পারবো না ছাড়তে তোকে,পর্ব ১৮+১৯

0
1600

পারবো না ছাড়তে তোকে,পর্ব ১৮+১৯
রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৮

–বাই দ্য ওয়ে,আজ আমরা লালখাল যাচ্ছিতো?

কথা শেষ করেই জেরিন আপু আমাদের দিকে ছটাংঘটাং চোখে তাকাতে থাকেন আমার ডিসিশন জানার আকুলতায়।আমি দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে নিলয় ভাইয়ার দিকে একচোখে কানা ভাব করে তাকাই,পরে আবার জেরিন আপুর দিকে স্বাভাবিকভাবে চোখগুলো মুভ করি।তারপর স্মিতমুখে বলে উঠি,
–আ-আসলে আমার যেতে সমস্যা নেই।সমস্যা হলো যেখানে যাবো সে স্থানের মানুষজন।যদি ভুলবশত কোনো নউন পার্সোনের চক্করে পড়ি,তাহলে আর বাঁচার উপায় নেই।

জেরিন আপু আমার কথায় চোখগুলো মার্বেলের মতো বের করে কোমরের উপর দু’হাত গুঁজেন।আর মুখে বিরক্তির একটা ছাপ এনে বলেন,
–উফস—ভাবী,এভাবে ভীতু মনে চললে হবে?!আরে ইয়ার মনে, সাহস রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।নাহলে জয়ের মুখ আকাশের চাঁদ!
তাছাড়া,এভাবে যদি বদ্ধ রুমে নিজেকে লুকিয়ে রাখো দিনকে দিন।তোমার মনটাও মারা যাবে।মাইন্ড ফ্রেশ রেখে নিজেকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা করো দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে এবং মনে হাজারো দুঃশ্চিতা-কুশ্চিন্তা দূরে পালিয়ে যাবে।ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড মি,ভাবী?

আমি দু’ঠোঁট চেপে রেখে মনোযোগ সহকারে জেরিন আপুর সবটা কথা শ্রবণ করি।উনি বাচ্চামো ভঙ্গিমা করে আবারো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমি আর কিছুটি না ভেবে উনার ঝিলিক মুখে তাক লাগিয়ে দিই।
–আচ্ছা,আমি যাবো আপু…

উনি খুশির তালে বানর নাচ দিতে থাকেন।ডিংকু নাচ,ডিংকু নাচ,ন-ন্না-ন্না….
–বাহহ,নিলয় তোর বউটা-না আসলেই হেব্বি!!ইউ আর সো লাকী।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া প্রকাশ কর,হারামী….
নিলয় ভাইয়া আপুর কথায় খিলখিল হেসে মাথা নাড়েন।তবে,আমার লালখাল জায়গাটি ওত পছন্দ হয়নি।তাই আপওি নিয়ে বলে উঠি,
–আ-আপু একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন..
উনি হাসি থামিয়ে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টি রাখেন।আর মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেন।তারপর আমি বলা শুরু করি,
–আপু আসলে আমার লালখাল জায়গাটায় এই মুহূর্তে যেতে ইচ্ছে করছে না।আপনার যদি আপওি না থাকে তাহলে আমরা সাদাপাথর,ভোলাগন্জ জিরো পয়েন্টে যেতে পারি।ফেইসবুকে এই স্থানটি নিয়ে ভ্রমণপ্রেমীদের প্রসংসার গুঞ্জন।
–ওকে–নো প্রবলেম,নো প্রবলেম ভাবী।তুমি যেথায়, আমি সেথায়। দুজন-দুজনা এক পাখনায় ডানা ঝাপটাই।।
এ বলে আমায় জড়িয়ে নেন আদরের মোহিত।আবারো কথার প্রসঙ্গ টেনে বলেন,
–ভাবী,শুনো??ভাইয়াকে একটা সারপ্রাইজ দিব।আমি ভাইয়ার কলিগ শুচিস্মিতা আপুকে কল করে দিচ্ছি উনি ভোলাগন্জ জিরো পয়েন্টের দিকে আসতে।
এ বলে হনহন করে রুম থেকে চলে যান।উনার চলে যাওয়ার দিকে আমি তাকিয়ে থেকে বলি,
–জেরিন আপু সত্যিই অন্যরকম।সাদামনের মানুষ যাকে বলে !মনে কোনো হিংসা,বিদ্বেষ, রাগ ইত্যাদি এসবের কিছুটিই নেই।
আমার ধ্যাণ কথায় নিলয় ভাইয়া আমার কাঁধে হাত রেখে উনার দিকে চাপিয়ে নেন।আর কপালে চুম্বন এঁকে দেন।আর বলেন,
–হু, ও একটু মনখোলা টাইপের।আর,তোমার শরীর এখন কেমন, মিথি?শরীর আছেতো তোমার??
–হু।

দুপুরের পরে সাদমান ভাইয়া,জেরিন আপু,নিলয় ভাইয়া এবং আমি বাসা থেকে বের হই।সাদমান ভাইয়া প্রথমে যাওয়ার জন্যে অসম্মতি জানালেও জেরিন আপুর জোরাজোরির চ্যাপ্টায় যেতে বাধ্য হয়।
আমরা গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি।সামনে বসে নিলয় ভাইয়া এবং ড্রাইভিং সিটে সাদমান ভাইয়া।আর পেছনে আমি এবং জেরিন আপু।গাড়িতে বসার পর আমি গ্লাসটা খুলে দিই সিলেট শহরটিকে ভালোভাবে দেখার জন্যে।হুট করে মনে একটা বিষণ্নতার স্মৃতি এঁটে যায়।প্রায়,কিছুদিন আগেই তো বাংলাদেশকে দেখার জন্যে এন্জিলা সিস্টার উৎফুল্লতায় গাড়ির গ্লাস খুলে দেয়।ঠিক সেইম, আজ আমিও তাই করেছি।কতটা দিন হয়ে গেল সিস্টারকে দেখে নি।খুব দেখতে হচ্ছে উনাকে।দিনগুলো কে যেন এক-একটা বছর মনে হচ্ছে।
ভীষণ মায়া জমতে থাকে হৃদয়ের কোণে।মনে অজান্তে বিন্দু বিন্দু অশ্রু চোখের কোটরে ঘামতে থাকে।জেরিন আপু আমার মনখারাপ বুঝতে পেরে আমার কাঁধে হাত রাখেন।
–কিছু হয়েছে ভাবী?
আমি তড়িঘড়ি চোখের পানিটুকু মুছে নিই।
–নাহ,নাহ বাহিরে থেকে যে ধুলে ভাসছে, ওগুলো আমার চোখে পড়ছে।
–আচ্ছা,গ্লাসটা বন্ধ করে দিচ্ছি।

এ বলে উনি গ্লাসটা বন্ধ করে দেন।গ্লাস বন্ধ করার পর দৃষ্টি অগোচরে লুকিং গ্লাসের দিকে আমি চোখ রাখি।তৎক্ষনাৎ,সারা শরীরে আমার একটা হিম প্রবাহ বইতে থাকে। সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধে লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়।কারণ,বোধহয় সাদমান ভাইয়া এতক্ষণে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।আমি তাড়াতাড়ি মাথাটা নিচু করে ফেলি।

২ ঘন্টা পর।তখন বিকেল ৪ঃ০০ বাজে। আমরা সবাই সবে গাড়ি থেকে নামি।গাড়ি থেকে নামতেই কেউ এসে বাতাসের মতো তড়িৎ বেগে আমার পাশে দাড়িয়ে থাকা জেরিন আপুকে ঝাপটে ধরে।
–আপু,লাভভ ইউ।ফর টেলিং মি টু কাম হেয়ার।থ্যাংক ইউ সো মাচ,আপু।উম্মাহ…

জেরিন আপুকে এমনভাবে মেয়েটি চুম্মা দিয়ে যাচ্ছেন যেন গালদুটো খেয়েই ফেলবেন।আপু মেয়েটিকে নিজ থেকে ছাড়িয়ে আমাদের সামনে দাঁড় করান।আর তার পরিচয় দিতে থাকেন,
–এ-ই হলো শুচিস্মিতা যার কথা তোমাদের বল্লাম।
–হ্যালো,এভরি ওইন??
শুচিস্মিতা নামটি শোনার সাথে সাথেই আমি মেয়েটির পা থেকে মাথা অব্দি দেখতে থাকি।আর মনে মনে বলতে থাকি,
–ওম্মা,এতো পুরাই মডার্ণ রে বাবা!পায়ে হাই হিল,হাঁটু পর্যন্ত গাউন,ধবধবে সাদা দু’খানা পা অনাবৃত, মাথার চুলগুলো লাল কালারের উপর কার্লি করা,গলায় সিম্পল ন্যাকলেস!!আহা,যেন পুরাই নায়িকা। যে কেউ দেখলে ফিদা হয়ে যাবে।আমার নিলয় আবার ওর দিকে কু’নজর দিবে নাতো??এ ভেবে দাঁত চেপে একটা জিবকাঁটি।
অপরদিকে,সাদমান ভাই রাগে-ক্ষোভে জেরিন আপুর দিকে আড়নয়নে তাকাতে থাকেন।গিজগিজ গলায় বলেন,
–জেরিন,শুচিস্মিতা কে এখানে আনার আগে আমায় একবার বলবি না?
–ক্যান রে ভাই?সাজুগুজু কম করে আসছিস সেজন্যে এমন নাঁখোশ?

সবাই জেরিন আপুর কথাশুনে খিলখিল করে হেসে উঠে।আর আমি মাটির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছি।উনি আমার আলবোলা হয়ে বলতে থাকেন,
–জেরিন!!
–উফস,ভাইয়া!এটা তোর জন্যে অনলি সারপ্রাইজ। কেম বুঝছিস না?
–এটা আমার জন্যে সারপ্রাইজ??

এ বলে সাদমান ভাইয়া একগাদা বিরক্তি নিয়ে আমাদের ইঙ্গিত করেন সামনের দিকে হাঁটতে এবং নিজেও হাটা ধরেন।আমার মনে সন্দেহ হতে থাকে উনি সাডেন কেন এতটা ক্রুদ্ধ হলেন!আর এতটা ক্রুদ্ধ হওয়ার কারণ টা কি!এখানে তো জাস্ট উনার ফিউচার ওয়াইফ আসছে এন্ড এটাতো দোষের কিছু না।হায়রে আল্লাহ,কত্ত নাটক দেখলাম আজঅব্দি!!

তারপর আমি সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সামান্য দূর থেকে কিছু চকচক জিনিস পরখ করতে পারি।জেরিন আপুকে উৎফুল্ল মন নিয়ে বলে উঠি,
–আপু?দূর থেকে ওইযে সাদা কিছু দেখা যাচ্ছে ওগুলো কি??
–ওগুলোই সাদাপাথর।
–বাহহ,স্বচ্ছ পানির মাঝে সাদাপাথর গুলো চিকচিক করছে।বেশ দারুণই দেখাচ্ছে।
–সামনে গেলে আরো ভালোভাবে দেখতে পাবে।।

হাটতে হাটতে আমরা খুব কাছে চলে আসি।ওখানে এসে আরো অনেক কিছু দেখতে পাই।সবুজের ঘেরায় বড় পাহাড় অবস্থান ।পাহাড়ের পর সাদা সাদা ধোঁয়ার কণা ভাসছে।এমনিতেই শীত শীত অনুভূতি এসব অঞ্চলে,সো জলীয়কণা উড়ে যাওয়া সামথিং ব্যাপার।তবে খুব শখ জাগছে পাহাড়ের ওপারে কোন জায়গা…জেরিন আপুর থেকে আবার জানতে ইচ্ছুক হয়ে পড়ি।
–আপু??পাহাড়ের পর আর কিছু আছে??
–ভাবী??ওইযে পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছে না??ওইটা হলে মাতেয়ারা পাহাড়!আর এই পাহাড়টি ভারতের মেঘালয়ে অবস্থিত।
–তারমানে আমাদের সামনে ভারত?
–হুম।।
–ওয়াওওও!!!

আমি নিলয় ভাইয়ার থেকে তড়িঘড়ি ফোনটা নিয়ে ফটো তুলতে থাকি।এভাবে অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলি।তারপর ধেয়ে এসে নিলয় ভাইয়ার কাছে এসে উনার সাথে কয়েকটা সেলফি নিইই।।এখানে আমরা তিনজন ছাড়া বাদবাকি দুজন ঠ্যাটামী করে দাড়িয়ে আছে। কোনো ছবি নিচ্ছে না,মুখে নেই কোনো হাসি।সাদমান ভাইয়া এবং শুচিস্মিতা আপু সামান্য দূরত্বে হাতদু’টো ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছেন।শুচিস্মিতা আপু আমাদের সেলফি তোলার দিকে তাকিয়ে আছেন।আর সাদমান ভাই অন্যদিক মুখ করে তাকিয়ে আছেন।বোধহয় উনাদের মাঝে কোন মনোমালিন্য হয়েছে।তবে,এখানে আমি উনাদের মনোমালিন্যের কিছুটিই দেখিনি।তাহলে,মুখ গোমড়া হবে কেন দুজনের??শুচিস্মিতা আপু এখানে আসাতে সাদমান ভাই কি এখনল রেগে আছে??হু ভাবভঙ্গি দেখে মনতো তা-ই বলে!!
আমি তড়িঘড়ি জেরিন আপুর কাছে যাই।উনি এখনো সেলফি তোলায় ব্যস্ত।কাঁচ চশমাকে চোখের উপর ফাঁক করে, মুখ বাঁকিয়ে সেলফি তোলায় মগ্ন।
আপু আমাকে দেখে আমার সাথেও সেলফি তুলে নেয়য়।আপু সেলফি তোলার মাঝে আমি বলে উঠি,
–আপু?শুচিস্মিতা আপুকে ডাকো??আমাদের সাথে সেলফি নিতে..প্লিজজ??

শুচিস্মিতা আপু চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে দৌড়ে গিয়ে উনাকে নিয়ে আসে।আর শুরু হয়ে যায়য় উনাদের ছবি তোলার মেলা….

পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-১৯
রোকসানা আক্তার

ঘুরাঘুরি শেষে আমরা পাশের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে হালকা কিছু খেয়ে নিই।দ্যান,সন্ধের পরে আমরা বাসায় রওনা করি।
আমি ভীষণ ক্লান্ত!ক্লান্তি মগ্নে নিলয় ভাইয়ার কাঁধে মাথাটা রেখে বসে আছি।আর আমার চোখের দৃষ্টি বাহিরের দিকটায়।বাহিরের পরিবেশটা হালকা কুয়াশার ভ্যাঁপসায় মুড়ানো, আর রাস্তার কিণার ঘেঁষে কিছুক্ষণ পর পর সোডিয়াম বাতির আলো। এ জায়গাটি জেরিন আপুদের বাসা থেকে অনেকটা দূরে।সন্ধের অন্ধকার নামা অব্দি এখানের মানুষগুলোও মিলিয়ে যায় যে যার আস্তাবলে।তাই পরিবেশটা এত নিরব।আর এই শুনশান পরিবেশের মাঝে গাড়ি চলার শব্দ এবং প্রবল বাতাসের ধ্বনি ছাড়া কানে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
আমার মাথার চুলগুলো দিকে দিকে আমার সমগ্র মুখে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসের গতির তেড়ে।নিলয় ভাইয়া তা দেখে আমার মুখের উপর থেকে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেন।আমায় একহাত হাত দিয়ে নিজের দিকে জোরে চেপে ধরে বলেন,
—ঠান্ডা লাগছে,মিথি??
আমি আলতো মাথা নাড়ি।উনি গ্লাসটা বন্ধ করতে চাইলেই আমাদের পেছনের সিট থেকে শুচিস্মিতা আপু বলে উঠেন,
—আরে ভাই,এইতো আমি আর একটু পরই নেমে যাবো।আর তোমাদের কষ্ট করতে হবে না।
শুচিস্মিতা আপুর একটা প্রবলেম।উনি বদ্ধ জায়গায় থাকতে পারেন না।কারণ,উনার নাকি দম বন্ধ হয়ে যায় এবং অক্সিজেন নিতে কষ্ট হয়।আর হুম,,উনার বাসাও নাকি একই রাস্তার মোড়ে।সেজন্যে আমাদের সাথেই যাচ্ছেন।

অন্যদিকে,জেরিন আপু সামনের সিটে বসে ড্রাইভিং সিটের লোকটির ঘ্যাঁনঘ্যাঁন কথা চোখবুঁজে শুনেই যাচ্ছেন।যদিও উনাদের কথা আমি মোটামুটি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি এখান থেকে,আর শুচিস্মিতা আপু শুনতে পাচ্ছেন কি না তা জানি না।
—ভাই,প্লিজজ?একটু অফ যাবি?একই কথা কত্তবার বলবি!এমনিতে সেই শুরু থেকে কানটা বহেরা করে দিছিস!
—“জেরিন………
সাদমান ভাই কিছু বলার জন্যে হাঁক ছাড়তেই জেরিন আপু হাত দিয়ে ইশারা করে সাদমান ভাইকে আমাদের সামনে কথা বাড়াবাড়ি আর না করতে!!আমিও সেটাই ভাবছি!শুচিস্মিতা আপু ঘুরতে এসে আজ কী এমন দোষ করে ফেললেন যে উনি জেরিন আপু এবং শুচিস্মিতা আপুর উপর এতটা ক্ষেপেছেন!আজব পাবলিক!!জাস্ট না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিবে বলে নিয়ে এসছে,এটাইতো!বাব্বাহ,ভাব বলে কি এমন আহামরি ভুল করে ফেলল।ঘাড় ত্যাড়া কোথায়কার!
এসব ভাবনার মাঝে আমি শুচিস্মিতা আপুর দিকে একটা নজর দিই।উনি শিষ বাঁজানোর তালে তালে গান গাচ্ছেন,আর বাহিরের আবছায়া পরিবেশটা উপভোগ করছেন।পাগলা হাওয়া মনের মাঝে আমাদের দিকে উনার এখন একদম ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে।উনাকে দেখে অনেকটাই বুঝলাম।উনি একটু বাউন্ডুলে টাইপের হবেন বোধহয়।

–এই এই গাড়ি থামাও,গাড়ি থামাও!!??
সড়াৎ করে সাদমান ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে দেন।আর শুচিস্মিতা আপু তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়েন।শুচিস্মিতা আপু গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির গ্লাসের উপর দিয়ে আমাদের দিকে উঁকি মেরে বলেন,
–আমি বাসার প্রায়ই কাছাকাছি ।একটা রিক্সা নিলেই বাসার নিচে।আর হুমম,তোমরা সবাই ভালো থেকো।তোমাদের খুব খুব মিস করবো।বিশেষ করে টুকটুকি মিথি আপু তোমাকে। আর তোমাদের সাথে নাও দেখা হতে পারে।বায়য়…
—তোমাকেও আমরা ভীষণ মিস করবো।সময়ের সুযোগ হলে দেখা করে যেওও।(আমি)

শুচিস্মিতা আপু মাথা নাড়িয়ে হাতের ইশারায় বিদেয় জানিয়ে চলে যান।আমরাও উনাকে বিদেয় জানাই।।

রাত প্রায়ই ন’টার দিকে আমরা বাড়ি এসে পৌঁছাই।
ক্লান্তিমনে সবাই বাসার মধ্যে ঢুকে যে যার রুমে চলে আসি।আমি সোফার উপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে মাথা হেলিয়ে রাখি।নিলয় ভাইয়া শার্ট,জ্যাকেট গাঁ থেকে খুলতে থাকেন।উনিও বোধহয় অনেকটা টায়ার্ড।টায়ার্ড না হয়ে তো উপায় নেইই অনেক দূরের রাস্তা,গাড়ির জার্নি মাথাটা যেনো পৃথিবীর মতো ঘুরছে।

এরইমাঝে নিলয় ভাইয়া জ্যাকেট টি হাতে তুলে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলেন,
–মিথি?আমরা এ বাসা থেকে চলে যাবো।
আমি উনার কথা শুনে তাড়াতাড়ি মাথাটি সরু করে আনি।আর ভ্রু কুঁচকে অনেকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকাই।
উনি আবারও বলে উঠেন,
–আমরা কালই চলে যাবো।কী বলো??
আমি এবার পুরোদমে অবাক।মুহূর্তেই উনার মনের মুড পাল্টে গেলো বুঝতেছি না কিছু।হা হয়ে উনার কথাই শুনে যাচ্ছি।কিন্তু জবাব তুলেও মুখ দিয়ে বের করতে পারছি না।উনি আমাকে আর ভ্রুক্ষেপ না করে হনহন করে বাথরুমে চলে যানন।তারপরও আমার মনে প্রশ্ন…হুটহাট মাইন্ড চ্যান্জ হওয়ার কারণ কী?আর সবে তো আসলাম এমনত জরুরী কাজ পড়ে নি যে যেতেই হবে!!
এসব ভাবতে ভাবতে আমার সামনে কারো উপস্থিতির গন্ধ পাই।ভাবনার টনক নড়তেই চোখতুলে তাকাই জেরিন আপুর দিকে।উনি আমার দিকে তাকিয়ে ধুমছে একটা মুঁচকি হাসি দিয়ে ওঠেন।আর গালে হাত রেখে বলেন,
–ভাবি?পরসু আমার খালাতো বোনের বিয়ে।আমরা সবাই কাল ওই বাড়িতে যাবো এবং তোমরাও আমাদের সাথে যাবে।ওকে??

আমি কি থেকে কি বলবো ভেবে না পেয়ে বলে উঠি,
–নাহ মানে কাল আমরা এখান থেকে চলে যাবো।
–চলে যাবেন মানে??ডু ইউ ফিল হ্যাজিটেশন?
–নাহ,নাহ তেমনটি নয়।
–তাহলে ভাবী??

বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিলয় ভাইয়া তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে উঠেন,
–জেরিন?আমরা কাল আমাদের বাসায় ব্যাক করবো।আমি মায়ের সাথে কথা বলেছি।
জেরিন আপু অনেকটা অবাক হয়ে বলেন,
–তোর মায়ের সাথে??
–হু..
–হোয়াট?? উনারা মেনে নিয়েছেন?ডু ইউ নট ফান উইথ মি?
–তোর সাথে কেন মজা করতে যাবো,বলতো??
এ বলে উনি বিছানার উপর এক ঝাপটে তোয়ালে টা রেখে দেন।জেরিন আপুর দিকে দু’চোখের দৃষ্টি সরু করে আবারও বলে উঠেন,
–এত বকবক না করে আমাদের জন্যে তোদের সিলেটি পাতা দিয়ে দু’কাপ রং চা করে নিয়ে আস।যা…
–ওরে আমার আদেশদাতা!!ঢং যত্তসব।আচ্ছা যাচ্ছি যাচ্ছি।

এ বলে হনহন করে জেরিন আপু রুম থেকে প্রস্থান করেন।জেরিন আপু চলে যাওয়ার পর আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে নিলয় ভাইয়াকে বলতে থাকি..
–আদৌ কি সত্য?আপনি যে কাল চলে যাবেন.?তাও আপনাদের বাড়ি?
–মিথি?তোমাকে নিয়ে কোথায় যাবো তা জানি না।তবে,যতটুকু ভাবছি এ বাসায় তোমাকে নিয়ে থাকাটা মোটেও নিরাপদ না।
–নিরাপদ না কেন??
–জেরিনের ভাইকে আমার ভালো ঠেকছে না।

এ বলে উনি বেলকনির দিকে চলে যান।আমার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে থাকে।উনি কি সাদমান ভাইয়ার আজকের বিহেভে অন্যকিছু মনে করেছেন?তবে অন্যকিছু মনে করার তো কথা না!আমিতো আর সাদমান ভাইয়ার সাথে কথা বলিনি।হু….
ছেলে মানুষের মন,আসলেই বুঝা বড় দায়!

পরে আমি উনার পিছু পিছু এসে উনার পাশে গিয়ে দাড়াই,আর বলতে থাকি,
–“খালামণি রাজি”-এই কথাটা যদি সত্য হতো আমি যে কত্ত খুশি হতাম!সত্যিই তা আপনাকে বলে বুঝাতে পারতাম না।
উনি আমার কথায় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে।আমি তড়িঘড়ি নিচের দিকে চোখের পলক নামিয়ে ফেলি।আর কানের পাশের চুলগুলো গুঁজতে থাকি।উনি আলতো আমার গালে হাত রেখে বলেন,
–এই কল্পনাকে আমি বাস্তব করে ছাড়বই!!ইনসাল্লাহ!!!

জেরিন আপু তড়িঘড়ি রুমে ঢুকেন চা নিয়ে।
–এই যে মহারাজ, মহারানী আপনাদের চা হাজির।
আমরা জেরিন আপুর দিকে তাকিয়ে একটা হাসির রেখা টানি।আর টি-টেবিলের কাছে এসে একটু কাচুমাচু দিতে থাকি।উনি কি ভেবে জানি আমার পেটের উপর হাত রাখেন।আমি হালচোখে উনার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকি,,
–আপু?কিছু হয়েছে?
–য়ু-হু।তোমার পেটের বাচ্চা কি লাফালাফি করছে কি না ত অনুধাবন করতে হাত রাখলাম।
আমি লজ্জাভঙ্গিতে বাচ্চামো গলায় বলে উঠি,
–তোমার লজ্জা-সরম নেই।দেখো না?নিলয় ভাইয়া আমাদের সামনে দাড়িয়ে আছেন?
উনি হাসতে হাসতে ফিদা আমার কথা শুনে।নিলয় ভাইয়াও আমাদের ভাবভঙ্গি বুঝে গিয়ে বলতে থাকেন,
–সবেতো রক্তের ফুটো জমা হয়েছে।হাত-পা না বাড়তেই সারাক্ষণ লাফালাফি করবে নাকি তোর মতো??বাদর…
–এই আমি বাদর??
–য়ু-হু,, তুই হনুমান।।
জেরিন আপু নিলয় ভাইয়ার উপর খেপে গিয়ে উনার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সুযোগে আমি এ’কাপ চা হাতে নিয়ে আরামসে উনাদের তামাশা দিতে থাকি।আর ফু দিয়ে দিয়ে চা টা খেতে থাকি।
এরইমধ্যে সাদমান ভাইয়া দৌড়ে আমাদের রুমে প্রবেশ করেন।আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে উঠেন,
–মিথিলা?তোমার মা এসছেন আমাদের বাড়ি!!
একথা শুনামাএই আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা ফ্লোরের উপর পড়ে ঝংকার আওয়াজে কাপটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।তড়িঘরি আমি অবাক দৃষ্টিতে নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকাই।উনিও বোধহয় একথা শুনে অবাকের একদম চরম পর্যায়ে!!উনার পুরো শরীরে ঘামের বিন্দু এক এক করে জমা হতে থাকে।আর আমার পুরো শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়য়।কানদুটো থেকে গরমের ভ্যাঁপসা ধোঁয়া যেন বের হচ্ছে!

চলবে….
(আহা,,কেমন অনুভূতি মিথিলার মায়ের প্রতি আপনােদর??উনি কিভাবে জানতে পারলেন যে নিলয় এবং মিথিলা সিলেটে??পরবর্তী পর্যায়ে আপনাদের কেমন আশঙ্কা?,,,কমেন্ট করে জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here