তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ২
লেখক-এ রহমান
৩
ঈশা পানি খেতে বের হয়ে দেখে ইলহাম টিভি দেখছে।সে ইলহামের কাছে বসলো। তাকে দেখে ইলহাম বলল
–আপি এখনো ঘুমাওনি?
–ঘুম আসছেনা। তুই এখনও ঘুমাস নি কেন?
–ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।
তার কথা শুনে ঈশা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১ টা বাজে। চোখ ফিরিয়ে আবার টিভির দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো রাতে কোথায় গেছে?
–এতো রাতে না তো।তখন থেকেই আসে নি।এখনও ছাদে।
কথাটা শুনে ঈশার খারাপ লাগলো। ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলল
–ডেকে আন।
–গিয়েছিলাম আসেনি।
–কি বলে?
–বলেছে মন ভালো হলে নিজে থেকেই আসবে। কিন্তু আমি জানি তুমি গেলে আসবে।
ঈশা ইলহামের দিকে তাকাল। ইলহাম বুঝতে পারছেনা সে কথাটা বলে ভুল করলো কিনা। কিন্তু তার মনে হয়েছে এই মুহূর্তে ঈশাকে এই কথাটা বলা তার দরকার ছিল। তাই তো বলে ফেললো। ঈশা ইলহামের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে দরজা খুলে চলে গেলো। ইলহাম বুঝতে পারছে ঈশা ছাদে গেলো।
ইভান ছাদে দাড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট জালিয়ে যাচ্ছে। নিস্পলক সামনে তাকিয়ে আছে। অনেক গুলো সিগারেট খাওয়ার কারনে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। তবুও থামছেনা। আজ এতদিন পর আবার নতুন করে পুরনো ক্ষত গুলো কষ্ট দিচ্ছে ইভানকে। পারছেনা নিজেকে সামলাতে। ঈশা পিছনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
–এতো রাতে এখানে কি করছ?
ইভান ঈশার আওয়াজ পেয়ে হাত থেকে সিগারেট টা ফেলে দিলো। একটু চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিলো। কারন ইভানের মন মেজাজ কোনটাই ভালো নেই। আর ঈশার কথা শুনে এই মুহূর্তে তার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যাবে সেটা সে জানে। তাই ঈশার সব কথা হজম করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–কিছুনা।
–নিচে চল।
ঈশার কথা শুনে ইভান তার দিকে তাকাল। তারপর সামনে তাকিয়ে বলল
–আমি যেখানেই থাকি তাতে তোর কি কোন যায় আসে?
–ইলহাম না ঘুমিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও আমাকে পাঠাল তোমাকে ডাকতে।
ঈশার কথা শুনে একটু হেসে বলল
–সত্যি কি ইলহাম পাঠাল তোকে?
ঈশা আর কথা বলল না। তার চুপ থাকা দেখে ইভান বলল
–ঈশা তুই কি সত্যিই চাস জীবনটাকে এভাবে থেমে দিতে?
–তুমি কি চাও?
–আমি আগের ঈশা কে দেখতে চাই। নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে দেখতে চাই।
ঈশা এবার ইভানের পাশে এসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
–৫ বছর আগের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও?
ইভান এবার ঈশার কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা ইভানের চোখ মুখ দেখে চমকে উঠলো। সব কেমন লাল হয়ে গেছে। বুকের ভিতরে ঈশার কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ইভান ঈশার এক বাহু ধরে দাতে দাঁত চেপে বলল
–আমি কোন ভুল করিনি।
ইভানের কথা শেষ হতেই ইলহাম আসলো। তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে দুজনি ঘুরে তাকাল। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ইলহাম বলল
–ইরা তোমাকে খুজছে আপি।
ঈশা আবার ঘুরে আবার ইভানে মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু ইভান আর ঈশার দিকে না তাকিয়েই নিচে চলে গেলো। ঈশা ইলহামের সাথে নিচে গেলো। নিচে এসে দেখে ইভান পানি খাচ্ছে। ঈশা ইলহামকে বলল
–তুই শুয়ে পড়।
ইলহাম ঘরে চলে গেলো। ঈশা ইভানের সামনে গিয়ে বলল
–শুধু পানি খাচ্ছ কেন? রাতে তো কিছুই খাওনি।
–খিদে নেই।
ইভান কঠিন গলায় বলল। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–এভাবে জেদ করে নিজেকে কষ্ট দেয়ার মানে কি?
–তাতে তোর কিছুই যায় আসেনা। এসব লোক দেখানো নাটক আমার সামনে করিস না।
বলেই ইভান ঘরে চলে গেলো। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে ঘরে চলে গেলো। বিছানায় শুয়ে ঈশার চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ছে। ইভানের এই জেদের কারনে আজ তাদের এই অবস্থা। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে। ইভান কি কখনই বুঝবেনা। কখনই কি এই কষ্টের শেষ হবেনা।
৪
ইভানের ছোট বেলা এই শহরেই কেটেছে। তাই এখানে তার অনেক বন্ধু। ইভান সকাল সকাল বেরিয়েছে তাদের সাথে দেখা করতে। সেই পুরনো জায়গায়। যেখানে সব সময় তারা দেখা করত। সবাই ইভান কে দেখে বেশ খুশি। ৫ বছর পর প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা। সেই ৫ বছর আগে ইভান এই শহর ছেড়ে চলে যায়। তারপর আর দেখা হয়নি তার সাথে। ইভানকে দেখে তার বন্ধু রাশিক জিজ্ঞেস করলো
–তুই আবার কবে যাবি?
ইভান একটু হেসে বলল
–আমি এখানেই থাকব। আমাদের নতুন অফিস এর কাজ চলছে। এখানকার অফিস এর দায়িত্ব আমার উপরে।
রাশিক ইভানের কথা শুনে খুশি হল। তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল
–বাহ! এ তো ভালো খবর শোনালি। খুব খুশি লাগছে।
ইভান একটু অন্য মনস্ক হয়ে বলল
–এখানেই তো আমার সব কিছু পড়ে আছে। এতদিন ছেড়ে রেখেছিলাম কিন্তু এখন আর না। সব কিছুর হাল শক্ত হাতে ধরতে চাই।
রাশিক এবার জিজ্ঞেস করলো
–এখন ঠিক কি ভাবছিস? কি করবি?
–আপাতত অফিস নিয়েই ভাবছি। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে তারপর বাকি বিষয় গুলা দেখা যাবে।
ইভানের কথা শুনে রাশিক একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–ভবিষ্যতের কথা কিছু কি ভেবেছিস? এভাবে আর কতদিন চলবে?
ইভান একটু বাকা হেসে বলল
–কিছুই ঠিক হবেনা। যা যেমন আছে তা তেমনি থাকবে।
–ঈশার সাথে কথা বল। এতদিন পর আসলি।সব কিছু ঠিক করে নে।
–ঈশা বোঝার মতো মেয়ে নয়। ৫ বছর কম সময় না। সে বুঝলে এতদিনে বুঝে যেত। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেই এখন চাইনা সব ঠিক করতে। ঈশা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমার সব কষ্টের হিসাব তার কাছে তোলা আছে। সেসব না মিটিয়ে এতো সহজে কিভাবে ছেড়ে দেই।
ইভান একটু বাকা হেসে কথাটা বলল। রাশিক ইভানের এই রুপ দেখে চিন্তায় পড়ে গেল।কারন সে জানে ইভানের আচরণ সম্পর্কে। ইভান যেমন সবটা উজাড় করে ভালবাসতে জানে তেমন শাস্তির বেলাতেও কাউকে মাফ করেনা। এই প্রতিশোধের খেলায় তার ভালোবাসার মানুষটার প্রতি ইভানের আচরণ কেমন হবে তা নিয়ে সে খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। দুজনের জেদ আজ তাদের জিবনের সব থেকে বড় কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কাউকে বুঝতে চাইছেনা। এক অদ্ভুত দেয়াল তাদের দুজনের মাঝে দাড়িয়ে আছে। যা কেউ ভাংতে চায়না। রাশিকের ভাবনায় ছেদ পড়ে ইভানের ফোনের শব্দে। ইভান ফোনটা বের করে ইলহামের ফোন। সে ফোন ধরে
–হ্যালো
–ভাইয়া কই তুমি?সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
–আসছি।
কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে রাশিকের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল
–থাক আজ আসি। পরে দেখা হবে।
বলেই ইভান চলে গেলো।রাশিক তার দিকে দেখে ভাবছে। “কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? কিভাবে সব ঠিক হবে? কেউ যে বুঝতে চাইছেনা।”
৫
ঈশার রুম থেকে ইলহাম আর ইরার আওয়াজ কানে আসতেই ইভান দৌড়ে রুমের দিকে গেলো। সবাই বাথরুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। আর ভিতরে ঈশা বমি করছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। তার এই অবস্থা দেখে ইভানের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার এই কষ্টের এই মুহূর্তে ঈশার কাছে কোন দাম নেই। এই ভেবে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা মুখে পানি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে ওড়নার মাথা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মনে হল মাথাটাও ঘুরে উঠছে। তাই এক হাত মাথায় দিলো।
–কি হল আপি? খারাপ লাগছে?
ইলহাম ঈশার দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো। ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভান ইরাকে বলল
–ইরা ফ্রিজে মিষ্টি আছে?
ইভানের কথা শুনে ঘুরে সবাই তার দিকে তাকাল।সবাই একটু অবাক হল এই অবস্থায় ইভানের এই ধরনের কথা শুনে। ইরা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–আছে তো। খাবে?
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা মুখে ওড়না ধরে ইভানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বেশ বুঝতে পারছে ইভান কিছু একটা বলবে। তার জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশার দিকে তাকিয়েই ইভান বলল
–সিরিয়াসলি!! আসতে না আসতেই খুশির খবর! নিজের এই প্রতিভা সম্পর্কে আমারও এতদিন ধারনা ছিলোনা। বিষয়টা ভেবেই নিজের উপরে গর্ব হচ্ছে।
বলেই সেই ভিলেনি হাসি দিয়ে ঈশার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–বাসার সবাইকে মিষ্টি খাওয়া। বলিস আপু বমি করছে আর মাথাও ঘুরছে।
বলেই হাসতে হাসতে চলে গেলো। ঈশা ইভানের কথার মানে বুঝতে পেরে ভ্রু কুচকে নিলো। সে জানতো ইভান তাকে অপ্রস্তুত করার জন্য এমন কিছুই বলবে। কিন্তু কি বলবে সেটা তার ধারনা ছিলোনা। ইভানের কথার মানে ইলহাম আর ইরা কিছুই বুঝলনা। তারা ইভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইলহাম ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–যা সবাইকে মিষ্টি দিয়ে বলে আয় আপি বমি করছে।
ঈশা তাদের দুজনের উপরে রাগ করে ধমক দিয়ে বলল
–বড় হয়েছিস কিন্তু মাথায় এখনও বুদ্ধি কিছুই হয়নি। স্টুপিড!
ইলহাম বুঝতে পারল ঈশা খুব রাগ করেছে তাই আমতা আমতা করে বলল
–ভাইয়া যে বলল…।
ঈশা এবার রাগ করে ওয়াশ রুম থেকে বিছানায় বসে বলল
–শুধু বড় হলেই হয়না। মাথায় বুদ্ধি থাকতে হয়। তোর ভাইয়া কি বলেছে তা বুঝলে এভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতিস না। বেয়াদব কথাকার।
ইলহাম আর ইরা বেশ বুঝতে পারছে ইভান এমন কিছু বলেছে যাতে ঈশা খুব রাগ করেছে। কিন্তু তাকে রাগ দেখাতে না পেরে তাদের উপরে রাগ দেখাচ্ছে। তাই তারা অসহায়ের মতো দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। বাইরে এসে দেখে ইভান সোফায় বসে টিভি দেখছে। ইরা আর ইলহাম দুজনে তার দুই পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো
–ভাইয়া আপির কি হয়েছে?
ইলহামের কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাল। পিছন থেকে ইভানের মা বলল
–কি হয়েছে রে?
–মা আপি কেন জানি বমি করছে? আর ভাইয়া সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে বলল এই কথা শুনে আপি খুব রাগ করেছে।
সব কথা শুনে ইভানের মা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তারপর ইভানের দিকে তাকাতেই দেখে সে মুচকি হাসছে।কাছে এসে গালে আসতে করে একটা মেরে বলল
–মেয়েটার সাথে কেন এমন করিস বল? কাল সারা রাত না খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। আর তুই ওর সাথে এসব করছিস?
–তোমার মেয়েকে কি আমি খেতে নিষেধ করেছিলাম। এতো জেদ দেখালে এমনি হবে।
ইভান একটু রেগেই কথাটা বলল। ঈশা তার দরজায় দাড়িয়ে এই কথা গুলো শুনছিল। ইভানের মা তার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুইও তো কাল রাত থেকে কিছুই খাস নি।
কথাটা শুনে ঈশার মন টা বেশ খারাপ হল। সে বুঝতে পারছে যে ইভান যতই মুখে না বলুক সে খায়নি বলেই ইভানও খায়নি। ইভানের মা কথা শেষ করে চলে গেলো। ইভান এসব কথার গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতো সামনে তাকিয়ে থাকলো। ইরার চোখ ঈশার দিকে পড়তেই সে একটু হেসে ইরাকে ইশারা করে ডাকল। ইরা তার কাছে আসতেই কাধে হাত রেখে ফিস ফিস করে বলল
–ফ্রিজে আইস্ক্রিম আছে। ভাইয়া কে দে। বলিস না আমি বলেছি।
ইরা ফ্রিজ থেকে আইস্ক্রিম বের করে ইভানের সামনে ধরল। ইভান আইস্ক্রিম এর বাটির দিকে ঘুরে ঘুরে দেখল। তার পছন্দের ফ্লেভার। তার বুঝতে বাকি থাকলো না এটা কে পাঠিয়েছে। আড় চোখে দেখল ঈশা দরজায় দাড়িয়ে দেখছে তাই সে একটু বিরক্ত হয়ে বলল
–কাটা জায়গায় লবন লাগিয়ে তারপর ফু দিয়ে আরাম দেয়ার কোন প্রয়োজন নাই। লবনের তেজ টা এখন আর আগের মতো কষ্ট দেয়না। সহ্য হয়ে গেছে।
বলেই উঠে গেলো। ইরা ইলহামকে জিজ্ঞেস করলো
–আমি আবার কখন কাটা জায়গায় লবন দিলাম।
–কি জানি বাপু। আমি তো কারও কথার কোন মানেই বুঝতে পারছিনা। তুইও বাদ দে। দে আইস্ক্রিম খেয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করি।
বলেই দুজন মিলে আইস্ক্রিম খেতে লাগলো।
চলবে………