শিরোনামহীন,পর্বঃ২১+২২
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
পর্বঃ২১
একজন মানুষকে ভালোবাসলে তার সবটা ভালোবাসতে হয়।
ভালো লাগাকে ভালোবাসতে হবে, খারাপ লাগাকে ভালোবাসতে হবে।
তার রাগ-অভিমান,দুঃখ, কষ্ট,শান্তি-পরিশ্রান্তি সব কিছুকে ভালোবাসতে হয়।
ভালোবাসায় একান্ন, চুয়ান্ন ধারা নেই, তবে ধারা গুলো থাকা বড্ড প্রয়োজন।
কারণ শুধু নারীই পারে সবটা দিয়ে ভালোবাসতে।
কর্তব্যের বেড়াজালে বন্দী পুরুষদের ভালোবাসা।
পৃথিবীর সব পুরুষ এক নয় তেমনি এক নয় সকল নারী।
পরকীয়ার জন্য যখন একদল নারী আংগুল তুলে দোষ দিচ্ছে পুরুষ সমাজকে ঠিক তখন কিন্তু বাকী চার আংগুল নিজেদের দিকেই রয়ে যায়, ঠিক তেমন ধর্ষনের জন্য পুরুষ সমাজ যেমন নারীর পোশাকে আংগুল তুলে বাকী আংগুল থেকে যায় নিজেদের দিকে।
দিন শেষে নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক।
আমরা একজাতি অন্য জাতি কে ছাড়া চলতে পারি না, তবে কেনো একদল অন্য দলের দোষ খুঁজে বেড়াই?
পুরুষ মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি।
ভালোবাসার সাথে শারিরীক একটা সম্পর্ক রয়েছে।
সঙ্গী যত স্মার্ট হবে, তার প্রতি চাহিদা আমাদের বাড়বে৷
মূলত আমাদের মনে লাভ এট ফার্স্ট সাইড বলতে কিছুই নেই। আমরা ভেবে চিন্তা করে, হিসেব-নিকেশ অনুযায়ী ভালোবাসি।
কারণ আমরা সবাই সুন্দরের পূজারি।
ভালোবাসা এবং সৌন্দর্য দুটোই বেদনা মেশানো হওয়া উচিৎ। মহান সৌন্দর্য এবং ভালোবাসার সাথে বেদনা মেশানো না থাকলে তাদের কদর আমরা করতে পারি না৷
এডগার এলেন পোর কি বলেছিলেন জানেন?
“A feeling of sadness and longing
That is not akin to pain,
And resembles sorrow only
As the most resembles the rain.
আমাদের জীবন বড্ড ছোট।
অন্যকে শুধরে দেওয়ার আগে নিজে শুধরে নিতে হবে।ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পেতেই হবে এমন নয়।
সেশন শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজতেই উঠে দাঁড়ায় তাফসির।ধীরে স্টুডেন্ট বেরিয়ে যাওয়ার পর বেধে রাখা চুল খুলে দিল সে৷
হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে লেখাপড়া করেছে তাফসির।তাই খুব দ্রুত মানুষের মন অবধি পৌঁছাতে পারে সে।
এখন তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে সাবেত আসবে৷
এসে বলবে সে আনতারা কে ভুলতে পারছে না, দেশে ফিরে যাবে।
তবে তাফসির এটাও জানে যে,
সাবেতের মা আবার কোনো একটা কসম দিয়ে তাকে আটকে দিবে, যেমন টা দিয়েছিল মাস দুয়েক আগে৷
ভদ্র মহিলা যুক্তিতে না পেরে মারিয়ার পেটে সাবেতের হাত রেখে কসম নিয়েছিল
বাচ্চা হওয়ার আগ অবধি সে দেশে যাবে না, যদি যায় তাহলে তার অনাগত সন্তানের ক্ষতি হবে৷
সাবেতের মনে হয়তো বাবা হওয়ার সূক্ষ্ম অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল।তাই সাবেত চুপচাপ মেনে নিয়েছিল।
মারিয়া সন্তান জন্ম দেওয়ার পর কসমের সময় সীমা শেষ তাই সাবেত আসবে এখানে, আনতারার কাছে ফিরে যাবে এটা জানাতে।
সারা বিকেল আনতারা কে খুঁজে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
একা কোথাও যাওয়ার অবস্থা তার নেই।
সাত মাসের ভরা পেট, কংকালসার শরীর, খুব একটা জোড় পায় না শরীরে৷
কিন্তু সে গেল কোথায়?
জেলার সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রফেসর পদে জয়েন করেছে মাহির।
আজ প্রফ ছিল তাই ফিরতে দেরি হয়েছে।
কিছুদূর আসার পর খেয়াল করে
আনতারার দুই ভাই আশেপাশে পাগলের মতোন কিছু খুঁজতেছে।
বাইক থেকে নেমে তাদের জিজ্ঞেস করতেই বলল,
“আনা কে পাচ্ছি না। বিকেলে বাইরে গেছিল, এখনো বাড়ি যায় নাই। এই অবস্থায়….. .
কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি নামলো ঝুমঝুমিয়ে।
মূহুর্তে ভিজে গেল চার পাশের সব।
কি মনে করে মাহির ছুট লাগালো সাবেতদের বাগানে। পিছন পিছন আনতারার দুই ভাই।
মাহির এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। আনতারার দুই ভাই এসে দেখল,
মাটিতে পড়ে আছে আনতারা, বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে বিপরীতে মাটি সহ জায়গা করে নিচ্ছে তার মুখে।
আবছা আলোয় কারোর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, তাদের সামনে বিপদ, ভয়ানক বিপদ অপেক্ষা করছিল।
চলবে
শিরোনামহীন
সাদিয়া খান(সুবাসিনী)
পর্বঃ২২
“আমরা কি কোনো কিছুই করতে পারি না?”
“অতীত নয়, আগামীর জন্য ওকে বাঁচতে শিখাও মাহির৷ ”
“ওর প্রতি আমার তেমন অধিকার নেই ম্যাম।”
“ডক্টরদের রোগীর সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তোমার কি সম্পর্কের প্রয়োজন?”
“ওর অতীত……
” থামো। শুনো, ওকে হাসতে শিখাতে হবে না, শুধু এটুক খেয়াল রাখো যেন কান্না না করে৷ ব্যস৷ মোট কথা ব্যস্ত রাখো। অতীত হচ্ছে নর্দমার পঁচা পানি। যত ঘাটবে ততই দূর্গন্ধ ছড়াবে। তাই বর্তমান বুঝতে শিখাও। কোনো মনো বিশেষজ্ঞ কে দেখাতে হবে না, ওর সাথে ওর সন্তানের পরিচয় করাও।
আসলের থেকে সুদ বেশি প্রিয় হয়। তোমার রোগী অতীতে এত মগ্ন সে নিজের ভিতরের অস্তিত্ব সম্পর্কে টের পাচ্ছে না।
তাকে সন্ধান দাও তার সন্তানের।”
মাহির বসে আছে তার এক সিনিয়র প্রফেসর এর সামনে।
আনতারাকে নিয়ে আসার পর সম্পূর্ণ চিকিৎসা উনিই করছেন। আদ্যোপান্ত সব শুনে উনি মাহিরকে এই পরামর্শ দিলেন।
এবং এর পর চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে চলতে লাগলেন আনতারার কেবিনের দিকে।
আনতারার দুচোখ বন্ধ৷ চুপচাপ শুয়ে আছে সে। হাতে স্যালাইন চলছে। শরীর প্রচন্ড দুর্বল। আজ বিকেলে বকুল তলায় বসে ছিল। উঠার সময় মাথায় বেশ চিনচিনে ব্যথা হচ্ছিল। চোখের সামনে পুরোটা প্রকৃতি ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে লাগলো। একটু বিশ্রামের জন্য চুপচাপ গাছের গোড়ায় বসে।
তারপর আর কিছুই মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন খেয়াল হলো ছোট ভাই হাত ধরে কান্না করছে। পাশেই ভেজা পাঞ্জাবী পরা দাদাভাই জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পেটের মধ্যে তরল ঠান্ডা জাতিয় কিছুর উপস্থিতিতে চোখ মেলে তাকায় আনতারা।
তার সাত মাসের ভরা পেটে নার্স কিছু লাগাচ্ছে।
তারপর ঘরে এলেন পর পর দুজন মানুষ । একজন বয়স্ক মহিলা ডাক্তার, অন্যজন মাহির।
আনতারা বাম পায়ে বেশ টান অনুভব করছে।কেমন এক বিশ্রী পরিস্থিতি। তার পেট থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলা হয়েছে অথচ মাহির সামনে। মাহিরের দিকে তাকিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা যেন কয়েকশো গুণ বেড়ে গেল।কারণ মাহিরের দৃষ্টি নিচের ফ্লোরের দিকে।
বয়স্ক ডক্টর পেটের মধ্যে চাপ দিয়ে কিছু করছে। আনতারা চোখ বন্ধ করে রইল।
“তারা চোখ মেলে তাকা৷ দেখ! ”
মাহিরের কথায় আনতারা চোখ মেলে তাকিয়ে স্ক্রিনে ছোট্ট একটা বাচ্চার অবয়ব দেখতে পায়।
ছোট্ট একটা প্রাণ, নিজের মধ্যে ধীর গতিতে বেড়ে চলেছে অথচ সে……..
দুচোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জলের স্রোত।
“তুমি কি ওকে শুনতে চাও?”
ডক্টরের কথায় ইশারায় সম্মতি দিলে নার্স আনতারা কে উঠিয়ে বসিয়েছে। ততক্ষণে হাতের ক্যানোলা থেকে স্যালাইনের লাইন খুলে ফেলা হয়েছে।
ভদ্রমহিলা আনতারার হাত নিয়ে ওর পেটের উপর রেখে বললেন,
“তুমি মা। অনুভব করো তোমার সন্তানের হৃদস্পন্দন। দেখবে বাঁচতে ইচ্ছে করবে এই সন্তানের জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করবে।”
ইংরেজিতে একটা কথা আছে। Nature revenge is a kind of wild justice. When nature take revenge it’s become frightful.
অর্থাৎ প্রকৃতি প্রতিশোধ হয় এক প্রকার বন্য ন্যায়বিচার। যখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় তখন সে প্রতিশোধ হয় কুৎসিত প্রতিশোধ।
তেমনি হয়তো হতে চলেছিল মারিয়া-সাবেতের সন্তানের সাথে।
শিশু বিভাগের এক বাচ্চাকে নিয়ে বেশ হৈচৈ লেগেছে। জন্মের সময় বাচ্চাটা ঠিক ছিল কিন্তু হঠাৎ শ্বাস নিতে পারছে না।
বাচ্চাটার বয়স মাত্র ১৭ ঘন্টা, তাছাড়া অন্য রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। যদি মেডিসিনে ঠিক মতোন রেসপন্স না করে তাহলে বাঁচানো মুশকিল।
হাসি খুশি সাবেতের মায়ের চেহারা একরাশ ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
তবে কি আনতারার অভিশাপ লাগলো তার নাতীর উপর?
মরে যাবে কি সাবেতের প্রথম সন্তান?
চলবে