যূথীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।এই চিন্তাটা আগে কেনো মাথায় আসলো না!যূথী তড়িঘড়ি করে রুমের দরজাটা ভেজিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।



নীলিমা ঘুমিয়ে পরেছে অনেকক্ষণ আগেই।মনীষাও বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানালার থাই গ্লাসের লক আটকাতেই দরজার খটখট শব্দ হলো।ভ্রু কুচকে ফেলল মনীষা। এত রাতে আবার কে আসলো।নিশ্চয়ই বিদীষা।এই মেয়েটারই রাতের বেলা হুটহাট এই রুমে আসার অভ্যাস আছে।
মনীষা দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল।বিদীষা নয়।যূথী কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“—কি হলো যূথী! এখনো ঘুমাও নি?”

যূথী আমতাআমতা করে উত্তর দিল,
“—আসলে…মনীষা..আমি কি তোমাদের সাথে ঘুমাতে পারি?আজ তোমাদের সাথে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”

“—আশ্চর্য! ঘুমাতে মন চাইলে ঘুমাবে।এত হেসিটেট করার কি আছে!কিন্তু ভাইয়া…..”

মনীষাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই যূথী বলল,
“—আচ্ছা তাহলে সরে দাঁড়াও।রুমে ঢুকি।আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে। ”

মনীষা ঈষৎ সন্দেহের দৃষ্টিতে যূথীর দিকে তাকিয়ে আছে।যূথীর তো এখন ভাইয়ার রুমে থাকার কথা।তাহলে এখানে কি করছে।
যূথী বিছানায় যেতেই মোবাইলে টুং করে আওয়াজ হলো।হাতে নিয়ে দেখে নিশানের মেসেজ।

‘হোয়্যার আর ইউ?’

প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে যূথীর।নিশ্চয়ই নিশান ভাইয়া তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে রুমে গিয়ে পায় নি।এবার লোকটাকে ভালোমত জব্দ করা গেছে।সবসময় তাঁকেই কেনো হেনস্তা করবে!এবার তো যূথী জিতে গেল।মুখভর্তি হাসি নিয়ে যূথী ঘুমিয়ে পরল।

মাত্রই চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে তখনই মনীষার ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল যূথী।ঘুমের কারণে অন্ধকার দেখছে চোখে।

“—কি ব্যপার মনীষা?ডাকলে কেনো?”

“—দেখো না যূথী বোতলে পানি নেই।তখন আনতে ভুলে গেছি।এখন একা একা নিচে যেতে ভয় লাগছে।তুমি একটু সাথে আসো প্লিজ।নীলিমাকে ডেকে লাভ নেই।ভুমিকম্প আসলেও সে ঘুম থেকে উঠবে না।”

হেলতে দুলতে যূথী মনীষার পিছন পিছন এগিয়ে চলছে।দুএকবার হোঁচট খেতে গিয়েও সামলে নিয়েছে।একটু ভালোভাবে চোখ মেলতেই দেখে মনীষা দাঁড়িয়ে পরেছে।সামনের বন্ধ দরজাটায় নক করছে।
যূথী হাই তুলে বলল,

“—পানি আনতে না গিয়ে কোথায় এলে মনীষা? কার রুমে যাচ্ছো?”

“—তোমার বরের।”

চমকে উঠল যূথী। এটা তো নিশান ভাইয়ার গলা।মুহূর্তেই চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল।
একি! সে তো নিশান ভাইয়ার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। আর ওই তো নিশান ভাইয়া দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ তো ঘুমের কারণে কিছুই খেয়াল করেনি।মনীষার দিকে তাকাতেই দেখে মুখে বিশ্বজয় করা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।তারমানে এই মেয়েটা ট্রিকস খাটিয়ে তাঁকে নিশান ভাইয়ার রুমের সামনে নিয়ে এসেছে।

“—স্যরি যূথী।তোমাকে এখানে আনতে বাধ্য হলাম আমি।ভাইয়া বলেছে এই কাজটা করতে পারলে আমাকে নতুন ল্যাপটপ কিনে দেবে।এতবড় অফার ইগনোর করার সাধ্য আমার নেই।হিহিহি।এখন যাই আমি।টাটা।”

কথাটা বলেই উল্টোদিকে হাঁটা দিল মনীষা। যূথী এখনো বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।কি হচ্ছে এসব?
নিশান একটান দিয়ে যূথীকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল।

“—আমার সাথে চালাকি?দেখলে তো কিভাবে তোমার চালাকির গলায় দড়ি পরিয়ে দিলাম!”

ভ্রু নাচিয়ে কথাগুলো বলল নিশান।ঠোঁটে ঝুলছে বাঁকা হাসি।রাগে যূথীর শিরা-উপশিরা গুলো ফেটে যাচ্ছে। ইনি কি মানুষ না অন্য কিছু!

“—আমার এই রুমে ঘুম আসে না।শুনতে পেয়েছেন?”

“—আস্তে কথা বলো যূথী।চিল্লাচ্ছো কেনো।তোমার ঘুম না আসলে আমি কি করব।আমার তো বউ ছাড়া ঘুম আসে না ”

“—ন্যাকামো করছেন আমার সাথে?ঢং! বউ ছাড়া ঘুম আসে না!”

ধপধপ পা ফেলে যূথী বিছানায় গিয়ে উল্টোদিক হয়ে শুয়ে পরল।নিশান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যূথীর কান্ড দেখে হাসি আর চেপে রাখতে পারছে না।
যূথীকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে যূথীর গলায় মুখ গুঁজে দিল।
বিছানার চাদর খামচে ধরল যূথী।নিশানের দাঁড়ি গুলো ফুটছে ওঁর গলায়।একজোড়া উষ্ণ ঠোঁটের বিচরণ টের পাচ্ছে সে। তাঁর মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এ কেমন অনুভূতি! মনের গহীনে এলোমেলো হাওয়া বইছে। যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে তাঁকে।যূথী চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিশানের চুল খামচে ধরল।
তখনই নিশানের গলার আওয়াজ শোনা গেল।

“—ভয় পেয়ো না যূথী।যথেষ্ট টাইম দেব তোমায়।ঘুমিয়ে পরো।”

চলবে……….

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_২২

দুপুরের মধ্যভাগ এখন।মাথার উপর গনগনে সূর্য। তার তীব্র তেজে মানুষের শোচনীয় অবস্থা। রাস্তাঘাটে তৃষ্ণায় লোকজনের বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
মনীষা এবং নীলিমা ঘর্মাক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।গরমে তাঁদের বেহাল দশা।এসি গাড়ি দিয়ে চলাচল করেও এই অবস্থা তাহলে সাধারণ মানুষদের না জানি কি হাল!
দুইবোন শুকনো মুখে ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপাস করে বসে পরল।
কয়েকহাত দূরে ডাইনিং টেবিলে সদ্য ফ্রিজ থেকে নামানো ঠান্ডা পানির বোতল দেখা যাচ্ছে। বোতলের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা।দুইজন উৎসুক চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে।উঠে গিয়ে যে বোতল থেকে পানি খাবে সেই শক্তিও যেন নেই।
সিড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে নীলুফা চৌধুরী সবটাই দেখলেন।পানির বোতল নিয়ে ওঁদের সামনে যেতেই ওঁরা ক্লান্ত গলায় বলল,

“—থ্যাংকস বড়মা।”

ঠান্ডা পানি খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওঁরা।দুইজন সোফায় গা এলিয়ে দিল।

“—যূথী কোথায় বড়মা?ওঁর খবর আছে আজ।আমাদের না বলে কেনো চলে আসলো?আমরা কতক্ষণ ওঁর জন্য গেইটে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

নীলিমার কথা শুনে নীলুফা চৌধুরী অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন।মনীষা সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে উঠল,

“—তুমি বাঁধা দিবে না কিন্তু। ওঁকে আজ অনেক বকবো।”

“—কি যা তা বলছিস!যূথী কখন বাড়ি আসলো।বিগত একঘন্টা ধরে আমি ড্রয়িংরুমেই আছি।কই ওঁকে আসতে দেখিনি তো!”

দুইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।যূথী কি তাহলে কলেজে রয়ে গেল।এতক্ষণে হয়তোবা তাঁদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছে।

“—বড়মা যূথী মনে হয় কলেজে আছে।আমাদেরকে খুঁজে না পেয়ে চলে আসবে নিশ্চয়ই। দাঁড়াও ওঁকে একটা কল দেই।”

যূথীর ফোন বন্ধ। নীলিমা বেশ কয়েকবার ট্রাই করল।ফলাফল শূন্য।
মনীষা সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল,

“—চিন্তা করো না বড়মা।ও এখনই এসে যাবে।হয়তোবা কলেজে কোনো কাজে আটকে পরেছে।”

“—ঠিক আছে।তোরা হাত-মুখ ধুয়ে আয়।আমি খাবার দিচ্ছি।ততক্ষণে যূথীও এসে যাবে।”
দুইবোন মাথা দুলিয়ে উপরে চলে গেল।



একঘন্টা পার হয়ে গেছে।যূথীর বাড়ি ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই।নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত মুখে মেইন ডোরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত দেরি হচ্ছে কেনো মেয়েটার!ফোনও ধরছে না।এমন তো কখনো করে না।বিথী চৌধুরী বারবার বলছে,

“—চিন্তা করো না আপা।এসে যাবে।আর সে-ই বা কেমন মেয়ে।কোনো কাজ থাকলে ফোন করে বলে দিলেই হয়।তা না করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে।সব দায়িত্ব জ্ঞানহীনের মত কাজকর্ম।”

নীলুফা চৌধুরী কোনো উত্তর দিলেন না।মনীষা এবং নীলিমা হাতে পার্স নিয়ে নিচে আসল।ওঁরা দুজনও খুব অশান্তিতে আছে।যূথী তো ঢাকার রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না।একা একা আবার অন্য কোথাও চলে যায় নি তো!

“—বড়মা, আমি আর মনীষা একবার কলেজে দেখে আসি।তুমি দুশ্চিন্তা করো না কেমন।”

নীলুফা চৌধুরী মাথা তুলে তাকালেন।তিনি মনে মনে খুব ভয় পেয়ে আছেন।আবার রাগও হচ্ছে খুব।এমন বোকার মত কাজ কেউ করে! যূথী তো জানে টাইমমত বাড়ি না ফিরলে তাঁর বড়মা কতটা চিন্তিত থাকে।এরপরেও ফোন বন্ধ করে রাখলো কেনো।আজ আসুক বাড়িতে।ঠিকমতো কয়েকটা বকা দিয়ে দেবে।

“— তোরা একা যাস না।একটু অপেক্ষা কর।আমি কাপড়টা পাল্টে আসি।আমিও যাব।”

নীলুফা চৌধুরী দ্রুত পায়ে উপরে উঠে গেলেন।
মনীষা শেষবারের মত যূথীর নম্বরে কল করল।আগের মতই মিষ্টি গলার একটা মেয়ে বলছে ‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না।’
ফোনের ওপাশের মেয়েটার মিষ্টি গলাটাও যেন বিষের মত লাগছে মনীষার কাছে।মেয়েটার গলা চিপে ধরতে পারলে শান্তি লাগত।



কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে ওঁরা তিনজন।আশেপাশে কোনো ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে না।ওঁরা ভালোভাবে পুরো ক্যাম্পাস খুঁজে নিয়েছে।কিন্তু যূথী কোথাও নেই।কলেজের বাইরের আঙিনায়ও চক্কর দিয়েছে কয়েকবার।
নীলুফা চৌধুরী’র মুখ শুকিয়ে আসছে।কলেজে না থাকলে মেয়েটা গেল কোথায়।আর কোথায় খুঁজবে।
তখনই নীলিমার ফোন বেজে উঠল। ফোনের আওয়াজে তিনজনের চোখ চকচক করে উঠল।হয়তোবা যূথী কল দিয়েছে।
ফোনের স্ক্রিনে ‘নিশান ভাইয়া’ নামটা দেখে তিনজনই হতাশ হয়ে গেল।নীলিমা কল রিসিভ করতেই নিশানের ধমক মিশ্রিত কন্ঠ শোনা গেল।

“—যূথী কোথায়?ওর ফোন বন্ধ কেনো?সে কোন কাজে ব্যস্ত যে ফোন বন্ধ করে রাখতে হবে?ওঁকে বল আজ বাড়িতে এসে দফারফা করব আমি।”

নীলিমা করুণ চোখে বড়মা’র দিকে তাকালো।নিশান ভাইয়াকে কি এখনই সবটা বলে দেয়া উচিত!নাকি আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে দেখবে।
নীলুফা চৌধুরী ইশারায় না করতেই নীলিমা আমতাআমতা করে বলল,

“—আ..আসলে ভাইয়া।কলেজ থেকে আসার পর যূথীর খুব মাথা ব্যথা করছিল।তাই ঘুমিয়ে পরেছে।ওর ফোনে বোধ হয় চার্জও নেই।তাই…”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিশান বলল,
“—ঠিক আছে।ঘুম থেকে উঠলে বলবি আমাকে কল দিতে।অপেক্ষা করব আমি।”

ফোন রাখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই।নিশানকে এখন কিছু বললেই অযথা চেঁচামেচি শুরু করবে।তার চেয়ে ভালো যূথীর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ নেওয়া যাক।
নীলুফা চৌধুরী মনীষা এবং নীলিমা নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে পরলেন।


সন্ধ্যা মিলাবার কিছুক্ষণ আগে তিনজন হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন।তাঁদের মুখে আশঙ্কার ছায়া।কোথাও খুঁজে পায়নি যূথীকে।
কিছুক্ষণ পরই বাহিরে অন্ধকার নেমে আসবে।বাড়ির সকলে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে।
নীলুফা চৌধুরী কোনো উপায় না পেয়ে স্বামীকে ফোন দিলেন।সব ঘটনা বলতেই মফিজ চৌধুরী ঠান্ডা গলায় বললেন,

“—নিশানকে খবর দাও নি কেনো।ওঁকে তো সবার প্রথমে খবর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”

স্বামীর কথাটা সহ্য হলো না নীলুফা চৌধুরী’র।কড়া গলায় বলে উঠলেন,

“—মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর তুমি এখনও তোমার রাগ -অভিমান নিয়ে পরে আছো! কবে থেকে এত পাষাণ হলে।মেয়েটার সাথে আমার ছেলের জীবন জড়িয়ে আছে।যূথীর কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ব না।”

“—উত্তেজিত হচ্ছো কেনো নীলু।আমি দেখছি কি করা যায়।বেশি টেনশন করো না।প্রেশার বেড়ে যাবে তোমার।”

এই মুহূর্তে স্বামীর কথাগুলো খুবই বিষাক্ত মনে হচ্ছে। তিনি খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন।
সবাই থমথমে মুখে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। নীলুফা চৌধুরীর চোখ ছলছল করছে।কাল রাতেও তো মেয়েটাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে কে জানে।নিশ্চয়ই ক্ষুধায় কাতর হয়ে থাকবে।
নীলিমার ফোনের ভাইব্রেশনে সকলের মনোযোগ সেদিকে চলে গেল।নিশান কল করেছে।নীলিমা কাঁপা হাতে রিসিভ করল।

“—হ্যালো ভাইয়া….!”

কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই নীলুফা চৌধুরী তড়িৎ গতিতে ফোনটা কেড়ে নিলেন।
“—নিশান তুই এই মুহূর্তে বাড়ি আয় বাবা।আমার মাথা কাজ করছে না কি করব।কোনো প্রশ্ন করবি না এখন।প্লিজ বাড়ি আয়।”
নিশানের উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিলেন তিনি।মনীষা এগিয়ে গিয়ে তাঁর বড় মা’কে জড়িয়ে ধরল।

*

দশমিনিটের মাথায় বাড়ির মেইনডোর দিয়ে নিশানকে ঢুকতে দেখা গেল।নীলুফা চৌধুরী দৌড়ে এসে নিশানের হাত ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,
“—যূথীকে খুঁজে পাচ্ছি না নিশান।তুই কিছু কর।”

“—খুঁজে পাচ্ছো না মানে?নীলিমা তো বলেছিল যূথী ঘুমাচ্ছে। ”

নীলুফা চৌধুরী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু খুলে বললেন।মুহূর্তেই নিশানের চেহারা পাল্টে গেল।যেখানে রাগ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।চিল্লিয়ে বলে উঠল,

“—এই খবরটা আমাকে এখন বলছো?পাগল তোমরা?”

নীলুফা চৌধুরী ভয়ে ভয়ে বললেন,
“—তোর বাবাকে জানিয়েছি।মাহিরকেও কল করেছিলাম।সে বলেছে যূথীর কলেজে খোঁজ নিবে।”

গর্জে উঠল নিশান।
“—ওদেরকে জানিয়েছো আর আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না!ওঁদের ফোন দিয়ে বলে দাও কিচ্ছু করতে হবে না।আমার বউকে আমিই খুঁজে বের করব।যূথীকে না পাওয়া পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরব না”
বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল নিশান।

__________________________

দুইদিন দুইরাত কেটে গেছে।নিশান যূথীকে নিয়ে এখনো বাড়ি ফিরেনি।নীলুফা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে অস্থির।বাকিরা সবাই শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সন্ধ্যা সাতটা বাজছে এখন।মফিজ চৌধুরী সিগারেট হাতে ছাদে বসে আছেন।তাঁর চোখে মুখে এক ধরনের বিষন্নতার ছাপ।সিগারেটটা টানতে ইচ্ছা করছে না আবার ফেলে দিতেও মায়া লাগছে।
তাঁর মনের ভেতর এক ধরনের যুদ্ধ চলছে।আজ দুইদিন হলো যূথী মেয়েটা বাড়ি নেই।সেই সাথে নিশানও লাপাত্তা। তিনি তো সর্বোপরি চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ।আজ সকাল থেকেই কেনো জানি যূথীর কথা ভাবতেই তাঁর মনটা ভার হয়ে আছে।গভীর মমতা বোধ করছেন মেয়েটার প্রতি।সেদিন রাগের বশে মেয়েটাকে কয়েকটা জঘন্য কথা বলে ফেলেছিলেন।শত হোক তাঁর পুত্রবধূ।
চমকে উঠলেন মফিজ চৌধুরী। নিজের অজান্তেই তিনি যে কখন যূথীকে তাঁর ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তা টেরও পেলেন না।হঠাৎ করেই যূথীর জন্য তাঁর বুকটা হাহাকার করে উঠল।কোথায় আছে মেয়েটা।মফিজ চৌধুরী সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় সিগারেটে আরেকটা টান দিলেন।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here