তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ২৯

0
3168

তোর ছায়ার সঙ্গী হব,পর্ব ২৯
লেখক-এ রহমান

৬৮
ঈশা হন্তদন্ত করে হসপিটালে এসে দেখে ইভান কার সাথে যেন খুব বিচলিত হয়ে কথা বলছে। ঈশা দৌড়ে গিয়ে ইভান কে জড়িয়ে ধরে। ইভানও তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত দিয়ে বলে
–রিলাক্স জান। সব ঠিক আছে।
ঈশা ইভান কে ছেড়ে দিয়ে ভালো করে দেখে নিলো। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। বেশ রকমের চিন্তিত। চিন্তার কারনি তো। তার অফিসের স্টাফ মিস রিনিকে কেউ রেপ করেছে। তার অবস্থা আসংকা জনক। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ইভান ঈশার গালে হাত দিয়ে হালকা স্পর্শ করে বলে
–ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঈশা অবাক হয়ে তাকে দেখছে। এই মানুষটা কি দিয়ে তৈরি। এতো বড় একটা বিপদের মাঝেও ঈশাকে বিচলিত হতে দেখে তার টেনশন কমানোর জন্য শান্তনা দিচ্ছে। অথচ এই জিনিসটা তারই প্রয়োজন। তার মাথার উপরে অনেক বড় বোঝা কিন্তু সেদিকে কোন খেয়ালি নেই। ঈশাকে নিয়েই সে ব্যাস্ত। ঈশা তাকে আসস্ত করে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল
–আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি সব ঠিক করে ফেলবে।
ঈশার কথা শুনে শত বিপদের মাঝেও ম্লান হাসল ইভান। এই হাসির মানে ঈশার বুঝতে বাকি থাকলো না। সত্যিই সে যে বড় বিপদে তা ঈশাকে বুঝতে না দেয়ার জন্যই সে হাসি। রিহাব রুম থেকে বের হয়ে বলল
–জ্ঞান ফিরেছে।
সবাই তার কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ইভানের দিকে তাকিয়ে রিহাব বলল
–মেনটালি শকড। একটু সময় লাগবে ঠিক হতে।
এমন সময় রিমাকে কাঁদতে কাঁদতে হসপিটালে আসা দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। ঈশা এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে বলে
–কি হয়েছে? তুই এখানে এভাবে?
রিমা কাঁদতে কাঁদতে বলে
–রিনি আমার বোন।
তার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকায়। ঈশা কিছু বলেনা। কারন এটা কাররি জানার কথা না। ঈশার সাথে রিনির দেখা হয়েছিলো আজই। তেমন কথাও হয়নি। আর ইভানও তেমন ভাবে রিমার সম্পর্কে সব জানেনা। রিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল
–আমি ভিতরে যেতে চাই।
রিহাব শান্ত ভাবে বলল
–কোন সিন ক্রিয়েট করা যাবেনা। খুব শান্ত ভাবে কথা বলতে হবে।
রিমা তার সব কথা শুনে মাথা নাড়ল। রিহাব তাকে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। সবাই বিচলিত হলেও একজন খুব শান্ত ভাবে প্রতিটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করছিলো। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভান খুব শান্ত দৃষ্টিতে সামনে রিমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের আচরণ ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করছে। ইভানের মুখ দেখে এই মুহূর্তে তেমন কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। কিন্তু এটা খুব স্পষ্ট যে সে বড় কোন হিসাব মিলাচ্ছে। রিমা ভিতরে যেতেই রিহাব ইভান কে উদ্দশ্য করে বলল
–এটা পুলিশ কেস। পুলিশ আসছে।
ইভান রিহাবের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে চোখের ইশারায় কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করলো। রিহাব তার সেই চোখের ইশারা বুঝে এক মুহূর্তও দেরি করলো না। ঈশা কৌতূহলী চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ঈশার সামনে এসে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গালে হাত দিয়ে ধরে বলল
–আমি বলেছিলাম তোকে কখনও কষ্ট দিবনা। কিন্তু সরি জান।
ঈশা ইভানের কথার মানে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলো। ইভান তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–এইভাবেই সারা জীবন বিশ্বাস রাখিস। আমি সব কিছু সামলে নিবো। তুই পাশে থাকলে আমার আর কিছুই দরকার নেই।
ঈশা ইভান কে আশস্ত করলো যে সে তার পাশে আছে। কিন্তু নিজে শান্ত হতে পারছেনা। কি হচ্ছে এসব। তার ভাবনার মাঝেই পুলিশ এসে বলল
–আমরা রিনির সাথে একটু কথা বলতে চাই।
সবাই পুলিশের দিকে তাকাল। ইভান তাদের ভিতরে যেতে বলল। সেই সময় রিহাব এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। তার দিকে একবার তাকিয়ে ইভান দেয়ালের সাথে হেলানি দিয়ে হাত গুঁজে খুব শান্ত ভাবে দাঁড়ালো। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে ইভানকে সব থেকে শান্ত মনে হচ্ছে। তার মুখে এখন আর আগের মত চিন্তার ছাপটাও নেই। একদম নিশ্চিন্ত শান্ত দৃষ্টি স্থির রেখেছে মেঝেতে। তার আচরনে ঈশা বেশ বুঝতে পারছে এর পরে কি হবে তা সে জানে। নাহলে এভাবে শান্ত থাকার কথা না। পুলিশ বের হয়ে এসে বলল
–মিস রিনি কিছুই বলতে পারছেন না। ওনাকে রেপ করার আগে নেশা জাতীয় কিছু একটা খাইয়ে অজ্ঞান করা হয়েছিলো। কে খাইয়েছে সেটাও বলতে পারছেন না। আমরা আপনার অফিসের সি সি টিভি ফুটেজ দেখতে চাই।
ইভান সাহিল কে ইশারা করে বলল দেখাতে। সাহিল তাদেরকে দেখাতে নিয়ে গেল। ইভান তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। রাশিক কে উদ্দেশ্য করে বলল
–পুলিশ চলে যাওয়ার পর রিনির সাথে কেউ যেন দেখা করতে না পারে। কেউ না। সেটা তোর দায়িত্ব।
রাশিক মাথা নাড়াল। তারপর বলল
–আর রিমা…।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–রিমাকে সামলানোর দায়িত্ব তোর। ভালো ভাবে খেয়াল রাখিস ওর। পারবি তো?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। ঈশা তার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকলো। ঈশার এই চাহুনি ইভান কে এই মুহূর্তে যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দিবে। তাই সে ঈশার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা। মাথা নামিয়েই ঈশাকে উদ্দেশ্য করেই বলল
–নিজের খেয়াল রাখিস জান।
ইরা আর ইলহাম এতক্ষণ পর আসলো। ঈশার কাছে গিয়ে ইরা জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে আপু?
ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–আমার ফোনে একটা ফোন আসে অফিসের নাম্বার থেকে। আমি ফোন ধরতেই আমাকে বলে অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি করে অফিসে চলে যাই। গিয়ে দেখি অফিসে কেউ নেই। আমি চারিদিকে খুঁজে দেখি কাউকে দেখতে পাইনি। কনফারেন্স রুমের এক দিকে দেখি মেঝেতে রিনি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। আমি সেখানে গিয়ে তাকে উঠানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে। যা হয়েছে তা ভালো কিছু না। তাই তাড়াতাড়ি তাকে তুলে হসপিটালে নিয়ে এলাম। এসে জানতে পারি যা ভেবেছিলাম তাই ঠিক। রিনিকে রেপ করা হয়েছে।
সব কথা শুনে ইলহাম বলল
–এখন কি হবে ভাইয়া?
ইভান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল
–যা হওয়ার কথা ছিল তাই হবে।

৬৯
হসপিটালের করিডোরে সবাই বসে অপেক্ষা করছে। রিমা কেদেই চলেছে অনবরত। ঈশা তাকে সামলে রাখছে। ইরা ইলহাম সবাই অপেক্ষা করছে। ইভান অনেক্ষন যাবত কার সাথে যেন কথা বলছে ফোনে। ঈশা মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। এর মাঝেই রাশিক এসে বলল
–ঈশা আমার সাথে একটু আসো।
খুব শান্ত ভাবে কথাটা বললেও ইভানের কান এড়াল না। সে কান থেকে ফোনটা কিঞ্চিত সরিয়ে একবার ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা তার দিকে একবার তাকিয়ে রাশিকের সাথে যাবে তখনি রিমা তার হাত ধরে ফেলে। করুন চোখে তাকিয়ে বলে
–আমাকে রেখে যাস না।
ইভান রিমা আর ঈশার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা রিমার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–আমি এখনি আসছি।
ইরাকে ইশারা করে তাকে দেখার দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। রাশিক তাকে পাশেই এক রুমে নিয়ে গেলো। বেশ খানিকক্ষণ পর ঈশা বের হয়ে এলো। ইভানের সামনে দাঁড়ালো। তারপর রিনির সাথে দেখা করতে ভিতরে গেলো। রিনি চোখ বন্ধ করে আছে। ঈশা তার পাশে বসলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে রিনি চোখ খুলে তাকাল। সে খুব দুর্বল। ঈশা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার মনের ভিতরে ভীষণ কষ্ট। ঈশা তার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। একটা মেয়ের কাছে তার সম্ভ্রম কতটা দামি সেটা একটা মেয়েই বুঝতে পারে। ঈশা বুঝতে পারছে তাকে সামলানো সহজ হবেনা। তার বোন তো তার কাছেই আছে। সে ঠিক বোন কে সামলে নিবে। এই মুহূর্তে একজন আপনজনের শান্তনাই পারে বিদ্ধস্ত মানুষটাকে সামলাতে। ঈশা তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–কেদনা। আমি বুঝতে পারছি তোমার উপরে কি চলছে। এতো বড় একটা ঘটনা মেনে নেয়া এতো সহজ না। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ?
ঈশার কথা শুনে রিনি তার দিকে তাকাল। সে একটু হলেও স্বস্তি পেলো। মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। ঈশা আবার তাকে জিজ্ঞেস করলো
–একটু মনে করে বলবে ঠিক কি হয়েছিলো?
রিনি একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল
–আপনারা চলে যাওয়ার পর আমি নিজের ডেস্কে বসেই কাজ করছিলাম। কিছুক্ষন কাজ করার পর ওয়াশ রুমে যাই। সেখান থেকে এসে পানির পিপাসা পায়। ডেস্কের সামনে পানির বোতলটা দেখতে পাই। সেখান থেকেই পানি খাই। অনেক টা সময় কাজ করার পর মাথাটা ঝিম ঝিম করে। শরীর টা ঝিমিয়ে আসে। আমি স্যারকে ফোন দিয়ে বলি আমার শরীর খারাপ লাগছে তাই আজকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাই। সব কিছু গুছিয়ে রেখে আমি ওয়াশ রুমে যাই মুখে পানি দিতে। কিন্তু মুখে পানি দিতে পারিনা। তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হসপিটালে জানতে পারি আমার সাথে কি হয়েছে।
বলেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। ঈশা তার কথা শুনে বুঝতে পারে তার পানির সাথে কেউ নেশা জাতীয় কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছিলো। তার জন্যই সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় আর সেই সুযোগেই কেউ তাকে কনফারেন্স রুমে নিয়ে যায়। ঈশা আবার একটু ভেবে তাকে জিজ্ঞেস করে
–অফিসের কারও আচরনে তোমার কি কাউকে কখনও সেরকম মনে হয়েছে? মানে কাউকে কি তোমার সন্দেহ হয়?
রিনি না সূচক মাথা নাড়ায়। ঈশা তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে
–তুমি রেস্ট নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলেই রুম থেকে বের হয়ে আসে। ইভান সাহিলের সাথে কথা বলছিল। ঈশাকে বের হতে দেখে তার দিকে শান্তভাবে তাকায়। ঈশা তার একটু কাছে আসে। ঈশাকে খুব ধির কণ্ঠে বলে
–রিমাকে রিনির সাথে দেখা করতে দিস না। বিষয়টা খেয়াল রাখিস।
ঈশা অবাক হয়। এই সময় কাছের মানুষের খুব দরকার। কিন্তু ইভান এই কথা কেন বলল? ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পুলিশ চলে এলো। ইভানের সামনে দাড়িয়ে বলল
–মিস্টার ইভান! মিস রিনির এই অবস্থার জন্য যে দায়ী আমরা তার সব প্রমান পেয়েছি। শুধু তাকে এরেস্ট করা বাকি আছে।
সবাই নিশ্চিন্ত হল এই কথা শুনে। কিন্তু ইভানের দৃষ্টি অন্য কথা বলছে। সে অপেক্ষা করছে পরের কথাটা শোনার জন্য। পরের কথাটা তার জানা। সে মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইন্সপেক্টর বলল
–মিস রিনির রেপ করার জন্য আপনাকে এরেস্ট করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি মিস্টার ইভান।
সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। ইভান এমন কাজ করতে পারে সেটা কেউ ভাবতেই পারেনা। ইন্সপেক্টর আবার বললেন
–আমরাও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু সব প্রমান দেখার পর আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি এই জঘন্য কাজ কিভাবে করলেন?
কথা গুলো সবার মাঝে তিরের মত বিধলেও ইভানের কোন ভাবান্তর হল না। সে চোখ তুলে একবার ঈশার দিকে তাকাল। খুব শান্ত তার সেই দৃষ্টি। কিছুই বলছেনা তার দু চোখ। ঈশাও তার দৃষ্টি স্থির রেখেছে তার দিকে। কিন্তু ইভান বেশিক্ষন ঈশার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে ইন্সপেক্টর কে উদ্দেশ্য করে বলল
–চলুন।
বলেই আর দাঁড়ালো না। ঈশা খুব শান্ত ভাবে ইভানের যাওয়া দেখছিল। ইরা কেঁদে ফেললো। রিহাব তাকে বুকে নিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। ইলহাম ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশার ভিতরে কি চলছে? এতো কিছুর পর তারা দুজন কাছে আসতে পেরেছে। কিন্তু এই ঝড় কি তাদের জীবনের শান্তি নষ্ট করে ফেলবে? কি হবে এর শেষ পরিণতি?

চলবে………।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here