শিরোনামহীন,পর্বঃ১৩+১৪

0
2635

শিরোনামহীন,পর্বঃ১৩+১৪
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১৩

কিছুক্ষণ পূর্বে সাব্বির, সাবেতের জন্য একটি বই নিয়ে এসেছে।
“রিটার্ন অফ শী”।
সাবেত সবে মাত্র দুচোখ বন্ধ করেছে।
ডান হাত মাথার নিচে, বাম হাত কপালের উপর রাখা৷ দুচোখ বন্ধ রাখার পরেও মনে হচ্ছে সে কিছু দেখতে পাচ্ছে। অনুভব হচ্ছে তীব্রভাবে।সেদিনের “শী” উপন্যাস, আনতারার কন্ঠে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর কবিতার অংশ, আজকের আনতারার স্পর্শ সব মিলিয়ে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে সাবেতের।
বাহিরে তখনো আলো নিভে যায়নি। কি মনে করে সাবেত উঠে বসল,তারপর পাশে রাখা টিশার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে ছুটলো আনতারার বাড়ির পথে।

মাগরিব ওয়াক্তের আজান পড়েছে৷ আনতারা গাছে পানি দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাশেই।
মান্থলি চলার কারণে নামাজ পড়তে পারছে না। তাই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কুসুম রঙা আকাশের দিকে।
ঝুপ করেই যেন সন্ধ্যা নেমে এলো। পিছন ফিরে দাঁড়াতেই বাধা পেলো সে। সাবেতের সটান বুকের সাথে সংঘর্ষ হলো তার কপালের।

কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াতেই সাবেত জিজ্ঞেস করল,

“আমি কি আমার কাজের জন্য তোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য?”

দু দিকে মাথা দুলিয়ে আনতারা না সূচক ইশারায়, সাবেত খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আনতারার হাত। তারপর সে হাত নিয়ে রাখে তার প্রশস্ত বুকের বাম পাশে।

ইদানীং আনতারার অঅনুভূতি আনতারা নিজেই বুঝতে পারে না।এদিকে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সাথে সৃষ্টি হয়েছে তার অদৃশ্য দেয়াল।তবে সাবেতের অনুভূতি গুলো না বুঝতে পারার মতোন নির্বোধ সে নয়।ভালো লাগে, বেশ ভালো লাগে এমন ছোট ছোট অনুভূতি আনতারার। তবে এই অনুভূতি কে ভালোবাসার নাম দেওয়ার মতোন অনুভূতি এখনো মনে জাগেনি দুজনের কারো।

সাবেত আনতারার হাত ছেড়ে দিতেই আনতারার হাত খসে পড়ছিল সাবেতের বুক থেকে। অথচ গাঢ় অন্ধকারে আনতারা যেন সাবেতের সেই দৃষ্টি দেখতে পেল,এবং হাত আপনা-আপনি আবদ্ধ হলো সাবেতের বুকে।

ম্যাচের কাঠি দিয়ে ফস করে আগুন জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরায় সাবেত।
সিগারেট মুখে নিয়ে সবে মাত্র টান দিবে অমনি আনতারা এক টানে সিগারেট নিয়ে ফেলে দেয় পাশের জংগলে। ঘটনার আকস্মিকতায় সাবেতের উচিৎ ছিল চমকে যাওয়া, তবে সে মুচকি হাসলো।
আনতারা তেঁতে উঠে একটানে হাত সরিয়ে নিয়ে গটগট করে চলে গেল।

দুইটি ভিন্ন মানব, দুটো ভিন্ন অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হওয়া কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার ছিল।

বাড়ি ফিরে সাবেতের হুশ ফিরল।এতক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।এবার হুশ ফিরল।ভাগ্যিস আবেগের তাড়নায় অন্য কিছু করেনি। না হলে সদ্য পিতা হারানো মেয়ে হয়তো নিজেও গলায় দড়ি দিত। কারণ তার যে আত্নসম্মান বোধ সবার থেকে কিছুটা হলেও বেশি।

দেখতে দেখতে চলে এলো প্রি-টেস্ট পরীক্ষার দিন৷ নাকানিচুবানি খাওয়া হলো সব পরীক্ষার্থীর। কারণ গনিত, রসায়ন পরীক্ষার প্রশ্ন কমন পড়েছিল মাত্র ৭০%। প্রায় অনেকটা কাছাকাছি নাম্বার নিয়েই হিমু প্রথম এবং আনতারা দ্বিতীয় হলো।
আনতারাকে এ বিষয়ে কেউ কিছুই বলেনি, তবে সাবেত বেশ রেগে আছে। কেননা সে আনতারা কে সবার থেকে আলাদা ভালো ভাবে বেশি সময় নিয়ে পড়ায়৷বাবার মৃত্যুতে এভাবে ভেংগে পড়লে চলবে না কি?
সাবেতের বাবা মারা গিয়েছেন, তখন সাবেতের বয়স মাত্র বারো।মাথার উপর কেউ ছিল না। মা, ভাই, বাবার ব্যবসা সাথে বাগান সব নিজ হাতে সামলেছে সে।
বাবার লাশ ঘরে রেখে দুদন্ড কাঁদার সময় পায় নি। কারণ তাকেই দাফনের সব ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।সেদিকে আনতারার সবাই আছে। অথচ?

সন্ধ্যেবেলা বিদুৎ চলে গেছে৷ বাহিরে ভাপসা গরম৷ তাই উঠোনে বসে আছে আনতারার বাড়ির সবাই৷ হঠাৎ কুমুদ বেগম ধীরে চিৎকার করেন। রওশন বেগম জানতেন এমন কিছু যখন তখন হবে৷
দ্রুত সব গুছিয়ে নিয়ে কুমুদ বেগম কে নিয়ে রাত-বিরেতে ছুটলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
কিছু রাস্তা আসার পর তাদের মনে হলো আনতারা ঘরে ঘুমিয়ে ছিল।দ্রুত পায়ে ফিরে এলেন আনতারার বড় ভাই। বোনকে ডেকে তুলে প্রায় কোলে নিয়েই এগিয়ে গেলেন কুমুদ বেগমদের ভ্যানের দিকে।আনতারার ঘুম আগলা হলে খেয়াল করল সে ছুটে চলেছে দাদাভাইয়ের সাথে৷
কিন্তু পথে সিদ্ধান্ত বদল হলো।
আনতারাকে রেখে যাওয়া হলো সাবেতের মায়ের কাছে। এমন অবস্থায় যত মানুষ সাথে যাবে সাহস তত বেশি তাই, সাব্বির চললো তাদের সাথে। সাবেত তখনো ফিরেনি।

বাজার থেকে ফিরে এসে অন্ধকারের মাঝেই ঘরে ঢুকে সাবেত গা এলিয়ে দেয় সোফায়। মাথা রেখে মুখ সামান্য কাত করতেই অনুভব করে বেশ নরম তুলতুলে কিছু অনুভব করে।
শ্বাস-প্রশ্বাস স্পষ্টত। এটা মোটেও বিড়াল নয়।উক্ত ব্যাক্তির গা থেকে আগত সৌরভ সাবেতের পরিচিত। সে ঘুমন্ত আনতারার কোলে মাথা রেখেছে। আনতারার ধীর গতিতে গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস মুখ ডুবাতে হুকুম দিচ্ছে তার মস্তিষ্ক কিন্তু আত্নবোধ বলছে,

“সাবেত, কি প্রয়োজন অন্ধকারে সুযোগ নেওয়ার? এ তো তোমার প্রেয়সী।তোমার ভবিষ্যৎ সম্পদ৷ তুমি কি তার পবিত্রতা নষ্ট করবে?”

পরক্ষণেই ভিতরের প্রেমিক পুরুষ গর্জে উঠে বলল,

“প্রেয়সীর শরীরে প্রেমিকের হাত হতে হয় অবাধ্য৷ তুমি প্রেমের নীতি না মেনে প্রেমে ডুব না দিলে তোমাকে প্রেমিক সমাজ মানবে তো?”

চলবে

শিরোনামহীন
সৌরভে সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ১৪

দেখতে দেখতে শীত চলে এসেছে। এক টুকরো রোদের ফালি সবে মাত্র এসে বসেছে।আনতারার কোলে কুমুদ বেগমের চার মাসের বাচ্চা। সেরাতে কুমুদ বেগম এক ছেলে জন্ম দিয়েছেন। পরদিন সকালবেলায় যখন বাড়ি ফিরে এলো তারা তখন বাচ্চা ছেলেটা পিট পিট করে তাকিয়ে দেখছিল সব কিছু। কেউ কিছু বললে ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট গোল করে তাকিয়ে থাকত। তাই আনতারা নাম দিল আগ্রহ।
সবার সব কথায় আগ্রহী ছেলের নাম হলো আগ্রহ।

আগ্রহ কে কোলে নিয়ে, কাপড়ে প্যাচিয়ে নিয়ে আনতারা বসেছিল উঠোনে।
ইদানীং তার রুটিন কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। গাছে পানি দিয়ে নামাজ শেষে সে সকালে সাবেতদের বাগানে যায়। বাবার কবর এক ঝলক দেখে দরুদপাঠ করে ফিরে এসে কিছুটা সময় কাটায় আগ্রহের সাথে তারপর পড়তে বসে সাবেত এলে।

সাবেত আনতারার আশেপাশে তো থাকে কিন্তু যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে।
আনতারার শরীরের সৌরভে একধরনের মাদকতা অনুভব করে সে।এই মাদকতায় একটা আনন্দ পায় সে। কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা ভালোলাগা সব মিলিয়ে ভালোবাসা।

সকাল সকাল সে যাচ্ছে আনতারার বাড়ি। রাস্তায় নামতে নামতে খেয়াল হলো গতকাল আনতারার জন্য কিনে আনা ছোট্ট নুপুর জোড়া তো ঘরেই রয়ে গেছে।
আপাতত আনতারার পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করবে তারপর ভালোবাসার কথা জানাবে। তবে এই কয়েকমাস বেশ খেয়াল রেখেছে সে আনতারার।অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে আনতারা। বাবার মৃত্যু মেনে নিতে পারছিল না। বিশেষ করে ক্ষত-বিক্ষত লাশ।
ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো সাবেতের। সে সকালে সিদ্দিক কল দিয়ে বলল,
রেললাইনে যেতে। আড্ডায় বসে থাকা মাহিরের মুখ চুপসে যায় কল আসার পর। দ্রুত ছুট লাগায় তারা রেললাইনের দিকে। পুরো দেড় মাইল হেটে হেটে তারা সম্পূর্ণ দেহের মাংস কুড়িয়ে এনেছিল।মানুষের মাথার ভিতর মগজ এত বড় হয়! না দেখলে বুঝতেই পারতো না।

আনতারার চিৎকার, বাবা ডাকে আহাজারি সব মিলিয়ে সে দিন ছিল একটা জঘন্য দিন। সেদিনের পর চুপচাপ মেয়ে আরো চুপ হয়ে গিয়েছিল।এতটা কষ্ট নিতে পারেনি সে। চোখের জল কে অপমান করা যায় না।দূঃখ কষ্ট কে দুচ্ছাই করা যায় না। না হলে জীবন তাকে চোখের জলের সমুদ্রেই ফেলে দেয়।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আনতারার ঘরে চলে এসেছে খেয়াল করেনি সাবেত। ঘরে ঢুকতেই খেয়াল হলো
সাদা কভার ওয়ালা লেপের নিচে ঘুমিয়ে আছে আনতারা। তার বাম হাতের উপর আগ্রহের মাথা রাখা।
সাদায় অপরুপ লাগছে আনতারাকে।
বাচ্চাটা মনে হচ্ছে তার নিজের।
মুচকি হেসে সাবেত পাশে বসে কপালে হাত দিতেই চোখ মেলে তাকায় আনতারা৷
আগ্রহ কে ধীরে সুস্থে নামিয়ে উঠে বসে।

মিনিট দুয়েক যেতে না যেতেই সাবেত কিছু কারণে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
আনতারার গা থেকে আফটার শেভ ক্রিমের গন্ধ আসছে।
মনে হচ্ছে আনতারা কাউকে জড়িয়ে ছিল। যার ফলে সেই লোকটার আফটার শেভ ক্রিমের গন্ধ আনতারার গায়ে মিশে আছে।
সাবেতের গায়ে কে যেন ফুটন্ত তেল ঢেলে দিয়েছে তার গায়ে। এতটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে সে।
ত্রস্ত হাতে আনতারার গলায় চাপ দিয়ে বিছানার সাথে লাগিয়ে দিয়ে বলল,

“তোর সাহস কি করে হয়? তোর গা থেকে কি গন্ধ আসে? তুই আমার না তো কারো না।আগে তোকে গলায় কলসি বেধে নদীতে ফেলবো তারপর আমি ডুব দিয়ে মরবো। মনে রাখিস। ”

কথা শেষে নুপুরের প্যাকেট জোরে আনতারার দিকে ছুড়ে দিয়ে চলে যায় সাবেত।

আনতারা মুচকি হেসে তাকিয়ে রইল সাবেতের যাওয়ার পথে।অথচ সে জানতো না ঘন্টা দুয়েক পরেই পাল্টে যাবে তার এই জীবন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here